সেই মাদ্রাজের মহাবলীপুরমে এই প্রথম দেখলাম যে গুরু মনে–প্রাণে অশান্তিই চায়, অশান্তি না পেলে যেন তার শান্তি হয় না। কিংবা জিনিসটা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, অশান্তি দূর করবার জন্যেই অশান্তি ডেকে আনা।
চন্দ্রগেশমের কথা আগেই বলেছি, তাকে নিয়ে একটা গল্পও লিখেছিলাম। গল্পটা বেরিয়েছিল ‘গল্প না–লেখার গল্প’ নাম দিয়ে। ‘দেশ’ পত্রিকার ১৯৬৩ সালের পুজো সংখ্যায়। মিস্টার চন্দ্রগেশম এক অদ্ভুত চরিত্র। সন্ধেবেলা গুরু যেই স্টুডিও থেকে আসত, সেই সময়ে একতলা থেকে উঠে এসে বসত আমাদের টেবিলে। টুরিস্ট হাউসটার দোতলায় বিরাট–বিরাট দুটি ঘর। আমরা দুজন সেই দুটি ঘরে রাত্রে শুই। সারাদিন আমি আমার ঘরে বসে ‘একক–দশক–শতক’ লিখি। বই তখন শেষ হয়ে আসছে, সুতরাং উত্তেজনা–আগ্রহ–উদ্বেগ চরমে। সঙ্গে সঙ্গে সিনেমার সিনারিও লেখার তাগিদ আছে।
কিন্তু গুরু এলেই আমার আর লেখার কাজ চলত না, একেবারে সোজা আমার ঘরে চলে আসবে। বলবে— আসুন—
‘আসুন’ মানে গল্প করতে আসুন। দোতলায় বিরাট বারান্দা আর খোলা ছাদ দুপাশে।
সেই বারান্দায় সার–সার বেতের আরাম–চেয়ার পাতা, আর মধ্যেখানে একটা গোল টেবিল। তার চারপাশে কাঠের চেয়ার অনেকগুলো।
সেইখানেই গুরুর চাপরাশি আনবে হুস্কির বোতল, বরফ আর গেলাস। চন্দ্রগেশম এসেই একটা চেয়ারে বসে বলবে— আজকে কি খাবেন ডিনারে?
গুরুর ইচ্ছে হত চন্দ্রগেশমকেও একটু খাতির করে, একটু হুইস্কি দেয়। কিন্তু বললে যদি চন্দ্রগেশম অপরাধ নেয়?
একদিন গুরু বলেই ফেলল— একটু হুইস্কি খাবেন মিস্টার চন্দ্রগেশম?
নিস্পৃহ গলায় চন্দ্রগেশম বললে— ডিনারে কি খাবেন তাই বলুন।
কিন্তু গুরু তার নিজের কথার জের টেনে আবার বললে— হুইস্কি দেব একটুখানি?
চন্দ্রগেশম তেমনি নিস্পৃহ গলাতেই বললে— দিন, তবে সামান্য—
চাপরাশি যথারীতি সোডা মিশিয়ে দিয়ে হুইস্কির গেলাস এগিয়ে দিয়েছে চন্দ্রগেশমের দিকে। নজর পড়তেই চন্দ্রগেশম্ বলে উঠল— এ হেঃ হেঃ, সর্বনাশ করে দিলে একেবারে।
আমি বললাম— কেন, কি হল?
চন্দ্রগেশম বললে—এঃ, হুইস্কির সঙ্গে কখনও সোডা মিশিয়ে খাই না আমি—
গুরু বললে— তাহলে কি জল মিশিয়ে খান?
—না, শুধু হুইস্কি খাই। জলও মেশাই না, সোডাও মেশাই না—
গুরু আর আমি দুজনে অবাক হয়ে গেলাম। চন্দ্রগেশম বললে— আমি ঊটি ইউরোপিয়ান ক্লাবে বাইশ বছর বার ম্যানেজারের চাকরি করেছি, কখনও কোনও সাহেবকে সোডা মিশিয়ে হুইস্কি খেতে দেখিনি—
গুরুর হুকুমে তখুনি আবার নতুন করে নির্জলা হুইস্কি তার গেলাসে ঢেলে দেওয়া হল। চন্দ্রগেশম এক চুমুকে সমস্তটা নিঃশেষ করে দিয়ে গেলাসটা টেবিলে রেখে দিলে। আমি নির্বাক বিস্ময়ে তখন দৃশ্যটা দেখছি। শেষকালে থাকতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম— আপনি কি রোজ হুইস্কি খান?
চন্দ্রগেশম বললে— রোজ খাবো কি করে? এখানে কি হুইস্কি পাওয়া যায়? আটা তো ড্রাই জায়গা, তা ছাড়া হুইস্কি খাওয়ার পয়সা কোথায় পাবো? আমি তো মাত্র দুশো টাকা মাইনে পাই এখানে—
— আগে কত বছর খেয়েছেন?
— বাইশ বছর?
— বাইশ বছর ধরে খেয়েছেন তবু আপনার নেশা হয়নি?
এ এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। গুরু বললে— এখানে যদি কোনোদিন পার্টি দিই তো আপনি একটু সাহায্য করবেন?
এমন একজন এক্সপার্ট লোকের সন্ধান পেয়ে গুরু যেন উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমি প্রমাদ গুণে জিজ্ঞেস করলাম— সত্যিই আপনি পার্টি দেবেন নাকি?
গুরু বললে— ভাবছি দেব—
বললাম— বেশ তো আছি নিরিবিলিতে। কাজ–কর্ম হচ্ছে। আর কাজ করবার জন্যেই তো এখানে এসেছি আমরা। পার্টি হলে তো সে দিনটাই নষ্ট!
চন্দ্রগেশম নিজের কাজে চলে যাবার পর গুরু বলতে লাগল— আমার মনটা খুব ফাঁকা–ফাঁকা লাগছে। সামনের উনিশে অগাস্ট মেয়ে নীনার ফার্স্ট বার্থ ডে। ওই দিনেই আমার মেয়ের এক বছর বয়স পুরো হবে। গীতাও লন্ডনে। মাকে আমার বাড়িতে রেখে এসেছি মেয়েকে দেখবার জন্য। নীনাকে দেখবার জন্যে মনটা ছটফট করছে—
বুঝলাম, গুরু ঠিক এভাবে এই নিরিবিলিতে আর থাকতে পারছে না। সে অসহ্য হয়ে উঠেছে এই কদিনেরই মধ্যে। আমার এখানে যত ভালো লাগছে, তার তত খারাপ লাগছে। গল্প লেখা এগোচ্ছে, ওদিকে তার শুটিংও চলছে। তাস খেলতে পাচ্ছে না। আমি তাকে সমস্ত আপদ থেকে দূরে রেখেছি।
কথা বলতে বলতে গুরু ঝোঁকের মাথায় একের পর এক অনেক গ্লাস হুইস্কি খেয়ে ফেলেছে তখন। সেই অবস্থাতেই বললে— আর এখানকার খাওয়াও আর আমার ভালো লাগছে না—
বললাম— কেন?
গুরু বললে— একদিনও হাতে গড়া রুটি করে না, ডাল করে না। কেবল রোস্ট, কেবল চিকেন, কেবল মাটন, ফিশ্ আর এগ্-ফ্রাই। আমি এবার থেকে নিজে রান্না করব—
আমি তো অবাক। বললাম— কিন্তু আমার তো এখানকার খাওয়া খারাপ লাগছে না, বরং খুব ভালো লাগছে— চন্দ্রগেশম সমুদ্র থেকে টাটকা মাছ ধরে রান্না করে দেয়। এ–রকম আর কোথায় পাব?
গুরু বললে— দেখবেন, আমি ডাল রাঁধব, চচ্চড়ি রাঁধব, সেটা আরো কত ভালো লাগবে—
গুরুর যে রান্না ভালো লাগছে না, তা সত্যিই আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। তবে সকালবেলা আমি যখন ব্রেকফাস্ট খেতে যেতাম ম্যানেজার চন্দ্রগেশম প্রায়ই অভিযোগ করত যে মিস্টার দত্ত কিছুই তো খান না।
আসলে মহাবলীপুরম্-এর সেই রেস্ট–হাউসে বোর্ডার বলতে আমরা কেবল দুজন। যারা ওখানে যেত তারা কেউই এক ঘন্টা–দু–ঘন্টার বেশি থাকত না। কোথায় ফ্রান্স কি ব্রিটেন কি আমেরিকা থেকে, বিরাট স্টেশনওয়াগনে করে একদল টুরিস্ট আসত। এসে বারান্দার ওপরেই হ্যাম্পার বক্স খুলে যা হোক কিছু লাঞ্চ করে নিত। আর তারপরেই কস্টিউম্ পরে আধা–উলঙ্গ অবস্থায় সমুদ্রে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত! তারপর কিছুক্ষণ ঝাঁপাই জুড়ে আবার কোট–প্যান্ট গাউন পরে দল বেঁধে চলে যেত। ষোল বছর থেকে শুরু করে সত্তর–আশি বছরের বুড়োরা পর্যন্ত এমনি করত দিনের পর দিন। একলা–একলা বসে বসে আমি তখন ‘একক–দশক–শতক’ লিখতাম আর মাঝে মাঝে ওদের কেলি–কলাপ দেখতাম।
সেদিন স্টুডিও থেকে ফেরবার পর দেখি গুরুর চাপরাশি একটা বিরাট প্রেশার–কুকার একটা স্টোভ আর এক টিন কেরোসিন তেল আর এক বোতল স্পিরিট কিনে নিয়ে এসেছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম— এগুলো কি?
গুরু বললে— রান্নার সরঞ্জাম। আমি আজ নিজে রাঁধবো—
তবু বুঝতে পারলাম না। বললাম— রাঁধবেন মানে?
—ডাল–রুটি–চচ্চড়ি রাঁধবো। এদের রান্নাটা খুব খারাপ। স্টু আর কারি–চপ–কাটলেট করতে জানে। ও–সব আমার ভালো লাগে না—
কিন্তু তরকারি কই? ভেজিটেবল?
গুরু বললে— কাল থেকে তিন দিন শুটিং নেই আমার, আমাকে স্টুডিওতে যেতে হবে না। কাল বাজারে গিয়ে আলু–বেগুন–পালংশাক কিনে আনব—
আমি সত্যিই প্রথমে বিশ্বাস করিনি যে গুরু সত্যি–সত্যি রাঁধবে। সন্ধেবেলা যথানিয়মে আমাদের আলোচনা চলতে লাগল। অর্থাৎ গল্পের আলোচনা। গুরুর সঙ্গে গল্প আলোচনা করতে আমার যত ভালো লাগত, এমন আর কারো সঙ্গে ভালো লাগেনি। গল্প অনেকেই লেখেও বটে। এক–একজন লোককে দেখেছি উপন্যাস নিয়ে মশগুল হয়ে আছে। কিন্তু তাঁদের সবাই যে গল্প বোঝে, এমন নয়। আইনস্টাইনের ‘থিওরি অব্ রিলেটিভিটি’ যেমন সবাই বোঝে না, তেমনি গল্পও সবাই বোঝে না। গল্প বুঝতে গেলে রসবোধের দরকার হয়। সেই রসবোধ হয়তো একজন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপকেরও না থাকতে পারে, আবার রসবোধ থাকতে পারে এমন একজন লোকের যে কখনও স্কুল–কলেজ– ইউনিভার্সিটির চৌকাঠও মাড়ায়নি। ওটা প্রারব্ধ। ওটা পূর্ব জন্মার্জিত। অবশ্য যদি পূর্ব–জন্ম স্বীকার করা যায়। ওটা স্কুল–কলেজে শেখাবার জিনিস নয়।
কিসে গল্প হয় আর কিসে গল্প হয় না, তা নিয়ে ঝুড়ি–ঝুড়ি বই লেখা হলেও এখনও দেখেছি শিক্ষিতদের মধ্যে দিনে–দিনে রসবোধের অজ্ঞতা পাহাড়প্রমাণ। এ নিয়ে এখন দুঃখ করা ছেড়ে দিয়েছি, আর সার বুঝে নিয়েছি যে ও নিয়ে হতাশ হওয়ার কারণ নেই, কারণ বিপুলা চ পৃথ্বীঃ আর নিরবধি কাল। সেইজন্যই গুরুর সঙ্গে আমার ভালোরকম বনতো। গল্প সম্বন্ধে একটু আলোচনা করার দরকার হলেই সেই মাদ্রাজ–বোম্বাই থেকে আমাকে ট্রাঙ্ককলে ডাকতো। হঠাৎ একদিন গুরু বলত— সময় আছে আপনার?
আমি জিজ্ঞাসা করতাম— কেন? কিছু দরকার আছে—
গুরু বলত— হ্যাঁ, যদি কাজ না থাকে তো একবার আসতে পারবেন? একটা কাজ আছে—
আমি সেই দিনেই চলে যেতাম গুরুর কাছে। গিয়ে জিজ্ঞেস করতাম— কি কাজ?
গুরু বলত— কাজ কিছু নেই, এমনই গল্প করতে ইচ্ছে হল—
গল্প করবার আর যেন লোক ছিল না তার বাড়িতে। গীতা ছিল, তরুণ ছিল, অরুণ ছিল। তাছাড়া ছিল তার হাজার–হাজার দায়–দায়িত্ব। বন্ধু–বান্ধবেরও তো অভাব ছিল না তার। কিন্তু তবু একলা থাকতে তার ভয় করত। একলা থাকলেই মনটা ছটফট করত। তখন কোথাও দূরে বাইরে চলে যেত গাড়ি নিয়ে, কেউ জানত না তার গতিবিধি। কিংবা পাওয়াই লেকে গিয়ে মাছ ধরত। কিংবা চলে যেত লন্ডন। বা প্যারিস। সারা পৃথিবী চষে ফেলেও তবু যে তার একাকীত্ব ঘুচতো না।
একবার মনে হত ওয়াহিদা রেহমানকে ডাকে। কিন্তু ওয়াহিদা রেহমানের সঙ্গে তখন সম্পর্ক ছেদ করে দিয়েছে গুরু। তার ছায়া পর্যন্ত মাড়ায় না সে। না, ওয়াহিদার সঙ্গে মেলামেশা করলেই যদি তোমরা আমাকে চরিত্রহীন বল তো আর তার সঙ্গে মিশব না। যদি মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশা করবার জন্যই কাগজে–কাগজে আমার বদনাম হয়, তো কোনও মেয়ের সঙ্গেই আমি আর মিশব না। গীতা কড়া নজর রাখে দূর থেকে। রতনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে— আজ সাহেব কোথায় গিয়েছিল রতন?
রতনও তেমনি। রতন যেন কাঠের পুতুল। তার মুখ দিয়ে রক্ত বার করা সোজা, কিন্তু কথা কেউ বার করতে পারবে না।
সে বলত— না দিদি, সাহেব তো কোথাও যায়নি—
গীতা জিজ্ঞেস করত— তাহলে কাল রাত দুটো পর্যন্ত কোথায় ছিল?
রতন কখনও বলত কে আসিফ সাহেবের বাড়িতে, কখনও বলত স্টুডিওতে।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত