ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • সামথিং সামথিং: পর্ব ১৮


    চন্দ্রিল ভট্টাচার্য (November 6, 2021)
     


    খেলা, ঠেলা, কান্নাড্যালা

    খুউব সাবধান। যদি পাকিস্তানের খেলা ফ্যান্টাস্টিক লাগে, বাবর আজম বা মহম্মদ রিজওয়ান আপনাকে মুগ্ধ করে, শাহিন আফ্রিদির বল তাক লাগিয়ে দেয়, তাহলে খবরদার তা প্রকাশ্যে বলবেন লিখবেন না, স্ট্রেট জেলে ধরে নিয়ে যাবে, রাজনীতির পান্ডা হুমকি দেবেন আপনার জ্যান্ত ছাল ছাড়িয়ে নেওয়া উচিত, প্রাক্তন ক্রিকেটার বলবেন এমন বেয়াদবি লজ্জাকর, আর পাবলিক বাসেট্রামে তো গালাবেই: ভারতের খাবে ভারতের পরবে আর ভারতের খেলায় পাকিস্তানকে সাপোর্ট করবে? মার! পাকিস্তানে পাঠা! কিন্তু কেন একটা ম্যাচে আমাকে আমার দেশের দলটাকেই সমর্থন করতে হবে? কেন বিপক্ষের খেলা দেখে সম্মোহিত হওয়ার স্বাধীনতা আমার নেই? কেন নিজের দলের খেলা দেখে বিরক্ত হওয়ার অধিকার নেই? কেন একটা ম্যাচে যে-টিম বেশি ভাল খেলবে তাকে একজন দর্শক চেঁচিয়ে সাপোর্ট করতে পারবে না, সে-টিম নিজের না হলেও? এমনিতে এর কোনও উত্তর নেই, কিন্তু ওমনিতে আছে। তা হল, নিজের দেশকে তোমায় সর্বক্ষণ গাঁতিয়ে ভালবাসতেই হবে, খেলা বলে তাকে স্রেফ খেলাচ্ছলে উপেক্ষা করলে চলবে না। তাহলে কি অস্ট্রেলিয়ায় থাকা ভারতীয়রা যখন ভারতের সমর্থনে পতাকা নাড়ান, তাঁরা দেশদ্রোহিতা করেন? অস্ট্রেলিয়া সরকারের কি উচিত তাঁদের ঘাড়ে ধরে হাজতে পোরা? না কি তাঁদের দেখে ভারতের ভারতীয়রা উল্টে আপ্লুত হয়ে বলেন, দেখেছ, বিদেশি মুদ্রায় কাঁড়ি উপার্জনান্তেও দেশকে ভোলেনি? 

    কিন্তু উল্টো-যুক্তিটা বলবে, এসব কথাবাত্তাই খাপে-খাপ খাটে সাধারণ একটা ক্রিকেট ম্যাচের বেলায়। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ আদৌ তা নয়। এ দুটো দেশ শত্রু, আর তাই খেলার মধ্যেও স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের চেয়ে শত্রুতা খোঁজাই কাঙ্ক্ষিত। যদি প্রতিবেশী সারাক্ষণ আমার বাড়িকে খিস্তি করে আমার বোনকে টোন কাটে আমার জানলায় ঢিল ছোড়ে, এবং আমি তার কাচা কাপড়ে কালি ছেটাই তার ভাইকে ল্যাং মারি তার লেটারবক্সে চকলেট বোম রাখি, তাহলে তার আর আমার ক্যারম খেলা কি নিতান্ত অ্যাঙ্গল আর টাংকি-র জ্যামিতিক নৈপুণ্যবিচারে সীমাবদ্ধ থাকবে? রেড ফেলার মধ্যে কি বিরোধীর বাপ-ঠাকুদ্দার মাথা নর্দমায় চোবানোর হৃদি-প্রোজেকশন কাজ করে যাবে না? সেটাই কি স্বাভাবিক, বা, তর্কবাজদের মতে, উচিত-মানসিকতা নয়? যখন খেলাকে আমরা একটা ‘অ-নীতি বাবল’এর মধ্যে অবস্থিত দেখতে চাইছি, ইতিহাস রাজনীতি সন্দেহ অভিযোগের বাইরে একটা সর্ববিচ্ছিন্ন স্যানিটাইজড উল্লম্ব দ্বীপে ঘটমান, যেখানে খেলোয়াড় ও দর্শকের মগজে স্মৃতি নেই জ্ঞান নেই ভিনচিন্তা নেই শুধু ব্যাট বল ইয়র্কার আর হাফভলি আছে, যেথা সবাই নিজের মনকে খবরকাগজ থেকে ছিঁড়ে স্পাইডারক্যামের লেন্সে প্রোথিত করেছে– তখনই কি বরং আমরা উদ্ভট ও বাস্তববিরোধী সিনসিনারি প্রার্থনা করছি না? আজ ইজরায়েল আর প্যালেস্তাইনের মধ্যে ক্রিকেট খেলা হলে, বা আফগানিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে ফুটবল ম্যাচ হলে, অথবা জার্মান বনাম ইহুদি কবাডি টুর্নামেন্ট হলে, তা শুধু স্কোরবোর্ড-সর্বস্ব হয়ে থাকবে?  

    উত্তরটা অবশ্যই এই, শত্রুতা লালন করাই অপরাধ। রাষ্ট্রনায়করা যত আকচাআকচি করুন না কেন, সাধারণ মানুষকে নাগাড়ে মনে রাখতে হবে, সব দেশের সাধারণ মানুষ অ্যাক্কেবারে একরকম, এবং কাউকে খুন করার পুঁতে দেওয়ার অপদস্থ করার গাঁট্টা কষাবার ইচ্ছেই অশ্লীল। সভ্যতা একটাই কথা শেখায়, প্রবৃত্তির মধ্যে যতই হিংস্রতা থাক, মানুষকে সেগুলোকে প্রশমিত করে ঔচিত্যের চেয়ারে চেপে বসতে হবে। তার জন্য লাগাতার অনুশীলন প্রয়োজন, আর সেই প্র্যাকটিসের একটা চমৎকার জায়গা হল খেলার ময়দান। ম্যাচের শেষে বিরাট কোহলি যখন পাকিস্তানের দুই ব্যাটসম্যানকে হাসিমুখে অভিনন্দন জানান, তখন হিন্দু-জঙ্গিদের যতই রক্ত চনমনাক, তিনি অত্যন্ত ন্যায়কাজ করেন। পাকিস্তানেও ভারতের প্রতি কম ছোবল নেই, কোথাও তাদের জয়কে বলা হচ্ছে ইসলামের জয়। এক প্রাক্তন পাক ক্রিকেটার বলেছেন হাফসেঞ্চুরি করার পর হিন্দুদের সামনে যে রিজওয়ান নমাজের ভঙ্গি করলেন, গোটা খেলায় এ-ই তাঁর সেরা প্রাপ্তি। ২০১৬-য় এক পাকিস্তানি নাগরিক বিরাট কোহলির খেলায় মোহিত হয়ে ভারতের পতাকা ওড়ানোয় তাঁকে দেশদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ভারতেও এই টি-২০ বিশ্বকাপের পরাজয়ের পর উদয়পুরের শিক্ষিকাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হচ্ছে ও জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আগ্রার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিন ছাত্রকে কলেজ থেকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে ও গ্রেফতার করা হচ্ছে (কোনও উকিল তাঁদের পক্ষে দাঁড়াতে রাজি নন), কাশ্মীরের দুটো মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ও স্টাফদের বিরুদ্ধে উগ্রপন্থা-বিরোধী আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, কারণ এঁরা সব্বাই পাকিস্তানের জয় উদযাপন করেছিলেন। দুটো সরকারেরই উচিত একটু পরিণতমনস্ক হয়ে ভাবা, খেলায় যে কোনও দলকে যে খুশি সাপোর্ট করুক, তাকে দেশপ্রেম ও দেশবিদ্রোহের তীব্রতায় অনুবাদ না করাই ভাল। অবশ্য হাস্যকুড়কুড়িয়ে লাভ নেই, দু’দেশের কত্তাবাবারাই (এবং কর্ত্রীমায়েরা, মেয়েদের ইগনোর করা ঠিক নয়) জানেন, দেশটাকে তাঁরা যতই ন্যাৎরাছ্যাৎরা করে রাখুন, যেই বলবেন পাকিস্তান আমাদের জওয়ানদের মেরেছে (বা হিন্দুস্তান আমাদের কাশ্মীর দিচ্ছে না), তক্ষুনি কোরাস-ঘৌ তুলে নাগরিকেরা চাল জল চিকিৎসা চাকরির দাবি ভুলে খেউড়-মেশিনে ঢুকে পড়বে, এবং তা থেকে ভোট বেরোবে গলগলিয়ে। খেলার সময়ও (অর্থাৎ সবসময়ই) সে অশান্তির গরম হাওয়া জিইয়ে রাখলে, বেশ একটা উদ্দেশ্যের ও প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়। মন্দ কী?

    হয়তো ধাঁধার উত্তরটা এইরকম: খেলা থেকে প্রেম ও ঘৃণাকে বিযুক্ত করা যতটা সহজে সম্ভব, বস্তু থেকে তার ব্যবহারকে বিযুক্ত করা ততটা সহজ নয়, তা প্রত্যাশিতও নয়। যে বস্তুটার ধর্মই ছিল মানুষকে সংখ্যায় রূপান্তরিত করা, তাকে নিয়ে খেলাধুলো হয় না। তাই এ দুটো পরিস্থিতি তুলনীয়ই নয়। এও মনে রাখতে হবে, হলোকস্টের গাম্ভীর্য-সমর্থকেরা লাঠিবাজি ফিরি করছেন না, একবারও বলছেন না, ‘জার্মানদের মারব, কারণ তারা আমাদের মেরেছিল’, তাঁরা বলছেন, ‘বর্বরতার প্রতীককে সাড়েবত্রিশভাজার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না।’

    কিন্তু এবার আসরে লাফিয়ে নামল আরেক ঝঞ্ঝাট: আউশউইৎজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দিদের গায়ে উল্কি দেগে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত অনেকগুলো ছুঁচ, আর একটা উল্কি দাগার ম্যানুয়াল নিলামে তোলার কথা ঘোষণা করল জেরুসালেমের এক সংস্থা। ইজরায়েলের হলোকস্ট জাদুঘরের প্রধান প্রতিবাদ জানালেন, নাৎসিদের অত্যাচারের যন্ত্র কি বেচাকেনার জিনিস? হলোকস্ট-এ বেঁচে যাওয়া বহু মানুষ ও তাঁদের বংশধর, এবং আরও অনেকে প্রকাণ্ড রইরই করলেন, বাজারের আর পাঁচটা পণ্যের মতোই বিক্রি করা যায় কি এমন কিছু বস্তু, যার গায়ে প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদির হত্যার ইতিহাস লেগে আছে? ক্যাম্পে ঢোকার পর ওই ছুঁচগুলো দেগে বন্দির গায়ে নম্বর লেখা হত, তারপর তাতে কালি ঢেলে দেওয়া হত, কোনওদিন সেই উল্কির দাগ মুছত না, এবং তাই ওগুলো লাগাতার নৃশংসতার, সমষ্টি-নিধনের, মানবিকতার অপমানের অন্যতম বীভৎস প্রতীক। সেই সরঞ্জাম টেবিল-চেয়ারের মতো নিলাম হবে? ইজরায়েলের আদালত ওই নিলাম নিষিদ্ধ করে দিল। কারও মনে বেয়াড়া প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা লোকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে ওই ছুঁচগুলো থাকলে, হলোকস্টের শিকার হওয়া মানুষগুলোর দহনকে অসম্মান করা হত কীভাবে? জিনিসগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে, ওগুলো মিউজিয়ামে থাকলে কেউ আপত্তি করতেন না (অমন সেট আছেও আউশউইৎজ মিউজিয়ামে এবং রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গের মিলিটারি মেডিক্যাল মিউজিয়ামে), তাহলে বড়লোকের বাড়ির শো-কেসে যদি সাজানো থাকত, আর তিনি অভ্যাগতদের ডেকে বড়াই করে দেখাতেন, আর নিমন্ত্রিতরা হাতে নিয়ে ঘুরিয়েফিরিয়ে অবলোকন করে বলত ‘বাবা রে, গা শিউরে উঠছে’, তাতে অশুদ্ধিটা কোথায়? উত্তর হল, তাতে মানবেতিহাসের এক চূড়ান্ত কলঙ্কজনক অধ্যায়কে অনেকটা তুচ্ছ, নগণ্য করে দেওয়া হত। কিছু মানুষের পৈশাচিকতা, মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা, ঠান্ডা মাথায় একটা জাতকে মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা, অসংখ্য মানুষের কলজে-মচকানো আর্তনাদ, প্রিয়জন হারাবার অসহ্য যন্ত্রণা, ক্যাম্পে ক্যাম্পে মানুষের সমস্ত মর্যাদা ও অধিকার মাড়িয়ে কচলে নিংড়ে রগড়ে ফেলার রুটিন, সমস্ত জানতে পারার পর পৃথিবীর সব দরদির বুকছেঁড়া দীর্ঘশ্বাস, এবং জার্মানদের দশক-দশকব্যাপী চূড়ান্ত অপরাধবোধ ও অনুশোচনা— সঅঅব বোনা রয়েছে আউশউইৎজের যে-কোনও একটা সুতোতেও, একটা সেফটিপিনেও। সেটাকে যদি কোনও লোক টাকা দিয়ে কিনে পেপারওয়েট করে, বা বাচ্চার জন্মদিনে প্রধান আকর্ষণ হিসেবে বেতের মোড়ায় হেলান দিয়ে রাখে, তাহলে এতগুলো মানুষের আত্মার লাঞ্ছনাকে একটা শপিং মলের খেলনা ফড়িং-এ পর্যবসিত করে দেওয়া হয়। হলোকস্টের আগের ঘৃণার অধ্যায় এবং হলোকস্টের পরের বিচারের বহুস্তর প্রসঙ্গ মিলিয়ে এদের ওজন একশো পাহাড়ের। তাকে ছেঁদো করার অধিকার কারও নেই। 

    কিন্তু এই বস্তুগুলোকে যদি ঘটনার ৭৫ বছর পরেও তাদের ইতিহাসের থেকে এতটুকু বিযুক্ত করে না-দেখা যায়, যদি হলোকস্টের কোনও একটা জিনিসের নিলামে মানুষ এত স্পর্শকাতর হয়ে আঁতকায় ‘এদের উল্লেখমাত্রে গোটা ইতিহাসটা তার সমস্ত আঁধার জটিলতা নিয়ে আমাদের বুকে চেপে বসছে’, তাহলে কেউ যদি চিৎকার করে: ভারত বনাম পাকিস্তান কথাটা শুনলেই দেশভাগ থেকে শুরু করে যুদ্ধ ও টেররিস্ট আক্রমণ অবধি, কারগিল, ২৬/১১, পুলওয়ামা মিলিয়ে পুরো স্রোতটা আমার মাথায় নানাবর্ণের আগুন জ্বালিয়ে দিচ্ছে, আমি কিছুতেই পাক বোলারকে ছক্কা মারা থেকে আমার ক্রোধ গেলে দেওয়াকে আলাদা করতে পারছি না, কিছুতেই পাক ব্যাটসম্যানকে ক্লিন বোল্ড করা থেকে আমার প্রতিশোধের আনন্দকে আলাদা করতে পারছি না— সে বাড়তি বখেড়াটা পাকালো কোথায়? ভারত ভেঙে যে পাকিস্তান হয়েছে, তার আগেরও একটা বড় ইতিহাস আছে, দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাসের ও দাঙ্গার সেই আখ্যান ভয়াবহ, কষ্টদীর্ণ, তীব্র জ্বলুনিময়। এরপর দেশভাগের ছবি তো কোটি মানুষের দেহ-মনের কালশিটের রঙে চির-নীল, উৎকট, তছনছিয়া, হৃৎপিণ্ডে ব্যাঁকা পেরেক-ঠোকা গরলের নীল, যা কোনও দেবতাই কণ্ঠে ধারণ করে ত্রাণ করতে পারবেন না। তারপর দুই দেশের মধ্যে ৭৫ বছর ধরে পারস্পরিক সন্দেহ, বৈরিতা, অসভ্য দোষারোপ, এ-ওর মানুষকে মেরে অভব্য উল্লাস— সবসুদ্ধু একটা কুয়াশাপিণ্ড কান্নায় ক্ষোভে অভিশাপে ভারী হয়ে পার্মানেন্ট ঝুলে আছে। তাহলে এই প্রবহমান রোষ ও দ্বেষের ছ্যাঁকছোঁক কড়া থেকে আমি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচকে আলাদা করে দেখব কোন প্রাণে? কী কারণে? কেন বলব না, আমি পিচ খুঁড়ে তেল ঢেলে দেব? যদি একটা ব্যাপারে বলি, ‘আরে বাবা, ইতিহাস-ফিতিহাস ভুলে তুমি শুধু এই ঘটনাটাকে স্রেফ এই ঘটনাটার মূল্যে ওজন করছ না কেন?’ তাহলে অন্য একটা ব্যাপারে কেন গ্রাম্ভারি গাল ফুলিয়ে ফুকারি, ‘কোনওদিনই এইগুলোকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা সম্ভব নয়, তাড়স ও ফোঁপানির ইতিহাস চিরকাল এদের লেপটে-জাপটে আঁকড়ে থাকবে’?

    হয়তো ধাঁধার উত্তরটা এইরকম: খেলা থেকে প্রেম ও ঘৃণাকে বিযুক্ত করা যতটা সহজে সম্ভব, বস্তু থেকে তার ব্যবহারকে বিযুক্ত করা ততটা সহজ নয়, তা প্রত্যাশিতও নয়। যে বস্তুটার ধর্মই ছিল মানুষকে সংখ্যায় রূপান্তরিত করা, তাকে নিয়ে খেলাধুলো হয় না। তাই এ দুটো পরিস্থিতি তুলনীয়ই নয়। এও মনে রাখতে হবে, হলোকস্টের গাম্ভীর্য-সমর্থকেরা লাঠিবাজি ফিরি করছেন না, একবারও বলছেন না, ‘জার্মানদের মারব, কারণ তারা আমাদের মেরেছিল’, তাঁরা বলছেন, ‘বর্বরতার প্রতীককে সাড়েবত্রিশভাজার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলো না।’ অথবা ভাবা যায় এইরকম: সুপরিকল্পিত বিনাশ-যজ্ঞের ক্ষেত্রে মানুষ অনেক বেশি ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে। হটাস-দাঙ্গা, আর ব্লুপ্রিন্ট-মানা ছক-কষা হলোকস্টের দ্যোতনা তাই আলাদা। অবশ্য কেউ যদি বলে, অমুক দেশটা একেবারে গোছালো বদমাইশি করে বহুদিন ধরে আমার দেশের লোককে খেপিয়ে তুলছে বা খুন করছে, বোম ফেলে সৈন্য মারছে, তাহলে এ যুক্তি ধোপে টেকা শক্ত। ভাবনা হতে পারে এইরকম: হলোকস্ট যেমন নিশ্চিতভাবে, প্রশ্নাতীত ভাবে, নিঃশর্তে একটা খারাপ ব্যাপার, অন্য একটা দেশ তেমন অবিসংবাদিত, অবশ্যস্বীকার্য ভাবে খারাপ হতে পারে না। দুই দেশেরই গুচ্ছের ত্রুটি ও কুমতলব (এবং গুণ ও সুনীতি) থাকে। আরেকটা পথ হতে পারে এইরকম: কিছু কিছু ব্যাপারকে হলোকস্টের ক্ষেত্রেও অতটা সূক্ষ্ম-সংবেদন ছাড়া দেখার সময় হয়েছে। হয়তো বলার সময় এসেছে: অ্যাঁ? আউশউইৎজের উল্কির দ্রব্য যে-সে কিনে নেবে? সে নিক, নিলাম করার অধিকারে হস্তক্ষেপের প্রশ্ন উঠছে না, এই বেচা-কেনাও বাকস্বাধীনতা বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতারই অঙ্গ, তাই ফতোয়া জারি করে একে বন্ধ করা যাবে না, আর গা-জোয়ারি নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বাসও করি না, কিন্তু আমার তরফ থেকে এই লেখায়, বা ইউটিউবের এই বক্তৃতায়, বা এই নাটকে খোদাই করা থাকল এ-কাণ্ডের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ, বা, নিদেন এই সিদ্ধান্তের একটা সমালোচনা: একবার বোধহয় ভেবে দেখা দরকার, আমরা কি যন্ত্রণাকে প্রোডাক্ট করছি? যার বিরুদ্ধে হয়তো অন্য কেউ লিখতে পারেন, মাঝেমধ্যে ভাবা দরকার, বড্ড একবগ্গা হয়ে আমরা প্রায় গোঁ ধরে হলোকস্টের বিষাদটাকে এমনকী কয়েকটা তাৎপর্যহীন ঘটনার ক্ষেত্রেও সেঁটে দিচ্ছি কি না, যা অনায়াসে অগ্রাহ্য করা যায়, তৃণজ্ঞান করা যায়, তাকেও তালপরিমাণ করে তুলছি কি না এই ভয় থেকে: এই রে, আমরা অমন গুরুত্বপূর্ণ বেদনাবিন্যাস বিস্মৃত হলাম না তো? শোক শিথিল হয়ে গেল না তো? আমাদের সিরিয়াসনেস, আমাদের দায়বদ্ধতা তার বেদী থেকে চ্যুত হল না তো? হয়তো উল্কির ছুঁচের চেয়েও আমাদের এই পাপের ভীতি অধিক ছুঁচলো। এই অতিরিক্ত নীতিনিষ্ঠা আমাদের না শেষ অবধি ভুরু-কোঁচকা বকুনিবাজ শুচিবায়ুগ্রস্ত জেঠু-কমিটিতে বদলে দেয়। তার চেয়ে অখেলোয়াড়োচিত মনোবৃত্তি আর নেই। 

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook