একেই বলে ‘প্রত্যাবর্তন’। Abba একটা সুইডিশ ব্যান্ড। ভেঙে গেছিল আশির দশকের গোড়ার দিকে। তারপর পৃথিবীর সব নদী দিয়েই গ্যালন-গ্যালন জল বয়ে গেছে। পার হয়ে গেছে চল্লিশ বসন্ত। অ্যাদ্দিন পর তাঁরা হঠাৎ ঠিক করেছেন যে, ফিরে আসলে কেমন হয়? দল বেঁধে আবার গান হবে, ঢোল হবে, সুর হবে, তাল হবে, লয় হবে। কিন্তু এই সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের গান গাইতে দেখে লোকে কি আর ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চুপ করে থেমে যাবে? নাহ্… অন্য কিছু ভাবতে হবে। ভেবে উপায়ও বের হল। নাম দেওয়া হল ‘ভয়েজ’। তাঁদের এই যাত্রার নোঙর তোলা হল নভেম্বর মাসে। একটা অ্যালবাম প্রকাশ হল। সাথে ঠিক হল যে, দু’হাজার বাইশের মে মাসে লন্ডনের কুইন এলিজাবেথ অলিম্পিক পার্কে তাঁরা একটা কনসার্টও করবেন। সেখানেই থাকবে লোককে আসল ভ্যাবাচ্যাকা-খাওয়ানো চমকের আয়োজন। কিন্তু কনসার্ট আয়োজন করার মধ্যে চমকের কী আছে? ব্যাপারটা হল এই যে, এই কনসার্টটাতে Abba-র ব্যান্ড-সদস্যরা হাজির হবেন তাঁদের চল্লিশ বছর আগের চেহারায়। আসলে তারা সশরীরে হাজির হবেনই না— হাজির হবে তাঁদের ডিজিটাল অবতারেরা, যাকে তাঁরা কায়দা করে বলছেন ‘Abba-tar’। একদল সত্যিকারের বাজনদারের সাথে গান গাইবেন অশরীরী চার অবতার। এমন গানের জলসা কেউ কক্ষনও দেখেনি আগে। হুঁ হুঁ বাওয়া, এভাবেও ফিরে আসা যায়!
কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে থেকেই যায়— কীভাবে সম্ভব হবে এসব? Abba তাদের এই প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যবহার করেছে মোশন ক্যাপচার টেকনোলজি এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি। মোশন ক্যাপচার প্রযুক্তির প্রয়োগ কমবেশি আমরা সকলেই দেখেছি হলিউডি ছবির দৌলতে। ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’, ‘হ্যারি পটার’ কিংবা ‘গেম অফ থ্রোনস’-এর মতো ফ্যান্টাসি ছবির অদ্ভুতপানা জানোয়ারদের তৈরি করার জন্য এই প্রযুক্তির আকছার ব্যবহার। কিন্তু তারা তো ছবির পর্দায় থাকে। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে লাইভ ব্যান্ডের মতো গানবাজনা করবে কীভাবে? তার জন্যই প্রয়োজন অগমেন্টেড রিয়্যালিটি বা সত্যিকারের বাস্তবতার সাথে এক ছটাক কল্পলোকের মিশেল। আর এই কল্প-বাস্তবতাকে নিয়েই নতুন স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছেন ফেসবুকের মার্ক জুকারবার্গ— সামনের বছর দশেকের মধ্যে এক অন্য দুনিয়ার চাবিকাঠি নিয়ে হাজির হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি, যার নাম হবে ‘মেটাভার্স’।
মার্ক জুকারবার্গের দৌলতে ‘মেটাভার্স’ শব্দটির সাথে সদ্য পরিচিত হয়েছি আমরা। অবিশ্যি আদতে এর প্রথম ব্যবহার হয় প্রায় তিন দশক আগে— আমেরিকান ঔপন্যাসিক নিল স্টিফেনসনের কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস ‘স্নো ক্র্যাশ’-এ। ভবিষ্যতের এক অরাজক জগৎ থেকে মুক্তির পথ হিসাবে মেটাভার্সের উল্লেখ করা হয়েছিল সেখানে। জুকারবার্গও অবিশ্যি সেরকমই বর্ণনা করেছেন হালের এই মেটাভার্সকে। আমাদের রোজকার এই ক্লেদাক্ত, বিচ্ছিরি, একঘেয়ে, বসের বকুনি, শাশুড়ির গঞ্জনা, বউয়ের খিটখিটেমিতে ভরা দুনিয়া থেকে এক কাল্পনিক দুনিয়ায় পাড়ি দেওয়ার রূপকথা। কাল্পনিকই বা বলি কেন? আপনার বাস্তব জগৎই সেখানে উঠে আসবে— শুধু তাকে সাজিয়ে নেবেন আপনার চাহিদামতো।
ব্যাপারটা খোলসা করে বলি তাহলে। বাস্তবতা বিষয়টি যে বাস্তবিকই বেশ ঘোরালো একটা বিষয়, এটা তো রোজ সকালে দাঁত মাজতে-মাজতেই আমরা অনুধাবন করি। তাই পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা আর দুই প্রকারের বাস্তবতার কথা ভেবেছেন। অবিশ্যি ‘ভেবেছেন’ কেন বলি, এক সময় যদিও এই ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বা কৃত্রিম বাস্তবতা এবং অগমেন্টেড রিয়্যালিটি বা উদ্দীপিত বাস্তবতার কথা ছিল কল্পবিজ্ঞান লেখকদের কল্পনায়, কিন্তু বিগত বেশ কিছু দশক ধরেই সেসব ঘোর বাস্তব। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি, সংক্ষেপে VR, আমাদের আশপাশের জগৎকে সরিয়ে আপনাকে নিয়ে ফেলে একটা অন্য জগতে। কীভাবে? ঠিক যেমন আমরা সিনেমা দেখি। পর্দার ছবি একটা ভিন্ন বাস্তবতাকে আপনার সামনে হাজির করে। কিন্তু সেই বাস্তবতার সাথে আপনার বাস্তবতার একটা ব্যবধান থাকে। সে আপনি যতই ভিলেন ঠ্যাঙানো দেখে আনন্দ পান আর হিরোর হার দেখে চোখের জল ফেলুন, আপনি কখনওই ওই ঢিসুম-ঢাসুমের একটা অংশ হয়ে উঠতে পারেন না। VR আপনার সেই অভাবই পূরণ করে। চোখে একটা চশমা পরে নিলেই আপনি ওই কৃত্রিম জগতের একটা অংশ। হিরো একাই কেন হাতের সুখ করবে? আপনিও দু’একটা চালিয়ে দেবেন ভিলেনের চোয়াল লক্ষ্য করে। উনিশশো সত্তরের দশক থেকেই এই VR-এর প্রয়োগ দেখা গেছে অনেক জায়গায়— নাসার জেট প্রপালশন ল্যাব থেকে ফ্লাইট বা গাড়ির বিভিন্ন অংশের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। যদিও এই ‘ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি’ শব্দবন্ধটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন ভিপিএল রিসার্চের হত্তা-কত্তা-বিধাতা জ্যারন ল্যানিয়ের। এখন কম্পিউটার গেমের দুনিয়ার এক বড় অংশ জুড়ে আছে VR।
অন্য যে আর একটি বাস্তবতার কথা বললাম— অগমেন্টেড রিয়্যালিটি— তা ভার্চুয়াল রিয়্যালিটির মতো পুরো আগাগোড়াই কৃত্রিম নয়। বরং, এটি হল মিশ্র। মনে করুন আপনি ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখছেন— এমন সময় দেখলেন সত্যিই আপনার ছেঁড়া কাঁথার এক কোণে একটা লাখ টাকার বান্ডিল পড়ে আছে। অমন লোভনীয় জিনিসকে ধরতে পারলে শুধু মনোবেড়ি না, একেবারে তালাবন্ধ সুটকেসে রেখে দিতে চাই আমরা কিন্তু সে-গুড়ে বালি। ধরা সে যে দেয় নাই— সফটওয়্যারের কল্যাণে আপনার কাঁথার উপর টাকার বান্ডিলের একটা ছবি তৈরি করে একটা নকল বাস্তব তৈরি হচ্ছে। এটাই হল অগমেন্টেড রিয়্যালিটি বা AR— এখানে আপনার ছেঁড়া কাঁথা বা পলেস্তারাখসা ঘর পালটে গিয়ে পাঁচতারা জলমহল হয়ে যাচ্ছে না— বরং ওই রোজকার দুনিয়ার মধ্যেই একটু উদ্দীপনার স্পর্শ রেখে যাচ্ছে সে। আপনার স্মার্টফোনেই হাজারও অ্যাপ আছে, যারা এই অগমেন্টেড রিয়্যালিটির দুনিয়ায় নিয়ে ফেলতে পারে আপনাকে অনায়াসে। আপনার ফোনের ফ্রন্ট ক্যামেরায় নিজেকে ধরলেই দেখবেন আপনার মুখের নানাবিধ পরিবর্তন ঘটিয়ে মজারু থেকে হাঁসজারু সব বানিয়ে দিচ্ছে আপনাকে। আবার মনে করুন, আপনি গেছেন হন্ডুরাস অথবা কামস্কাটকা— ভাষা-টাষা কিচ্ছু বুঝতে পারছেন না, একেবারে দিশেহারা দশা— দোকানের সাইনবোর্ড অবধি পড়তে পারছেন না। আপনার হালে পানি দিতে আছে ফোনের অ্যাপ— অচেনা হরফে লেখা অজানা ভাষার শব্দকে তাক করে আপনার ফোনের ক্যামেরা ধরলেই তা নিমেষে পালটে দেবে বাংলায় বা আপনার পছন্দের ভাষায়।
মেটাভার্স হল এই দু’রকমের বাস্তবতার একটা মিশ্রণ। তার সাথে ব্লকচেন টেকনোলজি এবং কয়েক ছটাক সোশ্যাল মিডিয়া। বছর কয়েক আগে ‘রেডি প্লেয়ার ওয়ান’ নামে স্পিলবার্গের একটি ছবি এসেছিল। সেখানে ছেলেমেয়েরা সকলে একটা কম্পিউটার গেম খেলে। সেই গেমে বিভিন্ন অবতার আছে প্রত্যেকের। সেই অবতারদের মাধ্যমে একে অন্যের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করছে, শত্রুতা করছে, প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। কিন্তু আসলে কেউ কাউকে চেনে না। ভার্চুয়াল জগতের পরম বন্ধুর সাথে আসল বাস্তবে কোনও পরিচয়ই নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে আমরা সকলেই কমবেশি এই ব্যাপারটা বুঝতে পারি। একটা কৃত্রিম দুনিয়ার মাধ্যমে একটা সমাজ গড়ে উঠছে, বরং বলা ভাল অনেকখানি গড়ে উঠেছে ইতিমধ্যে। রেস্তোরাঁর খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে ছেলেবেলার বন্ধুর সাথে এয়ারপোর্টে ক্ষণেকের জন্য দেখা হয়ে যাওয়া— সব কিছুই যেন অর্থহীন হয়ে যায় ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামে ফলাও করে সেটা না জানালে। প্রতিদিন আসল বাস্তবতা থেকে কৃত্রিম বাস্তবতার দিকে ধীরে-ধীরে সরতে থাকে মানুষদেরকে সেদিকে আরও আকর্ষণ করে নিয়ে যাওয়ার ‘টোপ’ হল মেটাভার্স। জুকারবার্গ বলছেন, একা ফেসবুক বা কোনও নির্দিষ্ট একটি কোম্পানি এই মেটাভার্সের মালিক হবে না। বরং অনেকগুলি কোম্পানি মিলে জন্ম দেবে এই স্বপ্নিল জগতের। ঠিক যেমন অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোনের জন্য বিভিন্ন সংস্থা নানাবিধ অ্যাপ বানিয়ে আপনার বিভিন্ন কাজের সুবিধা করে দেয়। তিনি আরও বলছেন, এই মেটাভার্স শিল্পী এবং সৃষ্টিশীল মানুষদের কাছে আশীর্বাদের মতো হবে— শহর থেকে অনেক দূরে নিজের পছন্দের প্রকৃতির মধ্যে বসেও তাঁরা নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলতে পারবেন তাঁদের পরিচিত মানুষজনদের সাথে। ক্লায়েন্টের সাথে মিটিং বা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা সবই সম্ভব হবে এই মেটাভার্সে। আর এই ব্যবস্থাকে আরও আরও বাস্তবানুগ করে তোলার জন্য ফেসবুক প্রোজেক্ট ক্যাম্ব্রিয়া, প্রোজেক্ট নাজারেথ এবং অকুলাসের মতো কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর দ্বারা ভার্চুয়াল অবতারের চলাফেরা, মুখভঙ্গি হয়ে উঠবে আসল মানুষের মতো, কথা বলার ভঙ্গি থেকে তাকে ডিজিটাল বলে মালুম হবে না।
তাহলে এক কথায় মেটাভার্স হল এমনই একটা ব্যাপার যেটা একটা সমান্তরাল বিশ্ব বা প্যারালাল ইউনিভার্সের মতো সর্বদা সঙ্গে থাকবে— চোখে স্মার্ট চশমা, কানে হেডফোন ইত্যাদি নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুরে আসা যাবে, ফেসবুকে বন্ধুরা অনলাইন থাকলে তাদের সাথে যেমন চ্যাটে আড্ডা দেওয়া যায়, তেমনি এখানেও বন্ধুদের সাথে সত্যি-সত্যি মৌখিক বাক্যালাপ করা যাবে, চাইলে দু’এক দান লুডো কিংবা দাবাও খেলে নেওয়া যাবে। আর এই সব কাজ করবে আপনার অবতার— আপনারই নির্দেশ অনুযায়ী। সুতরাং মেটাভার্স যে নিছক একটা অ্যাপ বা গেম নয়, বরং সমাজ, কর্মক্ষেত্র এসবের একটি ভার্চুয়াল প্রতিচ্ছবি সেটা মালুম হল। কিন্তু এসব করে লাভটা কী? এই তাবড় টেক কোম্পানির দল লাখ-লাখ ডলার খরচা করে যে উঠে পড়ে লেগেছে, সেটা কেন? ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য কী?
এর উত্তর হল, এক বিশাল সমান্তরাল সমাজ, তার বাজার এবং তৎসংলগ্ন অর্থনীতি। ওই যে ব্লকচেনের কথা বলছিলাম আগে, সেই ব্লকচেনই হবে মেটাভার্সের দুনিয়াতে আপনার সম্পত্তির মালিকানার দলিল এবং তার রক্ষাকর্তা। কিন্তু ভার্চুয়াল সম্পত্তি! সে আবার কেমন কথা! তাহলে কয়েকটা উদাহরণ দিই। দু’হাজার দশ সালে এন্ট্রোপিয়া ইউনিভার্স নামে একটি গেমে একটি নাইট ক্লাব বিক্রি হয় ছ’লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার ডলারে। বলা বাহুল্য সেই নাইট ক্লাবটির অস্তিত্ব আছে কেবলমাত্র ওই গেমের ভার্চুয়াল দুনিয়াতেই। সে-বছরই ওয়ার্ল্ড অফ ওয়্যারক্রাফট নামে একটি অন্য গেমে জেউজো (Zeuzo) নামে একটি এলফকে একজন কিনে নিয়েছিল প্রায় ১০,০০০ ডলার খরচা করে। এমন হাজার-হাজার ডলারের বিনিময়ে ভার্চুয়াল সম্পত্তি কেনাবেচার নজির কম্পিউটার গেমের দুনিয়াতে অজস্র। আর তাকে মূলধন করেই গেমিং কোম্পানিগুলির রমরমা। তাহলে বুঝতেই পারছেন একটা সামান্য কম্পিউটার গেম যদি এত হাজার-হাজার মার্কিন ডলারের ব্যবসা করতে পারে, তাহলে মেটাভার্স নামক সম্পূর্ণ এক ভার্চুয়াল দুনিয়াতে কী পরিমাণ টাকাপয়সার লেনদেন হতে পারে! ইচ্ছে হলে লন্ডন, নিউইয়র্ক যেখানে খুশি ভার্চুয়াল জমি কিনুন, সম্পত্তি কিনুন। অবিশ্যি সম্পত্তি কাল্পনিক হলেও গ্যাঁটের কড়িটা যে একেবারে ঘোর বাস্তব হবে, সেটা মাথায় রাখতে হবে। আপনার এক্ষেত্রে প্রয়োজন হবে ক্রিপ্টোকারেন্সির আর এই সব সম্পত্তি আপনার নামে সুরক্ষিত রাখতে সাহায্য করবে ব্লকচেন।
শুধু এই শখের বাবুয়ানির জন্যই মেটাভার্সের দুনিয়ার ইকোনমিক্স বা মেটানমিক্স এত লোভনীয় নয়। মাইক্রোসফ্ট, ফেসবুক, গুগলের মতো টেক-দৈত্যরা আরও সম্ভাবনা দেখছে। করোনা-উত্তর সমাজ যে আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক থাকবে না, তার আঁচ আমরা পেতে শুরু করেছি। বাচ্চারা দিনের পর দিন বাড়ি থেকে ল্যাপটপ বা মোবাইলে ভিডিও কলের মাধ্যমে স্কুল করছে। আমরা বুড়োরাও আপিস যাওয়া কাকে বলে ভুলতে বসেছি। ঘরের কোণায় টেবিলে কম্পিউটার সাজিয়ে কানে হেডফোন লাগিয়ে বানিয়ে নিচ্ছি আমাদের আপিস। কর্মক্ষেত্রের প্রিয় সহকর্মীর সাথে কফির কাপ নিয়ে আড্ডা মারা তো আগের জন্মের কথা বলে মনে হয়। এই সব কিছুর সুরাহা করে দিতে পারে মেটাভার্স। কানে হেডফোন, চোখে স্মার্ট গ্লাস— ব্যাস! আপনি, থুড়ি, আপনার অবতার অফিসের বারান্দায় বসে কফির কাপ হাতে গল্পে মাতলেন সহকর্মীদের সাথে। একসাথে টিম লাঞ্চ, অথবা ইন্টারভিউ নেওয়া কিংবা বসের টেবিলে পদত্যাগপত্র ছুঁড়ে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে আসা— এ সবই সম্ভব করে দেবে মেটাভার্স। কর্মীদের আরামদায়ক পরিবেশ দিয়ে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর জন্য এমন মেটাভার্সের পিছনে টাকা ঢালতে তৈরি অনেক কোম্পানিই। আর তাদের জন্য যন্ত্রপাতি, পরিকাঠামো প্রদান করে অর্থোপার্জনের রাস্তাও তৈরি হবে অনেকের কাছে। ফেসবুক বলেছে শুধু মেটাভার্সের জন্য ইউরোপে তারা দশ হাজারের উপর নতুন কর্মী নিয়োগ করতে চলেছে।
তাহলে মোদ্দা কথা হল, আগামী পাঁচ-দশ বছরের মধ্যে আমাদের চারপাশের দুনিয়াকে অনেকটাই বদলে দেবে এই মেটাভার্স। কিন্তু ছেলেবেলার রচনা লেখার মতো যদি প্রশ্ন হয় যে, ইহা মানবজাতির জন্য অভিশাপ না আশীর্বাদ, তাহলে বিশ্বের নামকরা টেকনোলজিস্টরা দুই দলে বিভক্ত। জুকারবার্ক বা নাদেল্লার দল মানুষকে স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য আশাবাদী। অন্য দল বলছেন এইসবই হল মানুষকে আরও আরও আসল সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক জীব বানিয়ে তোলার চক্রান্ত। অগমেন্টেড রিয়্যালিটি নির্ভর গেম ‘পোকেমন গো’র নির্মাতা জন হ্যাঙ্কে নিজেও সে-কথা বিশ্বাস করেন। তাঁর মতে মেটাভার্সের ফলে ভবিষ্যতের পৃথিবী এক ‘ডিস্টোপিয়ান’ পৃথিবীতে রূপান্তরিত হবে— আসল জীবন ভুলে মানুষ ওই ভার্চুয়াল জগৎকেই বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করবে। ফলে দ্রুত আসবে অবসাদ, মানুষ হারাবে তার মনুষ্যত্ব। কিন্তু বিশ্বের তাবড় কোম্পানি যখন এই মেটাভার্সের পিছনেই দৌড় শুরু করেছে, এই পরিণতি থেকে পালানোর উপায় কী? ‘স্নো ক্র্যাশ’ উপন্যাসের অরাজক জগৎ থেকে পালানোর পথ ছিল ‘মেটাভার্স’, আর বাস্তবে কি মেটাভার্সই ডেকে আনবে ভুবনজোড়া ডিস্টোপিয়া? জানি না। এর উত্তর কারো কাছেই নেই আপাতত। একমাত্র ভবিষ্যতই দেবে এর জবাব।