এক চলমান ইতিহাস ছিলেন বিরজু মহারাজ। চলমান ইতিহাস শব্দবন্ধটি পরস্পর বিরোধী কিন্তু পণ্ডিতজীকে বর্ণনা করতে হলে এই শব্দটিই অমোঘ। কারণ তিনি কেবল নাচের শিল্প শৈলী বহন করেননি, সারা জীবন ধরে নৃত্যের বিভিন্ন আঙ্গিক সৃষ্টি করেছেন, ঐতিহ্যের সঙ্গে নতুনত্বকে মিশিয়ে ক্রমাগত রচনা করে গিয়েছেন নতুন ধারা এবং সামগ্রিক ভাবে নাচকে বয়ে নিয়ে গিয়ে তৈরি করেছেন এক মহাবিশ্ব। তাঁর মধ্যে ছিল আদির বীজ, তার সঙ্গে বর্তমানের সৃষ্টি ও বিশ্লেষেণের মিশ্রণে তিনি পরিণত হয়েছিলেন এক মহীরুহে। যে মহীরুহের মধ্যে গ্রথিত ছিল বহমান সৃষ্টির ইতিহাস। আমার দেখা একমাত্র সম্পূর্ণ নৃত্যশিল্পী।
বিরজু মহারাজের ঘরানা ছিল বিন্দাদিন ঘরানা। যে ঘরানা ছিল ভারতে কত্থক নাচের আঁতুরঘর। ভারতীয় কত্থক নাচের সৃষ্টি বিরজু মহারাজের আঙিনায়। মূলত তাঁর বাবা অচ্চান মহারাজের হাত ধরে। সঙ্গে ছিলেন তাঁর কাকা লাচ্ছু মহারাজ ও শম্ভু মহারাজ। কিন্তু বিরজু মহারাজের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তিনি শুদ্ধ মার্গ সঙ্গীতের অন্তর্গত কত্থক নৃত্যশৈলীকে আম-জনতার কাছে কেবল প্রিয় নয় বহুল জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। আজ যে আমরা ঘরে ঘরে কত্থক নাচের প্রতি ভালবাসা, শেখার উদ্যোগ দেখতে পাই, তার কৃতিত্বটা কিন্তু বিরজু মহারাজেরই। যিনি নিয়মিত মার্গ-সঙ্গীত চর্চা করেন না কিন্তু গান-বাজনা ভালবাসেন, তাঁরাও কিন্তু বিরজু মহারাজের পারফরম্যন্স দেখে তাতে ডুবে যেতে পারবেন। আনন্দ পাবেন, বুঝতে পারবেন। এমন ভাবে তিনি পারফর্ম করতেন ভেঙে ভেঙে, যা সহজবোধ্য এবং উপভোগ্য। তিনি নিজে বোল বলতেন, তার মতো মিঠে কিছু হয় না, তিনি তবলার সঙ্গে বোলের লয়কারি করতেন যা দেখার মতো এবং যখন তিনি নাচতেন তখন মনে হত যেন এর বাইরে পৃথিবীতে কিছু হচ্ছে না এখন।
মহারাজজীর কথা বলতে গেলে যেটা বলতেই হবে, তা হল তাঁর লয়কারি সম্পর্কে ধারণা, তাল সম্পর্কে ধারণা এবং অনবদ্য সব লয়কারি সৃষ্টি করা। এই যে বিশাল তাল আর লয়কারির সমুদ্র, তাকে তিনি যথাযথ বুঝতেন এবং অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে তবলা বাজাতে পারতেন, লয়কারি সৃষ্টি করতে পারতেন। অনেক কত্থক নৃত্যশিল্পী আছেন, যাঁরা কিন্তু তবলার জগতটা ভাল বোঝেন না। কেবল তাল সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেই হয় না, একটা শিল্পকে যথাযথ আয়ত্ত করতে হলে তাকে আত্মস্থ করতে হয়। মহারাজজী তবলাবাদন এবং লয়কারিকে আয়ত্ত তো করেইছিলেন এবং এতটাই আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন যে সেই শিল্পের শৈলীকে অটুট রেখেও তার মধ্যে নিজের উদ্ভাবনকে বুনে দিতে পেরেছিলেন। সৃষ্টি করেছিলেন নতুন লয়কারি। এক জন তবলিয়া হিসেবে আমার বলতে একটুও দ্বিধা বা লজ্জা নেই যে আমি ওঁর কাছ থেকে তবলার অনেক লয়কারি শিখেছি। এবং আমি নাম করে বলতে পারি আমি ছাড়াও জাকির হোসেন এবং আরও বড় বড় তবলিয়ারা মহারাজজীর সঙ্গত ছাড়াও অন্য শিল্পীদের সঙ্গে যখন বাজিয়েছি তখন মহারাজজীর লয়কারি বাজিয়েছি। এবং সেটা কিন্তু সবর্ত্র। সেতার শিল্পী, সরোদ শিল্পী, বাঁশি কিংবা গায়ন– সব রকম মার্গ সঙ্গীতের চর্চায়।
মহারাজজীর সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশক থেকেই কিন্তু আমি তাঁর সঙ্গে সঙ্গত করতে শুরু করেছি অনেক পরে। ২০১০ সাল নাগাদ এবং এই আক্ষেপ আমার কোনও দিন যাবে না যে কেন আমি আরও আগে ওঁর সঙ্গে সঙ্গত করিনি। কত কিছু যে শিখেছি ওঁর থেকে তার গুণতি না-ই বা করলাম। কেবল লয়কারি, তালের কেরামতি তো শিখিনি, জীবনের শিক্ষা পেয়েছি ওঁর কাছ থেকে। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি, মহারাজজী আমায় বলেছিলেন, ‘অনিন্দ্য, তুমহারে হাত মে স্বরস্বতী কা বাস হ্যায়। তুম কঁহা থে ইতনে দিন? পহেলে কিঁউ নহি মিলে?’ এর থেকে বড় পুরস্কার তো আমার কাছে কিছুই হতে পারে না। আমার আর সত্যিই কিছু চাই না।
সঙ্গত করার সময় মহারাজজীকে দেখেছি তিনি কত বড় মাপের মানুষ। এমন অনেক বার হয়েছে এবং সেটা শুধু আমার ক্ষেত্রে নয় অনেক ছোট এবং বড় তবলিয়ার সঙ্গে যে, উনি হয়তো নাচতে শুরু করেছেন, প্রথম আবর্তনটা করলেন এবং আমাদের সঙ্গতে এক মাত্রা কিংবা আধ মাত্রা ভুল হয়ে গেল। মহারাজজী নিজের নাচের তাল এবং উপস্থাপনার ওই সময় স্টেজে রদ-বদল করে ফের তালে ফিরে এসে আবার ওঁর পূর্ণ মহিমায় নাচতে শুরু করলেন। কখনও বিরক্ত হননি, কখনও অন্য সঙ্গতকারীকে ছোট করেননি। নিজে বরং সেটাকে নিজের মতো করে গড়ে নিয়ে উপস্থাপনা করেছেন। এক জন শিল্পী কত দক্ষ হলে এমন সব জিনিস করতে পারেন। একটা শিল্পের ওপর কতটা দখল থাকলে সেটাকে গড়ে-পিটে, সহজবোধ্য করে উপস্থাপনা করা যায়!
আর মহারাজজীর ঘুঙরু। এমন পরিছন্ন আওয়াজ, এমন মিঠে তাল তোলার ক্ষমতা, না দেখলে, না শুনলে বিশ্বাস করা শক্ত। এবং কী নিয়ন্ত্রণ! নিজের শিল্প এবং দক্ষতার ওপর কত নিয়ন্ত্রণ থাকলে নিজের ঘুঙরুকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাঁর নাচ যখন পূর্ণগতিতে, পূর্ণমাত্রায় চলছে তখনও তিনি তাঁর ঘুঙরুর শব্দকে বাড়াতে কমাতে পারতেন। এবং পূর্ণমাত্রায় নাচের সময়ও তাঁর ঘুঙরুর শব্দ স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন ও পিন পড়ার শব্দের মতো তীক্ষ্ণ।
মানুষ হিসেবে মহারাজজী সম্পর্কে কিছু না বললে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মহারাজজীর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি অহংকারী ছিলেন না। অমন বিশাল মাপের শিল্পী হয়েও তাঁর কোনও অহং ছিল না। বহু শিল্পী আছেন, যাঁরা রুক্ষ, কর্কশভাষী, দাম্ভিক। শিল্পের দক্ষতা তাঁদের অহমিকা বোধকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেয়। কিন্তু মহারাজজীর মতো অমন মাটির মানুষ, মিতভাষী শিল্পী দেখা যায় না। তাঁর কোনও রাগ ছিল না। কখনও রাগের প্রকাশ দেখিনি। আর কোনও প্রত্যাশা বা চাহিদা ছিল না– আমি কেন ওই পুরস্কার পেলাম না, ওই সম্মান আমায় কেন দেওয়া হল না– এ সব নিয়ে কখনও ওঁর ভাবনাই ছিল না। বলতেন, ‘অনিন্দ্য, জিতনে দিন হ্যায়, বস, কাম করতে যাও’। কোনও দিন নিজের কোনও কাজের জন্য, লাভের জন্য কারও কাছে তদ্বির করেননি। যা জীবনের প্রাপ্তি তাঁর হয়েছে, সবটাই তাঁর নিজগুণে। হয়তো পার্থিব এই সব তুচ্ছ জিনিস তাঁকে ছুঁতে পারত না বলেই তিনি এমন মহান শিল্পী হতে পেরেছিলেন। তিনি থাকতেন মাটির খুব কাছাকাছি, মানুষের মধ্যে মিলেমিশে, কিন্তু তাঁর নাগাল পাওয়া কোনও দিনই সম্ভব ছিল না।