আঁধার গলি দেখে নিরিবিলি হিসি অবধি ব্যান, সিসিটিভি রেকর্ড করে নিচ্ছে। নির্জন চাতাল পেয়ে নির্মল গালে নিড়বিড়ে হামি বসিয়ে দিলাম, যুগলের এ চিৎপুলকটুকু চিরতরে হৃত। হোটেলে ঢুকেও নিশ্চিন্দি নেই, আয়না বা ঘুলঘুলি থেকে সর্ষেদানার ন্যায় ক্যামেরা ছবিছাবা তুলে খুল্লমখুল্লা ইউটিউবে সেন্ড। ইস্কুলেও সিসিটিভি চোখ পাকাচ্ছে, টিপিনটাইমে কে কার বাক্স হতে হাফবয়েল গেঁড়িয়ে দিল। আপত্তি জানালেই বলবে, সম্ভাব্য অপরাধ আটকাচ্ছি, কেউ কাউকে মলেস্ট করলে, গাড়ি কাউকে ধাক্কা দিলে, কেউ মাথায় রড হানলে, বেমক্কা ছিনতাই বাগালে, কে সাক্ষী দেবে আমার ফুটেজ ছাড়া? এবং সত্যিই তো তা-ই দেখেই কিনারা হচ্ছে গাদা গাদা রহস্যের। এমনকী গেরস্থ-বাড়ির ঘরে ঘরে সিসিটিভি ফিট করা আছে বলেই মা দেখতে পেলেন টিউটর তাঁর সোনামণিকে লাথাচ্ছে, বা দুধের বাচ্চার আপেলসেদ্ধ আয়া গাপিয়ে সাঁটাচ্ছে, বা প্যারালিসিস-গ্রস্ত মা’কে নার্স দু’থাবড়া কষিয়ে বলছে দিনে ২৭বার পটি যাস কেন বুড়ি হাবড়ি? সর্বক্ষণ পৃথিবীর প্রতিটি কোণাঘুপচিতে নজর রাখলে ও সমস্ত ঘটনা নথিবদ্ধ করলে, অপরাধীকে শনাক্ত করা ও শাস্তি দেওয়া সহজ হয়, তাই সে-সমাজকল্যাণের হাড়িকাঠে যদি ব্যক্তির স্বাধীনতার গর্দান বিলকুল বলি যায়, তবে যাবে— এ সিদ্ধান্তে প্রায় প্রত্যেকেই প্রীত। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হবে, ট্রেড-অফ ছাড়া সুখ কোথা কবে, মানুষের খলবলে মুক্তি মানে যদি হয় খুচরো আমোদ ও প্রণয় ভোগ, বা পাজামা চুলকোতে চুলকোতে উদাস ঝালমুড়ি চর্বণ, তাহলে তার এত মূল্যই বা কীসের, এত মর্যাদা-প্রদান স্রেফ তাত্ত্বিক কচকচি ছাড়া কী? রেপিস্ট ধরা পড়া বেশি জরুরি না তোর নিভৃত মাস্টারবেশন নিরালা নজরহীন অলিন্দে?
কারও সঙ্গে প্রথম আলাপ হল, ক্যারম খেলে অঙ্গুলি-পাউডার মুছে সে সিঁড়ি দিয়ে নেমেছে কি নামেনি, পটাস গুগল করে ফেললাম তার নাম। মুহূর্তে উন্মোচিত বিশদ ঠিকুজি, ঐক্য বাক্য ব্রণর আধিক্য, প্রাচীন লেঙ্গি ও ইনফেকশাস ডেঙ্গি। আর সেও সিঁড়ি ঝুঁকে ল্যান্ডিং-এ পৌঁছনোর আগে খুলে ফেলেছে আমার ফেসবুক, দেখে ফেলেছে ৫১ বন্ধু ১০১ জোকস, ৪৯ বায়ু ৪৫ কোলবাল্লিশ। আমাদের ডিজিটাল হাতের ছাপ এবং আমাদের গালে অন্যের ডিজিটাল আঙুলের ছাপ সমস্তই দিব্যি দগদগ করছে খোলা পাতায়, তা উড়ে বেড়াচ্ছে বারান্দায় পার্কে, সাঁটাও আছে মোড়ের চাটাইয়ে। অবশ্য ইদানীং কিছু মামলা হয়েছে গুগলের বিরুদ্ধে, যেখানে মানুষজন দাবি করেছেন, তাঁদের আছে ‘right to be forgotten’, অর্থাৎ নিজের সম্পর্কে তাবৎ তথ্য বারোয়ারি-উঠোনে আচারের বয়ামের পাশে ডিসপ্লে না দেওয়ার অধিকার। হয়তো কেউ একটা অপরাধে জেল খেটেছেন ১২ বছর আগে, কিংবা তাঁর বিচ্ছিরি কলহমুখর ডিভোর্স হয়েছে পাঁচ বছর আগে, অথবা তাঁকে নিয়ে অশ্লীল মিম তুড়ুক নেচেছে বছর আষ্টেক হল, এখন নতুন চাকরি বা প্রেম বা বাড়িভাড়া পেতে তিনি অতিষ্ঠ হয়ে খরখরে পাঁচিলে কপাল ঠুকছেন, কারণ সব্বাই অন্ধিসন্ধি সার্চ করে তাঁকে ক্রমাগত নিক্ষেপ করছে বাতিলের ঝুড়িতে। অতীতে যা ঘটেছিল, তা তাঁকে চির-বহন করে চলতে হবে, কখনও তিনি কেঁচে গণ্ডূষিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে পারবেন না, তাঁর নবীন প্রতিজ্ঞা নয়া প্রত্যয় নওল মনোভঙ্গি বেবাক গঁদলা হয়ে নালায় গড়াবে, একটা লোককে আত্মশুদ্ধি বা পুনঃ-স্বনির্মাণের ন্যূনতম সুযোগ দেওয়া হবে না। অনেক রাষ্ট্র যদিও অতীতের ডিজিটাল নথি মুছে ফেলার অধিকার দিচ্ছে, গুগল কিছু মামলা হারছেও, কিন্তু উল্টোদিকের যে বিশাল তরঙ্গ-শৃঙ্গটি অবধারিত দানবের মতো মঞ্চে উত্থিত হচ্ছে আত্মবিশ্বাসী ঝুঁটি ঝাঁকিয়ে— তা হল: জানার অধিকার। আমি যাকে অফিসে নেব, কেন তার ট্র্যাক রেকর্ড ও বেলাইন হওয়ার আখ্যান গোটাটা জানতে পাব না? আমি যাকে বাড়িতে ঢোকাব (বা আরও বড়: জীবনে প্রবেশাধিকার দেব), তার পূর্ণ অতীত-জীবনটা আমার সামনে কেন টিক ও ক্রস দেওয়ার বাক্স সাজায়ে লাল-পেনের অপেক্ষায় বেডকভারে শুয়ে থাকবে না? একটা লোককে কেন তার কৃতকর্ম গোপন করার সুযোগ দেওয়া হবে? কে কবে নিজেকে শুধরে ডেলি ধ্যানে বসছে সেই অনুমানে আমি চোরকে করব কেয়ারটেকার, ধর্ষকের সঙ্গে গড়ব অনুরাগের সম্পর্ক? নতুন করে নিজেকে খুঁড়ে উপকারী গাছ পুঁতলে ভাই অন্য এলাকায় সেসব ইতিবাচক ড্রামা (নেপথ্যে গণসঙ্গীত) মচাও, আমাকে শান্তি ও স্বস্তিতে থাকত দাও জ্ঞানের, স্বচ্ছতার, অবগতির অঞ্চলে। কবেকার সব নভেলে নাট্যে সিনেমায় অবধি অতীত পাঁইপাঁই উড়তে উড়তে ঠিক ছুঁয়ে ফ্যালে দেশান্তরী পেশান্তরী বেশান্তরীর টিকি, সবেগে ‘ধাআআপ্পা!’ অন্তে ঠিক তাকে নামিয়ে নিয়ে যায় প্রারব্ধের হাঁ-গত্তে, আর এই যুগে, এই সর্বজ্ঞতার সিনসিনারির বিস্ফোরণের কালে, সে কিনা নিজেকে লুকিয়ে কুঁচকে সোফার তলায় বেসিনের খাঁজে লেপটে ফেলবে, ওদিকে আমি নজর সরিয়ে ভাবব ওয়াঃ অজ্ঞতার কী গ্ল্যামার, না-জানার কী চার্ম, শুধু বর্তমান দিয়ে একটা মানুষকে বিচার করার মধ্যে অধিক মানবিকতা? সুবিধে পেয়ে পায়ে ঠেলার মধ্যে মহত্ত্ব কোথায়? যেচে ঠকার মধ্যে নির্বুদ্ধিতার বদলে উদারতা শুঁকছে কোনজন?
যে মোবাইল সারাক্ষণ পকেটে ওথলাচ্ছে, পরম বান্ধব পার্মানেন্ট সহকারী প্রকাণ্ড বোর-বিনাশী, প্রতি দু’সেকেন্ড অন্তর থাবড়ে দেখে নিচ্ছি চিরসখা ঠিকঠাক অধিষ্ঠান করছে না গাঁটকাটা গেঁড়িয়ে দিল, তাকে আজ বাদে কাল অমোঘ ‘ট্র্যাকিং-যন্তর’ হিসেবে কাজে লাগাবে (অনেকের মতে ইতিমধ্যেই লাগাচ্ছে, zানতি পারো না) সরকার ও অন্য ক্ষমতা-সেন্টার, একেবারে কড়াক্রান্তি গুনেগেঁথে রেকর্ড করে রাখবে সব গতিবিধি, সমুদয় কথোপকথন, প্রতিটি নড়াচড়া— তা জেনে কেউ কেউ শিউরে উঠলেও, অনেকে বলছে, ‘ধুত!’ যাকে আরেকটু মানসিক আলস্য দিয়ে সাঁতলালেই পাই: ‘হোক না!’ তাদের সমর্থন সাপটে নিয়ে রাষ্ট্র বলবে, বাঃ, তোমার হোয়াটসঅ্যাপে চোখ না বোলালে, তোমার ঘনিষ্ঠ সংলাপে আড়ি না পাতলে, কোথায় যাচ্ছ কার সঙ্গে মিশছ সবটা ডেবিট-ক্রেডিটে ছকা না থাকলে, আমি টেররিজম রুখব কী করে, দেশদ্রোহিতাকে অঙ্কুরেই মুড়িয়ে দেব কী উপায়ে? এ ওয়ার্নিং প্রায় সব মহাজন দিয়ে গেছেন, দেশের বিরুদ্ধে কে কী চক্রান্ত ভাঁজছে, তা জানার অজুহাতে রাজারাজড়ারা পারলে প্রত্যেকের স্বপ্নেও ক্যামেরা পুঁতবে, যাতে কোনও মানুষের কোনও চিন্তা শাসকদের চেনা ও অনুমোদিত গৎ ছেড়ে অন্য সুরে বাজলেই, কড়াৎ কড়কানো যায়। যাতে অধীনস্থ ম্যাপের গোটাটাই এক কম্যান্ডে ঘাস-বিচুলি-ঘাস প্যারেডে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে ও তাকেই শ্রেয় মনে করে। সব লোক সারাদিন কী ভাবছে, তা জেনে ফেলাই শাসকের চূড়ান্ত অর্গ্যাজম। কারণ সিসিটিভি নাগরিকের মুখের চেহারা স্ক্যান করতে পারলেও, ভাবনার নিসর্গ পড়তে পারে না, কম্বল-ধোলাই একটা লোকের খুলি দুমড়ে দিতে পারলেও, খুলির ভেতরের স্রোত পাকড়াতে পারে না। কিন্তু লোকটার ডাইরিটা ফেসবুকে, ফ্যান্টাসিগুলো হোয়াটসঅ্যাপে (বা নেট-সার্ফিং হিস্ট্রিতে), চকিত ব্রেন-ঝলক ইনস্টাগ্রামে, অসন্তুষ্ট অভিযোগাবলি আড্ডায়, ক্ষোভ ও খিস্তি সান্ধ্য বার-এ, নিষিদ্ধ স্বগতোক্তি বাথরুমে— সবটাই যদি টকাস টকাস পুলিশ বা খোচড় বা পাহারোলা বা শাহেনশার লোমশ থাবার নখদর্পণে স্ক্রোল করতে থাকে, তাহলে বশে রাখা জলভাত। তাই মানুষের জীবন ক্রমশ হবে মাইক্রোস্কোপের তলায় অ্যামিবার ন্যায়, ল্যাবরেটরির সার্চলাইটের নীচে গিনিপিগের প্রায়। এখনই তা-ই হয়ে এসেছে, অনেকটাই, এবং তাতে আমাদের আপত্তি আছে কি? গিনিপিগ কি জানে সে পরাধীন? অ্যামিবা কি জানে সে চক্ষুবন্দি? জানলেও কি তারা প্রকৃত গাঁইগুঁই করবে, যদি খেতে পায় নধর গাজর (অ্যামিবা কী খায় জানি না)? এয়ারপোর্টে যখন ধমকধামক ও সাংঘাতিক বদ-ব্যবহার সইতে সইতে হাত-পা ছেতরে থতমত পদক্ষেপে যাই-আসি, আমরা কি মনে-মনে বলি না, বাপ রে, এমনই তো দমন-বাচক দাপট হবে, নইলে এরা জাতীয় সুরক্ষা বজায় রাখবে কী করে, বাঘা উগ্রপন্থীর দাড়ি চুমরে বোম টসকে নেবে কী উপায়ে? এই ভয়টা যদি সবার মনে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, মাথার খুশকি থেকে পায়ের টুসকি না জানলে গণখুন আটকাতে পারব না, সম্ভাব্য উগ্রপন্থীকে আগে থেকে জেলে ভরতে পারব না, চরমপন্থী শিক্ষার আড়ত গুঁড়িয়ে দিতে পারব না, ফিসফিসে কনস্পিরেসির আখড়া রেড করতে পারব না— তখন লোকে সেধে ছুট্টে আসবে চড়া টর্চের আওতায়, আঙুলের ছাপ চোখের ছাপ থাইয়ের আঁচিলের মাপ উত্তেজিত যৌনাঙ্গের তাপ যেচে দিয়ে আসবে পাড়ার কোণে প্রহরা-কমিটির কাছে, শৌচালয়ে ঢুকতে গেলে না চাইতেই দেখিয়ে নেবে আধার কার্ড।
এবং সর্বোপরি, ‘অ্যাঁ! আমার সব তথ্য অন্যে জেনে নিচ্ছে!’ ধারণার প্রাথমিক শক কেটে গেলে বোঝা যাবে, তা ছিল নিতান্ত অনভ্যাসের, নতুনত্বের ঝাঁকুনি। জেনে নিলে অসুবিধে কোথায়? তা জেনে কিছু বাণিজ্যিক সংস্থা যদি বিরাট লাভ করে (কারণ সহস্র ক্রেতার উৎসাহ-প্যাটার্ন সে বুঝতে পারছে সার্ভে ছাড়াই), আর রাষ্ট্র যদি অনেকটা নিশ্চিন্ত বোধ করে (কারণ সে চিহ্নিত করছে তার পক্ষে বিপজ্জনক ভাবনা), তাহলে সাধারণ মানুষের সত্যি কী এমন ক্ষতি হচ্ছে? সে তো ‘ইস, আমার বেশ তিন কোটি টাকা থাকত’ আর ‘হেহে, শোভন-বৈশাখী কী বিচ্ছিরি নেচেছে!’-র বাইরে খুব কিছু ভাবে না। একটা গড়-লোকের সব মেল বা সব হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ কেউ পড়ে নিলে ঝামেলা কীসের? খুব বেশি হলে তার পরকীয়া বা আধা-পরকীয়ার কথা কেউ জেনে যাবে, চারটে অশ্লীল যৌন মেসেজ প্রকাশ্যে ছলকাবে (স্যালারির অঙ্ক আর সেক্সের আকাঙ্ক্ষা ছাড়া তার প্রগাঢ় গোপন আছেটা কী? আর আজ বাদে কাল যদি সব লোকের অসভ্য চিঠি সবাই পড়ে ফ্যালে এবং সক্কলের সাড়ে তিনটে সঙ্গমদৃশ্য ইউটিউবে প্রত্যেকেই দেখে ফ্যালে, তখন ব্যক্তিগত পবিত্রতা নিয়ে শুচিবাইও বেমালুম অন্তর্হিত হবে)। এবং সরকার অতটা ছিঁচকে নয় যে হরিপদ কেরানির ভুল-বানান-ভর্তি সেক্সটিং সাইটে টাঙিয়ে রাখবে। ক্ষমতায় যারা থাকে, তাদের দুশ্চিন্তা অন্য। কেউ কি ভোট বানচাল করতে চাইছে? এমন কথা বলে বেড়াচ্ছে যা এই সরকার সম্বন্ধে মন বিষিয়ে দেবে? কেউ কি একটা সংগঠন তৈরি করছে, জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কোনও গ্রামে গিয়ে গরিবদের কিছু বুঝিয়ে সংঘবদ্ধ করছে, কোথাও কি বিদ্রোহ উসকে তুলছে? কেউ কি অমুক দলকে তমুক মুখ্যমন্ত্রীকে সমুক প্রধানমন্ত্রীকে গমুক পাড়ামস্তানকে চিহ্নিত করছে দাঙ্গাবাজ, গণ্ডমূর্খ, গরিব-বিরোধী, বিজ্ঞানশত্তুর, পরিবর্তনরোধী হিসেবে? কেউ কি চলতি চিন্তাভাবনার ছাঁদ ভেঙেচুরে, প্রতিষ্ঠিত আবক্ষ মূর্তি গুঁড়িয়ে দিয়ে, বিকল্প খরখরে ছাঁচ এনে বসাতে চাইছে? এসব কাজ করলে আজ বাদে কাল পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয়, তা চিরকালই সকলেই জানে, ১৮৭৫-এও জানত। আর এরা ধরা পড়লে ফেসবুকে এট্টু দুঃখু-দুঃখু সংগ্রাম প্রচার করে নিজের কেদারায় বসে পটেটো চিপস চাখতে হয়, সে নামতাও দিব্যি সরল। তাহলে সত্যিই যদি বিগ ব্রাদার এ ধরায় অবতীর্ণ হন এবং সব্বাইকে তাঁর লাখ লাখ জ্বলন্ত রেটিনার তলায় রেখে আপাদমাথা ন্যাংটাপুটো করে পড়ে ফেলেন, প্রত্যেকের রোজনামচা ও মুদ্রাদোষ তাঁর নোটপ্যাডে নিখুঁত খচিত থাকে, তাহলে কী এমন মহাভারত পুনর্লিখিত হচ্ছে, কী এমন রামায়ণ ডিগবাজি খাচ্ছে?
খুব অন্যরকম চিন্তাভাবনা পৃথিবীতে রইরই রেলায় ঘুরে বেড়াতে পারলে হয়তো বিশ্ব অনেকটা বদলাত, (তাও খুব চকিতে নয়, এবং দীর্ঘমেয়াদে সে-বদল কদ্দূর টেকসই হত, তাও সন্দেহের) আর আখেরে মানবজাতের উন্নতি হত, কিন্তু মানুষ তো প্রধানত স্লোগান হাতবোমা হাঙ্গামা বিপ্লব গল্পহীন-চলচ্চিত্র প্রথা-ভ্যাংচানো সঙ্গীত চায় না। সে চায় স্বস্তি, স্বাচ্ছন্দ্য, শান্তি, শপিং, স্থিতাবস্থা। সংক্ষেপে, যেমন চলছে তেমন। পুলিশ পাশের বাড়ির ছেলেটাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলে সে পৌরাণিক যুগ থেকেই জানলার আড়ালেই লুকোয়, মোটে বুক চিতিয়ে প্রশাসনের সঙ্গে কোঁদলে জড়ায় না। তাই নজরদারি যদি পাঁইপাঁই বৃদ্ধি পায়, আর ফলে বেড়ে যায় ধরপাকড় চড়থাপ্পড়ও, লোকের মনে হবে, কী দরকার ছিল সোজাপথে না থেকে পেছনপাকামো মারার? বারবার বারণ করল জ্যাঠামশাই, তবু ভিড়তে গেল গুজুরদুজুরের দলে, পাতলা প্যামফ্লেট ছড়াল দুপুরের গলতায়। ভেবে পাবলিকের শিরদাঁড়া এট্টুনি শিরশিরিয়ে উঠবে হয়তো, কিন্তু তারপরেই নিরাপত্তার ওম এসে ঘিরে নেবে, যাক বাবা, আনরুলি এলিমেন্ট ভালই সাফাই হচ্ছে সমাজের লোমপত্তরে চিরুনি আঁচড়ে। আর, ধরা পড়ার ভয় বেড়ে গেলে যা হয়, হাত তুলে মুন্ডু বাড়িয়ে ডিং মেরে প্রচারের হিড়িক পড়ে যাবে: এই এই দেকুন হুজুর আমি কিন্তু একটিবারও পিছলোইনি অ্যাত্তটুক ছ্যাঁচড়াইনি নিবিড় নিয়মে নিয়ত আনুগত্যে নিমজ্জিত রয়েছি স্যার ম্যাডাম মায়-বাপ। আমার ছেলে এলেবেলে আমার ডটার হ্যারি পটার আমার পত্নী মাইক্রোযত্নী আমার বন্ধু পয়ারছন্দু, আপনার স্পাই-কে আমরা খাওয়াব পায়েস, পালিশ করে দেব উদ্যত বন্দুক। সেই নতুনতর নর্মাল-এ, প্রায় সকলেই যখন হয়ে উঠবে নির্বিবাদী ক্লিশেপন্থী নরম নকুলদানা, সব ‘না না’ ঘুচে ফুটে থাকবে কানা খানা গানা ঘানা, সার্বিক সামগ্রিক সামূহিক নজরদারিকে তারপর এক সময় মনে হবে অক্সিজেনের মতোই প্রয়োজনীয়, ভ্যাকসিনের মতোই জরুরি। কারণ তা আছে বলেই আমরা মাঝরাত্তিরে বেড়াতে পারছি রাস্তায়, ব্রিজ পেরোতে পারছি হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ার ঝুঁকি ছাড়াই, ঘুমোতে পারছি বর্ডার হতে মিসাইল আছড়াবে না এই আশ্বাস বগলে। চাকরি পাচ্ছি, ক্যাফেতে ল্যাপটপ খুলে পা নাচাচ্ছি, সন্ধেবেলা মুরগির ঠ্যাং খাচ্ছি সসে চুবিয়ে, জগতে কিচ্ছুটি কম পড়িতেছে না, বড়জোর সরকার জনজাতির জমি কেড়ে ব্যবসায়ীকে দিলে প্রতিবাদী জমায়েতের সম্ভাবনা কমে আসছে হু-হু করে, তা ওসব নিয়ে ভেবে লাভ নেই, বহু মিছিলমিটিং হল ভাই ইতিহাস জুড়ে, বহু মুষ্টি উত্তোলিত হল হুজুগের মলাট মুড়ে, হৃদয় খুঁড়ে ব্যর্থতার ডকুমেন্টারি জাগানো ছাড়া দ্বিতীয় ফলাফল বিশেষ দেখা গেল না। অরওয়েলের ওয়ার্নিং ডকে উঠুক, বিগ ব্রাদারের চরণতলে আশ্রিত হয়ে আমরা পরম আরামের শ্বাস ছাড়ি আর বলি, জয় চোখপুলকের জয়, নেত্রবাজির জয়! তব দৃষ্টি সতত থাক জাগরূক, আমারে ঘিরুক কখনও মারুক, ধন্য রয়েছি আঁখিদলতলে, খরদর্শক হে। অপলক অবলোকন-হ্যাবিটে, একঘাটে আনো ফক্স ও ব়্যাবিটে, গোচর-পরিধি মেনেই বড়ি দিই, নাহি ছোঁকছোঁক হে। ব্যসনে শ্মশানে ঘাগু প্রিকশানে জাগো মেগা-চোখ হে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী