মানিকদাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে সত্যিই কথা ফুরোবে না। ১৯৫৪ সালের শেষ দিক থেকে তাঁর সঙ্গে আমার পথচলা শুরু হয়। আমি তখন টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওর স্টাফ। ওখানকার মিচেল ক্যামেরাটা মানিকদা ‘পথের পাঁচালী’-র জন্য ভাড়া নিয়েছিলেন। আমি ওটার কেয়ারটেকার হিসেবে গিয়েছিলাম। আমার আগে দীনেন গুপ্ত যেতেন। মিচেল ক্যামেরাটা বেশ ভারী হত, দুজনে মিলে তুলতে হত। যারা তুলত, তাদেরকে বলা হত ‘কুলি’। বেশিরভাগ সময়ে অগ্নু আর পাগলা ওটাকে তুলত। ওরা দুজনেই টেকনিশিয়ান্স স্টুডিওর কর্মী ছিল। এই দুজনের কাছেই আমি ক্যামেরার অনেক খুঁটিনাটি বিষয় শিখেছিলাম।
‘পথের পাঁচালী’র শুটিংয়ে গিয়ে প্রথমেই যেটা আমার বেশ ভাল লেগেছিল, সেটা হল, কারোর মধ্যে কোনও আড়াল নেই। আর্টিস্টদের মধ্যে জুনিয়র-সিনিয়র ভাগ নেই, আর্টিস্ট-টেকনিশিয়ানদের মধ্যেও কোনও ভেদাভেদ নেই। সকলে একই খাবার খাচ্ছে। পরিচালক যা খাচ্ছেন, আমরা, জুনিয়র টেকনিশিয়ানরাও তাই খাচ্ছি। এই দৃশ্য আগে দেখিনি। সেখানে খাওয়া আলাদা হত। পারিবারিক আবহাওয়াটা মানিকদার ইউনিটে আজীবন বজায় ছিল। ঠাট্টা-তামাশা চলত। এই প্রসঙ্গে একটা মজার ঘটনা মনে পড়ছে। সেটা বোধহয় ‘অপুর সংসার’-এর।
অমিয় সান্যাল বলে মানিকদার একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। শুটিংয়ের মাঝে মানিকদা পিছন ফিরে বসে আছেন। অমিয় সান্যালও লম্বা ছিলেন, আর মানিকদার মতোই সাদা জামা পরতেন। মানিকদার আরেক অ্যাসিস্ট্যান্ট নিতাই দত্ত এসে, মানিকদাকে অমিয় সান্যাল ভেবে পিঠে তবলা বাজাতে আরম্ভ করলেন। মানিকদা হেসে জিজ্ঞাসা করছেন, ‘নিতাই, কী হচ্ছে?’ তারপর যেই ঘুরেছেন, ততক্ষণে নিতাই ভুল বুঝতে পেরে হাওয়া। আমরা সকলে সেই দৃশ্য দেখে হাসছি।
ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে মানিকদা নিজে সবটাই ভেবে আসতেন। ওঁর মাথায় পুরোটাই থাকত। সহকারী পরিচালক যাঁরা থাকতেন, কিংবা আমরা, ওঁর কথামতোই কাজ করতাম। মাঝে মাঝে অবশ্য নিজেদের ভাবনাগুলো ওঁকে বলতাম, তবে সেটা খুব কম। মানিকদার নিজস্ব একটা হোমওয়ার্ক ছিল। ফলে আমরা পরিষ্কার জানতাম যে, আমাদের কী কাজ করতে হবে। আউটডোরে অনেক সময়ে লোকেশানে পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তন করতে হত। সেই পরিবর্তনটা মানিকদা করতেন।
আমি আরও যে দুজনকে বড়ো শিক্ষক মনে করি, সুব্রত মিত্র এবং বংশী চন্দ্রগুপ্ত, এঁরাও সমস্ত হোমওয়ার্কটা করতেন। মানিকদার সঙ্গে আলোচনা করতেন। ওঁরাও হয়তো নিজেদের ভাবনা মানিকদাকে বলতেন, তবে সেটার ব্যাপারে আমার তেমন চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা নেই।
স্বাধীন চিত্রগ্রাহক হিসেবে আমার প্রথম কাজ ছিল মানিকদার ছবিতেই। ‘তিনকন্যা’ আমার করা প্রথম কাহিনিচিত্র। সঙ্গে ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তথ্যচিত্রটাও করেছিলাম। ‘তিনকন্যা’-তে কাজ করেছিলাম অ্যারিফ্লেক্স ক্যামেরায়। ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ তথ্যচিত্র করার সময়ে অ্যারিফ্লেক্সের সঙ্গে মিচেল ক্যামেরাও ব্যবহার করেছি কোনও কোনও ক্ষেত্রে। ‘তিনকন্যা’র তিনটে গল্পে তিনরকম আলো করেছিলাম মানিকদার কথামতো। গল্পের মেজাজ অনুযায়ী আলো করতে হয়েছিল। ‘পোস্টমাস্টার’ দুঃখিনী মেয়ের গল্প বলে সেখানে মেঘলা আলোয় শুটিং করতে হয়েছিল। ‘সমাপ্তি’ রোম্যান্টিক কমেডি বলে সফ্ট লাইটে শুটিং ছিল। তবে অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ‘মণি-হারা’র ক্ষেত্রে। সেখানে ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স আর হাই কনট্রাস্ট আলোয় শুট করেছিলাম অতিলৌকিকতাকে ধরবার জন্য।
এছাড়া, ‘মণি-হারা’তে আরও অনেকগুলো এক্সপেরিমেন্ট করেছিলাম। যেমন, মণিমালিকার আবছা শরীরকে দেখানোর জন্য ধুনোর ধোঁয়া ব্যবহার করেছিলাম। ধুনোর ধোঁয়ার সুবিধা হচ্ছে, সাদা আর ভারী। আর স্টুডিওতে বদ্ধ পরিবেশে হাওয়া চলাচল করে না বলে তা এক জায়গায় স্থির থাকবে। ফলে মণিমালিকার যে প্রেত, তার শরীরকে আবছা মনে হবে। ধুনোর ধোঁয়া আমি বারান্দার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করেছিলাম, সেটাকে অনেকটা লম্বা দেখানোর জন্য। আর ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স ব্যবহার করায় বারান্দাটা আসলে যতটা লম্বা ছিল, সিনেমাতে তার চেয়ে অনেক বেশি লম্বা হয়ে গিয়েছিল। ফলে, নির্জনতাটা স্পষ্ট হয়।
‘তিনকন্যা’-র পরে মানিকদার যে ছবিতে কাজ করি, সেটা ‘অভিযান’। এই ছবিটা মানিকদার করার কথাই ছিল না। বিজয় চট্টোপাধ্যায় আর দুর্গাদাস মিত্রের ভাবনা ছিল। স্ক্রিপ্টের জন্য লোকেশান দেখতে গিয়ে মানিকদা বীরভূমের প্রকৃতি দেখে এত মোহিত যে, নিজেই পরিচালনা করার ভার নিলেন। ফার্স্ট ডে শুটিংটা যদ্দূর মনে পড়ছে, বীরেশ্বর সেনের চরিত্রটা যেখানে নরসিংহকে (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বলছে, গেট আউট, গেট আউট, সেই দৃশ্যটা।
‘অভিযান’-এ নরসিংহের গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাতের রাস্তার দৃশ্যটা কীভাবে তুলব, সেটা নিয়ে বেশ ভাবনায় ছিলাম। তারপর একটা প্লেনের সার্চলাইট পেলাম, সেটা ২৪ ভোল্টের। ফুল চার্জ দিয়ে শুটিং করতে হবে, নাহলেই বিপত্তি। ওটাকে দুটো হেডলাইটের মাঝখানে বেঁধে দিয়েছিলাম। ওই শুটিংটা পুরো ন্যাচারাল লাইটের মধ্যে করতে হয়েছিল। তবে এরকম পাহাড়ি গ্রামের রাস্তায় রাতে শুটিং করেছি, কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে কখনও পড়তে হয়নি।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র শুটিং প্রায় পুরোটাই ছিল ন্যাচারাল লাইটে। তার আগে ন্যাচারাল লাইটে কাজের অভিজ্ঞতা থাকলেও পুরো ছবিতেই ন্যাচারাল লাইট ব্যবহার এই প্রথম। সেখানেও এমন রাতের রাস্তায় গাড়ি যাওয়ার দৃশ্য শুট করার ব্যাপার ছিল। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে অসীমরা মাতাল হয়ে ফিরছে যখন, তখন অপর্ণাদের গাড়ি এসে দাঁড়ানোর যে দৃশ্যটা, ওই দৃশ্যটা আগুন জ্বালিয়ে শুট করেছিলাম। জঙ্গলে শুকনো পাতা জ্বালিয়ে, সেই আগুনকে সোর্স অফ লাইট হিসেবে ব্যবহার করি। তবে ওখানে রাতের জঙ্গলে শুটিং করতে গিয়ে হাতি আর লেপার্ড দেখতে পেয়েছি। হাতির কারণে গাড়ির হেডলাইট বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।
ন্যাচারাল লাইটে শুটিং করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল, কারণ সেখানে প্রকৃতি আমাকে যা আলো দেবে, সেই অনুযায়ী আমাকে কাজ করতে হবে। সেজন্য আমার বরাবর ন্যাচারাল লাইটে কাজ করাটা পছন্দের। ন্যাচারাল লাইটে শুট করে মনে রাখার মতো কিছু শট নিতে পেরেছি। ‘অশনি সংকেত’-এর একটা শট মনে পড়ে। অনঙ্গ বউ (ববিতা) খিড়কির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তারপরেই সে ঘরে ঢুকে যাবে। সেখানে দেখি, আলো পড়ে এসেছে। আমি শট নেব কি নেব না ভাবছি। মানিকদা বললেন, ‘তুমি নাও।’ সাহস করে শটটা নিলাম। তারপর প্রসেসিং হয়ে আসার পর দেখা গেল, খুব ভাল এসেছে শটটা। মানিকদা বললেন, ‘দেখলে তো, তুমি নেবে কি না ভাবছিলে।’
তখন আমরা ইস্টম্যান কোডাকের ১০০ এএসএ (আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড অ্যাসোসিয়েশন) ফিল্মেই এই কাজগুলো করেছি। ফিল্ম হিসেবে ওটাই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের ছিল। ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে অরো ফিল্মে কাজ করতে হয়েছে অনিবার্য কারণে, তাতে সেই উৎকর্ষ ছিল না।
আমাদের খুবই টাইট শিডিউলের মধ্যে তখন কাজ করতে হত, কারণ অনেকদিন ধরে কাজ করার মতো পুঁজি বা সুবিধা কোনওটাই ছিল না। কিন্তু খুব চাপ কোনওদিন সেভাবে অনুভব করিনি। কারণ, আমরা কাজ করতাম আনন্দের সঙ্গে। কামু (মুখোপাধ্যায়) অনেক সময়ে থাকত আমাদের ইউনিটে, সে থাকলে হাসিঠাট্টায় সকলকে মাতিয়ে রাখত। কিন্তু এমনিতে আমরা কাজ করেছি কাজ করার আনন্দে। সেই কারণে কঠিন শট হলেও আমরা সকলে মিলে তা উতরে দিয়েছি।
একটা ঘটনার কথা বলি। ‘সোনার কেল্লা’-র শেষ দৃশ্যে, যেখানে মুকুল কেল্লার অলিগলি দিয়ে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে, আর তাকে ডক্টর হাজরা (অজয় বন্দ্যোপাধ্যায়) খুঁজছে, সেই দৃশ্যটার জন্য পঞ্চাশটা শট নেওয়ার ছিল। এই শেষ দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল রাজস্থানে আউটডোরের একদম শেষ দিনে। সেদিনই বিকেলে আমাদের কলকাতার ট্রেন। ফলে, এত শট সব নিতে হল সকালের মধ্যে। প্রথমে একটু টেনশনে ছিলাম সবাই। কিন্তু সকলের সম্মিলিত পরিশ্রমে অতগুলো শট নিখুঁতভাবে ঠিক সময়ের মধ্যে তোলা হয়ে গিয়েছিল। এই দৃশ্যটাও পুরোটাই ন্যাচারাল লাইটে তোলা হয়েছিল।
‘সোনার কেল্লা’-র আরেকটা দৃশ্যও ন্যাচারাল লাইটে শুট করেছিলাম। সেটা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ শট ছিল। উটের পিঠ থেকে নেমে জটায়ু ব্যায়াম করছে। সেই শটটা সূর্যাস্তের সময়ে নিতে হয়েছিল। আমার সময়ে মানিকদাই ক্যামেরাটা মূলত অপারেট করতেন, তবে এই শটটা আমিই নিয়েছিলাম। মানিকদার কোমরে তখন ব্যথা ছিল। শটটা ছিল বেশ লম্বা। লাঠি স্টেশন, সেটা ছবিতে ‘রামদেওড়া’ হয়ে গিয়েছিল, তার প্ল্যাটফর্মে ট্রলি পেতে নিতে হয়েছিল শটটা। আমি বেশ নার্ভাস ছিলাম। কিন্তু তারপরে বেশ ভালই হয়েছিল শটটা। শটটা নেওয়া হয়েছিল সূর্যাস্তের পরে। তখনও পশ্চিমের আকাশে যথেষ্ট আলো, কিন্তু জটায়ুর গায়ে আলো সেভাবে নেই। সিল্যুয়েটের মধ্যে কালো ছায়ামূর্তি হিসেবে দেখা যাচ্ছে তাঁকে। এই আলোর বিভিন্নতা ক্যামেরাতে কাজ করার মূল ধর্ম।
আগুনের আলোয় শুটিং করার অভিজ্ঞতা এই লাঠি স্টেশনেও ছিল। সেই দৃশ্যটা, যেখানে ক্যাম্প ফায়ার হচ্ছে, স্থানীয় গানবাজনা হচ্ছে, ফেলুদা এসে মন্দার বোসের হাতের আংটিটা দেখে তাকে চিনতে পারল।
আমার সহকারী পূর্ণেন্দু বসুর সঙ্গে প্রচুর ছবিতে একসঙ্গে কাজ করেছি। ‘তিনকন্যা’-র সময় থেকেই পূর্ণেন্দু আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট। পূর্ণেন্দু নিজে অসাধারণ ক্যামেরাম্যান ছিল। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবিতে চিত্রগ্রাহক হিসেবে আমার আর পূর্ণেন্দু দুজনেরই নাম যায়। কারণ, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে প্রথমদিকের বেশ কিছু শুটিং পূর্ণেন্দু করে। আমি তখন তরুণ মজুমদারের ‘কুহেলী’ ছবির কাজে বাইরে ছিলাম। তারপর আমি ফিরে এসে বাকি ছবিটার ক্যামেরাটা করি। চিত্রগ্রাহক হিসেবে দুজনেরই নাম থাকা সিনেমার ইতিহাসে খুবই বিরল। মানিকদা কিন্তু সবসময়ে এই ন্যায্য সম্মানটা দিতেন।
মানিকদা বরাবর একই ইউনিট নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। মাঝে মাঝেই পরিবর্তন হলেও ইউনিট মোটামুটি একই থেকেছে। এমনকী, যখন আমরা ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ শুটিং করতে গেলাম, তখনও আমরাই সকলে কাজ করেছি। শুধু হিন্দি আর উর্দু ডায়লগের জন্য মানিকদার সঙ্গে স্ক্রিপ্টে কাজ করেছিলেন শামা জায়দি আর জাভেদ সিদ্দিকি। মানিকদা স্ক্রিপ্টটা ইংরাজিতে লিখেছিলেন। শাবানার দৃশ্যগুলো বোম্বেতে তোলা হয়েছিল। কারণ ও তখন আসতে পারেনি।
তখন মানিকদা পুরোদমে কাজ করছেন, কিন্তু ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ ছাড়া পরে হিন্দিতে আর পূর্ণদৈর্ঘ্যের ছবি করলেন না। সেটার সঠিক কারণ আমি জানি না। তবে মনে হয়, যে ভাষাতে উনি স্বচ্ছন্দ নন, সেটাতে ছবি করতে ওঁর অসুবিধা হতে পারে ভেবে আর হিন্দি ছবি করেননি। এছাড়া, তখন বোম্বেতে কাজ করার মধ্যেও যথেষ্ট ঝুঁকি ছিল।
‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ পরিচালনার সময়ে মানিকদা ইংরাজিতেই নির্দেশ দিতেন। অনেক বিদেশি অভিনেতারা কাজ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রিচার্ড অ্যাটেনবরো। উনিও মানিকদাকে ‘মানিকদা’ বলেই ডাকতেন। এটা প্রথম প্রথম শুনে আমাদের বেশ অন্যরকম লেগেছিল। একজন বিদেশি মানুষ এতখানি আন্তরিক হয়ে উঠেছিলেন, সেটা নিশ্চয় মানিকদার তরফ থেকেও যথেষ্ট আন্তরিকতা থাকার কারণেই সম্ভব হয়েছিল। রিচার্ড খুব সহযোগিতা করেছিলেন আমার সঙ্গে। আমাকে বলতেন, ‘রায়, যখন আমি শট দেব, তখন তোমার যদি কোনও অসুবিধা হয়, তাহলে জানাতে দ্বিধাবোধ কোরো না।’ লাইটটা বসানোর সময়ে যথেষ্ট সহযোগিতা করতেন। কিন্তু মানিকদার থেকে কোনও পারিশ্রমিক নেননি। টম অল্টারও খুব ভাল অভিনেতা ছিলেন। হিন্দি, ইংরাজি, সব ক’টাই খুব ভাল বলতেন।
মানিকদার তৈরি ছবির মধ্যে আমার বরাবরের প্রিয় ছবি ‘চারুলতা’। এই ছবিটা সবদিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ছবি— ফোটোগ্রাফি, সেট, ড্রেস, স্ক্রিপ্ট, ডিরেকশন। এটার শুটিং স্টুডিওতেই হয়েছিল। বংশীদা সেট করেছিলেন। ‘চারুলতা’র সময়ে আমি অন্য ছবির কাজ করছি। তাই শুটিংয়ের সময়ে থাকা হয়নি। তবে মাঝে মাঝে শুটিং দেখতে যেতাম। সুব্রতবাবুর কাজ দেখতাম। বনেদি বাড়ির জানলার সামনে চারুলতা দূরবীন হাতে বাইরের পৃথিবীকে দেখছে, সেখানে সুব্রতবাবুর সিনেমাটোগ্রাফি কী অসাধারণ শেখার বিষয়! উনি এই ছবিতে বাংক লাইটিং ব্যবহার করেছিলেন, টিনের বাক্সে লাইট রেখে। চারু দোলনায় দুলছে, এই দৃশ্যটার জন্য একটা দোলনায় ক্যামেরা রেখে দৃশ্যটা তোলা হয়েছিল।
আমরা যখন কাজ করেছি, তখন আরও একটা খুব শিক্ষণীয় ব্যাপার ছিল এই ছবির জগতে। তথাকথিত যাঁরা মূলধারার ছবি করতেন আর যাঁরা সমান্তরাল ছবি করতেন, তাঁদের মধ্যে কিন্তু কোনও বিরোধ ছিল না। সকলের সঙ্গেই সকলের সম্পর্ক খুব ভাল ছিল। আমি সেই সময়ে দু’ধরনের পরিচালকের ছবিতেই কাজ করেছি। দেখতাম, মানিকদার সঙ্গে তরুণ মজুমদারের কত ভাল সম্পর্ক। আমি শুনেছি, ‘অতিথি’ ছবির শেষটুকু মানিকদা তরুণবাবুকে বদলাতে বলেছিলেন। পরবর্তীকালে, অর্থাৎ, আমাদের কাজের শেষ দিকের পর্বে এই পরিবেশটা আর থাকেনি।
‘অশনি সংকেত’-এর শুটিং হয়েছিল বোলপুর থেকে একটু ভেতরে, ডাঙালপাড়া বলে একটা গ্রামে। এই আউটডোরের সূত্রে বহু জায়গায় ঘোরা হয়েছে। আর আমি ক্যামেরাম্যান ছিলাম বলে দু’বার করে যাওয়ার সুযোগ হত। শুটিং শুরু হওয়ার আগে রেকি করার জন্য যেতে হত আমাদের। আমার আগে সুব্রত মিত্র যখন ক্যামেরাম্যান ছিলেন, উনি যেতেন। রাজস্থানে গেছি, দিল্লিতে গেছি, এছাড়া, ‘সীমাবদ্ধ’-র ওই একটুখানি দৃশ্যের জন্য পাটনায় গেছি। রেকি করতে গিয়ে মূলত আড্ডা হত মানিকদার সঙ্গে। মানিকদা তাঁর ভাবনাটা বলতেন, আমিও আলো কীভাবে করা যায়, এসব বলতাম। খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হত।
রেকির দলে মূলত আমাদের সঙ্গে থাকতেন মানিকদার অ্যাসিস্ট্যান্ট আর প্রোডাকশন ম্যানেজার অনিল চৌধুরী। আর কলকাতায় কোনও জায়গা দেখার হলে, বা সেখানে সেট তৈরির ব্যাপার থাকলে, আমাদের সঙ্গে বংশীদা যেতেন। রেকির সময়টা নির্ভর করত ছবির উপরে। ‘সোনার কেল্লা’য় যেহেতু আউটডোর অনেক বেশি ছিল, সেখানে অনেকদিন ধরে লোকেশান বাছতে হয়েছিল। আমরা মোট পাঁচটা কেল্লা দেখিয়েছিলাম ছবিতে। দিল্লির লালকেল্লা, জয়পুরের নাহারগড় কেল্লা, যোধপুরের কেল্লা, বিকানির দুর্গ, আর সবশেষে জয়সলমিরের সোনার কেল্লা। এই পাঁচটা কেল্লার পাঁচ রকম রং। সেই কারণে ছবিতে দর্শক যখন দেখেছেন, তখন তাঁদের কোনটা কোন কেল্লা, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
সেই সময়ে আউটডোর শুটিংয়ের আরও একটা ইতিবাচক দিক ছিল। স্থানীয় যে মানুষরা থাকতেন, তাঁরা শুটিংয়ের কাজে ভীষণ সহযোগিতা করতেন। সেটা শুধু সত্যজিৎ রায়ের ছবির ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য পরিচালকদের ছবির আউটডোরেও একই অভিজ্ঞতা হয়েছে। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে পাখির বাজারের দৃশ্যটা তোলার জন্য আগে থেকে কথা বলে রাখতে হয়েছিল। কারণ, বাজার, তার উপর পাখির, ফলে, প্রচণ্ড চিৎকার, আওয়াজের মধ্যে শুটিং করতে হবে। কিন্তু সকলে সহযোগিতা করায় শটটা দিব্যি উতরে যায়।
এই পরিস্থিতিটাও পরবর্তীকালে বদলে গেল। এখন তো শুনি, স্থানীয়ও মানুষজন পয়সা চায়। সেই উষ্ণ সম্পর্কের জায়গাটা আর নেই। এই বদলটা শুরু হল আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে। ধর্মীয় একটা বাতাবরণ তৈরি হল। মানিকদা এই ব্যাপারে কোনওদিন কিছু বলেছেন কি না, আমার জানা নেই। ছবির মাধ্যমে বলেছেন তো বটেই, ‘দেবী’তে দেখিয়েছিলেন, ‘আগন্তুক’ ছবিতে সবটাই প্রায় বলে দিয়ে গেছেন। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’তে নার্সের চরিত্রে মিস শেফালিকে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী হিসেবে। কোনও ভেদাভেদ করেননি কারও মধ্যে। কিন্তু আমার সঙ্গে কখনও এই পরিবর্তনের বিষয়ে কথা হয়নি। হালকা মন্তব্য উনি পারতপক্ষে করতেন না।
মানিকদার ইউনিটে সকলেই আমরা একে-অপরের খুব বন্ধু ছিলাম। তবে তার মধ্যেও অভিনেতাদের মধ্যে সৌমিত্রর উপর মানিকদার একটু বিশেষ টান ছিল। এটা সকলেই জানেন। আর নেপথ্য শিল্পীদের মধ্যে আমাকে খুব ভালবাসতেন। মানিকদার পরিবারের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক খুব ভাল হয়ে গিয়েছিল। মঙ্কুদি খুব ভালবাসতেন। ওঁদের বেডরুমেও আমার ঢোকার অনুমতি ছিল। ওঁদের বাথরুমও ব্যবহার করতাম। ছবিতে ড্রেস ডিজাইনের ক্ষেত্রে মঙ্কুদির বড় ভূমিকা থাকত। সেই কারণে, মানিকদার ইউনিট যখন আমি পুরোপুরি ছেড়ে দিই, অন্যান্য ইউনিটে মানিয়ে নিতে আমার বেশ অসুবিধাই হয়েছিল।
কভারের ছবি: নিমাই ঘোষ