পাঞ্জাবের শেরনি, বাংলার বাড়িওয়ালি
সেটা ১৯৯৯ সাল। ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘বাড়িওয়ালি’ ছবি করবে। দেখা করতে গেল ভাবী প্রযোজক অনুপম খের-এর সঙ্গে। আমরা সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। তখন ঋতুর কাজ পাওয়া মানে আমরা সবাই কাজ পাব। একসঙ্গে অন্তত ক’টা মাস রেকি করব, চিত্রনাট্য শুনব, শুটিংয়ের সাজ-পোশাক, সেট, কাস্টিং, প্রপার্টিজ নিয়ে আলোচনা চলবে… ঋতুর সঙ্গে দোকানে ঘুরব শাড়ি, ব্লাউজ, এমনকী পেটিকোট কিনতে।
ঋতু ফিরে এল লাঞ্চ মিটিংয়ের পর।
‘হল?’
ঋতু ড্রামা ও পজ দারুণ বুঝত। একটু থেমে বলল, ‘হয়েছে কিন্তু…’
‘কী?’
‘মূল চরিত্রে অভিনয় করবে প্রযোজকের স্ত্রী, কিরণ!’
‘ছবিটা কি হিন্দিতে হবে?’
‘না, বাংলায়। কিরণ বাংলা শিখবে। ঝুমু, পারবি না ওকে হেল্প করতে? মন্টুদা ফ্লোরে প্রম্পট করে দেবে। প্রযোজকের খুব ইচ্ছে একবার অন্তত ওঁর স্ত্রী একটা অ্যাওয়ার্ড পাক। মানে জাতীয় পুরস্কার।’
কাট।
পরবর্তী সিন শুটিংয়ের তিনদিন আগে। একটা অসম্ভব ক্রাইসিস। বাড়িওয়ালির কাজের মেয়ের চরিত্রে যে-অভিনেত্রীর করার কথা, সে করবে না। এদিকে কিরণ আসছে দু’দিন বাদে। আগামীকাল সিনিয়র যারা, তারা দশঘড়া চলে যাবে। একদিনের মধ্যে সেই কাজের মেয়ে মালতীর চরিত্রে অন্য অভিনেত্রীকে খুঁজে বার করা হল। সুদীপ্তা চক্রবর্তী। শুরু হল ওর জামাকাপড় লুক-সেট।
আমি অন্যদের সঙ্গে পরদিন গেলাম না।
আমাকে পোশাক-আশাক জোগাড় করে, কিরণের সঙ্গে যেতে হবে। এর আগে ওর সঙ্গে সামনাসামনি কখনও দেখা হয়নি। টিভির পর্দায় দেখেছি। সিনেমাতেও। তবে আলাপ হয়নি। পত্রিকায় ওর সম্পর্কে পড়েছি। সেসব থেকে ধারণা হয়েছিল, ও বোধহয় একটু নাক-উঁচু। সেসব ভাবতে-ভাবতেই পৌঁছলাম ওর হোটেলে। দশঘড়া যেতে হবে। তখন রাস্তাঘাট তেমন সুবিধার ছিল না, তাই আজ যা দুই থেকে তিন ঘণ্টার রাস্তা, তা পেরোতে তখন ঘণ্টা পাঁচেকও লাগতে পারত। তাই সকাল ন’টায় বেরোলাম। আমরা নন এসি গাড়িতে, কিরণের অবশ্যই শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত গাড়ি। কলকাতা থেকে বেরোতে-না-বেরোতেই হিরোইন ম্যাডাম গাড়ি থামাতে বললেন। প্রোডাকশনের ছেলেটি এগিয়ে গেল। ফিরে এসে বলল, ম্যাডাম ডাকছেন। গেলাম। কিরণ বলল, ‘আমার গাড়িতে এত জায়গা আছে, তাও তুমি ওই অ্যামবাসাডর গাড়িতে গাদাগাদি করে বসেছ কেন? চলে এসো, গল্প করতে-করতে যাব।’
সেই যে গল্প শুরু হল, তার যেন শেষ নেই। মুম্বইয়ের গল্প, স্বামী অনুপম, ছেলে— সব নিয়ে। আমিও বলতে থাকলাম আমাদের ইউনিটের কথা। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার একটা করে স্কেচ তৈরি করে দিলাম ওকে।
কিরণ জানিয়েছিল, চিত্রনাট্য যেমন ঋতু ওকে পড়ে শোনানোয় ওর বাড়িওয়ালি চরিত্রায়নে সুবিধা হয়েছিল, তেমনই আমি ওকে ইউনিটের সবার সম্পর্কে বলে দেওয়ায় ভীষণ সুবিধে হয়েছিল বুঝতে: ওর কার সঙ্গে কীভাবে ডিল করা উচিত।
দশঘড়ায় তেমন কোনও হোটেল ছিল না। তারকেশ্বরে আমরা এমটি আশ্রমে থাকছিলাম। চিরঞ্জীব চক্রবর্তীর জন্য ওখানকার একমাত্র বড় হোটেলের সেরা ঘর নেওয়া হয়। তাই কিরণের জন্য স্থানীয় একজনের বাড়িতে ব্যবস্থা করা হয়। শীতকাল ছিল, তাই বাঁচোয়া। ঘরে এসি নেই। পরিষ্কার বাথরুম, কিন্তু কোনও পাঁচতারা বিলাস নেই। একেবারে মধ্যবিত্ত ঘর, পরিচ্ছন্ন পরিপাটি। একটু ভয় ছিল, কিরণ কীভাবে রিঅ্যাক্ট করবে। বাড়িটা দেখে ও কিন্তু বেশ অভিভূত। কারণ শোবার ঘরের পালঙ্কটি ওর পছন্দ। তার সঙ্গে পুরনো ড্রেসিং টেবিলটাও। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নিজের ঘর সাজিয়ে ফেলল। বলল, ‘আমি মেথড অভিনেতা, এই ঘরে থাকলে বাড়িওয়ালিকে আত্মস্থ করতে সুবিধা হবে।’
পরদিন শুট শুরু ওখানকার জমিদারবাড়িতে। বাড়িটা বিশাল। তবে ঋতু ওখানকার বারান্দা আর উঠোনটাই মূল শুটিং এলাকা হিসেবে বেছে নেয় ।
তার আগে চলে কিরণের লুক-সেট। একেবারে নরম করা তাঁতের শাড়ি। কিরণ আসতে-আসতে যা বলছিল, তাতে বুঝছিলাম, ও বাংলার তাঁতের শাড়ি নিয়ে উচ্ছ্বসিত। কিন্তু আমরা চায়ের জলে চুবিয়ে সেই সুন্দর শাড়িগুলোর যা অবস্থা করলাম, তাতে দেখলাম ও মিইয়ে গেল। ওকে জানালাম, কাছেই আছে ধনেখালি, একেবারে ট্র্যাডিশনাল তাঁতের শাড়ির আড়ত। দিন সাতেক দশঘড়ায় ছিলাম। রোজই শুটিংয়ে পৌঁছেই, শুটিং-শেষে শাড়ি দেখতে যাওয়ার পরিকল্পনা হত। কিন্তু ওখানে এমন শেডিউল ছিল, কোনওদিনই আটটা-ন’টার আগে ছুটি নেই। কিরণ কিন্তু আশাবাদী ছিল শেষদিন পর্যন্ত। এটাই ওর একটা বড় গুণ।
আর ও-ই প্রথম আমাদের পরিচয় করায় স্টুডিও ফিক্স কম্প্যাক্টের সঙ্গে। ঋতু কোনও প্রসাধন করতে দিত না ওর অভিনেত্রীদের। কিরণ নিয়ে এসেছিল ম্যাক-এর কম্প্যাক্ট। সকালে এসেই লুকিয়ে লাগিয়ে নিত প্রলেপ। ঋতুর চোখেও ধরা পড়েনি সেই আস্তরণ। অবশেষে বারুইপুরে রূপা গাঙ্গুলি ধরে ফেলে কিরণের কীর্তি।
ওই জমিদারবাড়িতে ছিলেন এক প্রবীণ দম্পতি। তাঁদের সঙ্গে কিরণ ভাব করে নেয় একদিনেই। ওই বাড়ির মা কিরণের সঙ্গে অনর্গল বাংলা বলে যেতেন, আর কিরণও চালিয়ে যেত ওর ভাঙা বাংলা। ওর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না, কিন্তু পাঞ্জাবি জিভে সুললিত বাংলা বেরোনো যে খুবই শক্ত, তা আমরা তখনই বুঝে যাই।
কিরণের এমনি কোনও মুম্বইসুলভ রং-ঢং ছিল না। আমাদের সঙ্গে বন্ধুর মতোই মিশত। মন্টুদা, অর্থাৎ সুমন্ত মুখার্জি ছিল ওর ভরসা। শুটিংয়ে এসেই ওকে খুঁজত। কারণ মন্টুদা প্রম্পটার। মন্টুদাও মজা করতে ছাড়ত না। খুব ইন্টেন্স মুহূর্তে প্রম্পটের গলা নামিয়ে নিত। কিন্তু কিরণের জেদ কম নয়, ঠিক মনে করে সংলাপ বলত। ‘কাট’ বলার পর মন্টুদার কাছে এসে যা পাঞ্জাবি গাল দিত, তা শোনার জন্যই পরের দিন আবার একই খেলা খেলত মন্টুদা। এটা ছিল লেনদেনের খেলা। একজন বাংলা শেখাচ্ছে, আর অন্যজন চোস্ত হিন্দি ও পাঞ্জাবি গালাগাল শেখাচ্ছে। পুরোটাই আনন্দে।
কিরণের মুখে কোনও লাগাম ছিল না। একদিন মনে আছে, প্রোডাকশনের ছেলেরা এসে বলল, কিরণ ওদের গাল দিয়েছে। ভয়ঙ্কর সব গাল। আমি ও ঋতু গেলাম সরেজমিন তদন্তে। জিজ্ঞেস করলাম কিরণকে, ‘কী হয়েছে?’ ও শুধু তারকাই নয়, প্রযোজকের স্ত্রী বলে কথা!
কিরণ ফুৎকারে উড়িয়ে দিল ব্যাপারটা। ও ফুলকা, মানে, হাতে-গড়া রুটি চেয়েছিল। রান্নাঘরে তাওয়া ছিল না, তাই কড়াইয়ে রুটি করে দেওয়া হয় কিরণকে।
সে-রুটি পাতে দেওয়ার মতো হয়নি, তায় আবার পাঞ্জাবের শেরনির জন্য। কিরণ রেগে রুটি ছুড়ে ফেলে দেয় ও গাল দেয়। আমরা ওকে বলি, ‘তুমি রুটি ছুড়েছ ঠিক আছে, গাল দিলে কেন? তাও আবার অত খারাপ কথা!’
‘খারাপ কিছু তো বলিনি? শুধু বলেছি, শালা মুঝে কিয়া চুতিয়া সমঝা? ইয়ে রোটি তুমহারে য্যায়সে চুতিও কে লিয়ে হো সকতা, মেরে লিয়ে নহি!’
অকপট স্বীকারোক্তি। ঋতু আর আমি ওকে বোঝাতে পারিনি, ওই শব্দটা কেন খারাপ!
আর বাংলা নিয়েও ওর ছিল একটা অবসেশন। বিশেষত বাঙালি উচ্চারণ। রোজ সকালে ও জিজ্ঞেস করত, কোন-কোন সিন আজ হবে, আর কোনগুলো বাকি আছে। আর আমাকে বাংলায় বলতে হত। কোনওদিন বলছি চার, ছাপ্পান্ন, আট, দশ। কোনওদিন বাইশ, আটান্ন, তিপ্পান্ন…
শেষ দিনে হয় পঁয়তাল্লিশ, ষাট, বত্রিশ ও চোদ্দো।
আর শুটিং-শেষে কিরণের স্বস্তির নিঃশ্বাস। তারপরই উক্তি, ‘আজ মুঝে চোদ্দ করওয়া মেরা ডিরেক্টর! Thank God it happened on the last day!’