আমার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের যোগাযোগের সূত্র একদম আলাদা। ছোটবেলা থেকেই জোহান সেবাস্তিয়ান বাখ-এর বাজনা শুনতে ভালবাসতাম। শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে প্রচুর ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিকের রেকর্ড আছে। বাখ-এর অনেক লং-প্লেয়িং রেকর্ডও আছে। আমার মাসতুতো দিদি অনুভা গুপ্তা। একদিন দিদিকে বললাম, ‘আমায় নিয়ে যাবে একবার সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি? আমায় উনি রেকর্ড শুনতে দেবেন?’ শুনে দিদি বলল, ‘বেশ তো, একদিন নিয়ে যাব।’ আর আমি ছোটবেলা থেকেই ফোটো তুলতাম, আমায় সে-ব্যাপারে হাতেখড়ি দিয়েছিলেন শম্ভু সাহা। ওঁর কাছে থেকে লেন্সের ব্যবহার, কম্পোজিশন, ডার্করুমে কী ভাবে ছবি ডেভেলপ করতে হয়— সব শিখেছিলাম। উনি আমার বাবার বন্ধু ছিলেন। টালিগঞ্জের গ্রাহাম রোডের বাড়িতে বহু সময় কাটিয়েছি। বহু লাইকার বই আমাকে উনি দিয়েছেন। ফোটোগ্রাফি আর ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকাল মিউজিক— এই দুটো হবি ছিল আমার। এই দুটো বিষয়ে মানিকদার কাছ থেকে কিছু জানব বলেই, ওঁর সঙ্গে দেখা করার এত ইচ্ছে ছিল।
আমি তখন ক্লাস নাইন-এ পড়ি, ১৯৬১ সালের এক সন্ধেবেলায়, অনুভা গুপ্তা আমায় মানিকদার বাড়ি নিয়ে যায়। আমি সঙ্গে করে আমার তোলা কিছু ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম ওঁকে দেখাব বলে। সেদিন প্রায় ঘণ্টা-দুয়েক আড্ডা হয়। ওয়েস্টার্ন মিউজিক নিয়ে নানারকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। বাখ-এর কী কী শুনেছি? ব্রাহমস শুনেছি কি না? আরও কত কী। শেষে বললেন, ‘তোমার যখনই বাজনা শুনতে ইচ্ছে করবে, আমার বাড়ি চলে এসো, আমার বাড়িতে প্রচুর এলপি আছে।’ আর ছবি দেখে বললেন, ‘তোমার নিজস্ব একটা স্টাইল তুমি তৈরি করে ফেলেছ। কিন্তু you must be flexible. সবরকম স্টাইল আয়ত্ত করার চেষ্টা করবে। সবরকমের ছবি তুলবে। একরকম ধারায় কেবল ছবি তুলবে না। You should go on transforming yourself with the time’। তার পর ফেরার সময়, উনি আমায় একটা বই উপহার দিলেন। সেটা ছিল অরিঁ কার্তিয়ে ব্রেসঁ-র একটা ফোটোগ্রাফির বই। বললেন, ‘এই বইটা তুমি স্টাডি করবে। জানবে, একটা ছবি হল একটা গল্প। যদি একটা ছবিতে একটা গোটা গল্প বলে দিতে পারো, তাহলে সেই ছবিটা সম্পূর্ণ। তা না হলে জানবে সেই ছবিতে একটা ফাঁক রয়ে গেছে।’
এরপর আমি ওঁর বাড়ি গিয়েছি, মিউজিক শুনতে, ছবি দেখাতে। খুব সাধারণ দেখাসাক্ষাৎ সেসব। যেমন রোজকার জীবনে ঘটে থাকে, তেমন। আলাদা করে বলার মতো কোনও গল্প তৈরি হয়নি। হায়ার সেকেন্ডারি দেওয়ার পরে, আমি ‘শ্রীমতী’ বলে একটা পত্রিকার জন্য কাজ করতে শুরু করি। সেখানে কবি শান্তনু দাসও কাজ করতেন। একদিন তিনি বললেন, ‘চলো, মানিকদার ওপর একটা স্টোরি করি।’ আমি তো খুবই রাজি। এক সন্ধেয়, মানিকদার বাড়ি গিয়ে ঘণ্টা-দুয়েকের একটা ইন্টারভিউ নিল শান্তনু, আর আমি প্রচুর ছবি তুললাম। যখন শেষ হয়েছে ইন্টারভিউটা, মানিকদা আমাকে বললেন, ‘তুমি তো একবারও ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলে না?’ আমি বললাম, ‘আমি আসলে যেটুকু আলো পাওয়া যাচ্ছে, সেটুকু ব্যবহার করে, মানে অ্যাভেলেবল লাইটে ছবি তোলার চেষ্টা করছি।’ উত্তরটা শোনার পর মানিকদা আবার আমায় নিয়ে বসলেন। বললেন, ‘এক্সিসটিং লাইট যতটা সম্ভব ব্যবহার করবে, এতে খুব ভাল কাজ হয়। ফ্ল্যাশ ফোটোগ্রাফি আমি নিজে পছন্দ করি না।’ সেইদিন উনি আমায় আবার ব্রেসঁ-র একটা বই দিলেন। দুর্লভ দুটো বই আমি উপহার পেলাম মানিকদার কাছ থেকে। পরে আর একটা বই দিয়েছিলেন— বেস্ট ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটোগ্রাফি।
তখন ‘কোকুশাই বুনকা সিনঙ্কোকাই’ বলে জাপানে একটা প্রাইজ দেওয়া হত, অ্যামেচার ফিল্মমেকারদের। আমার বাবার একটা আট-মিমি ক্যামেরা ছিল, সেটা দিয়ে আমি একটা ফিল্ম বানিয়েছিলাম। নিজেই কাঁচি দিয়ে, ব্লেড দিয়ে কেটে এডিট করেছিলাম। সেই সাইলেন্ট ফিল্মটা পাঠিয়েছিলাম ওখানে, সেটা একটা প্রাইজ পেয়েছিল। প্রাইজটা পাওয়ার পর আমি মানিকদার কাছে যাই। ততদিনে অবশ্য মানিকদার সিনেমা নিয়ে অনেক কিছু আমার জানা হয়ে গিয়েছে। প্রাইজ পেয়েছি জেনে তো উনি ভারি খুশি। বললেন, ‘ফিল্মটা আমায় দেখাও।’ দেখে বললেন, ‘ বাঃ! খুব ভাল হয়েছে।’ এবং কিছু সাজেশন দিলেন। মানিকদার কাছ থেকে সাজেশন পাওয়ার ব্যাপারটা খুব দুর্লভ ছিল। কাউকে উনি কিন্তু কোনওদিন কিছু শেখাননি। আমিও বলতে পারব না, মানিকদা আমায় এটা শিখিয়েছেন বা ওটা শিখিয়েছেন। তবে হ্যাঁ, আমাকে উনি ভীষণভাবে গাইড করেছেন। মানিকদার এই সাজেশন দেওয়ার মধ্যে এমন একটা ব্যাপারটা ছিল যে, যার একটু ঝোঁক আছে, সে ওই সাজেশন থেকেই শিখে ফেলতে পারবে।
সেই সময় রিচার্ড রাইনস্ট্রফ বলে একজন জার্মান ফোটোগ্রাফার আসেন কলকাতায়। তাঁর সঙ্গে একটা ওয়ার্কশপ করার জন্য ম্যাক্সমুলার ভবন কয়েকজনকে বাছাই করে। সাতদিনের সেই ওয়ার্কশপে আমার সঙ্গে ছিল সুনীল দত্ত, অরুণ গাঙ্গুলি। সাতদিন পরে একটা থিম দেওয়া হয় আমাদের— কলকাতা ট্র্যাফিক— সেই থিমের ওপর আমাদের ছবি তুলতে হবে। বলা হল, ‘একদিন সময় দেওয়া হবে। তোমাদের তোলা ছবির ওপর ভিত্তি করে আমরা ঠিক করব, ডকুমেন্টশন ফোটোগ্রাফি তোমরা কে কতটা পেরেছ।’ আমি তো তড়িঘড়ি মানিকাদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানিকদা, ডকুমেন্টেশন ফোটোগ্রাফি জিনিসটা কী, আমায় বোঝান।’ উনি বললেন, ‘ডকুমেন্টশন ফোটোগ্রাফি তুমি তো জানো। যে ছবিটা একটা গল্প বলে, সেটাই ডকুমেন্টশন ফোটোগ্রাফি। সেটাই একটা ডকুমেন্ট।’ আমি ছবি তুললাম। আমার ১২টার মধ্যে আটটা ছবি নির্বাচিত হয়েছিল এবং আমি প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলাম।
পুরস্কার পাওয়ার পর তক্ষুনি মানিকদার কাছে ছুটলাম। মানিকদা বললেন, ‘শোনো, তোমার ফিল্ম, ফোটোগ্রাফি এবং মিউজিকে ইন্টারেস্ট আছে। তুমি টেলিভিশনে যাও।’ তখন টেলিভিশন মানে দিল্লি। কলকাতায় তখন টেলিভিশনের চিহ্নমাত্র নেই। আমি যা শুনেছিলাম, টিভিতে রেডিওর নিউজ রিডারদের মতোই নিউজ পড়া হয়, আর কিছু সিনেমা দেখানো হয়। আমি মানিকদাকে বললাম, ‘ও খুব কুচ্ছিত জিনিস, ওতে আমার কোনও ইন্টারেস্ট নেই।’ উনি বললেন, ‘আরে না না, তুমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না। এডুকেশনাল টেলিভিশন বলে একটা জিনিস আছে, যেটা আমাদের দেশে হয় না। তার ভবিষ্যৎ খুব ভাল। এবং আমাদের দেশে যেটা সবচেয়ে প্রয়োজন, সেটা হল এডুকেশনাল টেলিভিশন।’ এবং উনি বলতে শুরু করলেন, অডিও-ভিশুয়াল মাধ্যমের সাহায্যে শিক্ষিত করাটা কতটা জরুরি এবং কী করে তা করা যায়। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোথায় শিখব?’ উনি বললেন, ‘স্কটল্যান্ডে একটা ইনস্টিটিউশন আছে: সেন্টার ফর টেলিভিশন ডেভেলপমেন্ট, সেখানে তুমি যাও।’ বললাম, ‘আমার তো কোনও আর্থিক সামর্থ্যই নেই।’ মানিকদা পরে একদিন ওঁর বাড়িতে যেতে বললেন। গিয়ে দেখি, ওই প্রতিষ্ঠানকে একটা চিঠি লিখে রেখেছেন। আমার জন্য স্কলারশিপের রেকমেন্ডশন। যদিও এই প্রতিষ্ঠানে আমি অ্যাডমিশন পেয়েছিলাম, কিন্তু টাকার অভাবে আমার যাওয়া হয়নি।
১৯৭১। বাংলাদেশ যুদ্ধ। ২৫ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফায়ারিং হয়, আর আমি ২৭ মার্চ লুকিয়ে ইস্ট-পাকিস্তানে ঢুকে যাই। যতজন সাংবাদিক তখন ইস্ট-পাকিস্তান যুদ্ধের খবর করতে গিয়েছিলেন, আমি ছিলাম তাঁদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে ছোট। ‘টাইম ম্যাগাজিন’-এ বাংলাদেশ যুদ্ধ নিয়ে প্রথম যে ছবি ছাপা হয়েছিল, তা আমার তোলা। সেই সময় আমার বাংলাদেশি কয়েকজন বন্ধু হয়েছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম, একটা পাতলা বই করব এক্সোডাস নিয়ে। সব হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হচ্ছেন, আর তাঁদের প্রতি পাকিস্তান আর্মি যে আচরণ করছে— তা-ই নিয়ে হবে এই বই। এবং পাকিস্তানে সেই বই চোরাচালান করব। সেই বইতে আমার তোলা প্রচুর ছবি ছিল আর রমাপদ চৌধুরী, বুদ্ধদেব গুহ, মৃণাল সেন, সাধন ব্যানার্জি, জিতেন সেন এবং আরও অনেকে এই বইতে লিখেছিলেন। মানিকদাকে এই বিষয়ে পুরোটা জানানোর পর উনি বলেছিলেন, ‘বই স্মাগল করবে বলছ, কিন্তু খুব সাবধান। এখন যুদ্ধ চলছে।’ আমরা পাকিস্তানের বিভিন্ন লাইব্রেরি, দোকান, রেস্তোরাঁ, পেট্রোল পাম্প— এমন অনেক জায়গায় বইটা স্মাগল করে রেখে আসতে পেরেছিলাম। বইটা কলকাতা থেকে প্রথমে যেত কলম্বো, সেখান থেকে যেত করাচি, এবং করাচি থেকে যেত ইসলামাবাদ। বইটা হাতে পাওয়ার পর মানিকদা আমায় একটা চিঠি লিখেছিলেন, বক্তব্য ছিল— তোমার এই বইটা দেখে মানুষ ভাল হবে কি না জানি না, তবে তাদের চোখ খুলে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে।
তারপর মানিকদার কাছ থেকে শিখেছি, কী করে টেলিভিশনে লাইভ টেলিকাস্ট করতে হয়। সালটা ১৯৭৬। ফুটবলের প্রথম লাইভ টেলিকাস্ট। স্টেশন ডিরেক্টর মীরা মজুমদার বললেন, কলকাতা দূরদর্শন থেকে প্রথম লাইভ টেলিকাস্ট হবে। এর আগে তো কখনও লাইভ টেলিকাস্টের ট্রেনিং পাইনি। কোথায় ক্যামেরা বসাতে হবে, কী করতে হবে, কিচ্ছু জানি না। আমার ঘরে এসে মানিকদাকে ফোন করলাম, ‘মানিকদা, লাইভ টেলিকাস্ট করতে হবে। কোথায় ক্যামেরা বসাব? আর কাট কীভাবে করব?’ মানিকদা বললেন, ‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আমায় একটু ভাবতে দাও। তুমি বিকেলে আমায় একটা ফোন করো।’ রাতে বাড়ি ফিরে এসে মানিকদাকে ফোন করলাম। মানিকদা বললেন, ‘সেন্টার লাইনে ক্যামেরা প্লেস করবে, একটা লং থেকে ক্লোজ-এ কাটবে, আর মনে রাখবে, হাওয়ায় বলটা দেখাবে না।’ এছাড়াও, বাকি তিনটে ক্যামেরা কোথায় বসবে, কীভাবে অপারেট করতে হবে, সব বলে দিলেন। আজকে অবধি যে ফুটবল কভারেজ হয়, সেটা এই পদ্ধতিতেই হয়। উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি লাইভ টেলিকাস্ট করবে, আমি কিন্তু দেখব বসে।’ পরে বিকেলে ফোন করে বললেন, ‘খুব ভাল হয়েছে।’ এই হচ্ছেন মানিকদা আমার কাছে।
‘সদ্গতি’ সিনেমাটা তৈরি হয়েছিল দূরদর্শনের জন্য। সেই সিনেমাটায় আমার ভূমিকা ছিল এক্সিকিউটিভ প্রোডিসারের। ফলে দূরদর্শনের পক্ষ থেকে সমস্ত চিঠিপত্র আদানপ্রদান থেকে ব্যবস্থাপনা— সবই ছিল আমার দায়িত্ব। এমনিতে নিয়ম ছিল, প্রথমে দূরদর্শনকে স্ক্রিপ্ট জমা দিতে হবে। চিত্রনাট্য অনুমোদিত হলে, তবেই শুটিং শুরু হবে। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের চিত্রনাট্য আর কে নাকচ করবে? স্ক্রিপ্ট অনুমোদনের পর শুটিং শুরু হল। নিয়ম ছিল, প্রথমে পরিচালককে কিছু টাকা দেওয়া হবে, তার পর ‘রাফ কাট’ দেখে, বাকি টাকা দেওয়া হবে। সরকারি নিয়ম। একদিন আমাদের কাছে চিঠি এল, ‘My rough cut is ready’. টালিগঞ্জের ফিল্ম সার্ভিসে দেখানো হবে। আপনারা আসবেন।’ স্টেশন ডিরেক্টর ছিলেন মিস্টার শিবশর্মা। বললেন, ‘সত্যজিৎবাবুর চেক রেডি করো। আগে ওঁকে চেক দেব, তার পর স্ক্রিনিং শুরু হবে।’ সেইমতো অ্যাকউন্ট্যান্ট-বাবুকে চেক রেডি করতে বললাম। তিনি নারাজ। সরকারি নিয়মের ব্যতিক্রম হবে। তখন স্টেশন ডিরেক্টর বললেন, ‘সরকারি চাকরি করছ বটে, কিন্তু চাকর হয়ে যেও না। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার বিচার কে করবে? তুমি না আমি? তাই মাথায় যে বুদ্ধিটা আছে, সেটা খরচ করো। তুমি চেক হাতে করে যাবে। আগে চেক দেব, তার পর স্ক্রিনিং শুরু হবে।’ রাফ কাট দেখলাম। আমরা কেউ কিছু বলার আগে উনি নিজেই বললেন, ‘এটা একটু বড় হয়ে গেছে। আমি আরও ট্রিম করে দেব।’ সদ্গতি তৈরি হয়ে গেল। এবার টেলিকাস্ট হবে। ঠিক করলাম, টেলিকাস্টের আগে ওঁর একটা ইন্টারভিউ নেব। ইন্টারভিউ হবে দুটো ভাগে। প্রথম ভাগের পর সদ্গতির কিছু স্টিল ফোটোগ্রাফ দেখাব। সেই মতো প্ল্যান করে শমীকদা (শমীক বন্দ্যোপাধ্য়ায়) আর আমি গেলাম ওঁর বাড়িতে। আমি একবার ক্যামেরাটা বসালাম শমীকদার ডানদিকে। তারপর ক্যামেরা রেখেছি শমীকদার বাঁ-দিকে। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘ইম্যাজিনারি লাইন ক্রস করছ।’ বললাম, ‘মানিকদা, মাঝখানে একটা সিকোয়েন্স আছে।’ ‘ও, আগে থেকে প্ল্যান করেই এসেছ।’ সেই কত বছর আগে ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ ব্যবহার করলাম কি না থেকে সদ্গতির ইন্টারভিউয়ের সময় ইম্যাজিনারি লাইন ক্রস করছি কি না— সব কিছুই এক একাগ্রতায় লক্ষ করে যেতেন।
মানিকদার একটা ইন্টারভিউ নেওয়া হয়েছিল। যেটা বিভাসদা করেছিলেন, আর আমি এডিট করেছিলাম। সেটা ইউটিউবে আছে, ‘দ্য গ্রেট মাস্টার্স’ বলে। তারপর একটা সময়ে ঠিক করি, মানিকদার ওপরে অনেকগুলো ডকুমেন্টারি ছবি তৈরি করব। সেইজন্য আমি আর সুন্দর (ধৃতিমান চ্যাটার্জি) একদিন ওঁর বাড়ি গেলাম। খুব আড্ডা হল। সেই আড্ডায় এমন বহু প্রসঙ্গ এসেছে, সেগুলো হয়তো অনকের কাছে আপত্তিকর হতে পারে। এবং উনি বলেছিলেন, ওঁর মৃত্যুর আগে এই আড্ডার কোনও অংশ, কোনও কথা যেন প্রকাশিত না হয়। আমি এখনও তা কোথাও প্রকাশ করিনি।
সেই ডকুমেন্টারি সিরিজের প্রথম যে ছবি, ‘হিউমার অফ রে’— সেটার চিত্রনাট্য করে ঋতুপর্ণ ঘোষ। আমি তখন তো ন্যাশনাল প্রোডিউসার, তাই বাংলায় এই ডকু-ছবি করলে হবে না। আমার অফিস কলকাতায় হলেও, আমি দিল্লির আন্ডারে ছিলাম। সুতরাং সেই স্ক্রিপ্ট থেকে ইংরেজি তর্জমা হল এবং ন্যাশনাল টেলিকাস্ট হল— হিউমার অফ রে। পরে যে ফিল্মগুলো হওয়ার কথা ছিল: উইমেন ইন রে’জ ফিল্মস এবং চিলড্রেন ইন রে’জ ফিল্মস, রে অন রে, আর শেষটা ছিল ডেথ ইন রে’জ ফিল্মস। এই পাঁচটা ডকু-ফিল্ম হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু হিউমার অফ রে-র পরে মানিকদার এত শরীর খারাপ হয়ে গেল যে আমি ঋতুপর্ণকে ডেকে বললাম, আমাদের সত্যজিৎ রায়ের অবিচুয়ারির জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমরা ডেথ ইন রে’জ ফিল্মটা করব ওঁর অবিচুয়ারি হিসিবে। কোনও ইন্টারভিউ থাকবে না, সবাই কেঁদে কেঁদে কথা বলবে— সেটা আমি চাই না। যেদিন উনি মারা যান, তার আগের দিন ক্রিপ্ট হয়েছে। উনি মারা যাওয়ার পর আমি সারাদিন কভারেজ করেছি। আর ঋতু, আনন্দ লাল আর অশোক বিশ্বনাথন লাগাতার কাজ করছে। ঋতু লিখছে, আনন্দ লাল ভয়েস-ওভার করছে, আর অশোকের সঙ্গে আমার আরও তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ফিল্ম জোগাড় করছে, সেই ফিল্ম টেলিসিনে-তে দিচ্ছে, তারপর এডিট করছে। কথা ছিল, অবিচুয়ারি ফিল্ম যাবে নিউজের পরে। কিন্তু নিউজের পরে অবিচুয়ারি-ফিল্ম তৈরি হল না। ফিলার চলল। প্রায় চার মিনিট পরে ‘এ লিটল টাইম অন এ লং রোড’ টেলিকাস্ট হল। যা মূলত ছিল ডেথ ইন রে‘জ ফিল্ম, মানিকদার মৃত্যু দিয়েই সেই ফিল্মটা তৈরি হল।
ক্লাস নাইন থেকে আমার সঙ্গে মানিকদার যে জার্নি শুরু হয়েছিল, মানিকদার মৃত্যুর কভারেজ দিয়ে সেই যোগাযোগ ছিন্ন হল।