দয়াময়বাবুর দ্বিতীয় জীবন
বেকার বাচিকশিল্পী দয়াময় কাঞ্জিলাল তাঁর অপারেশনের পর যখন জেগে উঠলেন, তখন তাঁর মাথাটা ঝিমঝিম করছে, কেমন ঘোলাটে লাগছে সবকিছু। মাথাটা একটু পরিষ্কার হতে দয়াময়বাবুর মনে হল, তাঁর জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব তিনি যেন পেয়ে গেছেন। হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে টলতে-টলতে তিনি এগিয়ে গেলেন টেবিলের দিকে, ওই টেবিলেই রাখা আছে তাঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী একটি বাহাদুর ট্রানজিস্টর। এবারে একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। রেডিওতে রোজকার খবরের অনুষ্ঠানটি শুনতে গিয়ে তিনি টের পেলেন, খবর পড়ছে আসলে তাঁর নিজেরই কণ্ঠ! ক্রমে তিনি বুঝতে পারলেন, এক অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তিনি— তিনি বেতার তরঙ্গকে ধরে নেবার এবং মর্জিমাফিক পালটে দেবার ক্ষমতা লাভ করেছেন।
রতন ওস্তাদের শেষ কীর্তি
প্রখ্যাত ভাস্কর্যশিল্পী রতন ওস্তাদ কোনও বংশধর না রেখেই মারা গেলেন। তাঁর ত্রিশ বছরের সহকারী বীরেন হালদার খুবই মুষড়ে পড়ল, ওস্তাদ তার জন্য কিছুই রেখে গেলেন না।
এর পরের কয়েক সপ্তাহ বীরেন নিজের পোড়া কপাল নিয়ে দুঃখ করে আর বুড়োকে গালাগালি দিয়েই কাটিয়ে দিল। জীবনটাই মায়ের ভোগে গেল! ত্রিশ বছর কি কম সময়? কিছুদিন পরে বীরেনের কাছে রতনের একটা চিঠি এল, মৃত্যুর পরেই যাতে এই চিঠি পাঠানো হয়, সে-ব্যবস্থা করে গিয়েছিল রতন। এ-চিঠিতে লেখা আছে, রতন বীরেনের জন্য উত্তরাধিকারসূত্রে সত্যিই কিছু রেখে গেছে, এবং কীভাবে সেই জিনিস বীরেনের হাতে পৌঁছবে সেই ব্যাপারে কিছু নির্দেশও দেওয়া আছে। নিজের শেষ কাজটা করার সময়ে রতন মূর্তির গায়ে একটা গোপন প্রকোষ্ঠ বানিয়ে রেখে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই গোপন প্রকোষ্ঠের সন্ধান বীরেন পাবে কী করে? বুড়ো ওস্তাদকে সে আবার একটা গালি দিয়ে বসল বটে, তবে মনে-মনে এই নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে পড়ে তার নেহাত খারাপ লাগছিল না।
বরদা নন্দীর স্মৃতির প্রত্যাবর্তন
বাজারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে বরদাবাবুর মাথা ঘুরছিল। ইতিমধ্যেই অবশ্য মাথা গুলিয়ে দেবার মতো কিছু ঘটনা ঘটেছে। মর্নিং স্টোরের মালিক সাহনিজীকে তাঁর ষাট বছর বয়সের তুলনায় অনেকটাই নবীন লাগছিল, তার উপর আবার তিনি বললেন মেসওয়্যাক মার্কা টুথপেস্টের নাম তিনি কোনওদিন শোনেননি, যে-জিনিস বরদাবাবু মর্নিং স্টোর থেকে আজ দশ বছর ধরে কিনছেন। রাতারাতি যেন দোকানের অর্ধেক মাল উধাও হয়ে গিয়েছে, পড়ে আছে কেবল পরিপাটি খালি কিছু তাক।
খবরের কাগজের স্টলের মালিককেও বেশ নবীন লাগছিল। ড্রাই ক্লিনারের দোকান, মাদার ডেয়ারি, ইলেক্ট্রিকের দোকান, ওষুধের দোকান, সবগুলোকেই কেমন পরিপাটি লাগছিল, জরাজীর্ণ দশা একদমই না। কিছু দোকান উঠেই গিয়েছে, তাদের আর কোনও চিহ্নই দেখলেন না তিনি। যেন সেগুলো কোনওদিন এ-তল্লাটে ছিলই না। সবারই মনে হচ্ছে কয়েক কিলো করে ওজন কমে গিয়েছে, সবারই স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভাল, তাদের চলাফেরার মধ্যে একটা স্বাচ্ছন্দ্য, ব্যতিব্যস্ততার একটা অভাব দেখা যাচ্ছে। বাতাসেরও যেন গন্ধটা পালটে গেছে। সবকিছুই কেমন অন্যরকম, তবু যেন চেনা-চেনা। বরদাবাবুর একই সঙ্গে উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত লাগছিল।
তিনি ভীষণ অবাক হয়ে দেখলেন, সমস্ত খবরের কাগজের প্রথম পাতাতেই এমন সব ঘটনার কথা লেখা রয়েছে, যা পনেরো বছর আগে ঘটে গিয়েছে। একটু খুঁটিয়ে দেখতেই বরদাবাবুর চোখে পড়ল, কাগজের তারিখগুলো সব পনেরো বছর আগের।
বরদাবাবু পাগল হয়ে যাননি, একটু খবর রাখলেই সব বুঝতে পারতেন। গতকাল রাতে সরকার এই শহরের পুরনো নামটি আবার ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে-নাম শেষ পালটানো হয়েছিল পনেরো বছর আগে।
এই তিনটে চরিত্র (এবং তাদের গল্প) সত্যজিৎ রায়ের তৈরি করা নয়। আমার তৈরি করা। কিন্তু সত্যজিতের চোটগল্পগুলোর এবং তাদের প্রচুর চরিত্রের আদলে তৈরি করা, সেগুলোর অনুপ্রেরণায় তৈরি করা।
এই তিনটে গল্পের প্রেক্ষাপট আমার সত্যজিতের লেখনী অবলম্বন করে লেখা। রায়বাবুর ছোটগল্প এবং চিত্রায়ন আমাকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে দুটো গল্প নেওয়া যাক— ‘শিবু আর রাক্ষসের কথা’ আর ‘সেপ্টোপাসের খিদে’। গল্পদুটো যদিও আমার হুবহু মনে নেই, তবু মনের মধ্যে গেঁথে গেছে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য, কিছু অংশ। সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে গল্পগুলোর মধ্যে মিশে গেছে আমার নিজের কল্পনা, ফলে তারা সম্পূর্ণ অন্য রূপে বেড়ে উঠেছে।
রাক্ষসের গল্পে শিবু নামে একটি স্কুল-পড়ুয়া ছেলের সন্দেহ হয়, তার অঙ্কের মাস্টারমশাই আসলে মানুষ নন, এক দানব বা রাক্ষস। এ-সন্দেহের থেকে সে প্রায় নার্ভাস ব্রেকডাউন বা মনের দিক থেকে ভেঙে পড়ার অবস্থায় পৌঁছে যায়। দুর্দান্ত প্লটের পাশাপাশি এ-গল্পে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে মফস্সল জীবনের ছবি।
সেপ্টোপাসের গল্পে এক বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী একটি খামারবাড়ি ভাড়া করে সেখানে মাংসাশী গাছদের নিয়ে গবেষণায় নিজের জীবন কাটান। এই অধ্যাপক টের পান তাঁর একটি মাংসাশী গাছ, বস্তুত সবচেয়ে বড় যেটি, সেটি অবাধ্য হয়ে পড়েছে। মুরগি আর খরগোশ খেয়ে আর তার পেট ভরছে না, তাকে যে-মানুষটি খাওয়াতে যায় সে তাকেই আক্রমণ করতে শুরু করেছে।
দুটি গল্পই বাঁধা হয়েছে সম্ভাব্যতার আখরে। গল্পের সূচনা বাস্তবের হাত ধরে হলেও গল্পের মাঝামাঝি এসে তারা ‘উনহাইমলিখ’ হয়ে পড়ে। এই ‘উনহাইমলিখ’ কথাটি প্রথম ব্যবহার করেন জার্মান মনস্তাত্ত্বিক আর্ন্সট জেনশ, তাঁর ‘অন দ্য সাইকোলজি অফ দি আনক্যানি’ প্রবন্ধে। ‘উনহাইমলিখ’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ অ-ঘরোয়া। জার্মান ভাষায় আনক্যানি বা বিদঘুটে বোঝাতে এই শব্দটিই ব্যবহার করা হয়। ‘উনহাইমলিখ’ শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে, যা কিছু বিদ্ঘুটে তা আসলে বাসা বাঁধে অতি সাধারণ, স্বাভাবিক পরিস্থিতির বুকেই। যেমন, আমাদের পরিচিত বাসস্থান। একটা সময়ে আচমকাই যে-জিনিসকে দেখে খুব চেনা মনে হয়, সেই সম্পূর্ণভাবে অচেনা হয়ে ওঠে। যা কিছু মামুলি, তা নিজেকে পালটে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এতে বিচ্ছিন্নতা বা অমিলের একটা পরিবেশ তৈরি হয়, তাতে মনের মধ্যে উদ্রেক হয় গুলিয়ে যাওয়া বা ‘কিছু একটা ঠিক নেই’-এর আবেগ।
জেনশ সন্দেহপ্রকাশ করেছিলেন, ‘আপাতভাবে চলমান একটি বস্তু আদৌ জীবিত কি না, এবং বিপরীত যুক্তিতে, একটি নির্জীব বস্তু আসলে অচলমান কি না।’
২০১৬ সালে আমি পশ্চিম জাপানের একটি ছোট মৎস্যজীবী দ্বীপে কিছুদিন কাটাই। সেখানে থাকাকালীন নানা রকম মানুষের একটি দলের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, এবং জেন টাব বলে একটি প্রযোজনার আমি দায়িত্ব নিই। এ-প্রযোজনা ছিল শোদ-ও-শিমা দ্বীপের অনেকটা উপরে একটি রিয়োকায় (সাবেকি জাপানি সরাইখানায়) এক সেনটোতে (সাধারণ স্নানাগার) অল্প কয়েকজন পুরুষ বসে স্নান করছেন, এই মর্মে একটি ছবির সমষ্টি।
এই পুরুষদের মধ্যে রয়েছেন একজন একদা-খ্যাত কাবুকি অভিনেতা, এক সয় সস কারখানার মালিক, একজন নিঞ্জ-ও-বন (চড়চড়ে আবেগসর্বস্ব জাপানি সিরিয়াল) নির্মাতা, একজন রাঁধুনি, একজন পাঠ্যপুস্তক লেখক, একজন চাকুরে ইত্যাদি আরও কয়েকজন। এদের মধ্যে একজন আছে যে নিজের পেশা জিজ্ঞেস করলে বলে সে একজন ‘প্লেসার’। তার কাজ হচ্ছে চাকরির ইন্টারভিউতে বসে যারা দরখাস্ত করেছে তাদের নিজেদের শ্রেণি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পরিস্থিতি ইত্যাদির নিরিখে ‘প্লেস’ করা এবং তাদের সামাজিক মূল্যায়ন। গল্প এগোনোর সঙ্গে-সঙ্গে এই ব্যক্তির সঙ্গে যারা স্নান করছে, তারা আস্তে-আস্তে টের পায় সে আসলে মানুষ নয়, এক অপদেবতা।
২০১৯ সালে মুম্বইয়ের ডক্টর ভাউ দাজি লাড মিউজিয়ামে আমার একটি একক প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত হয়েছিল। শহরের এমন সব লোকজন যাদের অলৌকিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাদের সাক্ষাৎকারের একটি সিরিজ— এই মর্মে আমি একটি অনুষ্ঠান তৈরি করেছিলাম। ‘স্পেক্ট্রাল টাইমস’ বলে আমার এই কাজের মূলে ছিল একটি কল্পনা— দৃশ্যমান মুম্বই শহরের নীচে একটি অদৃশ্য, অলৌকিক শহর রয়েছে। কখনও-কখনও খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে কেউ-না-কেউ এই অন্য মুম্বইয়ের সাক্ষাৎ পেয়ে যায়।
এদের মধ্যে একটি সাক্ষাৎকারের নাম ছিল ‘শেহরি আদমখোর’। এ-গল্পে একজন বিবরণ দেয়, কীভাবে সিগারেট ছাড়ার পর সে মানুষ খাবার একটি রুচি অর্জন করে। লোকটা ভোরেফিলিক হয়ে গেছে, অর্থাৎ যে মানুষ খেতে ভালবাসে। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করার তার একমাত্র উপায় হচ্ছে তাদের খেয়ে ফেলা। সমস্ত চিকিৎসা যখন বিফল হয়, তখন থেরাপি হিসেবে সে একটি রান্নার বই লিখতে শুরু করে, যাতে তার বন্ধুদের রান্না করা নানা রকম পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করা আছে।
আমার প্লেসার এবং ভোরেফিলিক, এই দুটি চরিত্রের মূলেই রয়েছে সত্যজিতের রাক্ষস। আমার ভবিষ্যৎ কাজের উপরে সেপ্টোপাসেরও প্রভাব বিপুল। ২০১৮ সালে ডয়েচ ব্যাঙ্কের কমিশনে আমি বাগান বিষয়ক একাধিক মিউরালশিল্পের কাজ করি। বাগান করার সঙ্গে যুক্ত নানা রকম জায়গা, বস্তু এবং ব্যক্তিদের নিয়ে আমি চর্চা করেছিলাম। একটি মিউরাল পল সালিভান নামে একজনকে নিয়ে;
‘এক সময়ে পল ছিল জেট-সেটার, তার পকেটের পেজার যন্ত্রটি কখনওই নীরব থাকত না। কিন্তু কয়েক বছরেই সে একেবারে হাঁফিয়ে পড়ল। কিছু বাজে এসেটে টাকা ঢেলে তার দেদার ক্ষতি হল, আচমকাই বুঝতে পারল শহরটা আর তার প্রতি আগের মতো বন্ধুতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে না। সময় থাকতে-থাকতেই তাকে কেটে পড়তে হবে। এক শুভাকাঙ্ক্ষীর উপদেশে সে গার্ডেনিং থেরাপিতে নাম লিখিয়ে উত্তরে চলে গেল। সেখানে তুলনামূলক একাকিত্বের সুযোগ নিয়ে সে নিজের অন্তরে খুঁজে পেল বাগান করার প্রতি একটা অদম্য ভালবাসা, মাংসাশী গাছের পরিচর্যা করতে শুরু করল সে।
গার্ডেনিং থেরাপি কথাটি আসলে গার্ডেনিং-লিভ কথার অপভ্রংশ, যে-কথাটি দিয়ে আসলে ইঙ্গিতে ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের বরখাস্ত করা আমলাদের বোঝানো হত।’
আমার কাজকে দৃশ্যমান বা অদৃশ্যভাবে প্রভাবিত করে গেছেন সত্যজিৎ রায়, এবং আমার কল্পনার ইন্ধন তিনিই জুগিয়ে যাবেন। আমার চরিত্র এবং প্রেক্ষাপট আমি যেভাবে সৃষ্টি করি, যেভাবে গল্পের বিন্যাস করি, তার উপর ওঁর প্রভাব পড়েছে।
সত্যজিৎ রায়ের আঁকা দুটি ছবি ব্যতীত সমস্ত ছবিই সারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁকা।