ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আমার সত্যজিৎ


    অনীক দত্ত (September 11, 2021)
     

    সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল ছোটবেলাতেই, কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তিনি নানান ভাবে আমার কাছে পৌঁছে গেছিলেন। বিভিন্ন আঁকা, লেখা এমনকী সিনেমার মাধ্যমেও। সিনেমা বলতে আমি ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ ছবিটার কথা বলতে চাইছি। আমি যখন খুবই ছোট, আমার মা আমাকে নিয়ে গিয়ে ট্র্যাঙ্গুলার পার্কের একটা বাড়িতে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার গ্রাহক করে দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য গ্রাহক মানে কী, তা আমি জানতাম না। আমার মনে পড়ে, ওই পত্রিকা থেকে একটা অদ্ভুত কালির গন্ধ পাওয়া যেত। আজকাল আর সেসব পাওয়া যায় না। এরপর থেকে কিছুদিন অন্তর অন্তর বাড়িতে ‘সন্দেশ’ পত্রিকার এক-একটা সংখ্যা আসতে শুরু করে। তাতে উপরে একটা কাগজে আমার নাম লেখা থাকত। এই ঘটনাটা মনে আছে তার কারণ, ওই প্রথম আমার নিজের নামে ডাকযোগে কিছু একটা আসে। নিজেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হত সে-সময়ে।

    ‘সন্দেশ’-এর প্রতিটা সংখ্যার প্রচ্ছদ ছিল দেখার মতো। এক-একটা বছর একই ডিজাইনে রংগুলো কেবল বদলে বদলে যেত। কমলা, হলুদ, নীল এইরকম। আমি যেহেতু ছোটবেলা থেকেই আঁকিবুকি কাটতাম, এবং বড় হয়েও আঁকাআঁকি করেছি— ফলে প্রচ্ছদের বিষয়ে শুরু থেকেই একটা আগ্রহ আমার ছিল। একটা প্রচ্ছদ যেমন খুব পছন্দের ছিল মনে আছে, সেটা একটা পালতোলা নৌকা দিয়ে করা হয়েছিল। নানান রঙে। এই প্রচ্ছদগুলোর ভেতরে বরাবরই একটা নতুনত্ব থাকত। সত্যজিতের লেখা সেখানে তখন খুব একটা পড়তাম বলে মনে পড়ে না। লীলা মজুমদার কি নলিনী দাশ— এঁদের লেখাই তখন পড়তাম। আর মজার লাগত ইলাস্ট্রেশনগুলো। প্রতিটা ইলাস্ট্রেশন আমি খুঁটিয়ে দেখতাম। উনি আঁকতেনও নানান স্টাইলে। আরও একটা মজার জিনিস উনি করতেন ওখানে, সেটা হল, দু’পাতা জুড়ে অনেক কিছু কুটি কুটি করে আঁকতেন। এবারে বলে দেওয়া হত, ‘ব’ দিয়ে কী কী আছে খুঁজে বের করো। এটা উনি একটা ওষুধের বিজ্ঞাপনেও পরে ব্যবহার করেছিলেন। যাই হোক, এখানে আসল কথাটা হল, উনি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা খুব ভাল বুঝতেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, এখানে পাতার পর পাতা লেখার চেয়ে আঁকা থাকলে ছোটরা উৎসাহী হবে বেশি। যে-বিষয়টাকে তখনও পর্যন্ত আমাদের এখানে একেবারেই আমল দেওয়া হত না।

    মজার লাগত ইলাস্ট্রেশনগুলো। প্রতিটা ইলাস্ট্রেশন আমি খুঁটিয়ে দেখতাম। উনি আঁকতেনও নানান স্টাইলে। আরও একটা মজার জিনিস উনি করতেন ওখানে, সেটা হল, দু’পাতা জুড়ে অনেক কিছু কুটি কুটি করে আঁকতেন। এবারে বলে দেওয়া হত, ‘ব’ দিয়ে কী কী আছে খুঁজে বের করো। এটা উনি একটা ওষুধের বিজ্ঞাপনেও পরে ব্যবহার করেছিলেন। যাই হোক, এখানে আসল কথাটা হল, উনি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা খুব ভাল বুঝতেন। উনি বুঝতে পেরেছিলেন, এখানে পাতার পর পাতা লেখার চেয়ে আঁকা থাকলে ছোটরা উৎসাহী হবে বেশি।

    ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ওই রঙিন জগতের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে এই সময়ে দুটো ঘটনা ঘটে। প্রথম ঘটনাটা হল, আমার ছবি আঁকার মধ্যে নিজের অজান্তেই সত্যজিতের দু’একটা স্টাইল চলে আসে। আমি বুঝতেও পারিনি। তখন একদিন হল কী, আমার বাবার একজন আর্টিস্ট বন্ধু ছিলেন। শ্যামল সেন নাম। আমি মংলু কাকু বলতাম। উনি সত্যজিতের বিশেষ পরিচিত ছিলেন। উনি যেহেতু আর্টিস্ট, মা একদিন ওঁকে আমার ড্রইং খাতাটা দেখতে দিলেন। উনি একবার চোখ বুলিয়েই বললেন, ‘তুই তো মানিকদারে টুকলি করতাচস!’ আমি চুপ করে রইলাম।

    অন্য ঘটনাটা হল, সেই সময়েই ‘বাদশাহী আংটি’ বইটা বেরোয়। সেটা ১৯৬৯ সাল। কাছাকাছি সময়েই মুক্তি পেয়েছে ‘গুপী গাইন ও বাঘা বাইন’ সিনেমাটা। কিন্তু ওই বইটা বেরোতেই, গল্প-ছবি সব মিলিয়ে সেটা একটা বোমার মতো হল। আর এই প্রথম সত্যজিৎ রায় নামটা আমার কাছে বইয়ের প্রচ্ছদে স্পষ্টভাবে দেখা দিল। এইরকম সময়ে আবার মংলু কাকু একদিন বাড়িতে এসে আমার ছবি দেখে আমাকে বললেন, ‘যে এই ছবিগুলো এঁকেছে, যাবি তার সঙ্গে দেখা করতে?’ সত্যি বলতে কী, গুগাবাবা ভাল লাগলেও তখনও ওঁর সম্পর্কে আমার কোনও পরিষ্কার ধারণা ছিল না। এমনকী মনে আছে, ছোটবেলায় আমার দুই দিদির সঙ্গে ‘পথের পাঁচালী’ দেখতে গিয়ে খুব খারাপই লেগেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে এসে মা’কে বলেছিলাম যে, এত দুঃখের ছবি, আমি আর কোনও সিনেমা-টিনেমা দেখব না।

    সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ‘বাদশাহী আংটি’ বইয়ের প্রচ্ছদ
    ‘বাদশাহী আংটি’ বইয়ে আঁকা পেন এবং ওয়াশের কিছু ইলাস্ট্রেশন

    কিন্তু এইরকম একটা মনের অবস্থা নিয়েই আমি ওঁর কাছে পৌঁছাই। এবং প্রথা অনুযায়ী একটা পেন্নাম ঠুকি। উনি আমার ছবিগুলো খুব মন দিয়ে এবং বেশ সময় নিয়ে দেখেছিলেন, মনে আছে। এবং সাধারণত যে-প্রশ্নটা বাচ্চা দেখলেই করা হয় যে, ‘কী বাবা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?’, এই প্রশ্নটা তিনি করলেনই না। পাকেচক্রে স্কুলের প্রসঙ্গ ওঠাতে, পাঠভবন শুনে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন। আমার কোনও ধারণাই ছিল না যে ওই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে উনিও একজন। বড় হয়ে সেসব জেনেছি। একটা কথা আমার মনে আছে, উনি ছবিগুলো দেখে বলেছিলেন, ‘বাবু ঠিক এইসব সাবজেক্ট নিয়ে ছবি আঁকে।’ সময়টা ১৯৭০-’৭১ সাল। বাইরে মাঝে মাঝে বোমার আওয়াজ পাওয়া যায়। আমি নিজে দেখেছি দু-একজনকে বন্দুক হাতে রাস্তা দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই বিষয়গুলো ছবির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। ছবিগুলো ছিল দুর্গাপুজো, নকশালবাড়ি এবং ক্রিকেট নিয়ে। সত্যজিৎ রায় সেদিন ক্রিকেট নিয়ে দু-একটা প্রশ্নও করেছিলেন, যা থেকে জানতে পারি যে উনি ক্রিকেটে আগ্রহী। এই হল আমার ওঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ। এবং উনি একটা ছবিতে ‘শ্রীমান অনীককে, সত্যজিৎ রায়’ লিখে দিয়েছিলেন। হাফ স্লিভ শার্ট, ডোরা কাটা কাটা— মাটিতে বসে আছেন ক্যামেরার ওপর কনুইটা দিয়ে। নিমাই ঘোষেরই তোলা হবে। আমার কাছে সেটা ছিল বিরাট পাওনা। পরবর্তীকালে দুঃখও করেছি অনেক, ছবিটা হারিয়ে ফেলার জন্য। সম্ভবত স্কুলে নিয়ে গেছিলাম শো-অফ করার জন্য, সেখান থেকেই ছবিটা হারিয়ে যায়।

    ‘সোনার কেল্লা’-র একটি দৃশ্যে সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

    এইখান থেকেই সত্যজিৎ সম্পর্কে আমার জানলা-দরজাগুলো আস্তে আস্তে খুলে গেল। নানান সূত্রে সত্যজিৎ রায় সম্পর্কে জানতে পারতাম। ‘সোনার কেল্লা’য় আমাদের স্কুলের সিনিয়র সিদ্ধার্থকে (চট্টোপাধ্যায়) নেওয়া হল। আমাদের যিনি বাংলা পড়াতেন, পার্থদা, ওঁর সঙ্গে ‘সুকুমার সাহিত্য সমগ্র’ সম্পাদনা করেছিলেন। এছাড়াও বাইরে শুটিং-এর সময় উনি ওঁর সঙ্গে বাইরে যেতেন এবং ফিরে এসে খুব মজার মজার গল্প করতেন। আরেকটা জিনিস যেটা পরোক্ষে ওঁর দৌলতে হয়েছিল, সেটা হচ্ছে, ওঁর সুবাদেই আমরা হাতে টিনটিন-এর বই পাই। কেননা উনি বাইরে গেলেই কমিকস্‌-এর বই নিয়ে আসতেন বাবুদার জন্য। আর মনে আছে, পার্থদা যেহেতু আমায় ভালবাসতেন, উনি আমায় নানা রকম বই পড়তে দিতেন। একদিন সাহস করে ওঁর কাছে গিয়ে বললাম, ‘আমাকে একটা টিনটিনের বই দেবেন? একদিনে পড়ে ফেরত দেব।’ সেই প্রথম ওই বই হাতে আসে। এবং এইভাবেই আমার সামনে একটা নতুন জগৎ শুরু হয়, যেখানে চারিদিক আলো করে রয়েছেন ফেলুদা আর টিনটিন। কিছুটা শঙ্কু। অন্যান্য বইপত্র যা পড়েছিলাম তার আগে, সেসব অল-অল্প জোলো লাগতে শুরু করেছে তখন।

    ‘অপরাজিত’ছবির একটি দৃশ্য

    এবারে আসি সিনেমা প্রসঙ্গে। আমার কাছে সত্যজিতের ছবির যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক, সেটা হল, ওঁর ছবির মধ্যে দিয়েই আমার সিনেমা ব্যাপারটা আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করেছিল। ততদিনে হলিউড সিনেমা দেখা আরম্ভ করেছি। ফিল্ম সোসাইটির শো-গুলোতে অন্যান্য দেশের ছবি। নিজে মেম্বার ছিলাম না, কিন্তু আমার মামার একটা কার্ড ছিল। উনি যখন বিদেশ চলে যান, সেই কার্ডটা আমি পাই। আমি সেটার ভেতর থেকে ওঁর ছবি বের করে নিজের ছবি লাগিয়ে নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতাম। কিন্তু দেখলে হবে কী, অধিকাংশ ছবিরই মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারতাম না। আজও নন-ন্যারেটিভ ছবি আমার মাথায় ঢোকে না। কিন্তু সত্যজিৎ এই জায়গাতেই আলাদা। আমার প্রথম তাক লেগে গেছিল ‘অপরাজিত’ দেখে। এবং সে-সময়ে যেখানেই সত্যজিতের সিনেমা দেখানো হত, ছুটতে ছুটতে যেতাম। আমি পরবর্তীকালে প্রচুর ভাল ছবি দেখা সত্ত্বেও এ কথা স্বীকার করি যে, সিনেমায় সত্যজিতের মতো বিশালতা খুব কম পরিচালকেরই রয়েছে। এটা কুরোসাওয়াও বলেছেন, মার্টিন স্করসেসিও বলেছেন যে, ওঁর ছবি একেবারে ‘অতুলনীয়’। আমি নিজেও সেটা বিশ্বাস করি। আর এখন নিজে যত জানছি, ততই অবাক হচ্ছি। সেই সময়ে ওই যে তিনজনের পার্টনারশিপ, সত্যজিৎ রায়-বংশী চন্দ্রগুপ্ত এবং সুব্রত মিত্র— এটা বিশ্ব-চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটা আশ্চর্য হওয়ার মতো ঘটনা। আরও একটা বিষয় উল্লেখ করার মতো, সেটা হল আমি কিন্তু কখনওই দেখতে হবে বলে সিনেমা দেখিনি। নিজের তাগিদ যখন হয়েছে, দেখেছি। সে-কারণে বড় বড় পরিচালকদের অনেকেরই, কিছু কিছু করে ছবি আমার দেখা। কিন্তু সত্যজিতের সিনেমা দেখে আমি এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম, ওঁর প্রতিটা সিনেমা খুঁজে খুঁজে একাধিক বার দেখেছি। আজও দেখি।

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook