হয়তো রফি নিজের স্মৃতিশক্তির জোর যতটা ভেবেছিল তার থেকে অনেকটাই বেশি, বা হয়তো খুব ছোটবেলায় শোনা গল্প সহজে ভোলা যায় না। যেটাই হোক না কেন, একবার ফলকগুলো পরীক্ষা করতে আরম্ভ করলে রফি অনেকগুলো চিত্রের পরিচয় দিতে সক্ষম হল, কিছু খুঁটিনাটিও বুঝিয়ে দিল।
দেখা গেল বন্দুকি সওদাগর আর তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া চিহ্ন সম্বন্ধে ঠিকই অনুমান করেছিলাম। অন্য পাগড়ি পরিহিত চরিত্রটি যে সওদাগরের সঙ্গী ও পরামর্শদাতা ক্যাপ্টেন ইলিয়াস, আমার সে-ধারণাটাও সঠিক। কিন্তু ওদের সাথে জুড়ে দেওয়া চিহ্নটি সম্বন্ধে আমারই মতো রফিরও কোনো ধারণা নেই।
তবে ও জানাল শিরস্ত্রাণ পড়া চরিত্রটি সত্যিই জলদস্যু, বন্দুকি সওদাগর মনসা দেবীর রোষ থেকে বিদেশ পালানোর পথে যে হার্মাদদের হাতে বন্দী হয় তাদের সর্দার।
কিন্তু জানতে পারলাম অনেক ক্ষেত্রেই আমার ব্যাখ্যা ভুল, যেমন যে ফলকটায় শঙ্খের মতো দেখতে জিনিস দেখা যাচ্ছে সেগুলো আসলে কড়ি। এই তথ্যের মাধ্যমে কাহিনির একটা গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের অর্থ পাওয়া গেল।
গল্প অনুযায়ী জলদস্যুদের হাতে বন্দী হওয়ার পর বন্দুকি সওদাগরকে কোনো এক বন্দরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করার জন্য। এই সময়ে তার জীবনে ক্যাপ্টেন ইলিয়াসের পদার্পণ। বণিক যে বুদ্ধিমান এবং বহু ভ্রমণে অভিজ্ঞ, এটা বুঝতে পেরে ক্যাপ্টেন তাকে হার্মাদদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেয়। তার বদলে সওদাগর ক্যাপ্টেনকে কপর্দক সমৃদ্ধ এক দ্বীপে নিয়ে যায়, সেখানেই দুজনে ধনসম্পদ সঞ্চয় করে।
রফি কড়ির উল্লেখ করে আমার মনে পড়ল কোথাও যেন পড়েছিলাম ভারত মহাসাগর এলাকায় এমনকি আরও দূরেও বহু শতাব্দী ধরে কপর্দক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হত। এই কড়ির বেশিরভাগই বিশেষ একটি দ্বীপ থেকে আসত, তার নামটা মনে আসছিল না, আর মনে করার সময়ও নেই, কারণ রফি ততক্ষণে অন্য একটা ফলকের গল্প বলছে।
প্রভূত পরিমাণে কপর্দক সংগ্রহ করার পর বন্দুকি সওদাগর ও ক্যাপ্টেন ইলিয়াস তাদের কড়ি নিয়ে অন্য দেশে চলে যায়—রফি তাল গাছের তলায় ঢিপির ফলকটা দেখিয়ে বলল এটা তালমিশ্রির দেশ। সেখানে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে বিষোদ্গার করতে থাকা এক দানব তাদের আক্রমণ করে, ফলে আবার অন্য আরেকটা দেশে পালাতে হয়। এবার রফি পতাকা আর ধ্বজার ফলকটা দেখাল। এই জায়গাটার নাম রুমালি দেশ, কিন্তু এখানেও বন্দুকি সওদাগর আর ক্যাপ্টেনকে দুর্ভাগ্য ধাওয়া করে। মনসা দেবী তাদের বিরুদ্ধে এমন তপ্ত বায়ু পাঠান যে দেশ শুকিয়ে যায়, একদিন তাদের বাড়িতে আগুন ধরে যায়, আশেপাশে সব কিছু পুড়ে যায়। হতভাগ্য ভ্রমণকারীদের ওপর দোষ এসে পরে, পড়শিরা রুখে উঠে তাদের দেশছাড়া করে। এবার ক্যাপ্টেন ইলিয়াস মনস্থির করে একটি মাত্র যে জায়গা আছে যেখানে মনসা দেবীর হাত থেকে নিশ্চিত রক্ষা পাওয়া যাবে তারা সেখানে যাবে, এবং সেই জায়গার নাম বন্দুক দ্বীপ। রফি বলল এককেন্দ্রিক বৃত্তদুটি এই দ্বীপেরই প্রতীক, কারণ জায়গাটা আসলে দ্বীপের ভেতরে দ্বীপ, তাই একটি বৃত্তের ভেতর আরেকটি।
আর যে চিত্রে অনেকগুলি রেখা বৃত্তদুটিকে ছেদ করেছে?
মাথা চুলকে রফি বলল, ‘নানা একবার বলেছিল। এখন আর মনে নেই।’
রফির কথা বলার ধরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে আমার পরপর প্রশ্নে ও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ধামের দিকে পেছন ফিরে হাত নাড়াল, যেন সবকিছু উড়িয়ে দিচ্ছে।
‘পুরোটাই আজগুবি’, সিংহের কেশরের মতো চুলে ঝাপটা দিয়ে বলল। ‘তালমিশ্রির দেশ বা বন্দুক দ্বীপ, এসব কিছুই নেই আসলে। আষাঢ়ে গপ্প। সাপের ওপর কারও শাসন চলে না।’
কথাটা খুব জোর দিয়ে বলা সত্ত্বেও রফির গলায় এমন কিছু ছিল যাতে আমার মনে প্রশ্ন উঠল কাহিনিটা নিয়ে এই সন্দেহের সঙ্গে খুব পুরোনো কোনো হতাশা জড়িয়ে আছে কিনা—হয়তো শিশুরা যখন জানতে পারে স্যান্টা ক্লজ নেই, উত্তরমেরুতে খেলনা বানানোর কারখানাও নেই, সেরকম কোনো সংকট।
‘ঠিক বলেছ’, রফিকে খুশি করতে বললাম। ‘এটাও তো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই ধামের সঙ্গে মনসা দেবীর কোনো সম্পর্ক নেই।’
এক মুহূর্তের জন্য সুদীর্ঘ পলকের চোখ বিভ্রান্তে ঝলসে উঠল। ‘তা কেন?’ রফি জিজ্ঞেস করল।
বললাম, ‘কেন না মনসা দেবীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে নিশ্চয়ই এখানে সাপ থাকত, গোখরো সাপ।’
রফির দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম, ওর চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে। এক হাতে মুখ চেপে আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
বললাম, ‘কি হয়েছে?’
আস্তে আস্তে হাতটা মুখ থেকে নেমে এল।
‘আছে তো’, রফি ফিসফিস করে বলল।
‘কী আছে?’
‘গোখরো সাপ আছে, ধামের ভেতর। বহু বছর ধরে।’
এবার আমার পালা অবিশ্বাসভরা চোখে ওর দিকে চেয়ে থাকার।
বললাম, ‘অসম্ভব। ধামের ভেতর গেছিলাম, সাপ-টাপ কিছু দেখলাম না।’
‘আপনার ঠিক পেছনে ছিল’, রফি বলল। ‘আপনি যখন বেরিয়ে এলেন আপনার পেছনে দেখতে পাচ্ছিলাম। ফণা তোলা, মাথা আপনার ঘাড়ের চেয়ে উঁচু। ওকে কখনো এই ভাবে দেখিনি, আমি এলে কখনো বেরোয় না, আমিও ঘাঁটাই না, অন্য সাপখোপ জানোয়ারদের সরিয়ে রাখে। আমি কখনো ভেতরে যাই না, আপনার ঢোকাটা নিশ্চয়ই ওকে বিরক্ত করেছে।’
মাথা নেড়ে বললাম, ‘না না, অসম্ভব…’
সেই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত রফি হয় ঠাট্টা নয় ভুল করছে। গোখরো সাপের ডেরায় ঢুকে পড়েছিলাম এটা অকল্পনীয়। আমি স্ক্রিন বা পুরোনো বইয়ের দিকে তাকিয়ে দিন কাটিয়ে দেওয়া প্রাচীন বস্তুর গবেষক ও বিক্রেতা, আমি একাকিত্বের পক্ষপাতী, এরকম ঘটনা আমার মতো লোকের জীবনে ঘটে না।
তখন আমরা ধামের এক কোণায়, যেখানে মন্দিরের দেওয়াল প্রাঙ্গণের পাঁচিলের সাথে গিয়ে মিশেছে। এখন থেকে খিলান দেওয়া প্রবেশদ্বার আর ভেতরকার অন্ধকার ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না।
এক্ষুনি যা শুনলাম সেটা এতটাই অবিশ্বাস্য মনে হল যে নিজের অজান্তেই পা চলতে আরম্ভ করল। কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই দেখলাম প্রবেশদ্বারের সামনে চলে এসেছি, যাতে নিজের চোখে যাচাই করে নিতে পারি সবকিছু যেরকম ভেবেছিলাম সেরকমই আছে।
তারপর হঠাৎ তার আবির্ভাব, অন্ধকারের মধ্যে থেকে চাবুকের মতো, খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে যেন অনুপ্রবেশকারীর, অর্থাৎ আমার, দেখা দেওয়ার অপেক্ষায় ছিল।
এখন মাত্র কয়েক হাত দূর থেকে দেখে বুঝতে পারছি সাধারণ গোখরো নয়, শঙ্খচূড়। এত প্রকাণ্ড যে ফণা তুলে দাঁড়ালে উচ্চতায় আমার সমান।
চকচকে কালো চোখের দিকে তাকিয়ে আছি, সাপের জিভ লকলক করছে, একটা গরগর আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি (পরে জানতে পারব এই ধরণের সাপ হিস্ হিস্ করার বদলে এই ধরণের শব্দ করে)।
পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছি, যেন মাটির সঙ্গে ঝালাই করে দেওয়া হয়েছে আমায়, কিন্তু যদিও আমি তার নাগালের মধ্যেই, আজ পর্যন্ত আমি নিশ্চিত এর পরে যা ঘটল সেটা না হলে সাপটা কারও ক্ষতি করত না।
আমি তখন জানি না টিপু একটু আগেই প্রাঙ্গনের ফটকে পৌঁছে চোখের সামনে দৃশ্যটা দেখেছে। আমি যে কোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হব ভেবে মাছ ধরার জাল তুলে নিয়ে চুপিসারে আঙিনায় ঢুকে এসেছে।
জালটা সাপের দিকে ছুঁড়ে দিলে তবেই টিপুর উপস্থিতি টের পেলাম, আর সেই মুহূর্তেই গোখরো অবিশ্বাস্য গতি আর শক্তি নিয়ে ছোবল মারল। ফণার ওপর জাল নেমে আসছে, সেই অবস্থাতেই দেহটা টিপুর দিকে নিক্ষেপ করে বাঁ কনুইয়ের ওপর একটা দাঁত বসিয়ে দিল।
তারপর যেমনই অকস্মাৎ তার আবির্ভাব, তেমনই অকস্মাৎ তার অন্তর্ধান, শুধু জালটা মাটিতে পরে রয়েছে। টিপু কনুইয়ের ওপর ঝুঁকে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে, চোখ ক্ষতস্থানের ওপর। তারপর আস্তে আস্তে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আমার চোখে চোখ রাখল।
অমিতাভ ঘোষের ‘Gun Island’ উপন্যাসটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অরুণাভ সিংহ। উপরের এই লেখাটি তারই নির্বাচিত অংশ। বানান অপরিবর্তিত রইল।