একক দশক শতক’ উপন্যাসটা তখন ‘ঘরোয়া’ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছিল। এক দিকে পাঠকদের যত ছিল আগ্রহ, আমার ঠিক ততখানি ছিল উদ্বেগ। উদ্বেগের কথা পাঠক-পাঠিকাদের জানবার কথা নয়। তাঁরা প্রতি সপ্তাহে বৃহস্পতিবার সকালবেলা উপন্যাসের কিস্তি পড়তে পেলেই খুশি। কিন্তু কে খবর রাখে কি অবস্থায় সেটি লেখা হয়েছে? কে জানতে চায় যে তার আগের রাতে লেখক ঘুমিয়েছে কি না?
তবু লেখার মধ্যে যেন কোথাও সেই উদ্বেগের ছাপ না পড়ে। পড়তে-পড়তে কেউ যান টের না পায় তার দুঃখের বা অশান্তির কথা, উদ্বেগের কথা।
কিন্তু তখন আর ওসব ভাববার সময় নেই। টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি যাচ্ছি। সুতরাং যেতেই হবে। যথাসময়ে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। একদিন ইভনিং ফ্লাইটে উঠে পড়লুম। আবার পাড়ি দিতে আরম্ভ করলুম। সে প্লেন আবার গিয়ে থামল সান্তাক্রুজে। এবার রামজী যথারীতি আমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিল এয়ারপোর্টে। বললাম— রামজী, রতন কোথায়?
রামজী গুরুর ড্রাইভার। বললে— রতন নেই, সে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
কী রকম অবাক লাগল আমার। রতন কেন চাকরি ছেড়ে দিলে। সে না হলে কেমন করে গুরুর চলবে?
— আর তোমার সাহেব? তোমার সাহেব কেমন আছে?
রামজী বললে— ভালো—
তারপর বললে— আজ দিদিমণি লন্ডন চলে যাচ্ছে রাত দশটায়—
— কেন?
রামজী বললে— গান গাইতে—
গীতা দত্ত গান গাইতে লন্ডন যাচ্ছে? তা সেটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। গান গাইতে ইন্ডিয়ার বাইরে যাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। খবরের কাগজের লোকেরাও হরদম বাইরে যায়। সিনেমার লোকেরাও যায়। তাতে কারো অবাক হওয়ার নিয়ম নেই। লেখাপড়া শিখতে কোনও ছাত্র-ছাত্রী বিদেশে গেলেই সেটা হয় অস্বাভাবিক ঘটনা। তাতেই ইন্ডিয়ার ফরেক্স কমে যায়।
কিন্তু সে কথা যাক। গাড়িটা যখন বাড়ির কাছে গিয়ে পৌঁছুল তখন আরো অবাক হয়ে গেলাম। এ কোন্ বাড়িতে গাড়ি ঢুকছে? এ কার বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে? পালি হিল-এর পাহাড়ের ওপর উঠে খানিক দূরে গিয়েই বাঁ দিকের একটা তেতলা বাড়ি। বাড়ির সামনে না আছে বাগান, না আছে একটু বাহার। রাস্তার ওপর থেকেই বাড়িটা খাড়া উঠে গেছে ওপরে।
গাড়ি থেকে নামলাম। একজন রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গেল ভেতরে। সেই পুরনো চাকরটার দেখা পেলাম। কৃষ্ণা। কৃষ্ণা বহুদিন আমার খেদমত করেছে। আমাকে নিয়ে উঠে গেল তেতলার একটা ঘরে। দেখলাম এক জোড়া খাট, একটা আলমারি। রাস্তার দিকে সারি-সারি জানালা। জানালা দিয়ে সামনের বাড়িটার সবটা দেখা যায়। সেটাও একটা সিনেমা অভিনেতার বাড়ি। তাঁর নাম নাকি দিলীপকুমার। দিলীপকুমার তখন বিখ্যাত অভিনেতা।
অনেক দিন দেখেছি সকালবেলা পঞ্চাশ-ষাট জন রাস্তার ফুটপাথে বসে আছে। ঠিক দিলীপকুমার যখন গাড়ি নিয়ে বেরোবে তখন তারা দাঁড়িয়ে উঠে সেলাম করবে। তারপর আর কিছু কথা হবে না। কেউ চাক্রির উমেদার, কেউ সিনেমার পার্টের, এই রকম।
তা সেসব কথা যাক। প্রথম দিন যখন গিয়ে পৌঁছলুম তখন রাত প্রায় সাড়ে নটা। ঘরের ভেতরে জিনিসপত্র রাখা হল। তারপর কৃষ্ণা আমাকে নিয়ে গেল তেতলায়। দেখি গুরু মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। আমাকে দেখে হাসল। কিন্তু সেই আগেকার হাসির মতন নয়।
বললাম— শরীর খারাপ নাকি?
গুরু বললে— না, এখুনি গীতা এয়ারপোর্ট চলে গেল। তার সঙ্গে খুব ঝগড়া করেছি। তা আপনি কেমন আছেন?
বললাম— আমি তো ভালো আছি—
— কিন্তু এ বাড়িতে কবে এলেন? আপনার সেই আটচল্লিশ নম্বর বাড়ি কি হল?
গুরু বললে— আমি সে বাড়ি ভেঙ্গে ফেলেছি—
— ভেঙ্গে ফেলেছেন! আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম খবরটা শুনে।
*********************************************************
আমি প্রথমটা গুরুর কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম বটে, কিন্তু পরে ভাবলাম, এই-ই তো গুরু দত্ত। এ না হলে তো তাকে নিয়ে এই ‘বিনিদ্র’ লিখতামই না। অথচ সেই বাড়িটা কত সাধের বাড়ি ছিল গুরুর। প্রায় তিন বিঘে জমির ওপর তার সেই বাড়ি। বাড়ি তো নয় বাগান-বাড়ি। পাহাড়ের উপর প্রায় তিন বিঘে জমিতে চারিদিকে বাগান, আর মধ্যিখানে বাংলোবাড়ি। প্রায় সাতখানা বড়-বড় ঘর। আর বাড়ির পেছন দিকে আউট হাউস।
বহুদিন আগে অভিনেতা দেবানন্দ এই পালি হিলের ওপরেই থাকত। গুরু তখন শহরের ভাড়াটে বাড়িতে দিন কাটায়। কাজে-অকাজে আসত অভিনেতা দেবানন্দের কাছে। তখন থেকেই শখ ছিল যদি কোনওদিন সামর্থ্য হয় তো এই পালি হিলের ওপর বাড়ি করবে। সে ছোটবেলার শখ। অনেক-অনেক শখই মানুষের থাকে। কিন্তু সব কি পূরণ হয়?
কিন্তু হল! একদিন শখ পূর্ণ হল। তখন গুরুর সামান্য কিছু টাকা জমেছে হাতে। একদিন খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখলে পালি হিলের ওপরে একটা বাড়ি বিক্রি আছে।
বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করলে— কত দাম?
মালিক বললে— এক লাখ পঁচিশ।
পঁচিশ আর নয়। পুরোপুরি এক লাখেই সই হয়ে গেল। গুরু একদিন সস্ত্রীক নতুন কেনা আটচল্লিশ নম্বর বাড়িতে এসে উঠল। আর সেই থেকেই শুরু হল যন্ত্রণা। খাঁটি ইটালিয়ান মার্বেল এল বাথরুমের জন্যে। দামী বাহারি ফুল গাছের চারা পোঁতা হল বাগানে। তারপর একদিন বর্ষাকালে ছাদ দিয়ে জল পড়তে লাগল। আমি বললাম, ছাদটা কংক্রিট দিয়ে ঢেলে পাকা করে নিতে।
গুরু বললে— না, তাতে খারাপ দেখাবে।
সেই ছাদের জন্য কাশ্মীর থেকে কাঠ এলো একদিন, কাশ্মীরি মিস্ত্রি এল। ছাদ তৈরি হল। শুধু কাঠের ছাদ নয়। মিস্ত্রিকে দিয়ে আবার নৌকো তৈরি করা হল। সেই নৌকো করে বোম্বাই-এর পাওয়াই-লেকে বেড়ানো হবে।
সবই হল। আমি তখন বোম্বাইতে। কিন্তু গুরু কতক্ষণই বা সেই বাড়িতে থাকে। আর কখনই বা নৌকো চড়ে! সকাল সাড়ে সাতটার সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আর ফেরে অনেক রাত্রে।
আর গীতা? ছেলে দুটো তো সকালবেলা স্কুলে যায়। তখন বাড়ি যেন কবরখানা। গীতার জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে সেই শান্ত নিরিবিলি বাড়ির ভেতর। সেও বেড়িয়ে পড়ে সান্তাক্রুজে। সেখানে গীতার ভাইরা আছেন, মা আছেন, বোন আছে। আবার যখন ছেলেদের ফেরবার সময় হয়, তখন গীতা এসে আমার বারান্দায় বসে খানিকক্ষণ। কিন্তু বেশিক্ষণ ভালো লাগে না। করবার কাজ কিছু নেই। কাজের জন্য লোকজন আছে, বাড়ি পাহারা দেবার জন্যে দারোয়ান আছে, রাঁধবার জন্য ঠাকুর আছে। কিচ্ছু করবার নেই গীতার।
আমি কলকাতার ধুলো-শব্দ-ধোঁয়া থেকে সেখানে যেতাম। আমার কাছে সে-বাড়ি তখন স্বর্গ মনে হত। বাগানের বিরাট-বিরাট গাছের তলায় আমার ঘরখানার বারান্দা। সেই বারান্দার ওপর ইজি-চেয়ারটা টেনে নিয়ে আমি কল্পনার পাখায় চড়ে স্বর্গ-মর্ত করতাম। গীতা যাকে বলত কবরখানা, আমার কাছে তাই-ই মনে হত স্বর্গ।
সেই বাড়িতেই তো কত কুকুর পুষেছে গুরু। কত লেগ-হর্ন মুরগি পুষেছে। কত গরু পুষেছে। গরু দুটোর নাম দিয়েছে ‘গঙ্গা’ আর ‘যমুনা’। আমি কত দই খেয়েছি, কত দুধ খেয়েছি। শুধু আমি কেন, আমার মতো যে গেছে সেই বাড়িতে সে-ই মুগ্ধ হয়েছে, স্বাস্থ্য ফিরিয়ে এনেছে। মাদ্রাজের সিনেমার গল্প লেখক শ্রীসদাশিব ব্রহ্মম্ ওই বাড়িতে এসে কত দিন বাস করে গেছে। কলকাতার অভিনেত্রী তন্দ্রা বর্মণ আর তার বৃদ্ধ বাবা কত রাত ওই বাড়িতেই কাটিয়ে গেছে। সকলের কাছেই ও-বাড়িটাকে ‘ভূস্বর্গ’ বলে মনে হয়েছে। সেই বাড়িটাকেই গুরু অমন করে ভেঙে ফেললে?
কথা বলতে-বলতে অনেক রাত হয়ে যাচ্ছিল। গীতার প্লেন হয়তো তখন সান্তাক্রুজের এয়ারপোর্ট ছেড়ে চলে গেছে। বাড়িতে কেউ নেই।
গুরু বললে— জানেন, গীতার একটা মেয়ে হয়েছে—
বললাম— তাই নাকি?
— হ্যাঁ, নাম রেখেছি নীনা! কেমন নামটা?
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত