রাস্তায় রাস্তায় প্যান্ডালের বাঁশ পড়ছে, হোর্ডিং-ও চিতিয়ে ‘মা দুগ্গা বুকে আছে করবি আমার কী’, কোভিড-রহিত পুজো এই এই স্টেজে সাড়ম্বর ডাইভ। একটা অ্যাড-ফিল্ম রটাচ্ছে, কোভিডের হাতি গেট দিয়ে প্রায় বেরিয়ে গেছে, শুধু ন্যাজটা নাকি বাকি। টিভি চ্যানেলও তালিবানদের নিয়ে অধিক ব্যস্ত। কিংবা বিরাট কোহলির অফ-ফর্ম। খেলা ঘুরতে অবশ্য লাগে একদিন বা আধবেলা, যখন আছড়ে পড়বে তৃতীয় তরঙ্গ বা সপ্তদশ, সঙ্গে আসবে ডেঙ্গু বা সমধর্মী আশ্চর্য জ্বর, অথবা পঙ্গপাল কিংবা অরণ্যাগ্নি, বা নেড়ি কুকুরেরা মিসাইলের মতো ছুটে গিয়ে প্রত্যেকে দশ পিস ঠ্যাং কটাং কামড়ে ধরবে। এর মধ্যে কোথাও রোগ বাড়ছে কোথায় ভ্যাকসিনেশন, কোথাও বাচ্চারা বিপন্ন কোথাও বুড়োরা, আর প্যারালিম্পিক্সে ভারতের মেডেল গুচ্ছের। নরেন্দ্র মোদী অবধি সব্বাইকে খেলাধুলোয় হইহই ঝম্প মারতে উদ্দীপনা জোগাচ্ছেন, ফুল খেলবার দিন অদ্য, নেমে পড়ো জোয়ানমদ্দ। প্যারালিম্পিক্সের সফলদের নিয়ে নিশ্চয় সংবর্ধনা সমারোহ হবে, হওয়াই উচিত, কিন্তু ফের খবর আসবে অমুক এয়ারপোর্টে তমুক এয়ারলাইনস প্রতিবন্ধী দেখলে প্লেনে উঠতে দিচ্ছে না। দোকানপাট ডিজাইনের সময় মোটে ভাবা হবে না হুইলচেয়ার-সওয়ারির কথা, বাসট্রামের ঢালু সিঁড়ির বন্দোবস্ত তো ছেড়েই দিলাম। প্রতিবন্ধীর সিটে বসে ‘মোবাইলের দিকে চেইয়ে চেইয়ে থাকি সারাদিন তাই দেখতে পাইনি কে হাতহীন পা-হীন’ পোস্টার টাঙিয়ে দিব্যি স্টপের পর স্টপ আরামসে চলে যাবে লক্কা পায়রাগণ। তাতে অবশ্য বিরাট কিছু এসে যায় না, এই তো অলিম্পিক্সের মেয়ে-অ্যাথলিটদের নিয়ে কত্ত নেত্য, এদিকে ছত্তিসগড় হাইকোর্টের এক বিচারক রায় দিয়েছেন, স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধেও স্বামী তাঁকে যৌনভোগ করতে পারবেন। জোর খাটাতে পারবেন। স্ত্রীর বয়স ১৮ বছরের উপরে হলে, পুরুষের জবরদস্তিতে কোনও আইনি বাধা নেই। তা নেই, কিন্তু এই আইন যে থাকতে পারে না, তা নিয়ে আন্দোলন বা বোধোদয় কই? যে-আইন পুরুষকে বৈবাহিক ধর্ষণের অনুমতি দেয়, তা সভ্য রাষ্ট্রে থাকবে কেন? পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষ হয়ে জন্মালে এমনিতেই বেধড়ক মজা, এইমার্কা আইন রমরম করলে তা দেড়া, কারণ এতে স্পষ্ট: বিয়ের পর থেকে নারীর আপাদমাথা শরীর স্বামীর সম্পত্তি। ক্রীতদাস প্রথারই শামিল। প্রেমে খুব প্রচলিত, নারীশরীরের বিভিন্ন স্থানে হাত রেখে প্রেমিকের ‘এটা কার?’, কম্পালসরি কোমল উত্তর আসে ‘তোমার’। কিন্তু এ নেহাত কাদা-কাদা আহ্লাদ, সত্যিই ওই আঙুল স্তন নিতম্ব ননীত্বক তো পুরুষ-সঙ্গীর নয়, ওতে ফোসকা পড়লে পুরুষে উউফ চেঁচাবে না, ওতে চাবুক হানলে পুরুষের নার্ভ মচকে উঠবে না। একটা লোকের শরীরটা তার, মালিকানা অন্যের নয়, অনুমতি বিনা তার শরীরে গুঁতিয়ে ঢুকে পড়া চলবে না চলতে পারে না, এই সরলসোজা ব্যাপারও বিস্মৃত হলে মুশকিল, এদেশকে শ্রদ্ধা করা ক্রমশ ঝামেলাসঙ্কুল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দেশমাতৃকার পানে তাকিয়ে কিছুটা হাসি পায় কিছুটা ঘেন্নায় অধরোষ্ঠ বেঁকে ওঠে। এরপর পুরুষ যদি নারীর শরীরে ‘মেরা বাপ চোর হ্যায়’ ট্যাটু দেগে দেয়, কিংবা তাকে চুবিয়ে রাখে শীতরাতে গলাজলে, আর বলে আমার সম্পত্তি আমি ব্যবহার করছি, তোর পিতাঠাকুরের কী, কে জানে কোন উপধারায় তা বৈধতা পেয়ে যাবে। এগুলো কারও যৌন উপভোগের পদ্ধতি তো হতেই পারে। বিবাহ-সংক্রান্ত আইন বদলাবদলির কথা উঠলেই সরকার স্প্রিং-মাফিক ছটকে উঠে জানায়, আহা থাক থাক, বেগড়বাই না করাই ভাল, এদেশে বিবাহ অতি পবিত্র সম্পর্ক। হক কথা, সিরিয়ালে ও সিনেমায় প্রায়ই বোঝানো হয়, স্বামী জুতো মারলেও স্বামীর কল্যাণের জন্য উপোস করা উচিতকর্ম, ঈশ্বরের কাছে টর্চারার-স্বামীর অবিমিশ্র কল্যাণ যাচ্ঞা না করলে সতীনারী বেদি হতে দুমপটাস। ‘দহন’ ছবিতে মর্মন্তুদ ভঙ্গিতে বৈবাহিক ধর্ষণ চিত্রিত, বা ‘মাত্রুভূমি’ ছবিতে নারীকে পারিবারিক সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহারের নগ্ন আখ্যান বর্ণিত, এসব জপে লাভ নেই। ও ছবিগুলোকে প্রাইজ দেওয়া হয়, আর ঘরে ঘরে সেঁধিয়ে দেওয়া হয় সম্পূর্ণ বিপরীত শোলোক, মা কালীকে পুজো করা হয় আর গোটা সমাজ মিলে উঠে ডেঁটে গোড়ালি গেঁথে দাঁড়িয়ে থাকা হয় নারীদের বুকের ওপর, জিভটা কাটার সহবত অবধি ব্যয় হয় না।
যে কোনও খবরকাগজ এলোপাথাড়ি খুলে চক্ষু বুজে আঙুল ঠেকালে তা হত্যাসংবাদ বা ধর্ষণসংবাদ, চৌর্যসংবাদ বা ঠক-ঠক-ঠক-ঠকানিসংবাদ। ৩১ অগাস্ট এক ইংরিজি কাগজের শুধু তিনের পাতাটুকু লক্ষ করা যাক। এক সংবাদে পূর্ব পুটিয়ারির এক যুবক বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করছিল, মানে টাকা চাইছিল, খুব সম্ভব ড্রাগ খাবে বলে। যুবকের মা আর বোন বউয়ের পক্ষ নেওয়ায়, মা-বোনকে সে রান্নাঘরের ছুরি দিয়ে কুপিয়েছে (মা’কে ছ’টা কোপ, তাঁর অবস্থা সঙ্কটজনক), কেরোসিনও ঢেলেছিল, কিন্তু পোড়ানোটা আর হয়ে ওঠেনি। বোনকে পেটে কোপ মেরেছে, লাথিও। বউ পালিয়ে বেঁচেছে। ওই পাতারই অন্য খবরে, সল্টলেকে এক ৩২ বয়সি যুবক ধর্ষণ করল প্রতিবেশী মহিলাকে। মহিলার সামান্য মানসিক সমস্যা আছে, তিনি বাড়িতে একলা ছিলেন, দাদারা বেরিয়েছিল, ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলা ছিল। এক দাদা বাড়ি ফিরে মহিলার বিস্রস্ত আলুথালু অবস্থা দেখে প্রশ্ন করায় তিনি নিগ্রহের কথা বলেন, বলেছেন এ-জিনিস এর আগেও যুবকটি করেছে। অবশ্য এবার বেরোবার সময় একটা ড্রয়ার থেকে হাজার দুয়েক টাকাও নিয়েছে। একই পাতার আরেক খবরে, রাজারহাটের এক কমপ্লেক্সে এক যুবক তার তিন বন্ধুর সঙ্গে ঢুকে পড়ল প্রাক্তন প্রেমিকার ফ্ল্যাটে এবং তাঁকে ধামসে পেটাতে শুরু করল। মোটামুটি থাপ্পড় আর লাথির ওপরেই চলছিল, কিন্তু মহিলার পুরুষবন্ধু এবং দিদি বাঁচাতে ছুটে এলে তাঁদেরও ধোলাই ঘটে, তখন রান্নাঘর থেকে একটা ফ্রাইং প্যানও দিব্যি কাজে লেগে যায় (রান্নাঘর, দেখা যাচ্ছে, পুরুষদেরও ‘এমপাওয়ার’ করে)। সব্বাইকে রক্তাক্ত করে, পুরুষবন্ধুটিকে লাথি ও ঘুসি মারতে মারতে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁর একটা হাত ভেঙে গেছে, অপারেশন দরকার। অবশ্য একথাও স্বীকার করতেই হবে, কাগজটির ওই একই পাতায় আছে, সিংহলি ভাইরাল গান ‘মানিকে মাগে হিথে’-তে বাংলা কথা বসাচ্ছেন বহু শিল্পী ও তেড়ে গাইছেন, ফলে ইতিবাচক কিচ্ছুই নেই বলা ভুল।
প্রথম ঘটনাটি থেকে বোঝা যায়, নিজে রোজগার না করলেও বাড়ির অন্যদের থেকে ঝাঁঝিয়ে টাকা দাবি করা যায় (নতুন নয়, এ ব্যাপার লক্ষ্মীর আলপনার ন্যায় প্রাচীন, নিম্নবিত্ত প্রায় প্রতিটি পরিবারে মেয়েরা দিনমান হাকুশ খেটে যা রোজগার করে, রাতে স্বামী মত্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে তাকে চিলুবিলু পিটিয়ে পুরোটা কেড়ে নেয়), এবং সে-টাকা না দিলে নৃশংস পেটানি তো বটেই খুনের চেষ্টা করতেও দোষ নেই, দেশলাই খুঁজে না পেলে মিশন পূর্ণ হয় না, এটুকুই যা কেয়ারলেস মিসটেক। পরের আখ্যানে প্রমাণ হয় প্রতিবন্ধীর অক্ষমতার সুযোগ নেওয়া যায় একবার নহে বারবার, এবং অসহায় নারীর (বিবাহিত স্ত্রী না হলেও) ওপর চড়াও হয়ে মৌজমস্তি বেশ পালনীয় অনুষ্ঠান, ফাউ কিছু টাকা পেলে গেঁড়িয়ে দিতে দোষ কী। তারপরের সন্দেশটি প্রমাণ করে, একবার প্রেম হয়ে গেলে নারীটি চিরকালীন সম্পত্তি, সেই প্রেম ভেঙে দিয়ে অন্যের সঙ্গে লেপটে যাওয়ার বেইমানি ঘটালে, তাকে নৃশংস পেঁদিয়ে শাস্তি দিয়ে বোঝাতে হয় দখলীকৃত বস্তুর নিজস্ব পা গজিয়ে মালিকের আওতা থেকে চম্পটের অধিকার জন্মায় না, আর সঙ্গে যদি তার বর্তমান প্রেমিকটি (বা সম্ভাব্য প্রেমিকটি) থাকে, তাহলে তাকেও যথোচিত ৪৪০ ভোল্ট শকাতে হয়। যদিও গল্পগুলির মূল থিমটা হল, মেয়েদের কাছ থেকে সুবিধে নিংড়ে নাও এবং না পেলে তাদের মারো। মারো। হাড় ভাঙো, পোড়াও, পেটের মাংস কাটো। কারণ মেয়েরা নিচু। বোধহীন। পুরুষের অধীন।
কী আশ্চর্য, ওই কাগজ বেরোনোর দিনেই আবার ভারতের সুপ্রিম কোর্টে ন’জন বিচারক নিযুক্ত হলেন, যার মধ্যে তিনজন মহিলা, যা ঐতিহাসিক কাণ্ড। সুপ্রিম কোর্টে এখন চারজন মহিলা বিচারক, যা এর আগে কখনও হয়নি। সিনিয়রিটির বিচারে এঁদের একজন, বি ভি নাগরত্নম, ২০২৭-এ হবেন চিফ জাস্টিস, সেক্ষেত্রে ভারত তার প্রথম মহিলা চিফ জাস্টিস পাবে। এখনও আইনক্ষেত্রে মেয়েদের অংশ খুবই কম (এই বছরেরই এপ্রিলে মহিলা উকিলের একটি সংগঠন সুপ্রিম কোর্টকে আর্জি জানিয়েছিল হাইকোর্টে মহিলা বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে, বলেছিল ৭১ বছরের ইতিহাসে সুপ্রিম কোর্টে পুরুষ বিচারক ২৪৭জন ও মহিলা বিচারক আটজন, এ কেন? হাইকোর্টে বিচারকের আসন ১০৮০, তার মধ্যে পূর্ণ ৬৬১, তার মধ্যে ৭৩জন মহিলা, মানে ১১%। মণিপুর, মেঘালয়, বিহার, ত্রিপুরা, উত্তরাখণ্ডের হাইকোর্টে একজনও মহিলা বিচারক নেই), দুঁদে উকিল হওয়ার বা বিচারপতি হওয়ার যে জেদ তা বহুক্ষেত্রে মা হতে গিয়ে ও সংসারে ফুলকো লুচি সরবরাহ করতে গিয়ে চুপসে হাপিশ। এক মহিলা আইনজীবীকে যখন প্রশ্ন করা হয়, ভারিক্কি কোর্টের ক’জন বিচারক মহিলা হলে তিনি সুখী হন, তিনি বলেন, সক্কলে। তাতে বহু ভুরু কুঁচকে ওঠার পর জোড়েন, সব বিচারক পুরুষ হলে যদি ভুরু না কোঁচকায়, তবে ভুরুর এ কী মুদ্রাদোষ! কে বলতে পারে, নারীরা বিচার-ময়দানে সংখ্যায় ও ভারে বাড়লে, হয়তো কতকগুলো নারীলাঞ্ছনা-বাচক আইন সংশোধিত হবে। হয়তো তখন এদেশের মন্ত্রীসান্ত্রিরা স্পষ্ট নির্লজ্জ নারীবিরোধী বা ধর্ষণ-সাফাই-ধর্মী স্টেটমেন্ট বিলোতে কিঞ্চিত হেঁচকি তুলবেন, হয়তো এক নারী-বিচারপতির সামনে কোনও স্বামী ‘বেশ করেছি রেপ করেছি করবই তো’ গাইতে জিভ গিলে ফেলবেন। হয়তো। নিশ্চিত নয়, কারণ লিঙ্গে নারী হলেই কেউ পিতৃতন্ত্রের পাঁড় সমর্থক হবেন না তার মানে নেই, আর তাছাড়া এই দেশ তো মা দুগ্গাকে মাথায় তুলে ঘুর খেতে খেতে ও তাঁর পদতলে অঞ্জলির ফুল টিপ করে ছুড়তে ছুড়তেই বউয়ের টিকি ধরে টানে মেয়ের কান কশকশ মুলে দেয়।
অবশ্য এত ভেবে লাভ নেই, এ হপ্তায় টেক্সাসে সহসা অ্যান্টি-অ্যাবর্শন আইন চালু হয়ে গেল, ১৯৭৩-এর পর আমেরিকায় এই প্রথম, যেখানে বলা হল, গর্ভিণী হওয়ার ছ’সপ্তাহ পরে আর গর্ভপাত করানো যাবে না। যার মানে দাঁড়ায়, ৮৫%-৯০% গর্ভপাতই আর হবে না, কারণ অধিকাংশ অ্যাবর্শনই এই সময়ের পরেই হয়, অনেক সময় নারীটি ছ’সপ্তাহের মধ্যে বুঝতেই পারেন না তিনি গর্ভবতী। বহু সংগঠন এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করছে, নারীদের নিজের গর্ভের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার খর্ব করতে তারা দেবে না, স্বয়ং বাইডেন বলেছেন এ অধিকার তিনি রক্ষা করবেনই। সবচেয়ে আশ্চর্য হল, টেক্সাসে বলা হয়েছে, কোনও সাধারণ মানুষ যদি জানতে পারেন কেউ ছ’সপ্তাহের পর গর্ভপাতে সাহায্য করছে, তবে সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করতে পারেন, আর সেই মামলা জিতলে তাঁকে দেওয়া হবে ১০ হাজার ডলার। মানে, ব্যক্তিস্বাধীনতার তীর্থক্ষেত্রে এখন সাধারণ লোককে পুলিশি ভূমিকায় নামতে আহ্বান জানানো হচ্ছে, সমাজের গার্জেনি করতে প্রেরণা দেওয়া হচ্ছে, লেঠেলগিরিকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে, যেমন ‘১৯৮৪’ নভেলে হয়েছিল, সেখানে ছেলেমেয়েরা ধরিয়ে দিত মা-বাবাকে, বউ ধরিয়ে দিত বরকে, বন্ধু বন্ধুকে। মনে রাখা ভাল, মোদী সরকার এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নাগরিকের কাছে আর্জি জানিয়েছে, তাঁরা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রখর নজরদারি চালান, কোনও দেশবিরোধী পোস্ট দেখলেই খবর দেন (সঙ্গে অবশ্য চাইল্ড পর্নোগ্রাফি ও ধর্ষণধর্মী পোস্টের কথাও জুড়ে দিয়েছে), বোঝাই যাচ্ছে গো-রক্ষক দেশরক্ষক বিজেপি-রক্ষক হিন্দুমৌলবাদ-রক্ষকরা মিলেমিশে কী অসামান্য রাষ্ট্রখোচড়-বাহিনী প্রস্তুত করবেন (‘আমি এক স্বেচ্ছা-খোচড়, করি তব চক্ষুগোচর, কার ঘাড়ে উচিত মোচড়, আমি ভাল এবং ও চোর’— আধুনিক দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, তাল: আড়খেমটা, রাগ: গনগনে)। এও মালুম, দেশের লোককে সহ-নাগরিকের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে তৎপর এক সরকার মূলত বিদ্বেষ ও ঘেন্নায় পুষ্ট হয়। কতরকমের গাছ আছে, কেউ সূর্যালোক খায়, কেউ পোকা। এদেশে তো কোভিডের বিরুদ্ধে যথেষ্ট বন্দোবস্ত হয়নি বলাও অ্যান্টি-ন্যাশনাল। অবশ্য টাকার পুরস্কারটা ভারতে এখনও ঘোষণা হয়নি, কিন্তু একটা বখশিসশ্রী চালু হতে আর কদ্দিন?
তার মানে কি ভারতে ফুত্তির কিচ্ছুটি নেই? কে বললে? এই তো এলাহাবাদ হাইকোর্টের এক বিচারক এক গোহত্যা-অভিযুক্তের বিচার করতে গিয়ে বললেন গরুকে জাতীয় পশু করা উচিত, এবং তারপর: বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, গরুই একমাত্র প্রাণী যা প্রশ্বাসে অক্সিজেন নেয় ও নিঃশ্বাসে অক্সিজেন ছাড়ে, আরও: গরুর ঘি যজ্ঞে দিলে সূর্যের আলো স্পেশাল শক্তি পায়, এবং তাতেই বৃষ্টি হয়, সঙ্গে: পঞ্চগব্য, অর্থাৎ গরুর দুধ, ঘি, দই, গোমূত্র এবং গোবর মিশিয়ে খেলে নানা অনারোগ্য রোগ সেরে যায়। নিশ্চয়ই এঁর সমর্থনে কাল-পরশুর মধ্যে মিছিল বেরোবে, স্টেডিয়াম-ভরা হাত্তালি নির্মাণ হবে, এবং এ-কথাও কেউ গোটা-গোটা উচ্চারণ করবে, গরুর পিঠ থেকে পূর্ণিমারাত্রে পাখনা বেরোয় এবং তখন সেই পক্ষীগরুর (বা গো-পাখি, না কি গরুড়?) পিঠে চেপে যাওয়া যেতে পারে বিনিপয়সায় লন্ডন (বা বড়জোর বাইশ টাকায়), কিংবা গরুই শ্রেষ্ঠ গো-য়েন্দা ও গো-লন্দাজ (নিরীহ ভেক ধরে থাকে, যাতে আন্দোলনজীবীরা কিচ্ছুটি বুঝিতে না পারে), অথবা গরুকে ভাল না বাসা মানে cow-কে ভাল না বাসা, আর কাউকে যে ভালবাসে না সে তো অমানব অবমানব অপমানব, তাকে পাকিস্তানে নির্বাসন দাও। অথবা আফগানিস্তানও হতে পারে। ফলে ভারত রহিয়াছে ভারতেই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যতই বলুক কোভিডে পরিবর্তিত বড়দা ‘মিউ’ আসছে এবং তা ভ্যাকসিনকে সুদৃঢ় কাঁচকলা দেখাবে, আমাদের দেশের ফুলটু মস্তি তাতে কণামাত্র বিঘ্নিত নয়। ভারতের মজা-মাইফেল’কে বহুত ধাক্কা মারলেও, তার ন্যাজটুকু বেরোয় মাত্র, হাতিটা রয়ে যায়!
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী