রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে লিখেছিলেন, আমাদের চোখের দেখা, কানের শোনা, নিপুণ সেবা, আনাগোনা সব একদিন রেখে চলে যেতে হবে। সেই ভাবনার ভিতর কান পাতলেই শান্তিনিকেতনে শোনা যায় কত শব্দ। আগে শোনা যেত বেশি, কিছু আজও শোনা যায় আগের মতো। বছর জুড়ে বেজে ওঠে আশ্রমের ঘণ্টা, কখনও সিংহসদনের ঘড়ি-ঘণ্টা। বুধবার সাপ্তাহিক উপাসনার প্রহর যত এগোয়, ততই ক্ষীণ হয়ে আসে ঘণ্টা, বেজে ওঠে অনন্ত এস্রাজ!
এত গাছ, কত পাখি আসে, এত পাখি ডাকে! সব পাখির স্বর চিনি না, নাম জানি না। একসময় মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙত। পাড়ায় বাড়িতে বাড়িতে মুরগি পোষার চল ছিল। এখন, অন্তত আমি পূর্বপল্লী আর অবনপল্লী মিশিয়ে যে দুটো জায়গায় থাকি, সেখানে আর তেমন মুরগি ডাকে না। দোয়েল, কোকিল ঘুঘু আর দুপুরের ডাহুকের ডাক অনেক পাখির ডাকের মধ্যে আমার প্রিয়। এদের ডাকের ভিতর কোথাও যেন একটা খেই-না-পাওয়া, না-বোঝা বিষাদ আর নিঃসঙ্গতা থাকে। কোকিলের ডাক মানেই ধরে নেওয়া আনন্দ। আসলে ফাগুনের আগমনের আনন্দ। কিন্তু বসন্তের আসা মানেই, সে কিছু পুরাতন স্মৃতি যেন অকারণে আবারও ফেরাতে এসেছে। একটা কোকিলকে গাইতে দেখে একবার আমার মনে হয়েছিল, পাখি ডাকলেই তাকে গান বলি কেন? হয়তো বুঝি না পাখির কান্না, তাই শুধু গান ভাবি তাকে। এইসব ভেবে একবার লিখেছিলাম—
পাখিরা কেঁদেছে,
আমরা ভেবেছি
গান।
সাতজনের দল বেঁধে আসা ঝরা পাতার রাশে ছাতারের লাফিয়ে চলার শব্দ, সাপ দেখে তাদের ত্রস্ত কোলাহল, দোতলায় জানলার কাঁচে চঞ্চল টুনটুনি পাখির ঠোঁটের ধাক্কার আওয়াজ, শ্যাওলায় ঢাকা অগভীর চৌবাচ্চায় নিভৃত স্নানের শেষে বুনো বকের ডানার ঝাপট, বাঁশপাতার ভিতর দিয়ে আসা মাতাল হাওয়ার শব্দ— কান পাতলেই শোনা যায় শান্তিনিকেতনে। পাখিদের কিচিরমিচির লেগেই আছে। সবটাই গান নয়। আমাদের জীবনের মতোই। গানের পাশাপাশি আনন্দ, কলহ, বিরহ, বেদনা সবই আছে। আগে, শীতে দূরাগত পরিযায়ী পাখির দল, বালিহাঁস শান্তিনিকেতনের আশপাশের জলাশয়গুলোতে আসত। সন্ধেবেলা উড়ে কোথাও যেত। আকাশ কালো করে আসা বৃষ্টির আওয়াজের আদলে পেতাম তাদের উড়ে যাওয়ার শব্দ। পলাতকা মেঘের মতো তাদের ক্ষণিকের ছায়া উদাস করে দিয়ে যেত আমাদের বিকেলের খেলা-ভাঙা মনগুলো। শান্তিনিকেতনের দুপুরগুলো এমনিতেই নির্জন, বিশেষ করে গ্রীষ্মের দুপুরগুলো। তার মধ্যে একটা পাখি হঠাৎ ডেকে গেলে যেন শত বছরের বিরহী স্মৃতি এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল মনখারাপের একলা জানলা। হয়তো সেরকম একটা জানলাকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে ‘বিজন বাতায়ন’ বলেছেন।
ভোররাত্রে ট্রেনের বাঁশির সঙ্গে মিশে যেত শীতের কুয়াশা, পরীক্ষার ভয় আর প্রথম আজান। অতিমারী প্রকট হলে একসময় থেমে গেল ট্রেন। শান্তিনিকেতন তখন ঝিঁঝিঁপোকাদের দখলে। কিছুদিন তারা ভাল ছিল। আমাদের মনগুলো ছিল খারাপ, হারানো রেলের বাঁশির কথা ভেবে। আবার ফিরে এল সব। তখন লিখেছিলাম একটা কবিতা, প্রান্তিকের দিক থেকে ফিরে আসা ট্রেনের বাঁশির ডাক শুনে—
ট্রেনের বাঁশি ঢেকে দিচ্ছে
ঝিঁঝিঁপোকার স্বর,
চারটি ঋতু ঘুমিয়ে থাকার পর!
শীতে জমে উঠত পৌষমেলা। শান্তিনিকেতনগৃহ থেকে ভেসে আসত সানাইয়ের আওয়াজ। মাইকে ঘন ঘন অনেকের হারিয়ে যাওয়ার ঘোষণা, গভীর রাত্রে যাত্রাপালার গান আর মেলার দ্বিতীয় দিন আতসবাজির শব্দ। ওই মেলায় বহু বছর রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে এক প্রৌঢ় বেহালায় শোনাতেন রবীন্দ্রনাথের গানের সুর। হারিয়ে গিয়েছে সেই মুখ আর তাঁর বেহালাও।
তিন চাকার রিকশাগুলো এখন প্রায় উঠে গেছে। তার বদলে এসেছে টোটো। গরুর গাড়ি আর এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ঝুরঝুরে রিকশার আওয়াজ আমাদের ছেলেবেলা জুড়ে রয়ে গেছে। অঙ্কের কড়া মাস্টারমশাই জলে-ঝড়ে হাজির হতেন একটা যত্নে রাখা সাইকেল নিয়ে। সেই অনভিপ্রেত সাইকেলের চাকার কটকট আওয়াজ আমার সব আশায় জল ঢেলে দিত। সাইকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে যেতেন আমার বাবাও। বজ্র-বিদ্যুৎ আর বৃষ্টির ভিতর গভীর উৎকণ্ঠায় অপেক্ষায় থাকতাম তাঁর ফিরে আসার পথ চেয়ে। দুর্যোগে বাবার, বাড়ির গেট খোলার শব্দ মনে রয়ে গেছে জীবনের সেরা এক অপেক্ষার সমাপ্তি সংগীত হয়ে, আজও।
চোখ বুজলে এখনও শুনতে পাই কবির বিদ্যালয়ে বৈতালিকের সমবেত প্রার্থনার শব্দ। ‘ওঁ পিতা নোহসি’। এই উচ্চারণের ভিতর কিছু একটা রয়েছে, না হলে মৃত্যুশয্যায় বাবার মুখে এই মন্ত্র শেষবারের মতো শুনতে চাইতেন না কবির মধ্যম কন্যা রেণুকা। শিশিরের শব্দ আমি শুনিনি কখনও। শুনেছি শাল আর আমের মধু আর মঞ্জরী ঝরে যাওয়ার আওয়াজ। দমকা বাতাসে তালের শুকনো পাতা খসে পড়ার আওয়াজ আর দলে আসা হনুমানের চিৎকার। মনে বিঁধে আছে মসৃণ মেঝের উপর নৃত্যরতা মেয়েদের ঘুঙুরবিহীন পায়ের চপল আর ক্ষিপ্র আঘাতে জন্ম নেওয়া বুকে ঢেউ তুলে যাওয়া শব্দ। মনে আছে, প্রিয়জনের হাত থেকে পড়ে প্রিয় এক মৃৎপাত্র ভাঙার আওয়াজ। হারিয়ে ফেলেছি শান্তিনিকেতনে কত প্রিয় মানুষের গলার স্বর। শীতে নিস্তব্ধ বাগানে টুপটুপ ঝরে যেতে দেখেছি অভাবী শ্রমিকের ঘামের ধারার মতো ধুলোমাখা পাতা বেয়ে নামা কুয়াশার এলোমেলো স্রোত। ছিল কাঠকয়লায় উনুনে ভাত ফোটার আওয়াজ। মাঝে মাঝে বাষ্পের অভিঘাতে হাঁড়ির পলকা ঢাকনা মাটিতে গড়ালে খান খান হয়ে যেত আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালি সংসারের বিব্রত নীরবতা। সেই আওয়াজ থেমে গেছে কবে! আর প্রায় থেমে গেছে সেই অহরহ ডাক, ‘চিঠি আছে’। ছিল অনেক হরকরা। তার মধ্যে চুড়িওয়ালা, দইওয়ালা চলে গেছে কবে। আসে না তিলের নাড়ু নিয়ে সেই অবাঙালি গৃহবধূ, যার মিহি স্বর ভেসে আছে মনে। মাছ আর সবজি ফেরি করা কিছু স্বর ডেকে যায় আজও। ডাকে ভিক্ষুকেরা, কে জানে কেন, প্রতি শুক্রবার সকালের দিকে। রাষ্ট্রনায়ক, আচার্যদের হেলিকপ্টার একসময় ঘন ঘন উড়ে আসত আশ্রমে। আজ প্রায় স্তব্ধ তাদের ডানা।
কতবার চলে গেছি শ্যামবাটির ভাঙা খালে ঝরনার বয়ে চলা জলের শব্দ, কামারশালায় হাপরের নিঃশ্বাস আর লোহা পেটানোর আওয়াজ শুনব বলে। শুনেছি মাটির চাক ঘোরানোর আওয়াজ। কুমোরের বাড়ি। মুড়ি ভাজা আর খড় কাটার আওয়াজ শুনেছি আমি। ভয়াবহ পুলিশের পুরনো জিপের শব্দ, সাইরেন আর কুকুরের কান্নায় কতদিন ভেঙে গেছে রাত্রের ঘুম। দূর থেকে কখনও ভেসে আসে চটুল হিন্দি গানের সুরে তাসাপার্টির সান্ধ্যকালীন রেওয়াজের বিকট আওয়াজ, ইঁদুর মারা বিষ ফেরি করা প্রচারগাড়ির বিজ্ঞাপনী ঘোষণা। একাকিত্ব গভীর করেছে কত বন্ধু টিকটিকির গলা। ছোটবেলায় উপভোগ করেছি পাঁচিলে তাল তাল গোবর ছুঁড়ে ঘুঁটে লেপার ভেজা আওয়াজ, অনেকটা তাল আর আম পড়ার আওয়াজের মতো। তারপর কখন সেই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে দিগ্বিদিকে মুঠোফোনের বিচিত্র রিংটোন। গ্রীষ্মে পুরনো সিলিং ফ্যান যেন এক বিকট গায়িকা।
টেবিল ল্যাম্পের নীচে, পরীক্ষার খাতায় বাবা নম্বর দিতেন। এত দিন, এত লিখেছি, তবু যেন বাবার খাতায় আঁচড় কাটার শব্দ এ-যাবৎ মনে গেঁথে আছে বেশি। মনে আছে, পিছন থেকে মায়ের ডাক। বাড়ি ফিরলে পোষ্যদের খুশির চিৎকার। মহালয়ায় ভোররাত্রে বেজে উঠত রেডিও আর তার কিছু পরে গৌরপ্রাঙ্গণ থেকে ভেসে আসা ঢাকের আওয়াজ। আশ্রমে পুজো আসে না, তাই শরৎ এসেছে। কানে জেগে আছে সাঁওতালদের পরবে বাড়ি এসে ধামসা, মাদলের দাপট আর গ্রামে তাড়া করা শুয়োরের অসহায় চিৎকার। আছে বাউলের দোতারা, আর মন কেমন করা বাঁশির আওয়াজ। কখনও কোনও বারান্দা থেকে ভেসে আসা কান্নার আওয়াজ আর শ্মশানযাত্রীদের নিয়মের হরিধ্বনি।
শান্তিনিকেতনে বর্ষাই সম্ভবত আমার প্রিয় ঋতু। বর্ষণমুখর দিনে বৃষ্টির নেমে আসার আওয়াজ যেন পুরনো হয় না আর। সন্ধ্যায় পোকা আর ব্যাঙের গান। বজ্র আর ঝড়ে জানলার পাল্লা বন্ধ হবার আওয়াজ, রাস্তার নীচু জায়গাগুলো অঝোর বর্ষণে প্লাবিত হলে কুল কুল জল বয়ে চলার আওয়াজ, দমকা বাতাসে ছাতা উলটে যাওয়ার শব্দ, টালি অথবা টিনের চালে অবিরাম বারিধারা মনকে শুধু শুধু উদাস করে তোলে। বৃষ্টি থেমে আসার আওয়াজ আনন্দ আর বেদনা দুই-ই নিয়ে আসে। আছে অন্ধকার রাস্তায় জমা জলে পা পড়ে যাওয়ার ছলাৎ ছলাৎ আর অসাবধানে পায়ের নীচে শামুক গুঁড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ, যার পর হাতে শুধু কষ্ট পড়ে থাকে। একসময় এলাকায় এত বাড়ি ছিল না। আলো অথবা রোদ আসার সাধারণত কোনও আওয়াজ নেই। একবার মনে হয়েছিল, এক নিস্তব্ধ সকালে আমি যেন আলো পড়ার শব্দ শুনেছিলাম। আমাদের পাড়ায় শিল্পী ধীরেন্দ্রকৃষ্ণ দেববর্মার বাড়ির অদূরে দোতলার নিরালা ঝোলা বারান্দায় বসে বেহালা বাজাতেন ভূপেন দাদু, সাধারণত দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায়। একদিন বাইরে তুমুল বৃষ্টি। মিশে গেছে সোঁদা মাটি আর হ্যারিকেনের কেরোসিনের গন্ধ। লণ্ঠনের গরম কাঁচ বেয়ে আগুনে এগোচ্ছে মৃত্যুন্মুখ পোকা। পাচ্ছি তার ডানা পোড়ার আওয়াজ। ভেজা জুঁইয়ের গন্ধ মেখে দূর থেকে ভেসে আসছে ভূপেন দাদুর করুণ ভায়োলিন—
‘জানি নে কোথায় জাগো ওগো বন্ধু পরবাসী—
কোন নিভৃত বাতায়নে।
সেথা নিশীথের জলভরা কণ্ঠে
কোন বিরহিণীর বাণী তোমারে কী যায় বলে।’
ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র