কবির বিদ্যালয়, টুকরো দুষ্টুমি
অনেক সময়, হয়তো, তত্ত্বের থেকে গল্পের আয়ু আর তেজ বেশি হয়। ১৯০১-এ রুক্ষ শান্তিনিকেতনে, বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উপদেশ অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথ যে-আশ্রম বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এক সময় তা ডানপিটে ছেলেদের আখড়া হয়ে ওঠে। অভিভাবকেরা আশা রাখতেন, বেয়াড়া-বেয়াদপ ছেলেদের কবির বিদ্যালয়ে পাঠালে তারা হয়তো একদিন যথার্থ মানুষ হয়ে ফিরে আসতে পারবে। এই বিদ্যালয় গড়ে তুলতে রবীন্দ্রনাথকে বহু ব্যক্তিগত ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। এক সময় স্ত্রী মৃণালিনীর গয়না বিক্রি করে তিনি এর খরচ জুগিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, শান্তিনিকেতন আশ্রমে এক প্রকাণ্ড ছাতার মতো ছিলেন। তাঁর প্রশ্রয়ে ছাত্ররা নানা বিষয়ে আগ্রহ দেখাবার, এমনকী দুষ্টুমি করারও প্রভূত সুযোগ পেত। ডানপিটে ছেলেদের সেইসব দুষ্টুমি অনেক সময়ই ছিল খুবই সৃজনশীল এবং মনের বিকাশের সহায়ক। শিক্ষকদের কেউ-কেউ, এমনকী রবীন্দ্রনাথও সেইসব ছাত্রদের যেন কখনও উসকে দিতেন। শান্তিনিকেতনে কবির বিদ্যালয়ের প্রথম যুগের ছাত্রদের কেউ-কেউ স্মৃতিকথা রচনা করেছিলেন, যেখানে বহু মজাদার গল্প চোখে পড়ে। তার মধ্যে প্রমথনাথ বিশীর কয়েকটা গল্প নতুন করে বলা যাক। বলে রাখা ভাল, এখানে ব্যবহার করা উদ্ধৃতি একেবারে হুবহু প্রমথনাথের লেখা থেকে নেওয়া হয়নি। নতুন করে বলা হয়েছে, যেভাবে যুগ-যুগ ধরে আমাদের মুখে-মুখে গল্প বেঁচে থাকে।
‘বিপদে আমি না যেন করি ভয়’
পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে, পুষ্ট চেহারার রাশভারী শিক্ষক ক্ষিতিমোহন সেন প্রয়োজনে ছেলেদের পেটাতেন। ছাত্রদের ধারণা ছিল, তিনি কাউকে ডাকছেন মানেই কপালে লেখা রয়েছে প্রহার। আচার্য ক্ষিতিমোহনের ডাক পড়লেই তাই ছাত্রেরা পর্যাপ্ত, মোটা শীতের পোশাক পরে তাঁর কাছে হাজির হত। একবার তেমনই তাঁর ডাক পেয়ে, সতীর্থদের পরামর্শে ছাত্র প্রমথনাথ বিশী, প্রহৃত হবার যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়ে, মোটা শীতের পোশাক গায়ে চাপিয়ে ক্ষিতিমোহনের কাছে গেলেন। কী দু-একটা কথা বলে, ক্ষিতিমোহন তাঁকে ছেড়ে দিলেন। প্রমথর আশঙ্কা আর বাকি ছাত্রদের বিশ্বাস ভঙ্গ হল।
‘হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি’
ছাত্র প্রমথনাথকে সঙ্গে নিয়ে একবার রবীন্দ্রনাথ হাঁটছিলেন। কুয়োর পাশে একটা গাব গাছ দেখিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘অশোক গাছ ভেবে লাগিয়েছিলাম, এখন দেখছি গাব গাছ।’ তারপর প্রমথকে বললেন, ‘তোকেও তো অশোক গাছ ভেবে এনেছিলাম, হয়তো গাব গাছই।’
‘কী হেরিলাম নয়ন মেলে’
প্রতি বছর শারদ অবকাশের আগে আশ্রমে ছাত্ররা বিচিত্র জিনিসের পসরা সাজিয়ে এক মেলা বসায়, যার নাম ‘আনন্দবাজার’। একদল ছাত্র সেই মেলায় একবার এক ‘জাদুঘর’ খুলে বসল। সেখানে দেখানো হচ্ছিল রামের পাদুকা আর সীতার চুল। টিকিট কেটে উৎসাহীরা ভিতরে ঢুকে দেখলেন ‘প্রবাসী’র সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের জুতো আর তাঁর স্ত্রী সীতাদেবীর চুল।
‘যেন এই কথা রয় মনে’
ছাত্রদের হাতে, আশ্রমের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে তালতোড় বাঁধের পাশে একবার একটা এলাকায় সন্ত্রাস ছড়ানো বাঘ মারা পড়ল। আশ্রমের কর্মী সুধাকান্ত রায়চৌধুরী জেদ ধরে বসলেন, বাঘের মাংস খাবেন। কারণ হিসেবে বললেন, যুগে-যুগে মানুষের মাংস ভক্ষণ করে আসা বাঘের বিরুদ্ধে মানবজাতির প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই, নীতিগত তাগিদে তিনি বাঘের মাংস খাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে ছাত্ররা কিছুটা মাংস তাঁকে দিল। তিনি গরম মশলা দিয়ে-দিয়ে তা রান্নাও করলেন। খাওয়ার আগে কেউ একজন হাজির হয়ে বলল, বাঘের মাংস খেলে মানুষ পাগল হয়ে যায়। এটা শুনে সুধাকান্তের উৎসাহ যেন আরও বেড়ে গেল। কিন্তু আর একজন যেই বলেছে, বাঘের মাংস খেলে পাগলের পাগলামি ছেড়ে যায়, অমনি সুধাকান্ত রান্না করা সব মাংস ফেলে দিলেন। মানুষের বিরুদ্ধে বাঘের চিরকালীন গ্লানি রয়েই গেল।
‘আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া’
শিক্ষক হয়ে ক্ষিতিমোহন সেন তখন সবে আশ্রমে এসেছেন। ছাত্রেরা তাঁর ভাবগতিক, হালচাল একটু বাজিয়ে দেখছে। একদিন এক ছাত্র জুতো পরে ক্লাসে ঢুকল। ক্ষিতিমোহন বললেন, ‘জুতোটা বাইরে রেখে এসো।’ ছেলেটা বলল, ‘এখানে জুতো সমেত ক্লাসে ঢোকা যায়।’ শুনে ক্ষিতিমোহন বললেন, ‘মার খাবে।’ ছেলেটা বলল, ‘আশ্রমে কাউকে মারা নিষেধ।’ ক্ষিতিমোহন ছেলেটির দুই কান ধরে শূন্যে তুলে দুটো চড় মেরে বললেন, ‘এখন তুমি আশ্রমের বাইরে।’ এরপর তাকে আবার আশ্রমের মাটিতে প্রতিষ্ঠা করলেন।
‘তোমার কাছে কেন আসি, ভুলে যে যাই’
অঙ্কের শিক্ষক নগেন আইচের ক্লাসে দশটা অঙ্কের জায়গায় গর্বিত প্রমথ বারোটা অঙ্ক করে ভাবলেন একশোয় একশো কুড়ি নম্বর দিতে না পেরে মাস্টারমশাই খুব ঝামেলায় পড়বেন। নগেন আইচ সেই খাতা নিয়ে উত্তেজিত হয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথের দরবারে। ব্যাপারটা কী? রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, সব অঙ্ক ভুল করে, শেষ পাতায় প্রমথ একটা কবিতা লিখেছেন—
‘হে হরি হে দয়াময়,
কিছু মার্ক দিও আমায়
তোমার শরণাগত,
নহি সতত,
শুধু এই পরীক্ষার সময়।’
বিচার শেষ করে, নগেন আইচকে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ওকে অঙ্ক কষাতে চেষ্টা করো, কিন্তু কবিতা লিখতে বাধা দিও না। পরীক্ষার উদ্যত খাঁড়ার সামনে দাঁড়িয়ে ক’জনই বা এমন সরল স্বীকারোক্তি আর আত্মনিবেদন করতে পারে!’
‘আমার যা কথা ছিল, হয়ে গেল সারা’
রবীন্দ্রনাথ কোনও কারণে রুষ্ট হলেও রূঢ় ভাষা প্রয়োগ করতেন না। আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে, স্থির ভাবে কিছু কঠিন কথা বলে যেতেন, যা ছিল হাড় হিম করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। একদিন প্রমথকে ডেকে তেমনই কিছু কথা বললেন রবীন্দ্রনাথ। প্রমথ চুপ করে শুনলেন। গুরুদেবের বলা শেষ হলে বললেন, ‘কিন্তু অপরাধী যে আমি নই।’ শুনে যেন রবীন্দ্রনাথ আশ্বস্ত হলেন। বললেন, ‘বলতে হল, কিন্তু লোকটাকেও কষ্ট দেওয়া হল না!’
‘তোমার মুখের, চকিত সুখের হাসি’
একবার যেন রবীন্দ্রনাথেরও কিছুটা দুষ্টুমি করার ইচ্ছে হল। প্রমথ ঘুরতে-ফিরতে, কারণে-অকারণে এসে দাঁড়ান গুরুদেবের কাছে। একদিন দুপুরে তিনি একটা গ্লাসে কী যেন একটা খাচ্ছেন। কাঁচা সোনার রং। খুব উৎসাহ নিয়ে প্রমথকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞেস করলেন, ‘খাবি?’ প্রমথ মাথা নাড়লে, তাঁর পরিচারক সাধুচরণ তাকে একগ্লাস পানীয় এনে দিলেন। খাওয়া শেষ হলে, রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীরকম লাগল?’ প্রমথ বললেন, ‘ভাল’। সমাগত অন্যান্যরা যখন প্রমথর এই বিরল সৌভাগ্যের কথা চিন্তা করে দৃশ্যত উতলা, রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘নিম পাতা সিদ্ধ জল। আপনারা অকারণে চঞ্চল হবেন না!’
আশ্রম বিদ্যালয়ের স্মৃতিকথা অনেকেই লিখেছেন। কিন্তু প্রমথনাথ বিশীর ‘রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন’ বইয়ে ছড়িয়ে থাকা এমন অজস্র গল্প শান্তিনিকেতনে কবির বিদ্যালয়ের সোনালি দিনের একটা আদর্শ ছবিই তুলে ধরে— এমন এক শিক্ষাঙ্গনের ছবি, রবীন্দ্রনাথের কথায়, যেখানে ছাত্রদের ডাক শুনলে গুরুমশায়ের অন্তরের আদিম ছেলেমানুষটাই যেন বেরিয়ে আসে।
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র