ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • উদ্বাস্তু


    স্বর্ণেন্দু সাহা (August 20, 2021)
     

    ঝাপসা অন্ধকারের উদাহরণ হিসেবে উপযুক্ত সন্ধ্যার মধ্যে তুলনামূলক ভাবে নিরেট অন্ধকার হয়ে লোকটা বসেছিল। এই জায়গায় সচরাচর কাউকে বসতে দেখা যায় না। বাস চলাচলের রাস্তার থেকে দূরে, গলি তস্য গলির ভেতরে অবস্থিত চায়ের দোকান-সন্নিহিত পথের চেহারা সাধারণত যেমন হয়ে থাকে, ঠিক তেমনই এই রাস্তা। ঘোলাটে গড়নের অগোছালো পিচ, এখানে-ওখানে ক্ষত… সম্পূর্ণ পথটা জুড়ে চলাফেরার উপায় নেই। বাড়ির চাতালের আড্ডা নেমে এসেছে রাস্তায়। ল্যাম্পপোস্টের আলো এখনও জ্বলেনি। রাস্তার ধারে, উবু হয়ে বসে একদৃষ্টিতে সে চেয়েছিল সামনের চায়ের দোকানটার দিকে। পিচের সীমানা পেরিয়ে পেডিগ্রিহীন মাটির এলাকা যেখানে শুরু, সেখানেই বসেছে সে, রোজকার মতো। বেশিক্ষণ উবু হয়ে বসে থাকা কঠিন, পা ধরে যায়। তার উপর এই শীতকালে মশার জ্বালাতনও মারাত্মক। তাই মাঝে মাঝে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে আলগোছে উঠে দাঁড়ায়। মশা তাড়ানোর জন্য বাধ্য হয়ে অল্প নড়াচড়া করে। শুকনো গলায় ঢোক গিলতে থাকে বারবার। এতেও কিছু একটা পেটে নেমে যাওয়ার অনুভূতি হয়। এই অনুভূতিটা সে তারিয়ে-তারিয়ে উপভোগ করে। বস্তুত, বহু খিদে-বিহ্বল দিনরাত্রি সে এইভাবেই অতিক্রম করেছে। এখন আর আলাদা করে চিন্তা বা চেষ্টা ছাড়াই আপনমনে সে ঢোক গেলার প্রক্রিয়া আরম্ভ করে দেয়। 

    পুরোপুরি, সামগ্রিক ভাবে দোকানটাকে সে দেখছে না। দোকানের মধ্যে দর্শনীয় কিছু নেইও। সে দেখছে, চা-ভর্তি প্রমাণ আয়তনের কেটলিটা। দেখছে থরে-থরে সাজানো পাঁউরুটি, রকমারি বিস্কুটের বয়ামগুলো। তার নজরে লোভ নেই, তীর্থদর্শনের মতো করে চেয়ে রয়েছে। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে সে কিছুই ভাবছে না। সমগ্র চেতনা জুড়ে খাবার ও তার কাল্পনিক সুবাস। তুচ্ছ কোনও ভাবনাও ফাঁক পাচ্ছে না গুঁড়ি মেরে একটু হাত-পা খেলিয়ে নেওয়ার। বিকেল ফুরোনোর কিছু আগে এখানে আসবার উদ্দেশ্যে রওনা দেওয়ার সময় প্রতিদিন নিজের মধ্যে তীব্র একটা উদ্দীপনা টের পায় সে। নিজের কোথাও যাওয়ার আছে এই চিন্তাটাই কেমন যেন তিরতিরে সুখের প্রবাহের জোগান দেয়। এখানে এসে পৌঁছনোর পরে, নির্দিষ্ট জায়গায় বসে বা দাঁড়িয়ে পড়ার পর সে নিজের অস্তিত্ব বা অবস্থান যুগপৎ বিস্মৃত হয় লহমায়।

    কোমরে গিঁট মেরে বাঁধা লুঙ্গিটার আসল রং কবে উঠে গেছে, সে মনে রাখার চেষ্টা করেনি। গায়ে কলারওয়ালা ঘিয়ে রঙের টি-শার্ট, জামার অবস্থা চলনসই।

    পেটের মধ্যে খিদের ভোঁতা একটা যন্ত্রণা। আসলে তার কখনওই তেড়েফুঁড়ে খিদে চাগাড় দেয় না। কোনও এক অতীতে হয়তো… কিন্তু এখন নয়। বহু বছর ধরে খিদের সময় খাদ্যের জোগান না পেতে-পেতে ক্ষুধাও তার ধর্মমাফিক উচ্চবাচ্য করে না। করে লাভ নেই, তাই করে না। সে নিজের অজান্তেই ঢোক গিলতে থাকল।

    সে এখানে বসে আছে সেই বিকেল থেকে। এখনও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। সময়ের গতি তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। এই পরিস্থিতিতে দশ মিনিট বা দশ ঘণ্টার ফারাক বুঝে ওঠা শক্ত। দুঃসময়ের স্তর জমতে থাকলে একসময়, সময় কনসেপ্টটাই অর্থহীন হয়ে দাঁড়ায়। খানিকক্ষণ ও অনেকক্ষণ বাদে সময়ের অন্যান্য হিসেব সে কায়দা করে উঠতে পারে না। অভ্যাস ও আন্দাজমাফিক তার ধারণা, এখনও অনেকক্ষণ বসে থাকতে হবে। ঝাঁপ গোটানোর আগে দোকানি তার কাছে আসে। জেনেশুনেও এত আগে উপস্থিত হয়ে বসে থাকাটা আম-আদমিদের কাছে নিরর্থক ও পাগলামো মনে হলেও, তার কাছে এটা দিনের অন্যতম সেরা সময়। এই অপেক্ষা করে থাকাটা তাকে কিছুটা যেন ব্যস্ততার স্বাদ দেয়। চব্বিশ ঘণ্টার অখণ্ড একঘেয়ে অবসরের মাঝখানে এই অপেক্ষমান সময়টা তার কাছে মরূদ্যান। তাছাড়া কোনও-কোনও দিন দোকানি আগেভাগেই… দোকানির মনে হলে আজকেও হয়তো অলিখিত ধরাবাঁধা সময়ের আগেই বরাদ্দ দুটো বিস্কুট আর একখণ্ড পাঁউরুটি দেবে। কালেভদ্রে প্লাস্টিকের কাপে চা-ও জুটে যায়। তার অবশ্য চা পছন্দ নয়। পছন্দ করার কারণও নেই, পেট ভরে না যে! তবে চা একদিক দিয়ে ভাল জিনিস। বিস্কুট, পাঁউরুটি সাবড়ে চা-টুকু গলাধঃকরণ করে ফেললে দুপুরকালীন খিদেটাও তেমন চেপে বসে না। তাও আবছা একটা খিদে-খিদে ভাব হয় বটে, কিন্তু আহামরি কিছু নয়।

    খাবার জুটলে বা না জুটলে অভ্যাসবশত সে একসময় ঘরে ফেরে। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী তার বাসস্থানকে ঘর বলতে গেলে যথেষ্ট সহমর্মিতার প্রয়োজন হয়। ঘর না বলে ছাউনি বলাই শ্রেয়।

    ঘুম এলে আবছা, ধোঁয়াটে একটা কুয়াশার স্তর ডানা মেলতে থাকে তার মস্তিষ্কে। সেই ডানার পরিসীমা অপরিসীম কোনও সমতলের মতো অসীম। স্বপ্ন আসে না। কিংবা হয়তো আসে, কিন্তু সেই স্বপ্নে স্রেফ আঁধার ঘুরে বেড়ায়। ডানার ছায়ায় ঢাকা পড়া সেই স্বপ্নের অধিকাংশই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।

    সন্ধ্যা পেরিয়ে যাওয়ার অনেকটা অনির্দিষ্ট সময় পরে দোকানি তার দিকে এগিয়ে এল। ঝাঁপ ফেলার কিছুক্ষণ আগে কোয়ার্টার-খানেক পাঁউরুটি সে এই বুড়োটে মানুষটাকে দান করে। বিক্রিবাটা ভাল হলে কখনও-সখনও হাফ পাউন্ডও। দেয় মিইয়ে যাওয়া বিস্কুট। না-দিলেও যে কিছু সমস্যা তা নয়। সব ভিখারিকে খাদ্যের জোগান দিতে হলেই তার হয়েছিল আর কি! আসলে এই লোকটা যে কিছু চায় না, স্রেফ তাকিয়ে থাকে। কোনওরকম অসুবিধা সৃষ্টি না করেই চেয়ে থাকে। এ-রকমের উদ্দেশ্যহীন ক্ষুধার্ত দৃষ্টি সহ্য করা মুশকিল।

    লোকটা পাঁউরুটি হাতে নিয়ে সামান্য একটু হাসল। রোজই হাসে। কৃতজ্ঞতার হাসি। দোকানি ততক্ষণে ঘুরে গেছে। এই হাসি সে দেখতে চায় না। তুবড়ে যাওয়া মুখের এই হাসি তার মনে স্যাঁতসেঁতে, পিচ্ছিল এক আতঙ্ক তৈরি করে। তার মনে হয়, এমন কোনও দিন হয়তো আসতে পারে যখন তাকেও এমনি করে হাসতে হবে। সে ভয় পায়।

    লোকটা চওড়া হাসিভরা মুখে তাকাল পাঁউরুটির খণ্ডটার দিকে। অব্যক্ত শব্দ করে আঙুল বোলাল জড়ানো কাগজের উপরে। যত্ন, ভালবাসা আর সাফল্য চুঁইয়ে পড়ছে স্পর্শ থেকে। ঢোক গিলল একবার। পরের বার ঢোক গেলবার সময় গলায় সত্যিই কিছু খাবার থাকবে, আসল খাবার। ভাবলেই আনন্দ হয়। পাঁউরুটি ভাল করে আগলে ধরে সে উঠে দাঁড়াল। ধীরেসুস্থে রওনা দিল ঘরের দিকে। ঘরে ঢুকে খাবে।

    ঘর বা ছাউনির ভিতরের পরিসর একজন মানুষের পক্ষে অপর্যাপ্ত। প্রায় অভুক্ত থাকতে-থাকতে শুকিয়ে কুঁকড়ে যাওয়া দেহটা কোনও মতে গুটিয়ে পড়ে থাকতে পারে। সারাটা দিন সে ছাউনির ভিতর চুপচাপ শুয়ে কাটিয়ে দেয়। ঘুম কিছুটা হয়, বাকি সময় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। ঘুম এলে আবছা, ধোঁয়াটে একটা কুয়াশার স্তর ডানা মেলতে থাকে তার মস্তিষ্কে। সেই ডানার পরিসীমা অপরিসীম কোনও সমতলের মতো অসীম। স্বপ্ন আসে না। কিংবা হয়তো আসে, কিন্তু সেই স্বপ্নে স্রেফ আঁধার ঘুরে বেড়ায়। ডানার ছায়ায় ঢাকা পড়া সেই স্বপ্নের অধিকাংশই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। 

    অভাবের কোনও তলদেশ নেই। যার কিছুই নেই, খতিয়ে দেখলে তারও ‘কিছু’-র হদিশ মেলে। লোকটার জীবনে সম্পদ বলতে রয়েছে ওই নড়বড়ে ছাউনি, আপাত-নীরোগ দেহ আর প্রতিদিনের পাঁউরুটি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা।

    ২.
    ‘এই! কে আছে? কে?’ 

    বাজখাঁই চিৎকারে তার ঘুম ভাঙল। ঘোর কাটেনি। সে চুপচাপ শুয়ে রইল। একটু আগের শোনা চিৎকারটা সে মনে করতে চাইল। স্বপ্ন ছিল কি? মনে পড়ার আগেই চিৎকারটা এবার স্পষ্ট কানে এসে ধাক্কা দিল, ‘এই! কে আছে বেরোও!’

    দরজার বাইরে থেকেই আসছে। সে ভীষণ অবাক হল। তাকে ডাকছে কেউ? ডাকলে কী করতে হয়? সাড়া দিতে হয়। তার ক্ষীণ কণ্ঠস্বরের সাড়া কি বাইরে থেকে আদৌ শোনা যাবে? যতটা সম্ভব দ্রুত সে বেরিয়ে এল।

    ফিটফাট পোশাক পরা এক বাবু দাঁড়িয়ে আছে। 

    ‘কতক্ষণ ধরে ডাকছি! এখানে কেন আছ?’

    সে উত্তর দিতে পারল না। বহুদিন যাবৎ প্রশ্নের সম্মুখীন হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে সে দূরে সরে থেকেছে।

    ‘এখানে থাকতে পারবে না। চলে যাও শিগগিরই।’

    ‘কোথায় যাব?’ সে বলল। কিন্তু তার বলার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে অনুধাবন করল, কথাটা তার মুখ থেকে শব্দ হয়ে বেরোয়নি। সে মনে-মনে উচ্চারণ করেছে। তার সন্দেহ হতে শুরু করল যে, সে আদৌ কথা বলতে পারবে কি না।

    আপ্রাণ মানসিক চেষ্টার পরে সে বলতে সমর্থ হল, ‘কোথায় যাব?’

    ‘কোথায় থাকতে?’

    আবার প্রশ্ন! সে ভেতরে-ভেতরে অত্যন্ত কাহিল বোধ করল। আমার কিছু চাই না। রোজ পেটে দেওয়ার জন্য যে-কোনও কিছু… পাঁউরুটি… আর এক কোণে সামান্য জায়গা। ব্যাস! তার জন্য এত প্রশ্নের ঝকমারি কেন বাবু?

    ‘এই জায়গা তো তোমার নয়!’

    আমার নয়! মনে-মনে উচ্চারণ করল সে। আমার নয়! কিন্তু আমি যে থাকি এখানে? সে বলতে পারত, এই পৃথিবীটাও তো মানুষের নয়। তাহলে কেন মানুষ দখল করে আছে? কেন সবাইকে হটিয়ে দিয়ে নিজের সাম্রাজ্য বাড়িয়ে চলেছে? সে বলতে পারল না। সে জানে না কিছু।

    ঘরের পলকা দেওয়ালে আঘাত পড়তেই এই প্রথম তার চোখে কোনও ভাষা দেখা গেল। সেই ভাষার অক্ষর পড়বার যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ নেই। বিবর্ণ চোখে কোনও ক্ষোভ নেই, ক্রোধ নেই, আছে কেবল এক ধরনের আক্ষেপ। সেই আক্ষেপের মধ্যে বিন্দুমাত্র জ্বালা নেই, অসহায়তা নেই।

    ‘দলিল আছে?’

    ‘দলিল’ শব্দটা তার চেনা-চেনা লাগল। শব্দটা যেন দৃশ্যমানও হয়ে উঠল। কাগজ! দলিল মানে কাগজ। এই স্মৃতির আগমনের সঙ্গে-সঙ্গে মাথাটা ঘুরে গেল তার। মাথার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল একগাদা জটিল, আলোকোজ্জ্বল দৃশ্যের জাপটাজাপটি। ঝকঝকে দেওয়াল, লাল সিমেন্টের মেঝে, কয়েকটা আন্তরিক মুখ— যাদের চেনবার তীব্র তাগিদ বোধ করল সে। থালায় সাজানো শুভ্র ভাত। এসব কি দেখতে পাচ্ছে সে? স্বপ্ন এখনও তার সঙ্গ ছাড়েনি? ওই মুখগুলো তার যেন পরিচিত, কিন্তু মনে পড়ছে না।

    ‘চলে যাও। জবরদখল করে রাখলে চলবে? দুপুরের মধ্যে এই আস্তানা ভেঙে দেওয়া হবে। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে ভাগো।’

    দৃশ্যগুলো বিলীন হয়ে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে। সে ওদের আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইল, কিন্তু সাধ্য কী তার? ওই বাড়িটা কার? সে কি ওখানে ছিল কোনও এক জীবনে! এখন কেন নেই? কে উচ্ছেদ করে দিয়েছে তাকে? প্রশ্নগুলো বুজকুড়ি কাটতে থাকল তার ধন্দ লেগে যাওয়া মনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে।

    ‘মানে?’ সে বলল, ‘কোথায় যাব?’

    ‘আ!’ বিরক্ত হলেন ভদ্রলোক, ‘এক কথা কতবার বলব? তুমি কোথায় যাবে তার ঠেকা আমরা নিয়েছি না কি? যাওয়ার জায়গা নেই তো কি অন্যের জমি দখল করে রাখবে? এখানে মাল্টিপ্লেক্স হবে।’

    মাল্টিপ্লেক্স! শব্দটা তার ভীষণ চেনা। বোঝার কথা নয়, কিন্তু সে বুঝতে পারল কীসের কথা বলা হচ্ছে। এই মাঠের মধ্যে চকচকে দেওয়ালের বিশাল অট্টালিকা তৈরি হবে তাহলে?

    ‘যাও, যাও!’

    সে চলে গেল না। নিজের আস্তানার ভিতর ঢুকে চুপচাপ শুয়ে রইল। সে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নয়। 

    সূর্য ঠিক মাথার উপরে গিয়ে হাজির হওয়ার কিছুক্ষণ পর লোকজন এসে পড়ল। সে প্রস্তুতই ছিল বলা চলে। বিনাবাক্যব্যয়ে সে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াল।

    ‘কাকা, সব জিনিসপত্র নিয়ে নিয়েছ তো?’ একজন হাঁক দিল তার উদ্দেশে। 

    সে অভিব্যক্তিহীন চোখে তাকিয়ে অল্প হাসল। জবাব দিল না। 

    ঘর ভেঙে দেওয়ার সময় সে চেয়ে রইল বিবর্ণ চোখে। উন্মাদের মতো তার গলার কণ্ঠা উপর-নীচ হতে থাকল। মনেও পড়ে না, এই ছোট্ট ঝুপড়িতে সে কবে এসেছিল। সে কি বানিয়েছিল এই ঘর? কিছুই মনে পড়ে না। তবু ঘরের পলকা দেওয়ালে আঘাত পড়তেই এই প্রথম তার চোখে কোনও ভাষা দেখা গেল। সেই ভাষার অক্ষর পড়বার যোগ্যতাসম্পন্ন কেউ নেই। বিবর্ণ চোখে কোনও ক্ষোভ নেই, ক্রোধ নেই, আছে কেবল এক ধরনের আক্ষেপ। সেই আক্ষেপের মধ্যে বিন্দুমাত্র জ্বালা নেই, অসহায়তা নেই।

    ভাঙচুরে বেশি সময় লাগেনি। গাড়িতে আবর্জনা তুলে দেওয়ার পর গাড়ি চলে গেল।

    না-থাকা ঘরের দিকে সে চেয়ে রইল নির্নিমেষে। তার নজর বাধা না পেয়ে এগিয়ে গেল। কিছুটা উন্মুক্ত মাঠ, তারপর এঁদো জলাভূমি। তার খিদে পাচ্ছে। সবকিছুর পরেও, সব যন্ত্রণা, সব ব্যর্থতার পরেও সেই প্রাচীন খিদে তাকে ঠেলা মারছে। তাকে যেতে হবে সেই… 

    তার বুকে কাঁপুনি দিল। সে কোথায় ফিরে আসবে? পাঁউরুটি নিয়ে সে কোথায় ফিরবে? ফেরার আশ্রয় না থাকলে সে যাবেই বা কোথায়, কেন? সে চলৎশক্তিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। 

    অনেক… অনেকক্ষণ পরে তার পা ক্ষমতা হারানোর পর, সে বসতে বাধ্য হল। আরও অনেকক্ষণ পরে এলিয়ে পড়ল রিক্ত মাঠের উপর।

    ঠিক ওইখানে শুয়ে-শুয়েই তার মৃত্যু হল আরও অনেকক্ষণ পরে।

    ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook