তখনকার দিনে বাড়িতে একজন অন্তত বাড়তি লোক থাকতই, মুসলমানির হাজাম ধরে আনা থেকে শুরু করে ছাদের অ্যান্টেনায় অ্যালুমিনিয়ামের সরা ফিট করার মতন কাজ এরাই করত। চেহারায় তারা কোনও ল্যান্সনায়েকের ফটোর মতন ঝাপসা কিংবা নায়কের মতন টকটকে… এই বিশাল রেঞ্জের ভেতর যে কোনও একটা কিছু হত। কিন্তু যাই কিছু হত, কেউ তাদের চেহারার দিকে ফিরে দেখত না। আমাদের বাড়িতে এমন লোক ছিল হাসনাত ভাই। হাসনাত ভাইয়ের নামের বানান ভুল করে স্কুলের শিক্ষক ‘হাসানাত’ লিখেছিল। স্কুল-শিক্ষকদের ভুল লোকে জনম জনম বহন করে। ডাকতে ডাকতে উনি হয়ে গেছিলেন হাসান। হাসান মানে সুন্দর। আশুগঞ্জের নানি যখন আমাদের হাসান-হোসেনের গল্প কইতেন, আমি মনে মনে ঈমাম হাসানকে হাসান ভাইয়ের মতন চেহারার কল্পনা করতাম। ঘুমন্ত হাসান ভাইয়ের পায়ের কাছে শুয়ে আছে জয়নব, জায়েদা তা দেখে হিংসায় দিশেহারা। এক স্ত্রীকে অত ভালবাসতেন বলে আরেক স্ত্রী তাকে বিষ খাইয়ে দিল। মনে মনে আমি জয়নব হতাম না জায়েদা, তা আর আমার মনে নেই।
বিয়ের দাওয়াতের সোনালি এম্বস করা কার্ড আসত, হাতে নিলেই সোনালি আফসানে আঙুল ভরে যেত। ওপরে কখনও আব্বা-আম্মার নাম লেখা, কখনও আব্বা এবং ফ্যামিলি। এই ‘এবং ফ্যামিলি’ না লেখা থাকলে আমরা যেতে পারতাম না। কিন্তু যেমন নামই লেখা থাক, হাসান ভাইকে ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত ভাবা হত না, কেননা তাঁকে আমি কখনও বিয়েবাড়িতে যেতে দেখতাম না। বাড়ির সামনে বা ছাদে যেসব বিয়ের প্যান্ডেল টাঙানো হত, সেসবে খুব খাটতে দেখতাম। বিয়েবাড়িতে দেখা হত সব রাবিশ লোকদের সঙ্গে। দানেশ মামা আম্মাকে জিজ্ঞেস করত— ‘পুলাগোরে কই থুয়া আইছস? কাজের বেডির কাছে নি? বয়স কত হইল অগো?’
‘দশ। এখনও ছুটো।’
‘ছুটো ভাবলেই ছুটো।’
দানেশ মামার ওই কথায় আমার গায়ে কাঁটা দিত। বিয়ের দাওয়াতে আম্মা আমাদের সুন্দর প্রিন্টের ফ্রক পরাত, পরিষ্কার চুলে হেয়ারক্লিপ আর পায়ে রং মেলানো জুতা। জরি-চুমকির সাজ দিতে আমার ইচ্ছা হত, কিন্তু আম্মা মুখে পাউডারটা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দিতে দিত না। খালারা দেখামাত্র লিপস্টিক মাখিয়ে দিত ঠোঁটে, আর বাকিবেলা হাঁ করে থাকতাম। একবার মালিহা খালা এমনই করে চটচটে লিপস্টিক দিয়ে দিচ্ছে, পাশ থেকে ফরু মামা বলে গেল— ‘লিপিস্টিক পিন্দায়া অরে আমার বাপের কাছে পাডায়া দিস!’ কী সব বিশ্রী ঠাট্টা! কী সব লোক। অথচ হাসান ভাইয়ের দাওয়াত নেই।
হাসান ভাইকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতাম। বয়সে আমার চেয়ে পনেরো-ষোলো বছরের বড় তো হবেই। মাথাভরা চুল, চোখগুলো জ্বলজ্বলে, মুখে ইয়ার্কির হাসি। লুঙ্গি পরুক কি ঈদের পাজামা-পাঞ্জাবি, তাঁর দীর্ঘ একহারা শরীরে সব কাপড়ই কী মানাত! মনে হত প্রাপ্তবয়স্কদের ভুবন থেকে তরতর করে হেঁটে এসেছে পুরুষ, পৃথিবীর প্রথম পুরুষ। আমি তো জানি, আমি প্রথমে বাপের হাতে তুলোয় করে বড় হব, তারপর হস্তান্তরিত হব স্বামীর হাতে, তারা আমাকে সংরক্ষণবাদীদের মতো হাতে আলাদা করে তুলে রাখবে। ওই রকম সাংঘাতিক প্রাপ্তবয়স্কদের পৃথিবীকে আমার জানাই হবে না। আমি থাকব বাস্তব থেকে সামান্য দূরে, জানালা দিয়ে দেখবার মতন করে। অতএব হাসান ভাইকে চালের দর নিয়ে কথা বলতে দেখে, লন্ড্রির কাপড় ঠিকঠাক আনতে দেখে, মৌসুমের হিমসাগর আমের নাভি টিপতে দেখে, জলছাদে এক বালতি পানি ঢেলে শুকিয়ে উঠবামাত্র মাদুর পেতে গড়াতে দেখে, উঠানে লুঙ্গির বাঁধন খুলে আবার বাঁধতে দেখে (পিঠের পাখনাগুলো কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে, মেরুদন্ড নির্মেদ)… কী কী সব দেখে আমি মুগ্ধ হতাম। সেই ইতিহাসের কথা আমি কোত্থাও লিখে রাখিনি। অর্থাৎ অবচেতনে আমি জানতাম ওসব মুগ্ধতার ইতিহাস লজ্জাকর, আমাদের মাঝে সামাজিক বাধা দুস্তর। লোকটার কাছে উদযাপন মানে মামা-খালাদের সঙ্গে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাইন্ডলেস তাস-কাচ্চু খেলা। কোনও মননশীলতার ধারকাছ দিয়ে নেই। স্থির হয়ে ঈদের আনন্দমেলাটাও দেখতে পারে না, বকরির চামড়ার কত দাম পেল সেই সব নিয়ে আলাপ জুড়ে দেয়। সবচেয়ে সমস্যার কথা, হাসান ভাই আমাকে চোখ তুলে দ্যাখেও না। ছোটবেলায় আমাকে কান মুলে দিয়েছিল কোনও কারণে এমন ঘটনাও ঘটে থাকবে।
হাসান ভাই যে দেখতে সুন্দর ছিল, সেটা নিয়ে বাড়িতে অনেকে মন্তব্য করত। কিন্তু সেই মন্তব্যের সঙ্গে সবসময় কিছু ফুলফল, পশুপাখির নাম বলা হত, যেমন— মাকাল ফল, যেমন— ব্ল্যাক শিপ। দানেশ মামা মাঝে মাঝে আব্বার কাছে এসে হাসনাত কত সম্ভাবনাময় ছিল, কত ভাল হাতের লেখা ছিল, স্কুল ইন্সপেকশনের দিন কেমন করে সে ‘দুই বিঘা জমি’ মুখস্থ বলেছিল এইসব গল্প করত। গল্প শেষ হত বাবার অকালমৃত্যুর পর সে ডিপ্লোমাটাও শেষ করল না এইসব পরিতাপে। তখন তো আমি প্রাইমারিতে পড়ি, ঐকিক নিয়মে অংক করতে করতে ওইসব গল্প কান খাড়া করে শুনি। হাসান ভাই আমার অনুকূল হৃদয়ে একটি বিনষ্ট সম্ভাবনা হিসেবে ঠাঁই পেলেন। মনে মনে ভাবলাম, এসএসসি পাশ করতে করতে তো আমি বড় হয়ে যাব। তখন হাসান ভাইকে নিয়ে এই বাসা ছেড়ে পালিয়ে যাব। কোথায় যাব? বাংলাদেশের মানচিত্র দেখে একটা সুন্দর নাম ঠিক করলেই চলবে। এমন সাঙ্ঘাতিক প্ল্যান করে ফেলে আবার নিজের ভেতর রেখে দেওয়া যায় না, তাই প্রাণের বন্ধু আরিফাকে বলে ফেললাম। হাসান ভাইয়ের বিবরণ শুনে সে বিছানায় একেবারে কাত হয়ে পড়ল হেসে, ‘এহ! তোর রুচি হিন্দি সিনেমার জন্মদিনের পার্টির চেয়ে খ্যাত!’ লেডি ডাক্তারের গলায় জিজ্ঞেস করল— ‘তোদের কেমন আত্মীয় হয় বললি? শুঁটকি-টুটকি খায়?’ আরিফার দাদা মুর্শিদাবাদের দিকের লোক। শুঁটকিখোর বাঙাল ওরা সইতে পারে না। আমিও রাগ রাগ মুখ করে বল্লাম— ‘সে তো সব দেশের লোকেই শুকিয়ে-গাঁজিয়ে নয়তো জিইয়ে কিছু না কিছু খায়।’
‘উহ, কী প্রেম! সাফাই গাইছিস!’ পরে অবশ্য সে পালাবার জন্য পছন্দসই নামের উপজেলা খুঁজতে গিয়ে ম্যাপ থেকে বোদা-খোকসা-ছাগলনাইয়া ইত্যাদি নাম বের করল। আরিফাটা এক্কেবারে যা তা। ও যতক্ষণ ছিল, আমিও সাদাচোখে দেখতে পাচ্ছিলাম— হাসান ভাই কোনও পছন্দ করবার জিনিস নয়। কিন্তু ও চলে যাওয়ার পর হাসান ভাই ঘরে এসে যখন বললেন, ‘শিগগির ছাদে আয়, তারাবাত্তি জ্বালামু।’ তাতেই আমার পেটের মাঝখানে একটা খালি জায়গা মুচড়ে ওঠার মতন ব্যথা শুরু হল, খুলে রাখা বাসায় পরার জামা আবার পরার মতো আরামে আমি প্রেমে পড়ে গেলাম আবার।
দানেশ মামার ছোটভাই ফররুখ মামা, আমরা ডাকতাম ফরু। ফরুর বিয়ে হল গ্রামে। প্রবাসী ভাইদের কেনা প্রসাধনে সেজে ওঠা বউ। ধূলিমলিন আঙিনা। পুকুরে দুরন্তপনা করে ডুবতে বসা মুশু মামার ছেলে হিরণ। এর ভিতর একবার ফরুর বাসরঘরে ঢুকেছিলাম আমি। বিদেশি সেন্ট-সন্দেশ-রজনীগন্ধার গন্ধ স্থির হয়ে আছে সেখানে। ফরু ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ওর নতুন বিয়ে করা বউয়ের দিকে তাকিয়ে টাইয়ের কুণ্ডলি পাকাতে পাকাতে চোখে চোখে হাসছিল। যেন শুধু ওরাই জানে জগতের গোপন এমন একটা কিছু, আর কেউ জানে না। চোখের দিকে তাকিয়ে হাসবার অন্তরঙ্গতায় সেই আমার প্রথম দীক্ষা। পরে ফরু বউকে চিঠি লিখেছিল কাতার থেকে— ‘আকাশে আকাশে আছিল ছড়ানো তোমার হাসির তুলনা।’ ফরুর বউ চিঠি দেখাত আমাকে। এইসব ঘটনা আমার বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছিল।
এইখানে হাসান ভাই একটা ভুল করে বসলেন। একদিন আমাকে একটা হলুদ খাম হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা চারতলার ডলিরে দিয়া আয়। বলবি আমি দিছি। খালাম্মা যেন না দ্যাখে!’ খামের গায়ে ডলির নাম লেখা, ই-কারটার ডগায় শিসকলম দিয়ে আঁকা গোলাপফুল। পাহাড়ের গায়ে প্রায় নিরালম্ব ভাবে ঝুলে থেকে যেসব কালো লেমুর খনিজ জল চেটে খায়, তাদের মতো করে এতদিন ঝুলে থেকেছি আমি। প্রেমে অত্যন্ত হ্যাংলা। সেসব ডাকপিয়ন হবার জন্য নয় নিশ্চয়ই। ঈমাম হাসানের ঘরে পা টিপে টিপে ঢুকে দ্বিতীয়া স্ত্রী অভিমানিনী জায়েদা দেখলেন তৃতীয়া স্ত্রী জয়নব কেমন স্বামীসোহাগিনী, ঈর্ষায় বিকারগ্রস্ত জায়েদা হীরকচূর্ণ সোরাহীতে ঢালতে লাগলেন। জায়েদা না আমি? নইলে নাচতে নাচতে কেমন করে চারতলার খালাম্মার হাতেই আমি চিঠিটা দিয়ে এলাম?
ডলি আপার ভাইরা এসে হাসান ভাইকে একেবারে চোর পেটানো মার মারল। মামারা কেউ বাধা দিল না। বাপ-মা মরা মানুষ হলেও মানুষ যখন আশ্রিত হয় তখন আর সে দয়ামায়ার যোগ্য থাকে না। ভেবেছিলাম হাসান ভাই আমার সঙ্গে অন্তত কথা বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু আমার একেবারে বুক ভেঙে গেল যখন, সকালে উনি এসে বললেন, ‘স্কুলে যাবি না? পইড়া পইড়া ঘুমাইতেছিস? আর্লি টু রাইজ!’ হাসান ভাইয়ের সঙ্গেই ইস্কুলে গেলাম সেদিন। মাফ চাইবার অবকাশও দিলেন না। যার চেহারা যে কোনও ল্যান্সনায়েকের মতন ঝাপসা, তার মুখের দিকে কেউ তাকিয়ে দেখল না। আমিও না। সংকোচে অবশ্য।
একদিনের কথা। তখন সেকেন্ডারিতে উঠে গেছি। আকাশ শ্লেটরঙা মেঘে ছেয়ে গেছিল বিকেলে, পরে মেঘ ছিঁড়ে একটু যেন ছেঁড়া লেসের মতো সাদা মেঘের কিনারা দেখা গেল, আর একটুখানি নীল আকাশ। সেই সামান্য গহ্বরের দিকে চেয়ে মনে গান আসল আমার, চেনা গানেরই লাইন— ‘আমার নিভৃত নব জীবন-’পরে/ বাজিল কাহার বীণা মধুর স্বরে’। রেডিওতে শুনেছি। জলজ শাকে ছাওয়া পুকুরটা থেকে গুমোট দিনে কেবল পুকুর থেকেই যেমন গন্ধ উঠতে পারে, তেমন উঠছিল। মেঘ করেছে বৃষ্টি আসবে আর তখুনি গাছপালা বাইতে হবে এমনটি খবর হয়ে গেছিল নাকি শামুকদের জগতে? পিলপিল করে বের হয়েছে আপেল শামুক, যেন অবন ঠাকুরের সেই গঙ্গাস্নান করতে চলা গুগলির মতো বলে ফেলবে— ‘আমিও যেহ্যনে যাত্রা করি বাইরেচি, এই বেদ্ধোকালে, সেহ্যেনে গঙ্গাসাগরে না যাইয়া আমি ছাড়মুনি।’ মেঘ ডাকছিল গুরুগুরু, অথচ চোখের সামনে আকাশে এক খাবলা নীল ফুটো, ওই মন্দ্রধ্বনি আমার কানে সেইসব লোকের রাগের মতো লাগল, যাদের রাগের কোনও দামই নেই। যেমন হাসান ভাই। সেদিন আমি ছাদে গেছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাদেই ছিলাম। ভাদ্রমাসের চড়চড়ে রোদে কে আচারের বয়াম দগ্ধাতে দিয়েছিল, ফিরত নিতে ভুলে গেছে। হাসান ভাই মনোযোগ দিয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন। সামান্য কথাই। একবার শুধু আমি জিজ্ঞেস করলাম— ‘হাসান ভাই আপনে কিছু হইলেন না কেন?’
‘হইলাম না মানে?’
‘এই ধরেন ফুটবলার, নইলে হোমিওপ্যাথির ডাক্তার, নইলে…’
হাসতে হাসতে পত্রিকা ভাঁজ করে হাসান ভাই বললেন— ‘আমার কেন কিছু হইতে হবে? জগতের সবার তো কত কিছু হইতেছে, তাতে লাভ হইছে কিছু?’ যেন উনি ফুটবলার কিংবা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার হলে আমাদের মাঝখানে কোনও বিভাজনরেখা থাকত না! থাকত। থাকত। উনি জানেন। আমি কেন জানি না? কেন বোকার মতো কথা বলি?
ছাদ থেকে দেখলে আকাশটা কত বড়। তখন ওই আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে বক যেত। ঝাঁকে জোড় না বিজোড় এই হিসেব করতাম আমরা। আলো ফুরিয়ে আসছিল। আমাদের কথাও কমে আসছিল। আর ক’দিন পরেই এই অকালবর্ষণ ফুরাবে, আসল শরৎকাল শুরু হবে, ওই মেঘলা আকাশ মেঘ কেটে এমন ঝকঝকে রৌদ্রময় হয়ে উঠবে যেন পৃথিবীর সর্বত্র খবর চাউর করে দেবে যে, বৃষ্টিবাদলের মৌসুম ফুরিয়েছে, শারদোৎসবের ছুটি আসছে। ইস্কুল ছুটি ছিল বলে, পায়ে পেষা হয়নি বলে, আর অকালবর্ষণের প্রকোপে ঘাস-দূর্বা ফড়ফড়িয়ে কত দীর্ঘ হয়ে উঠবে! ছুটি ফুরালেই বার্ষিক পরীক্ষা। এভাবে ঋতুচক্র আমাকে বড় করে তুলতে তুলতে ওঁর কাছ থেকে কত দূরে নিয়ে ফেলবে। এখনই তো আমরা কত দূরে। সন্ধ্যার অন্ধকার আমাকে যেন একটু স্বস্তি দিল, ঝোঁকের মাথায় বললাম— ‘শোনেন একটা কথা…’
‘কী বলবি?’
আটকে গেলাম, বললাম— ‘কিছু না।’
‘আমি জানি।’ ওই একটা কথা। আমি জানি। আমার মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে কানী বক উড়ে যেতে যেতে যেন বলে গেল— আমি জানি আমি জানি। নিভন্ত আলো বলে গেল— আমি জানি। আমরা জানি। কতদিন ধরে জানো?
আমার অনভিজ্ঞ অনভ্যস্ত শরীর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে এনে চুমু খেল সে। আমার প্রথম। ইস্কুল-পালানোর আমোদ যে-সময়ে আমার কাছে প্রকৃষ্ট আনন্দ। ম্যাপে উপজেলার নাম খুঁজে যে-সময়ে আমি বাড়ি থেকে পালাবার ফন্দি আঁটি। মনে আছে সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে নামবার সময় আমার চোখ শিরশির করছিল। এর পরে কী? কোন পরিণতি? কোন সিদ্ধান্ত? কোন আনন্দ? ওই সব ভাবনা আমাকে এমন একটা সময়ের গভীরে ঠেলে ফেলে দিল, যে-কালে আমি পূর্ণবয়স্ক হব।
পরদিন সকালে কিন্তু হাসান ভাইকে আর কোত্থাও খুঁজে পাওয়া গেল না। বিকেল হতেই টের পাওয়া গেল, ডলি আপাকেও কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। পালিয়ে গেছে দুজন। অভিরাম কোনও নামের উপজেলায়? অত বড় বিস্ময় আমার জন্যে অপেক্ষায় ছিল কী করে জানব? চুমু তাহলে কোনও প্রতিশ্রুতি নয়, একটি অসমাপিকা ক্রিয়া। সারাদিন আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন বাজতে লাগল— তাহলে আমি? যেখানে যেখানে তার স্পর্শ লেগে আছে, সেসব গনগনে মোহরের মতন আমার চামড়ায় সেঁটে যাচ্ছিল। কী রাগ! কী অপমান! ওই রকম আপনা থেকেই জেনে যাবার সন্ধ্যা কি মিথ্যে হতে পারে? ওই রকম মৃদু হাসিভরা ঝাপসা সাধারণ মানুষের সাধারণতম চেহারা? মিথ্যে হয়ে যেতে পারে? অত রাগে-দুঃখে কান্নাও পেল না ছাই।
সে-সময়ে আমাদের বাড়ির আশপাশের কোনও একটি বাড়িতে গভীর রাতে কে যেন বাঁশি বাজাত। একই সুর ঘুরেফিরে, কিন্তু রাতের অপার নৈঃশব্দে সেই সুর ভারি নিবিড় এক বাঁধনে আমাকে বাঁধত, যেন বলত— ‘এ পৃথিবী ঘুমোলেও আমি ঘুমোই না, আমি কাল, আমি অন্তহীন, আমি সুন্দর।’ বহুকাল হয় সেই বাঁশির সুরটি শুনি না আর। মাঝে মাঝে খুব শুনতে ইচ্ছা হয়।
পরে কী হল? ওই যে ‘দুই বিঘা জমি’ যে কবি লিখেছিলেন, তিনিই লিখে গেছেন—
‘যাহার লাগি চক্ষু বুঁজে বহিয়ে দিলাম অশ্রুসাগর
তাহারে বাদ দিয়েও দেখি বিশ্বভুবন মস্ত ডাগর।’
আমি তো বড় হচ্ছিলাম। নানি বলত— ‘ম্যায়ামানুষের বাড় কলাগাছের বাড়।’ বড় হবার একটা অপার সুবিধা হল— স্পেস। মানে ছোট্টবেলার আঁটোসাঁটো পৃথিবীটা থলথলে হতে হতে কতটা ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়ে যায়, সেইসব ফাঁক পুরেও যায় নানান জিনিসে। পরের বছরই শীতকালে আরিফা আর আমি বিয়েবাড়িতে যাব বলে পাঞ্জাবের মেয়েদের মতন করে তুঁতে-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবি বানালাম, গলায় আর হাতায় সোনালি কাজ; ফ্রক পরবার দিনগুলো থেকে বের হয়ে আসছিলাম আলগোছে। বসন্তোৎসবে নাচগান করলাম, ফুচকা খেয়ে ব্যারাম বাধালাম— দাস্তরোগী রাতভর ঘুমায় না, সেই আমাদের প্রথম রাত জাগা। আশ্চর্য, প্রথম চুমু খাওয়া লোকটার হঠকারিতা আমাকে সারারাত গভীর বেদনায় জাগিয়ে রাখতে পারেনি! জাতিসংঘের মাপমতন আমি তখনও শিশু, শিশুর শরীর-মনের ক্ষয়পূরণ ও বৃদ্ধিসাধনের সঙ্গে পাল্লা দেবে কোন ক্ষতি?
জানি না হাসনাত ভাই এখন কোথায় আছেন। ফুটবলার কিংবা হোমিওপ্যাথির ডাক্তার কিংবা দোকানদার কিছু একটা হয়েছেন কি না? হয়তো এখনও জন্মাষ্টমীর ছুটির দিন বাজার থেকে ভাল পাকা তাল নিয়ে বাড়ি ফেরেন। উনি তো জানলেনই না কারও কারও ভালবাসা ওই তালটার ক্ষীরের মতো, স্বাদ-গন্ধ একেবারে নিজস্ব, আর একটা তেতো ব্যাকগ্রাউন্ড ফ্লেভার আছে তাতে।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী