ভিকির ফোন পেয়ে, ঘুমটা গেল চটকে। সারারাত কারখানায় কাজ করে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে সকাল প্রায় আটটা। দুটো পেটে দিয়ে বিছানায় গড়িয়ে ছিলাম। ঘুম যখন ভাঙল, দুটো বেজে গেছে। দিনের পর দিন কারখানায় কাজ করে একটা দিন হাত-পা ছড়াতে ইচ্ছে করে। ভিকির মুখে বীভৎস খবরটা শুনে সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হল না। টিভির সামনে হাভাতে নয়নে মা খবর গিলছে, ‘এই মুহূর্তের বিশেষ খবর, আগামীকাল থেকে লকডাউনের ঘোষণা!’
পরনের হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বেরোতে যাব, মা হাত পাতল, ‘এই মাসেরটা!’
‘সবসময় টাকা-টাকা করে জ্বালাবে না তো।’
‘খাবার বেলায় মনে থাকে না! টাকার সময় জ্বলতে থাকো।’
‘টাকা দিলেই তো হল। কাজে বেরোনোর সময় ব্যাগড়া দেবে না।’
একটা ভাল কাজে যাব, মুডটা পুরো অফ হয়ে গেল। মা না ছাই! একটু বললও না, দুপুরে খেয়ে নে। মাথা গরম, পুরনো চপ্পল, কলার খোসা এই ত্রিমূর্তির চক্করে হড়কে গিয়ে রাস্তার ধারের কালীমন্দিরের সামনে উপুড় হয়ে পড়লাম। প্রতিদিনের অভ্যাসমতো নিজের অজান্তেই এক হাত কপালে উঠে গেল, ‘স্টক পেলে, পুজো দেব মা।’ হাত-পা একটু ছড়ে গেলেও ব্যথা ভুলে নতুন উদ্যমে দোকানের সামনে হাজির। সামনে বিশাল ভিড়। মাঝে মাঝেই পুলিশে গুঁতিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ চলে গেলেই, ছত্রভঙ্গ জনতা আবার শ্যাওলার মতো খুঁটির পাশে জমা হয়ে পড়ছে। খুঁটি মানে মদের দোকান। এলাকার গর্ব। ইংরেজ আমলের এই প্রতিষ্ঠান। মদের বোতলের সাথে স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু গুপ্ত খবরের চিরকুট পাচারের সাক্ষী সে। আগের বার লকডাউনে ব্ল্যাকে মদ পাচারে পুরো জেলায় ফার্স্ট হয়েছিল। আপাতত গর্বিত জনতার ভিড়ে আমিও দাঁড়িয়ে। কালীঘাটের মতো লাইন পড়েছে। লাইনে ঢুকে বুঝলাম, একবার বেরোলেই, ঢুকে দেখব লাইনটা তারকেশ্বরের মতো হয়ে যাবে। আমার সামনে পূর্ণিমা জুয়েলারির কারিগরটা। ওর সামনে হার্ডওয়্যারের ছেলেটা। তার সামনে মাছওয়ালা। একী! এ তো মিষ্টির দোকানের মালিকও ঢুকে পড়েছে। ভাগ্যবান! এই বাজারেও সারাদিন ব্যবসা চালাবে। এদিকে আমাদের মালিককে রাতে লুকিয়ে-লুকিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে। ‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়।’ টাকা এনেছি তো? প্যান্টের এ-পকেট সে-পকেট করে দেখি, গত কাল মালিকের দেওয়া পাঁচশোটা টাকা। অনেক খিচাইন করে মালিক দিয়েছে। মায়ের ফোন ঢুকল, ‘তোর বাবা সেই সকালে বেরিয়েছে, বলতে ভুলে গেছি। ফেরার সময় পঞ্চাশ পোস্ত আনিস। অনেকদিন খাওয়া হয়নি।’
এই বাজারে পোস্ত খাবে! মা তো না, যেন রক্তচোষা! ছেলে সারাজীবন খেটেই যাবে। তার শখ-ফুর্তি বলে কিছু নেই। আগের বার কাউন্টার বন্ধ হয়ে ব্ল্যাকে মাল কিনে-কিনে শেষে চাখনা কেনার পয়সা ছিল না। এবারে ভুল করব না। পরক্ষণেই নিজের ভুল ভাঙল। বছরের পর বছর দুটো ছাপা শাড়িতে চালিয়ে যাওয়া একজন মানুষের রক্তচোষা শখের কথা ভাবতে-ভাবতেই দেখি পুলিশের গাড়ির আগমন। মুখে হাত দিয়ে মনে হল, মাস্ক নেই। কী করি? হাতের নাইলনের ঝোলাকে মাথায় গলিয়ে নিলাম। সামনের জন বাইকের হেলমেট, কেউ আবার রুমাল মুখে গুঁজে ফাঁকা-ফাঁকা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। পুলিশের গাড়ি বেরিয়ে যেতেই আবার জটলা, মুখে খিস্তি।
‘চৌকিদারগুলো কেন যে আসে!’
পুলিশ দেখেই দোকানি সবার হাতে একটা করে টোকেন ধরাল। টোকেন ছাড়া পাওয়া যাবে না। বেপাড়ার টিভি সিরিয়ালের ছেলেটা র্যালা মেরে সাইড দিয়ে লাইনে ঢুকতে গিয়েছিল। লাইনের জনতা মুহূর্তের মধ্যে ঘ্যাঁক করে চেপে ধরল। ছেলেটা অমনি চম্পট। সব জায়গাতে স্টার-পাওয়ার খাটবে না। ভোটে দাঁড়ানোর মুরোদ নেই, মদের দোকানে বেলাইন! অনেকক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। বিড়ি ধরানো হয়নি। মনটা আনচান করছে। পাশের চায়ের দোকানটা দিব্বি মাছি তাড়াচ্ছে। ওখানে গিয়ে সুখটান দিলে বেশ হত। লাইনটা একবার মিস হলেই বিপদ। একজন দশ-বারো পেটি মদের বোতল নিয়ে কলার তুলে একটা হাতে-টানা রিক্সাকে ডাকল, ‘রাম সিং!’ খর্বকায় রামের শরীরটা হাড়সর্বস্ব। কোনও রকমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মদের পেটির উপর বাবুর পা, কানে মোবাইল। হেসে-হেসে দিগ্বিজয়ের খবর দিচ্ছে। রিক্সা বেরিয়ে গেল। পেছনে ছেড়ে গেল এক পাকস্থলি হতাশা। কতদিন সেবা হয়নি। ডিজে লাইট জ্বালিয়ে লাউড ভলিউমে টুম্পাসোনা চালিয়ে মালের গ্লাস হাতে ফুর্তি করার দিনগুলো বড্ড টানে। জায়গা বলতে ভিকির মেস। আজকে বোতল জোগাড় হলে, ভিকির ওখানে গ্যারেজ করে আসতে হবে। ছেলেটা সৎ। আমার অনুপস্থিতিতে সিল ভাঙবে না। তবে মালটা একটু বেশি টানে। এসেছি অনেকক্ষণ। লাইন একটু কমে, দক্ষিণেশ্বরের মতো হয়েছে। মাথায় প্রচণ্ড রোদের তাপ। আর পারা যাচ্ছে না। বাড়ি থেকে ছাতাটা আনা যেতে পারত। ছাতাটার কাপড়ে অনেক জায়গায় ছেঁড়া। তাপ্পি মারতে হবে। যে ছাতার কারখানায় কাজ করে, তার বাড়িতে ছাতার অভাব! বহুদিন পর বেশ ভাল লাগছে। সবাই মিলে একটা অভিযানে এসেছি। ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ।’ বড়লোক, ছোটলোক সবাই একই জিনিসের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়েছে। মদের দেবতার চোখে সবাই সমান। দোকান থেকে বেরোলেই শুরু হয় ছোট-বড়-মাঝারি! যদিও আজকে সবাই মজুতদার। যার পেটে যতটা সয়। আজকে কারখানার মালিককে কড়কে দিতে হবে। শালা, পাঁচশো টাকায় তিনটে পেট কী করে চলে! বাড়ির মালিকের ফোন ঢুকল, ‘তোমার বাবা তো এই মাসের ঘর ভাড়াটা দিলেন না।’
‘চিন্তা করবেন না মেসোমশাই। দু’ঘণ্টার মধ্যেই পেয়ে যাবেন।’
মেসোমশাইও জানেন যে, এইরকম অনেক দু’ঘণ্টা পার হলে উনি টাকাটা পাবেন। তাও প্রতিদিন ফোন করে একবার মনে করাবেন। ওঁর কিছু করার নেই। আমিও চাপে আছি। সংসারের পুরো লোড আমার ঘাড়ে পড়েছে। বাবা ছাতার কারখানায় যে কী করে, মা আজ অব্দি বুঝতে পারল না। সকালে বেরিয়ে রাতে ফেরে। বাড়ির লোকের সাথে যোগাযোগ নেই বললেই হয়। সংসারের একজন নির্বাক সদস্য। এটাই রক্ষে যে, ওঁর হাতখরচের টাকাটা দিতে হয় না। দোকানের সামনে জটলা বাড়ছে। যে-হারে লোকে মাল কিনছে, আজকে পেলে হয়! একজন রিপোর্টার আবার ভিডিও শুরু করেছে, ‘আজকের বিশেষ-বিশেষ খবর, একদিনে রেকর্ড পরিমাণ ট্যাক্স জমা পড়েছে।’ হাড়-হাভাতেগুলো সব জায়গাতে হাজির। সবেতেই ওদের নজর। একটু শান্তিতে থাকতে দেবে না দেখছি! লাইনের মাঝখান দিয়ে জোড়া প্রজাপতি গুনগুন করে স্কুটিতে চলে গেল। আগের বছর শম্পাটার বিয়ে না হলে আজকে আমিও ভ্রুম-ভ্রুম করতাম। ভাগ্যিস কেটে পড়েছে, নাহলে গাড়ির তেল কিনতে-কিনতে জাঙ্গিয়া হলুদ হয়ে যেত। লাইন চলেছে পিঁপড়ের গতিতে। ভ্যাকসিনের লাইনের স্পিড এর থেকে বেশি। লাইনের ভয়ে ভ্যাকসিন এখনও নেওয়া হল না। সামনের জন কাশি শুরু করেছে। কাশতে-কাশতে ও লাইনের বাইরে বেরোতেই, আমার হল প্রমোশন। চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। এখন লাইন অনেকটা বর্গভীমার মতো। মাইকে আজানের আওয়াজ আসতেই কারেন্ট অফ হয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনভার্টার, চার্জার লাইট, হ্যারিকেন— যার যেমন সামর্থ্য জ্বালিয়ে দিল। একমাত্র মদের দোকানটি জেনারেটার চালিয়ে অতিথি বরণ করছে। তার আতিশয্যে মিষ্টির দোকানের মালিকের মুখ চুপসে গেল। লাইনে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ সং সাজবে! মালের দোকানে ধূপবাতি দেওয়ার জন্যে পাঁচ মিনিটের মৌনব্রত। সারা দুপুর ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে গায়ের ঘাম শুকিয়ে গেঞ্জির ইস্ত্রি হয়ে গেছে। সারাদিনে কিছুই খাওয়া হল না। খাওয়া মানে তো বাড়িতে ওই আলুসিদ্ধ, সোয়াবিনের ঝোল। যমের অরুচি! একদিন ভালমন্দ রান্না করতে পারে না। ভাল বাজার করতে গেলে টাকা লাগে। সেই টাকাটা প্যান্টের পকেটে নিসপিস করছে। হাতে আর আধঘণ্টা। এর পর পুলিশে বন্ধ করে দেবে। এর মধ্যে জোগাড় না হলে, ব্ল্যাকে চড়া দামে কিনতে হবে। মালিকের ফোন, ‘মদের দোকানে কী করছিস?’
‘আমি মদের দোকানে, তা আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমার লোক সর্বত্র। আমার জন্যে একটা বোতল তুলে নিস।’
‘টাকা কে দেবে?’
‘কালকে তো দিলাম।’
‘ওটা আমার কাজের টাকা।’
‘লকডাউনে মাইনেটা কে দেবে?’
‘আগের বার কত দিয়েছিলেন?’
‘বেশি কথা বলিস না।’
‘আলবাত বলব।’
‘তোকে পুলিশে দেব।’
‘বেশি কথা বলবেন না, নাহলে আমিই পুলিশে ফোন করব। সব জায়গায় কারখানায় ফিফটি পারসেন্ট লেবার করতে বলা হয়েছে। আপনি শাটার বন্ধ করিয়ে ফুল ম্যানপাওয়ারে কাজ করাচ্ছেন। রাতের পর রাত জেগে মেশিন চালাই। দু’মাসের টাকা পাঠান। তাহলে মাল আসবে।’
‘তোর বেশি মুখে কথা হয়েছে। তোকে আর কাজে আসতে হবে না।’
‘আগে আমার পাওনা টাকা ফেরত দিন।’
ওপাশ থেকে ফোন কেটে যাওয়াতে মটকা গরম হয়ে গেল। মুখের ভুলে মালিককে চটালাম। এবারে কাজ পাব তো! আগের বার লকডাউনে কতদিন ঘরে বসেছিলাম। কীভাবে ঘর চলেছিল, আমিই জানি। এটাও জানি, বাবার কাজটা নেই। বাড়িতে বলতে পারে না, তাই দিনভর বন্ধুদের সাথে আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে বলে, ‘মালিক খচ্চর।’ মদের দোকানে এসে দুঃখ করতে নেই। আজকে বোতল পেলে হয়! লাইনের সামনে আরও দশজন। হঠাৎ দেখি পাশের সিগারেটের দোকানে চেনা একটা মুখ। চোখদুটো দেখে বুঝতে পারলাম অনেকক্ষণ ধরে আমাকে ওয়াচ করছে। টাকা রোজগার না করতে পারলেও বিড়ির নেশা ষোলোআনা। সময়মতো যদি নজর দিতে, আমাকে মালিকের সাথে ভাতের লড়াই করতে হত না। সারাজীবন কি মিথ্যে করেই বলবে, ‘কাজে যাচ্ছি’? হঠাৎ কোলাপ্সিবেল গেট বন্ধের আওয়াজ পেলাম। মাল শেষ! দোকান বন্ধ হয়ে গেল। জনতা চোখের নিমেষে কোথায় মিলিয়ে গেল। বাবার সাথে ফিরতে-ফিরতে অনেক কথা হল। বাবাকে বললাম, ‘আমার কাজটাও চলে গেছে।’
‘কী করবি এখন?’
‘কী আর! বাড়িতে গিয়ে আজ রাতে জম্পেস করে পোস্তর বড়া খাব।’
‘টাকা আছে?’
মায়ের ফোন ঢুকল, ‘কোথায় আছিস? বাড়ির মালিক বলছে কবে টাকা দিবি।’
‘কাল…’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র