আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের কথা। কিম জং উন সদ্য ভার নিয়েছেন তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি, অর্থাৎ উত্তর কোরিয়া নামক দেশটির। কিমের আদেশে তৈরি করা হল এক ‘গ্লোবাল হ্যাপিনেস ইনডেক্স’, সে-তালিকার সর্বপ্রথমে রয়েছে চিনের নাম। দ্বিতীয় স্থানে উত্তর কোরিয়া, তার পর একে-একে কিউবা, ইরান ও ভেনেজুয়েলা। তালিকার সবশেষে ২০৩ নম্বরে রইল আমেরিকা। আর প্রতিবেশী দেশ এবং চিরশত্রু দক্ষিণ কোরিয়া? কিমের স্বপ্নে তাদের স্থান ১৫২ নম্বরে।
এই অবধি পড়েই নিশ্চয় বিস্তর হাসি পাচ্ছে? পাওয়াটাই স্বাভাবিক। উত্তর কোরিয়ার হ্যাপিনেস ইনডেক্স নিয়ে গত ১০ বছরে বিশ্বজুড়ে কম হাসাহাসি হয়নি। সেই হাসাহাসির মধ্যেই ১০ বছর পর খোদ রাষ্ট্রপুঞ্জ বার করেছে আরেক হ্যাপিনেস ইনডেক্স, সে-তালিকায় অবশ্য রয়েছে ৩৮টি উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ, যাদেরকে একত্রে OECD (Organization for economic co-operation and development) বলে ডাকা হয়। সে-তালিকায় স্বভাবতই উত্তর কোরিয়ার স্থান হয়নি কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াও রয়েছে তলা থেকে তিন নম্বর স্থানে। ইতিহাসের পরিহাস বড়ই নির্মম!
এও কি সম্ভব? স্যামসং-হুন্ডাই-এলজি’র মতন বাঘা-বাঘা কোম্পানির ধাত্রী যে দেশ, নব্বইয়ের দশক থেকে যাকে পূর্ব এশিয়ার বাঘ বলে ডেকে আসছি আমরা, সেই দেশের মানুষ এত অসুখী? পরশুরামের মতন করে ‘হয় হয়, zানতি পারো না’-ও বলা যায়, অথবা সেই চিরকালীন আপ্তবাক্যটিকেও স্মরণ করা যায় ‘All that glitters is not gold’। কিন্তু কেন এই গভীর অসুখ? ২০২০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সম্পদের মোট পরিমাণ ছিল ১.৬৩ ট্রিলিয়ন ডলার। মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার মতন একটা সংখ্যা। কিন্তু আরেকটি সংখ্যা শোনানোর আগে স্মেলিং সল্ট নিয়ে এলে মন্দ হয় না। সেটি হল দক্ষিণ কোরিয়ার সমস্ত গৃহস্থালির মোট ঋণের পরিমাণ— ১.৫৮ ট্রিলিয়ন ডলার! কিছু অর্থনীতিবিদ জানাচ্ছেন ওই সামান্য হেরফের গ্রহণযোগ্য নয়, জাতীয় সম্পদের ১০০ শতাংশই হল গৃহস্থের ঋণ। হয়তো-বা তার থেকেও বেশি।
দক্ষিণ কোরিয়ার গৃহস্থালি ঋণের পরিমাণ পৃথিবীর মধ্যে সর্ববৃহৎ। চাকরির আশায় ঘুরঘুর করতে থাকা ছেলেছোকরা, বারবার ঠকে ফের ব্যবসায় নামা মধ্যবয়স্ক মানুষ, ফ্যাশনেবল জেনারেশন Z, কেরানির চাকরি নিয়ে জীবনযুদ্ধে যুঝতে থাকা মধ্যবিত্ত, প্রত্যেকে নাম লিখিয়েছেন ব্যাঙ্কের খাতায়। সারা বিশ্বজুড়েই সুদের হার শেষ দশকে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, বিশেষত অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত দেশগুলিতে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাঙ্কগুলি আরও এক ধাপ এগিয়ে কোনওরকম ঝুঁকির তোয়াক্কা না করে ক্রমান্বয়ে ধার দিয়ে গেছে, কেউই খালি হাতে ফেরেননি। ব্যাঙ্কগুলিকে বোকা ভাবার কারণ নেই। এই ক্রমাগত ধার দেওয়ার পেছনে রয়েছে একটি চিরন্তন মোটিভ— লোভ। দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকাংশ মানুষ ছোট ব্যবসা করেন। মাসমাইনে পাওয়ার বরাত তাঁদের নেই। ধার মেটাতে না পারলে এই মানুষগুলিকেই হয় ব্যবসা নয় বাড়ি, কখনও-সখনও ব্যবসা এবং বাড়ি দুটিই, বেচে দিতে হবে। মহাজনরা হিসেব করে দেখেছেন এই দখলদারি থেকে প্রাপ্ত টাকা সুদের টাকার থেকে ঢের বেশি হতে পারে। অতএব, বেশ অঙ্ক কষেই তাঁরা টাকা ঢেলে গেছেন। প্রভাবশালী ব্যাঙ্কের কাজকর্মে সরকারও নাম গলাতে চাননি, ধনতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত মেনেই তাঁরা বাজারকে খুল্লমখুল্লা কাজ করতে দিয়েছেন। যতদিনে বোধোদয় হয়েছে ততদিনে দেশটির সমূহ সর্বনাশ ঘনিয়ে এসেছে। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে বারো হাজার মানুষ আত্মহত্যা করছেন সে-দেশে।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতি নিয়ে হয়তো আমার-আপনার মাথা ঘামানোর এত কারণ ছিল না, কিন্তু ২০২১-এর একটি অন্যতম পপ-কালচার সেনসেশন সব হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। ‘স্কুইড গেম’। যাঁরা নেটফ্লিক্স নামক ওয়েব প্ল্যাটফর্মটির সদস্য, তাঁরা এই নামের সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত। যাঁরা নন তাঁদের জ্ঞাতার্থে জানাই এই ওয়েব সিরিজটি নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে সবথেকে বেশি মানুষ দেখেছেন। এখনও অবধি সারা পৃথিবীর প্রায় দেড়শো মিলিয়ন মানুষ দু’বিলিয়নেরও বেশি ঘণ্টা ধরে দেখেছেন ‘স্কুইড গেম’। ওয়েব সিরিজটির অনেকটা থ্রিলার, অনেকটা আবার ফ্যান্টাসি ফিকশন— স্কুইড গেম একটি মরণখেলা, যেখানে মানুষ আক্ষরিক অর্থেই বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় নামে। মারো অথবা মরো, এই হল মন্ত্র। এবং লাস্ট ম্যান স্ট্যান্ডিং-এর জন্য সে-খেলায় রয়েছে এক বিপুল অঙ্কের পুরস্কার।
ব্যাঙ্কগুলিকে বোকা ভাবার কারণ নেই। এই ক্রমাগত ধার দেওয়ার পেছনে রয়েছে একটি চিরন্তন মোটিভ— লোভ। দক্ষিণ কোরিয়ার অধিকাংশ মানুষ ছোট ব্যবসা করেন। মাসমাইনে পাওয়ার বরাত তাঁদের নেই। ধার মেটাতে না পারলে এই মানুষগুলিকেই হয় ব্যবসা নয় বাড়ি, কখনও-সখনও ব্যবসা এবং বাড়ি দুটিই, বেচে দিতে হবে।
কিন্তু এ-কল্পকাহিনি জুড়ে রয়ে গেছে এক ভয়ের আবহ। যে আবহ রূঢ় বাস্তব। স্কুইড গেমের এই মরণখেলায় যাঁদের নামতে বাধ্য করা হয়েছে, তাঁদের সবারই রয়েছে বিশাল অঙ্কের দেনা। শিল্প যে সমকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি সে-কথা কে না জানে? আর জানি বলেই টের পাই, বোকা বাক্সের পর্দায় যা দেখছি তার সারবস্তুটির থেকে বাস্তব আর কিছু হতে পারে না। এবং ডার্ক হিউমর নিয়ে ছুঁৎমার্গ না থাকলে এক ধাপ এগিয়ে এ-কথাও বলা যেতে পারে যে, স্কুইড গেম একটি চমৎকার স্যাটায়ার-ও বটে। যে-স্যাটায়ারের শ্লেষ ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বুকে গিয়ে বিঁধেছে।
যে-নিলাজ ধনতন্ত্রকে অর্থনীতিবিদ মিলটন ফ্রিডম্যান পূজ্যবেদিতে বসিয়েছিলেন, যে-ধনতন্ত্রকে রোনাল্ড রেগন আর মার্গারেট থ্যাচার গোটা পৃথিবীর বুকে একটা জগদ্দল পাথরের মতন চাপাতে চেয়েছিলেন, তার দিন গেছে। ২০০৮-এর বিশ্বজোড়া আর্থিক বিপর্যয়ের সময়েই ওহেন ধনতন্ত্রের মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল। কিন্তু লোভ বড় বালাই। তাই ধুঁকতে-ধুঁকতেও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা দেখা যায় ইতিউতি। ধনতন্ত্রের পীঠস্থান আমেরিকায় আজ রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের আর্থিক নীতি ঠিক করে দিচ্ছেন ডেমোক্র্যাট পার্টির বামপন্থী সদস্যরা, সিয়াটলের মতন শহরে পুরপারিষদ পদে নির্বাচিত হচ্ছেন সমাজতান্ত্রিক পার্টির কর্মী, একের পর এক মার্কিনি শহর জুড়ে বড়-বড় কোম্পানির কর্মীরা নতুন উদ্যোগে ইউনিয়ন খুলছেন। আজ থেকে ১০ বছর আগেও যা অকল্পনীয় ছিল তাই ঘটে চলেছে বাস্তবে। দক্ষিণ কোরিয়ার চেহারাও বদলাবে, স্কুইড গেমের তীব্র শ্লেষ হয়তো সেই শেষের শুরু ঘটিয়ে দিয়ে গেল।
বছর শেষে যে-যে খবর দুনিয়ার সমস্ত সংবাদমাধ্যম ফিরে দেখছে, তার মধ্যে স্কুইড গেমের অভাবনীয় সাফল্যের পাশাপাশি রয়েছে আরও একটি খবর, যা আমাদের হৃদয়ের আরেকটু কাছে। শুধু হৃদয় কেন, বাড়ির কাছেও বটে। পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলনের সাফল্যকেও ‘অভাবনীয়’ আখ্যা অনায়াসে দেওয়া যায়। যে-তিন কৃষিবিল সরকারকে প্রত্যাহার করতে হল তার পক্ষে এবং বিপক্ষে বহু কথা বলা যায়, ঢুকে যাওয়া যায় এমন এক বিতর্কে যা আন্দোলনের সাফল্যের সঙ্গে-সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় না। কিন্তু সে-বিতর্কে না ঢুকেও একটি উপসংহার নিশ্চিত ভাবেই রেখে দেওয়া যায়— বিগত প্রজন্মের চেনা ধনতন্ত্রের দিন ফুরিয়েছে।
নব্বইয়ের গোড়ায় খানিক বাধ্য হয়েই ভারতকে মুক্তবাজারের অর্থনীতির পথে পা বাড়াতে হয়েছিল। বিশ্বায়ন এবং বেসরকারিকরণের রমরমার যুগে অর্থনীতির সে-মডেল পরের তিরিশ বছর ধরে টানা চলেছে। উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির সে-অর্থনৈতিক মডেল থেকে প্রভূত লাভ হয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে সম্পদ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য সব ক্ষেত্রেই অসাম্য ভয়াবহ ভাবে বেড়েছে। প্রান্তিক মানুষদের বেঁচে থাকার রসদ অর্থাৎ জল-জমি-জঙ্গল ক্রমাগত ধ্বংস হয়েছে। কিন্তু মুক্তবাজার আনবে প্রতিযোগিতা এবং প্রতিযোগিতায় আখেরে লাভ হবে উপভোক্তাদের, এ-কথা এই তিরিশ বছর ধরে আমরা বারবার শুনেছি। কথাগুলো ভুল নয়, কিন্তু সর্বৈব সত্যও তো নয়। যারা বাজারে ঢুকতেই পারলেন না তাঁদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যর ভার নেবে কে? জল-জমি-জঙ্গলের মতন প্রাকৃতিক সম্পদ যাতে স্থানীয় মানুষের ন্যায্য অধিকার তাকে পণ্যায়িত করার সঠিক মূল্যটিই বা মাপছে কে? মুক্তবাজারি অর্থনীতির প্রাথমিক শর্তগুলি না মেনে যদি বৃহৎ পুঁজিপতিরা প্রতিযোগিতার ধারণাটিকেই হাইজ্যাক করেন, তাহলে সে-ঠ্যালাই বা সামলাবে কে? এহেন হাজারও প্রশ্নের উত্তর কিন্তু আমরা পাইনি।
শিল্প যে সমকালীন সমাজের প্রতিচ্ছবি সে-কথা কে না জানে? আর জানি বলেই টের পাই, বোকা বাক্সের পর্দায় যা দেখছি তার সারবস্তুটির থেকে বাস্তব আর কিছু হতে পারে না। এবং ডার্ক হিউমর নিয়ে ছুঁৎমার্গ না থাকলে এক ধাপ এগিয়ে এ-কথাও বলা যেতে পারে যে, স্কুইড গেম একটি চমৎকার স্যাটায়ার-ও বটে। যে-স্যাটায়ারের শ্লেষ ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বুকে গিয়ে বিঁধেছে।
আর পাইনি বলেই ২০২১-এ এসে একটা কথা স্পষ্ট হয়ে গেছে— প্রতিযোগিতা এবং বাজারের সুবিধা নামক ধোঁকার টাটি দিয়ে মানুষকে আর ভোলানো যাবে না। প্রতিযোগিতার থেকেও বড় দাবি এখন তথ্য-স্বচ্ছতার (তত্ত্ব-স্বচ্ছতারও বটে, যে-তত্ত্বের ভিত্তি নেই তাকে চোখ বুজে মানা আর সম্ভব নয়)। ভারত সরকার জানিয়েছিলেন নতুন কৃষিবিল বলবৎ হলে কৃষকরা মুক্তবাজারের সুবিধা নিতে পারবেন, সরকারি মান্ডির মধ্যে আর আটকে থাকতে হবে না। দালালদের বাদ দিয়ে তাঁরা সরাসরি-বেসরকারি সংস্থাকে তাঁদের উৎপাদিত শস্য বেচতে পারবেন। খাতায়-কলমে কথাগুলো মন্দ নয়। কিন্তু কৃষকরা সিঁদুরে মেঘ দেখতে পেয়েছিলেন।
ভারতের প্রায় ৭৫ শতাংশ কৃষক এক হেক্টর অর্থাৎ প্রায় চার বিঘার থেকেও কম জমির মালিক। এবং যেটুকু ফসল তাঁরা এই কম জমিতে ফলাতে পারেন তা দিয়ে অনেক সময়েই জীবিকা নির্বাহ হয় না। দৈনন্দিন মজুরি পাওয়া যাবে এরকম কাজের সন্ধানে তাঁদের প্রায়ই বেরোতে হয়। এই প্রান্তিক কৃষকরা কীভাবে মুক্তবাজারে যোগ দেবেন? কীভাবেই বা তাঁরা প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারবেন অর্থবান কৃষকদের, যাদের কাছে হয়তো ১০ হেক্টরেরও বেশি জমি আছে? সত্যি বলতে কী, কিছু-কিছু রাজ্য যেমন বাংলা বা বিহারে এই প্রান্তিক চাষিদের উৎপাদন এতই কম যে, তাঁরা সরকারি মান্ডিতেও যান না, ফড়েদের হাতে যৎসামান্য মূল্যে তুলে দেন তাঁদের ফসল। মুক্তবাজার ঠিক কীভাবে বদলে দেবে তাঁদের ভাগ্য? শস্য জমিয়ে রাখাটাও একটা সমস্যা এই প্রান্তিক চাষিদের জন্য। বিহারে যেমন দেখা গেছিল সরকারি মান্ডি তুলে দেওয়ার ফলে বহু দরিদ্র কৃষক তাঁদের ফসলকে সংরক্ষণ করতে পারেননি। দিনের শেষে তাই শস্যের জোগান দিয়েছেন তুলনামূলক ভাবে অর্থবান কৃষকরা। একইসঙ্গে নতুন বিলে এ-কথাও বলা হয়েছিল যে, বেসরকারি কোম্পানিগুলি যথেচ্ছ পরিমাণে শস্য মজুত করতে পারে। এর ফলে কৃষকদের দিক থেকে জোগান বাড়লেও সে-শস্যের মূল্য কমে যাবে চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্য সূত্র মেনে। ফলে যেসব কৃষক যৎসামান্য উৎপাদন করছেন তাঁদের হাতে অতীব কম টাকা এসে পৌঁছত।
বিগত প্রজন্মের তৈরি করে দেওয়া ধনতান্ত্রিক কাঠামোর এও এক বড় সমস্যা। বিদ্যমান পরিকাঠামোকে ধীরে-ধীরে উন্নত করার বদলে এক ধাক্কায় সে-পরিকাঠামোকে গুঁড়িয়ে চলে আসে নতুন এক আইডিয়া। কিন্তু উন্নত দেশের কর্পোরেট বোর্ডরুমে যে-স্ট্র্যাটেজিকে সাহসিকতার পরিচয় বলে ধরা যেতে পারে তাকেই আগুপিছু না ভেবে উন্নয়নশীল দেশের কৃষিক্ষেতে নামিয়ে দিলে নেহাত অবিবেচনা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী বৃদ্ধির কথা না ভেবে দ্রুত মুনাফার পেছনে ছোটার এই মানসিকতাকে বহু ধনতান্ত্রিক পণ্ডিতও বারে বারে সমালোচনা করেছেন, ধনকুবের এবং বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ ওয়ারেন বাফেট তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতনামা অধ্যাপক রঘুরাম রাজন তাঁর বই ’Saving capitalism from the capitalists’-এও প্রায় একই কথা বলেছিলেন, ‘Insure people, not firms’। এই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে বসেই মিলটন ফ্রিডম্যান লিখেছিলেন আধুনিক সমাজে সরকারের কোনও স্থান নেই। রঘুরাম নিজেও ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং মুক্তবাজারের প্রবল সমর্থক ছিলেন। সেই রঘুরাম গত বছর ফোর্বস পত্রিকাকে এক সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেন ‘মুক্তবাজারের বাইরেও এক বিশাল জীবন রয়ে গেছে।’
চাকা যে ঘুরছে, সে-কথা বলাই বাহুল্য। রাষ্ট্রশক্তি যে-ব্যবস্থায় সমস্ত সম্পদের মালিকানা ধরে রাখে অর্থাৎ কমিউনিজম তাকে সারা পৃথিবী জুড়ে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ। কিন্তু চাহিদা ক্রমশই বাড়ছে এমন এক উদার সমাজতন্ত্রের জন্য যা শিক্ষা-স্বাস্থ্য-প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাপ্তিতে শ্রেণিগত বৈষম্য ঘোচাবে। অতিমারী এবং উষ্ণায়নের পৃথিবীতে এ-চাহিদা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সে-চাহিদাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে কিছু দার্শনিক আত্মবীক্ষণও আবশ্যিক। ‘হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ দিয়ে এ-লেখা শুরু করেছিলাম, সেই বিষয়েই একটি সংস্কৃত সুভাষিত দিয়ে শেষ করি,
লোভা-মূলানি পাপানি, রসা-মূলানি ব্যাধয়।
ইষ্ট-মূলানি শোকানি, ত্রীণি ত্যক্তবা সুখী ভব।।
স্কুইড গেমও সেই কথাই জানায়— লোভ সংবরণেই সুখী জীবনের প্রারম্ভ।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী