ইন্ডি গানের এ-কাল সে-কাল
সর্বনেশে এবং ভায়ানক যে অন্ধকার সময়ের মধ্যে আমরা সবাই বেঁচে আছি, তারই মধ্যে এ বছর নভেম্বর মাসের গোড়ার দিকে সুখবর এল, তিনজন ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী আশা-ভরসা-মনের জোর সঞ্চয় করে আসন্ন ৬৪তম গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য তাঁদের কাজ জমা দিয়েছেন, যে পুরস্কার অনেকেরই মতে বিশ্বজোড়া সঙ্গীত দুনিয়ার কর্মীদের জন্য সর্বোচ্চ সাফল্যের স্বীকৃতি। গ্র্যামির বিচার-পর্যায়ের জন্য যাঁদের সঙ্গীতকে মনোনীত করা হয়েছে, তাঁরা হলে রোহন সলোমন, কিয়ারা ছেত্রী এবং বিনীত সিং হুকমানি। যদিও এ সঙ্গীত কেবল পুরস্কারের জন্য জমাটুকুই দেওয়া হয়েছে, এবং এই তিনজন শিল্পীর মোট পাঁচটি কাজের মধ্যে একটিও নির্বাচনের অন্তিম পর্যায়ে পৌঁছোতে পারেনি, তবু তিনজন স্বাধীন শিল্পীর এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ না জানালেই নয়। ভারতবর্ষে শিল্পীরা যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন আজও হয়ে থাকেন, এ প্রচেষ্টা সে বিষয়ে খানিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রথমত, গ্র্যামির জন্য কাজ জমা দেওয়া এই তিনজন শিল্পীই ইন্ডি বা স্বাধীন শিল্পী। অতএব যে সব রেকর্ড কোম্পানি তাঁদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ শিল্পীদের বিনোদন জগতের চোখ-ধাঁধানো উচ্চতায় এক লাফে পৌঁছে দেবার মতো অভিজ্ঞতা, জনসম্পদ, এবং টাকার গরমের অধিকারী, তেমন কারোর হাত এঁদের মাথার উপর নেই। মজার কথা হচ্ছে, এই তিনজন যখন কাজ জমা দেবার ডেডলাইন মেনে সব দায়িত্ব পালন করতে কাঠখড় পোড়াচ্ছেন, সেই সময়ে বড় বড় রেকর্ড কোম্পানিগুলো কিন্তু আশ্চর্যভাবে তাঁদের সাথে চুক্তিবদ্ধ শিল্পীদের কাজ এই প্রতিযোগিতায় জমা দেবার কথা ভাবেনও নি। তবে কি নিজের শিল্পীদের প্রতিই তাঁদের কোনো বিশ্বাস নেই? নাকি তাঁদের কোনো সাঙ্গীতিক কাজকেই তাঁরা গ্র্যামিতে জমা দেবার যোগ্য মনে করেননি? নাকি তাঁরা এতই ব্যাস্ত যে গ্র্যামির ব্যাপারে মাথা ঘামানোর সময় তাঁদের ছিল না? কারণ যাই হোক, এই যে গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য রেকর্ডিং একাডেমির কাছে তিনজন স্বাধীন শিল্পী নিজেদের তাগিদে পাঁচখানা গান জমা দিলেন, কিন্তু আমাদের দেশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সঙ্গীত ইন্ডাস্ট্রি জমা দেবার যোগ্য কোনো গান পেলেন না, এর থেকে তাগিদ এবং পরিপ্রেক্ষিতের একটা মূল পার্থক্য চোখে পড়ে।
সতেরো বছর বয়সী কিয়ারা ছেত্রী গ্র্যামির স্বপ্ন দেখা এই তিন শিল্পীর মধ্যে সর্বকনিষ্ঠা। গ্র্যামির জন্য তিনি জমা দিয়েছেন তাঁর সদ্যপ্রকাশিত অ্যালবাম থেকে “হোয়াই” নামে একটি ট্র্যাক। রোহন সলোমন যে ট্র্যাকটি জমা দিয়েছেন, তার নাম “উই ডিমান্ড চেঞ্জ,” এবং বিনীত সিং হুকমানি শ্রেষ্ঠ রক গান, শ্রেষ্ঠ পপ কন্ঠশিল্পী, শ্রেষ্ঠ মেলডিক র্যাপ গান এবং বছরের শ্রেষ্ঠ রেকর্ড প্রভৃতি প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে মোট তিনটি ট্র্যাক জমা দিয়েছেন। সবকটি ট্র্যাকই ইংরেজি ভাষায়, সম্ভবত তিনজন গায়ক-গীতিকারই ইংরেজিতে লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। ভারতে ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতাকে প্রায়শই সমাদর এবং শ্রদ্ধা করা হয়, বহু ভারতীয় পরিবারই তাঁদের সন্তানদের ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলে পাঠাতেই পছন্দ করেন। অথচ তুলনামূলকভাবে মূলস্রোতের গানের বাজার ইংরেজি গীতরচনাকে কোনোরকম সাহায্য করতে চায় না, ফলে প্রচুর নাগরিক ব্যান্ড বা গীতিকারদের কাছে নিজেদের গান নিজেদেরই প্রকাশ করা বা প্রচারের বিকল্প পথ খোঁজা ছাড়া কোনো রাস্তাই খোলা থাকে না। আশ্চর্য কিন্তু এটাই, যে হিন্দি বা পাঞ্জাবীর মতো একাধিক ভারতীয় ভাষায় গীতরচনার আখরে বহু ইংরেজি শব্দ, শব্দবন্ধ বা বিশেষ্য সানন্দেই স্থান পেয়েছে। সিনেমার গান এবং সিনেমার বাইরে জনপ্রিয় গানের স্তর, দু’টোর ক্ষেত্রেই এ কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। ‘মুবারাকাঁ’ নামে সিনেমার “গগ্ল সং” এর একটি উদাহরণ:
তেরি আঁখিওঁ সে হো গ্যায়া প্যায়ার,
তেরে প্যায়ারে-প্যায়ারে গগ্ল উতার…
…হো খামখা মুঝে চেজ্ করে তু,
লাভ কা ম্যাটার ওয়েস্ট করে তু,
ডোন্ট থিংক টু মাচ সোঁনিয়েঁ,
মেরে সাথ কমর হিলা…
অতীতে যে আঠারোজন ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের কথা একটু ভাবলেই একটা নকশা চোখে পড়ে। ১৯৬৮ সালে প্রথম ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে গ্র্যামি জেতেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সেই থেকে আন্দাজ ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে ভারতীয় শিল্পীরা গ্র্যামি পুরস্কার পেয়েছেন, তাঁদের সিংহভাগই শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ। কিন্তু তাঁদের জেতা পুরস্কারগুলোর অধিকাংশই ওয়ার্ল্ড মিউজিক বা বিশ্ব সঙ্গীত বিভাগে। ২০০৮ সালে খ্যাতনামা শিল্পী এ আর রহমান গ্র্যামি পুরস্কার জেতেন ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’ সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনা করে, যে সিনেমা ভারতের প্রেক্ষাপটে হলেও তাকে ভারতের মাটিতে তৈরি বলা চলে না। ইদানীং কয়েক বছরে নিউ-এজ অ্য়ালবাম বা ট্র্যাক এবং সিনেমার জনপ্রিয় গানও ভারতবর্ষ থেকে গ্র্যামি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিততে শুরু করেছে, ক্রমেই বাদ পড়ছে প্রথাগত শাস্ত্রীয় সঙ্গীত। তবে জনপ্রিয় গানের ক্যাটেগরিতে বা ওয়ার্ল্ড মিউজিক, নিউ-এজ সঙ্গীতের আখরেও যে ভারতীয় শিল্পী, অ্যালবাম বা ট্র্যাক সমাদৃত হয়, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই অ-ভারতীয়দের সূচনায়, সাহায্যে এবং প্রযোজনায় সৃষ্ট। আমাদের গানের বাজার এবং ভারতে গানের স্বঘোষিত কাণ্ডারীদের ব্যাপারে এর থেকে কী বোঝা যায়? আমাদের শিল্পীদের কি আমরা লড়াইয়ের প্রাঙ্গণে একাই লড়তে পাঠিয়ে দেব, ভারতের গানের বাজার বা সরকার-চালিত শিল্পসংস্কৃতির প্রতিষ্ঠানগুলো তাঁদের কোনোভাবে সাহায্য করবে না? হলে আশ্চর্য হবার অবশ্য কিছুই নেই, কারণ অলিম্পিকে যাঁরা আমাদের দেশের হয়ে মেডেল জেতেন, তাঁদেরও অনেকেই জানিয়েছেন কী ভাবে কোনোরকম সরকারি সমর্থন বা সাহায্য ছাড়াই তাঁদের দুঃখ-কষ্ট-প্রতিকূলতার সঙ্গে ক্রমাগত যুঝতে হয়। আপাতত যা অবস্থা, তাতে মনে হয় যে ভারতীয় সঙ্গীতশিল্পীরা গ্র্যামি পাবার জন্য লড়ছেন, তাঁদের “একলা চলো রে” মন্ত্র নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র