তখন ১৯৬২ সাল। স্কুল ফাইনাল দিয়ে আমি তখন সদ্য কলেজে ঢুকেছি। এই সময়ে আমার যিনি ছবি তোলার সঙ্গী ছিলেন, পঙ্কজ দাশ, তিনি বিজয় ঘোষের সঙ্গে সহকারী ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করতে চলে গেলেন। ফলে যেটা হল, আগে তিনি যাঁর সঙ্গে কাজ করতেন, গণেশ বসু, তাঁর সেই জায়গাটা ফাঁকা হয়ে গেল। গণেশ বসু ছিলেন অজয় করের ক্যামেরাম্যান। সেই সময়ে আমি যেহেতু ফোটোগ্রাফি চর্চা করতাম, এবং নিয়মিত যাতায়াত করতাম স্টুডিওপাড়ায়, গণেশদা একদিন ডেকে আমাকে বললেন যে, আমি ওই জায়গায় যদি কাজ করি তাহলে খুবই ভাল হয়। তখন সুশীল ঘোষ বলে একজন পরিচালকের ছবিতে উনি ক্যামেরাম্যান হিসেবে কাজ করছিলেন। ছবির নাম, ‘সিঁদুরে মেঘ’। এই ছবির কাজ যখন প্রায় শেষের মুখে, সে-সময়ে একদিন ভানু ঘোষ নামে একজন এসে একদিন গণেশদাকে বলেন, ‘তোমার তো অনেক চেনাজানা আছে, তুমি একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট দাও, মানিকদা একটা ক্যামেরা নিয়ে এসেছেন পশ্চিম জার্মানি থেকে অ্যারিফ্লেক্স নামে, সে ওই ক্যামেরার কেয়ারটেকার হিসেবে কাজ করবে।’ ভানু ঘোষ ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের ইউনিটের একজন সহকারী ব্যবস্থাপক। এই কথা বলাতে, গণেশদা আমাকেই বললেন মানিকদার কাছে যেতে। ওদিকে আগের ছবির কাজও তখন প্রায় শেষ। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমি তখন ইন্ড্রাস্ট্রির কিছুই জানতাম না। আর অত বড় একজন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে হবে এটা ভেবেই আমি অনেকদিন পর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের কাছে যাইনি। কিন্তু কিছুদিন পর ভানু ঘোষ আবার এসে বললেন, ‘আমি কি লোক পাব, না অন্য জায়গায় দেখব?’ তখন সবাই আবার জোরাজুরি করাতে আমি শেষপর্যন্ত সত্যজিৎ রায়ের কাছে গেলাম। তখন উনি থাকতেন লেক টেম্পল রোডে।
প্রথম দিনের কথা আজও পরিষ্কার মনে আছে। আমি গিয়ে দেখা করাতে, উনি আমার পা থেকে মাথা অবধি দেখলেন বসা অবস্থাতেই। তারপর বললেন, ‘তুমি কি পারবে? এটা তো খুব শক্ত কাজ! এগুলো তোমার পক্ষে সম্ভব হবে কি না জানি না, কারণ তুমি বলছ খুব অল্পদিন কাজ করেছ ইন্ডাস্ট্রিতে। ঠিক আছে, আমি অন্য কাউকে দেখছি, যদি না পাই, তাহলে তুমি অমুক দিন অমুক জায়গায় আমার সঙ্গে এসে দেখা কোরো।’ কিন্তু ওই যাত্রায় উনি কাউকেই পাননি। সুতরাং আমি আবার যথাসময়ে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করলাম। সেদিন উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমার তো শেখারও দরকার, তুমি আমার ক্যামেরার কেয়ারটেকার হিসেবেই কাজ করো। কিন্তু তোমাকে সব শিখে নিতে হবে, নাহলে কোনও কাজ করতে পারবে না।’ আমি তখন একদিন সৌম্যেন্দুবাবুকে (রায়) ইন্ডাস্ট্রির মধ্যেই ধরি। বলি যে, ‘আমায় তো মানিকদা কাজ শিখতে বলেছেন, আমি কী করব!’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি ওখানে কাজ করতে থাকো, আমি আছি। আমার যে অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে পূর্ণেন্দু বসু, ও তোমায় সব দেখিয়ে-টেখিয়ে দেবে।’ আমায় তখনও ক্যামেরা নিয়ে কোথাও যেতে-টেতে হত না। মানিকদা সেই সময়টায় প্রোডিউসারের দেওয়া ক্যামেরা নিয়েই শুটিং করছেন। আমার কাজ ছিল, রোজ একবার করে গিয়ে ক্যামেরাটা দেখাশোনা করা, ঝাড়পোঁছ করা এইসব। সেই সময়ে যাঁকেই কাছে পেতাম, তাঁকেই ক্যামেরার নানান খুঁটিনাটি জিনিস জিজ্ঞেস করতাম। এইভাবে কিছুদিনের মধ্যে খানিকটা সড়গড় হই। এই সময়ে একদিন মানিকদা ঠিক করলেন, ওঁর ক্যামেরাটা যাতে বসে না থাকে, তাই ভাড়া দেবেন। আমি তখন ওই ক্যামেরাটা নিয়ে অন্যান্য ছবির আউটডোরে যেতে শুরু করলাম।
মানিকদার সঙ্গে প্রথম যে-ছবিতে কাজ করি, সেটা ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’। তখনও ঠিক খাতায়-কলমে সহকারী হইনি, কিন্তু যখন তিনটে ক্যামেরা চালাতে হয়েছিল, তখন সহকারীর ভূমিকাতেই আমি কাজ করেছি। মানিকদা আমার সঙ্গে শট আলোচনা না করে শট নিতেন না। তখন সেলুলয়েডের অনেক দাম। আমি মানিকদাকে কনফিডেন্টলি বলতাম, ‘আপনি যদি নিজের জন্য ছ’টা টেক নেন, সেটা আলাদা কথা। আমি আমার জন্য একটা টেক নেব, কিন্তু দরকার মতো দুটো মনিটর নেব।’ মানিকদা এতে খুব খুশি হতেন। এবং আমার পিঠে হাত দিয়ে বলতেন, ‘ব্রাভো!’
মানিকদা যখন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ সিনেমাটা করছেন, তখন উনি অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরাটা পাননি। ওঁর ক্যামেরাটা সারভিসিং-এ দেওয়া ছিল। উনি তখন বললেন, ‘ইন্দ্রপুরীতে যে মিচেল ক্যামেরাটা আছে, ওটা একবার টেস্ট করে নেওয়া যাক। স্ক্রিন টেস্ট আর ভয়েস টেস্ট দুটোই হয়ে যাবে।’ ধৃতিমান (চট্টোপাধ্যায়) আর দেবরাজ (রায়) তখন দুজনেই নতুন। সৌম্যেন্দুবাবু মোটামুটি মিচেল ক্যামেরা চালাতে জানতেন। কিন্তু আমি তো আর ওঁকে বলতে পারি না যে, আপনি সমস্তটা করে দেবেন! এদিকে আমার যিনি সিনিয়র, পূর্ণেন্দুবাবু, উনি মিচেল ক্যামেরার বিষয়টা একেবারেই জানতেন না। যথারীতি আমি তো ক্যামেরাটা এনে ঠিকঠাক করে দিয়েছি। মানিকদা ক্যামেরাটা মুভ-থ্রু করলেন। বললেন, ‘এটা রেডি করে দাও।’ আমি ফিল্মটাও লোড করে দিলাম। কিন্তু সেট করবে কে? ওটা তো আমার কাজ না। স্টুডিওর কেয়ারটেকারের কাজ। কিন্তু মুশকিল হল, সে-ও তখন ছুটিতে। অগত্যা আমাকেই পুরোটা করে দিতে হয়েছিল। মানিকদা আমাকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, ‘তুমি তো মিচেলটাও খুব ভাল করে জানো দেখছি।’ ছোট একটা কথা, কিন্তু এভাবে উনি সবসময়ই আমাকে উৎসাহ দিতেন।
ক্যামেরার বিষয়ে মানিকদা ছিলেন অসম্ভব খুঁতখুঁতে। ‘শাখা-প্রশাখা’র যখন শুটিং চলছে, উনি লন্ডনের মার্চেন্ট আইভোরির কাছ থেকে ক্যামেরা চেয়ে আনিয়েছিলেন। ক্যামেরার সঙ্গে এসেছিল তিনজন ক্যামেরা-কেয়ারটেকার। একজন মেয়ে, দুজন ছেলে। প্রথম যখন ক্যামেরা এল, তখন সেটা গ্র্যান্ডে রাখা ছিল। মানিকদা বললেন, ‘পরশু থেকে তো এই ক্যামেরায় কাজ হবে। তুমি তো পারবে না! জ্ঞান বলে ওই ছেলেটাই কাজ করবে। কেননা এর টেকনোলজিটা বুঝতে তোমার অনেক সময় লাগবে।’ এইসব বিষয়ে কোনও পক্ষপাত ওঁর ছিল না। ক্যামেরাটা একবার দেখা যাবে কি না মানিকদাকে শুধু জিজ্ঞেস করাতে, সেই ব্যবস্থাটা শুধু উনি করে দিয়েছিলেন। জ্ঞান ছিল পাঞ্জাবি ছেলে, কিন্তু হাবেভাবে পুরোদস্তুর সাহেব। আমার তো কাজ করার অসম্ভব ইচ্ছে, ফলে ওকে খানিক সাহায্য করতে বললাম। যাই হোক, প্রথম দিন ইন্ডোরে তিন-চারটে শট হল। ও-ই কাজটা করল। আমি ওকে ফলো করতে লাগলাম, কীভাবে ও কাজগুলো করছে। দ্বিতীয় দিন দুটো কি তিনটে শট হওয়ার পর আমি জ্ঞানকে বললাম, ‘এটা তো ফিক্সড শট, আমি কাজটা করি? তুমি শুধু আমায় একটু সাহায্য কোরো।’ জ্ঞানকে পিছনে রেখে এরপর বাকি কাজটা আমিই করেছিলাম। জ্ঞান করছে না আমি করছি, তার চেয়েও মানিকদার কাছে বড় ছিল কাজটা কেমন হচ্ছে। সেটা ভাল হলেই উনি খুশি হতেন।
লেন্স ব্যবহার করা নিয়েও মানিকদাকে উত্তেজিত হতে দেখেছি একবার। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী যখন ‘দেবশিশু’ সিনেমাটা বানিয়েছিলেন, মানিকদাকে নিয়ে গেছিলেন নন্দন ৩-এ দেখাতে। আমরাও ছিলাম সবাই। যাই হোক, সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। সিনেমা শেষ হওয়া মাত্রই, মানিকদা হলের বাইরে বেরিয়ে গেলেন সবার প্রথমে। কোনও কমেন্ট না, কিচ্ছু না। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি। এই সময়ে উৎপলেন্দু দৌড়তে দৌড়তে সিঁড়ির কাছে গিয়ে মানিকদাকে ধরে বললেন, ‘কেমন লাগল আপনার, কিছু তো বললেন না?’ সঙ্গে সঙ্গে এক ধমক। ‘তুমি ওইখানে, ওই দৃশ্যে অযথা জুম করলে কেন? লেন্স থাকলেই জুম করতে হবে?’ লেন্সের সূক্ষ্ম ব্যবহার সম্পর্কে এতটাই ভাবতেন মানিকদা।
ইউনিট মানে যে ইউনিটি, এই কথাটা সত্যজিৎ রায় মেনে চলেছিলেন সারা জীবন। একটা ঘটনা বললেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। একটা সময়ে আমরা বেশ অনেকে মিলে ‘সংরক্ষণ সমিতি’ নামে একটা কমিটি তৈরি করেছিলাম। তখন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ কম, সিনেমাহলগুলোও বন্ধ— আমাদের কাজ ছিল এইসব ব্যাপারে একটা প্রেশার তৈরি করা। যাই হোক, এইরকম কিছুদিন যাওয়ার পর যতগুলো গিল্ড আছে, তার মধ্যে থেকে বাছাই করে একটা ফেডারেশন বডি তৈরি হল। ওদিকে ওই সময়েই ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ আরম্ভ হচ্ছে। সমস্ত কিছু প্রায় রেডি। মানিকদা যেটা করতেন, ইন্ডাস্ট্রির রেটে কোনও কাজ করাতেন না। প্রোডিউসারের অবস্থা বুঝে, উনি আমাদের রেট নির্দিষ্ট করে দিতেন। এবং একদম শুরুতেই কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী নামের পাশে টাকাটা লিখে দিতেন। কিন্তু ওই ছবিতে সবার নাম ছিল, কেবল আমি ছাড়া। মানিকদা তো অবাক! আমাদের ইউনিটের প্রোডাকশান কন্ট্রোলার অনিল চৌধুরীকে ডেকে জিগ্যেস করলেন, ‘কী ব্যাপার, অনিলের নাম নেই কেন?’ উনি তখন বললেন, ‘না, ওকে আমরা এই ছবিতে নিচ্ছি না। ও সংরক্ষণ সমিতির হয়ে আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে!’ ততক্ষণে আমি বাবুকে (সন্দীপ রায়) বলে দিয়েছিলাম যে, ‘আমায় যদি উনি না রাখতে চান, আমার কোনও ব্যাপার না। হয়তো একটু খারাপ লাগবে, এই যা। কারণ আমি যখন কাজ শুরু করেছিলাম, আমি কিন্তু সত্যজিৎ রায়কে দেখে ইন্ডাস্ট্রিতে আসিনি।’ কিন্তু ইউনিট সম্পর্কে মানিকদা এতই কড়াকড়ি ছিলেন, অনিল চৌধুরীর ওই কথার প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। ওঁকে বলেছিলেন, ‘অনিল যে আদর্শেই বিশ্বাস করুক না কেন, আমায় দেখতে হবে ও কাজটা কী করছে। ওকে আমার দরকার।’ এই ঘটনাটা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
‘সদ্গতি’র শুটিং-এর জন্য আমরা তখন মধ্যপ্রদেশের রায়পুরে। গ্রামে গ্রামে শুটিং করছি। এরকমই একদিন হঠাৎ দেখি মানিকদা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলছেন, ‘সৌম্যেন্দু, শোনো, এক ঘণ্টার ওপর তুমি বৃষ্টি পাবে। শেষ দৃশ্যটা আমরা বৃষ্টিতেই নেব। তুমি রেডি হয়ে যাও।’ অবাক করা ঘটনা, বৃষ্টি হয়েছিল ঠিক এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট। মানিকদার এই বিচক্ষণতা ভোলবার নয়। কীভাবে যে ওই দৃশ্যটা শুট হয়েছিল, আজও মনে পড়লে অবাক লাগে। লেন্সটা কোনওরকমে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে শুট করছি, আর জল পড়লেই সঙ্গে সঙ্গে মুছছি। একটা প্রোটেকটর শুধু লাগিয়ে নিয়েছিলাম। ওই বৃষ্টির মধ্যে একশো ফিটের একটা ট্রলি লাগাতে বলেছিলেন মানিকদা। এবং ওই কর্মকাণ্ডে স্মিতা পাতিল থেকে ওম পুরী— আমরা সবাই ছিলাম। মানিকদাও একটা হাওয়াই শার্ট পরে টানা ভিজেছিলেন আমাদের সঙ্গে।
শুটিং-এ আমাদের মজার মজার নানান কাণ্ড হত। একটার কথা বলি। ‘হীরক রাজার দেশে’-তে রাজসভার দৃশ্য শুট হচ্ছে ইনডোরে। উৎপলদা (দত্ত) দূরে একটা প্ল্যাটফর্মের মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। মানপত্র গোছের কিছু একটা পড়ার কথা ওঁর। আমি আর মানিকদা ক্রেনের ওপরে বসে। উনি ক্যামেরা লুক-থ্রু করছেন, আমি অ্যাসিস্ট করছি পাশে বসে। কথা ছিল, পড়া হয়ে গেলে উৎপলদা মাথা তুলবেন, সেই সময় ক্রেনটা পিছিয়ে যাবে আর ক্যামেরায় গোটা রাজসভাটাকে তুলে ধরা হবে। কিন্তু উৎপলদা মাথা তোলার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় মানিকদা, ‘কাট, কাট, কাট’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। আমার দিকে ঘুরে বললেন, ‘কিছু দেখলে?’ আমার তো কিছুই চোখে পড়েনি! তখন মানিকদা মেক-আপ আর্টিস্ট অনন্ত দাশকে ডেকে বললেন, ‘তুমি উৎপলদার পাগড়ি থেকে মেটালটা সরিয়ে নাও।’ আমরা তো সবাই অবাক। পাগড়িতে মেটাল আসবে কোত্থেকে? উৎপলদা কিন্তু ততক্ষণে ব্যাপারটা আঁচ করে ফেলেছেন। শেষে যখন পাগড়ি নীচু করা হল, দেখা গেল ওই ‘মেটাল’ আসলে উৎপলদার খৈনির ডিবে। আলো পড়ে চকচক করে উঠেছিল। আর উৎপলদার এতই নেশা ছিল খৈনির, শেষ মুহূর্তে কোথাও না রাখতে পেরে, ওইখানে রেখে দিয়েছিলেন। আমাদের সবার সে কী হাসি!
মানিকদার মানবিকতা বোধও ছিল শেখবার মতো। রবীন মজুমদার নামে পুরনো দিনের এক জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন। গানও গাইতেন, অভিনয়ও করতেন। শেষ জীবনে ওই ভদ্রলোককে এতটাই আর্থিক কষ্টের মধ্যে পড়তে হয়েছিল, উনি মানিকদাকে প্রায়ই ফোন করে বলতেন, ‘দেখুন না, আমায় যদি কোনও ছোটখাটো কাজ দিতে পারেন, তাহলে খুবই উপকার হয়।’ মানিকদা ওঁর ফোন এলে খুবই কুণ্ঠিত হয়ে পড়তেন। এককালের অত বড় মাপের শিল্পী, তাঁকে কীভাবে যে উনি কাজ দিতে পারেন, এই নিয়ে ভাবতে দেখতাম ওঁকে। শেষে একদিন ঠিক করলেন, ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিতে অমর পালের কণ্ঠে ‘কতই রঙ্গ দেখি দুনিয়ায়’ গানটা যে দৃশ্যে আছে, সেখানে রবীনবাবুকে দিয়ে লিপ দেওয়াবেন। ছোট চরিত্র আর ওঁকে মানিয়েও গেছিল। কিন্তু অবাক হয়ে গেছিলাম, রবীন মজুমদারকে দিয়ে ইনডোরে তিনি তিনদিন ধরে শুট করিয়েছিলেন, যার কোনও দরকারই ছিল না। মানিকদা ওটা করেছিলেন, যাতে রবীনবাবু টাকাটা তিনদিনেরই পান।
এখন ভাবতে বসলে আরও নানান স্মৃতি ভিড় করে আসে। যত দিন গেছে, বুঝতে পেরেছি আমার জীবনে ওঁর ভূমিকা ঠিক কতখানি ছিল। কত কিছু যে ওঁর থেকে শিখেছি! একটা দিনের জন্যও মনে পড়ে না, আমাকে উনি বকেছেন বলে। উৎসাহ দিতেন, প্রশ্রয় দিতেন। ভালবাসতেন নিজের ছেলের মতো। আর মানিকদার সবচেয়ে যেটা ভাল লাগত, সেটা ওঁর সৌজন্যবোধ। নিজের ইউনিট নিয়ে উনি সারাক্ষণ গর্ব করতেন। যত বড় বড় জায়গাতেই পুরস্কার নিতে গেছেন জীবনে, সব জায়গাতেই আমাদের নাম করে বলেছেন, ‘আমার ছবি আমার একার তৈরি নয়, সবাই মিলে বানিয়েছি।’