সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের যেদিকটা দর্শকদের প্রধানত আকর্ষণ করে তা হল একটা ঠাসবুনোট কাহিনি। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে যেহেতু এই কাহিনির বিন্যাস ঘটে, তাতে থাকে দৃশ্য ও শব্দের সমন্বিত ছন্দ ও গতি, যা সৃষ্টি হয় সম্পাদনার মধ্যে দিয়ে।
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রের নানান দিক নিয়ে প্রচুর আলোচনা হলেও সম্পাদনা নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা মনে পড়ে না। এর প্রধান কারণ হল সম্পাদনার মূলমন্ত্র– যা প্রত্যেক সম্পাদক অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন। সম্পাদনা এমন হবে, তা যেন নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ না করে। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে এটা ভীষণভাবে সত্য। সম্পাদনার মসৃণতা অনস্বীকার্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্পাদনার আপাত সারল্য লক্ষণীয়। খানিক ব্যতিক্রম ওঁর কলকাতাভিত্তিক তিনটি ছবি।
সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে সম্পাদনা সুচারুভাবে কাহিনির বিন্যাস ঘটায়। সমস্ত ঘটনা খুবই মসৃণভাবে এগিয়ে চলে। শটের পর শট জুড়ে মুহূর্ত তৈরি হয়, দৃশ্য গঠন হয়, এবং পর পর দৃশ্য জুড়ে সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়। এসবের মূলে থাকে বিশেষভাবে সম্পাদনা নিয়ে চিন্তাভাবনা। সম্পাদনা-কক্ষে যাওয়ার আগেই শট কাটা ও জোড়ার পরিকল্পনা তৈরি হয়ে থাকত। অর্থাৎ শুটিং-এর সময়েই সম্পাদনার কথা মাথায় রেখে শট নেওয়া হত।
সত্যজিৎ রায় আধুনিকমনস্ক চলচ্চিত্র-নির্মাতা হলেও, ওঁর ছবিতে সম্পাদনার তাত্ত্বিক প্রয়োগ বা প্যাঁচ-পয়জার কখনওই চোখে পড়ে না। সরল cause and effect সম্পাদনার প্রয়োগই মূলত লক্ষণীয়। উনি বিশ্বাস করতেন দর্শক-অনুকূল চলচ্চিত্রে। কোনও technical প্রয়োগে দর্শকের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি তিনি অপছন্দ করতেন। তবে এর খানিক ব্যতিক্রম ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘সীমাবদ্ধ’ ও ‘জন অরণ্য’ এই তিন ছবিতে পাওয়া যায়।
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে সম্পাদনার চমকপ্রদ প্রয়োগ ধরা পড়ে। এই ছবিতে সম্পাদনা অনুসরণ করে মূল চরিত্রের চিন্তাস্রোতকে। ওঁর অন্যান্য চলচ্চিত্রের তুলনায় এ ছবিতে সম্পাদনার গতি বিশেষভাবে ক্ষিপ্র। এ যেন মূল চরিত্রের ভাবনাচিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা। মানসিক গতি যখন ধীর, সম্পাদনার গতিও তদনুরূপ। উদাহরণ, ধৃতিমান চ্যাটার্জির সঙ্গে জয়শ্রী রায়ের দৃশ্যগুলি। এইসব দৃশ্যে সম্পাদনার গতি বাকি ছবিটার তুলনায় ধীর লয়ের। মূল চরিত্রের একটা মানসিক ছটফটানি আছে, যেটা অনেকগুলি দৃশ্যে সম্পাদনায় প্রকাশ পায়। শহুরে গতি ও সময়ের অস্থিরতাও সম্পাদনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়।
ছবির শুরুর দিকে আমরা দেখি, প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থর বাসযাত্রা; বোটানিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া-র আপিসে ইন্টারভিউয়ের জন্য অপেক্ষা ও লক্ষ করা পরনের প্যান্ট ছেঁড়া; প্যান্ট রিফু করতে যাওয়া। ছোট ছোট শট দিয়ে এই দৃশ্যগুলি গাঁথা হয়। শটের দৈর্ঘ্য ছোট হওয়ায়, দৃশ্যগুলি সংক্ষিপ্ত হয় ও গতি তৈরি করতে সক্ষম হয়। এই গতি সারা ছবিতে ধরে রাখা হয়। এসব দৃশ্যের মধ্যে এক ধরনের প্রাত্যহিকতা লক্ষণীয়, যার মাঝে কল্পনা ও চিন্তাভাবনার মুহূর্তগুলি স্বল্প পরিসরে স্থান পায়। সিদ্ধার্থর প্যান্ট যখন রিফু হচ্ছে তখন dissolve করে দৃশ্যান্তর ঘটে ও তিনটি স্থিরচিত্র আসে— স্যুট পরা সিদ্ধার্থ সারি সারি ফুলের মাঝে greenhouse-এর একদিকে দাঁড়িয়ে। এ তিনটি স্থিরচিত্রের সঙ্গে চলতি দৃশ্যের কোনও সম্পর্ক নেই, আছে শুধুমাত্র সিদ্ধার্থর ভাবনার সঙ্গে। সিদ্ধার্থ কল্পনা করে বোটানিক্যাল সার্ভেতে চাকরি পাওয়ার পরে তার অবস্থান। দৃশ্যটি শুধুমাত্র যে ভাবনার বিষয়কে প্রকাশ করে তা নয়, কালক্ষেপ ঘটাতেও সাহায্যও করে। এই তিনটি স্থিরচিত্রের পরেই আমরা ফেরত আসি দর্জির দোকানে, রিফুর কাজ শেষ। এখানে dissolve কাল অতিবাহন হিসাবে ব্যবহৃত হয় না, হয় চরিত্রের মানসিক দৃশ্যপটে প্রবেশ করতে। দর্জির দোকান থেকে কাট করে দৃশ্য পরিবর্তন হয় ইন্টারভিউ-কক্ষে। সময় সংকোচনের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কাটের এই ভাবনা দৃশ্য পরিবর্তনকে দেয় গতি ও চলচ্চিত্রে সঞ্চার করে গতিময়তা।
আরেকটি ছোট দৃশ্য। সিদ্ধার্থ রাস্তা পারাপার করবে বলে ট্র্যাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়েছে। একজন নারী রাস্তা পার হচ্ছে। তাকে দেখে ফেলে আসা মেডিক্যাল কলেজের একটি ক্লাসের কথা মনে পড়ে যায়। রাস্তায় থাকাকালীন কলেজের শিক্ষকের পড়ানোর শব্দ শোনা যায়। দ্রুত কাট করে ক্লাসের ছোট একটি দৃশ্য দেখে আমরা আবার ফেরত আসি রাস্তায়। এই ক্ষিপ্র দৃশ্য পরিবর্তন ও ধ্বনির ব্যবহার সমগ্র দৃশ্যে উত্তেজনা সঞ্চার করে। সম্পাদনার এরকম তীক্ষ্ণ প্রয়োগ সারা ছবিতে ছড়িয়ে আছে। কোথাও আবার কাট প্রয়োগে চিন্তার আকস্মিকতা ধরা পড়ে ও চমক সৃষ্টি করে। সিদ্ধার্থ তার বোনের বসের বাড়িতে বসার ঘরে অপেক্ষা করছে। ঘরের সিলিং পাখা বন্ধ। খানিক অপেক্ষার পর বসের ঘরে প্রবেশ। সিদ্ধার্থ ঝট করে পিস্তল বার করে তিন বার গুলি চালায়। ঘটনার এই আকস্মিকতার রেশ কাটার আগেই সিলিং পাখা চলতে শুরু করে। বস শুরু করে কথোপকথন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সম্পাদনার এই প্রয়োগ একটি চমক সৃষ্টি করে। গুলি করার সংক্ষিপ্ত দৃশ্যটি সিদ্ধার্থর মনের ভাবনা বুঝতে সাহায্য করে। এবং স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দর্শককে দ্বিধায় ফেলে।
‘সীমাবদ্ধ’ ছবিতে শুরুর পরিচয়লিপি-দৃশ্য অবধি সম্পাদনার চলন এক ধরনের। এখানে split frame ও অন্য optical-এর ব্যবহার বিশেষভাবে নজর কাড়ে। ছবির শুরুতে প্রধান চরিত্রের voice over দিয়ে চরিত্র উপস্থাপন হয়। শট পরিবর্তন ও দৃশ্যবিন্যাস ঘটে voice over-কে অনুসরণ করেই। ছবির শুরু employment exchange-এর একটি বোর্ডের শট দিয়ে। তারপর বেশ কিছু শট আসে অপেক্ষারত লোকেদের। এখানে সম্পাদনার একটা বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়োগ দেখতে পাই। প্রত্যেকটি কাট হয় একটা করে wipe দিয়ে। এই ছোট দৃশ্যে প্রতিটি শটে ক্যামেরার সামনে দিয়ে গাড়ি চলাচল করে। গাড়ি যাতায়াতের সঙ্গে ছন্দ মিলিয়ে কাটগুলো এমনভাবে প্রয়োগ করা হয় যে, সম্পাদনা প্রায় ধরা পড়ে না। মনে হয় গাড়ির চলাচলের মধ্যেই যেন শট পরিবর্তন হচ্ছে। এ ধরনের সম্পাদনা একটি বিশেষ গতি ও মসৃণতা গড়তে সাহায্য করে।
Voice over চলাকালীন কালক্ষেপ বোঝাতে freeze frame ও mosaic technique-এর প্রয়োগ দেখতে পাই। এটি ঘটে যখন শ্যামলেন্দু নিজের কর্মজীবনের উন্নতির কথা voice over-এ বলে।
পরিচয়লিপি শুরু হয় split screen দিয়ে। এতসব সম্পাদনার technique-এর প্রয়োগ এই সমগ্র দৃশ্যটিতে corporate তথ্যচিত্র তৈরির আমেজ দেয়, যা পুরো ছবির উপস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখে।
ছবির পরবর্তী অংশে সম্পাদনার ছন্দ গড়ে ওঠে প্রধান চরিত্রের জীবনযাত্রা কেন্দ্র করে। ঘটনাপ্রবাহের গতি পরিবর্তন সম্পাদনার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। প্রতিটি কাট কাহিনিকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। মেদহীন ও ক্ষুরধার সম্পাদনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। অফিসের কিছু ছোট ছোট দৃশ্য দিয়ে কাহিনিবিন্যাস ঘটে। এসব দৃশ্যে সম্পাদনার গতি অনেকটাই ক্ষিপ্র, বাড়ির ভিতরের দৃশ্যের তুলনায়। অফিস-দৃশ্যের সম্পাদনায় corporate চাঁচাছোলা স্বাদ আছে। সংক্ষিপ্ত মুহূর্ত দিয়ে গঠন করা হয় অফিস পরিমণ্ডল। সে তুলনায় বাড়ির দৃশ্যে সম্পাদনার লয় অনেকটাই ধীর। শট ও দৃশ্য তুলনামূলকভাবে খানিক দীর্ঘ।
চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি ছোট দৃশ্য— অফিসে শ্যামলেন্দু একটি গুরুত্বপূর্ণ ফোন পায়। ফোনের অন্য পারে কে তাকে আমরা দেখি না, দেখি ও শুনি শুধু শ্যামলেন্দুর প্রতিক্রিয়া। তিনটে ছোট ছোট ক্লোজ শটে তার কথা শুনতে পাই। এই কথাগুলি নাটকীয় ভাবে একটা কি দুটো শটেও বলা যেত। কিন্ত তা না করে এখানে প্রয়োগ করা হয়েছে সম্পাদনার নাটকীয়তা। দ্রুত কাটের মাধ্যমে ও ক্লোজ শটের ব্যবহারে পরিস্থিতির গুরুত্ব খুব সহজেই দর্শকদের কাছে পৌঁছনো হয়।
‘জন অরণ্য’ শুরু হয় ধীর লয়ের পরিচয়লিপি-দৃশ্য দিয়ে। একটি পরীক্ষাগারের টুকরো-টুকরো কিছু শট দিয়ে তৈরি। দৃশ্যের প্রায় শব্দহীনতা ভাঙে হাসির রোলে। এই হাসির শব্দের সঙ্গে দেখা যায় কিছু স্থিরচিত্র এবং শুরু হয় নেপথ্য-সংগীত। স্থিরচিত্রগুলি ছাত্রদের হাসিমুখের। সম্পাদনার এই চিন্তায় তৈরি হয় এক সুন্দর staccato মুহূর্তের। পরবর্তী কয়েকটি শটে freeze frame-এর প্রয়োগও থাকে। পুরো ছবিতে সম্পাদনার টানটান গতি থাকলেও, কখনও তাড়াহুড়ো চোখে পড়ে না। এর মূলে হল চিত্রনাট্যের বাঁধুনি। সম্পাদনার বেশির ভাগ চিন্তাভাবনার সূত্র সুপরিকল্পিত শট বিভাজনে।
একটি মন্তাজ দৃশ্য। মুখ্য চরিত্র সোমনাথ বিভিন্ন চাকরির জন্য দরখাস্ত করছে ও সাক্ষাৎকার দিচ্ছে। মন্তাজের নিয়মানুসারে নানান শট দিয়ে এই দৃশ্য সাজানো হয়। সাক্ষাৎকারের জায়গায় এসে সম্পাদনার এক সুন্দর নিদর্শন পাই। প্রশ্নগুলো একতরফা শোনা যায়। পর পর প্রশ্ন শুনি ও ক্রমশ প্রশ্নের দৈর্ঘ্য কমতে থাকে। শেষে প্রশ্ন monosyllabic হয়ে ওঠে এবং এই মন্তাজ-দৃশ্য শেষ হয় সম্পূর্ণ একটি প্রশ্ন দিয়ে। সম্পাদনার এই ভাবনা সাক্ষাৎকার দৃশ্যে প্রয়োগ সত্যিই চমকপ্রদ। গতিময় একটি মুহূর্ত তৈরি করে দেখানো হয়েছে সাক্ষাৎকারের আধিক্য।
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’র থেকে ওঁর অন্যান্য ছবির সম্পাদনার ধরন খানিক আলাদা, ‘অপরাজিত’ ছাড়া। ‘পথের পাঁচালী’তে অনেক ক্ষেত্রে এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে যেতে dissolve ব্যবহার করা হয়েছে। এই dissolve-এর প্রয়োগ মূলত হয় দুই দৃশ্যের মাঝে বড় সময়ের ব্যবধান বোঝাতে। ‘অপরাজিত’তে dissolve-এর আধিক্য দেখা যায়। Dissolve ও fade in-fade out দিয়ে দুই দৃশ্যের মাঝে সময়ের ব্যবধান বোঝানো হয়েছে। এখনকার চলচ্চিত্রের চলনের নিরিখে দেখলে এই dissolve-এর ব্যবহার খানিক বেশিই বলে মনে হয়। কিছু ক্ষেত্রে কাট ব্যবহারে অসুবিধা হত বলে মনে হয় না— যেমন, হরিহরের দুধ পান করার দৃশ্য। ঘরের ভিতর থেকে হরিহর বাইরে আসে দুধ পান করতে করতে, ভিতর ও বাইরে একটি করে শট, মাঝখানে dissolve। কাট হলে কোনও অসুবিধা হত না, কেননা এখানে সময়ের তেমন কোনও ব্যবধান নেই।
পরবর্তী ছবিগুলিতে dissolve-এর প্রয়োগ অনেক সীমিত। সময়ের ব্যবধান বেশি থাকলেও দৃশ্যান্তর ঘটেছে কাট-এর প্রয়োগে। এতে নিঃসন্দেহে যোগ হয়েছে চলচ্চিত্রে গতিময়তা ও সম্পাদনায় আধুনিকতা।