জীবনের উপান্তে, প্রায় সত্তর বছর বয়েসে ছবি আঁকা শুরু করলেও, রবীন্দ্রনাথের ছবিতে জাপানি প্রভাব চোখে পড়ে না। কিন্তু জাপানি সরঞ্জাম ব্যবহার করে, জাপানি কায়দায় তিনি বেশ কিছু ক্যালিগ্রাফি করেছিলেন। দুই জাপানি শিল্পী কলকাতায় না এলে সম্ভবত জন্মই হত না অবনীন্দ্রনাথের (১৮৭১-১৯৫১) বিখ্যাত ছবি ‘ভারতমাতা’র (১৯০৫)। এই ছবিতে ভারতীয় রূপ আর জাপানের চিত্রকলার শৈলী মিলেমিশে গেছে। শুধু তাই নয়, স্বদেশি আন্দোলনের হাওয়ায়, এ যেন পাশ্চাত্যের ছায়া থেকে মুক্ত হবার লক্ষে এশিয়ার দুই প্রাচীন দেশের সাংস্কৃতিক আত্মশক্তির এক সম্মিলিত, শিল্পিত প্রদর্শন। বিশ শতকের একেবারে গোড়ায় যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের সূচনা করেছিলেন বাঙালি এবং জাপানি শিল্পীরা, তাই যেন পরে নতুন রূপ পেয়েছিল, জাপানের সহায়তায় ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা জাপান-প্রবাসী ভারতীয় বিপ্লবীদের রাজনৈতিক পরিকল্পনায়।
কলকাতার ঠাকুরবাড়ির শখের শিল্পী থেকে বিশ্ববিশ্রুত শিল্পাচার্য হয়ে ওঠার পথে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে পড়েছিল কিছু বিদেশি বনস্পতির ছায়া। একেবারেই নিজের খেয়ালে তিনি ছবি আঁকা শুরু করেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী উৎসাহ দিতেন। পরবর্তীকালে উৎসাহিত করেছিলেন আরও অনেকের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ, ভগিনী নিবেদিতাও। কলকাতায় সরকারি আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল, ইতালিয়ান শিল্পী গিলারডির কাছে ব্যক্তিগত ভাবে ইউরোপের আদলে ছবি আঁকার তালিম নিতে শুরু করেন। হাত তৈরি হল প্যাস্টেলে। এরপর তেলরঙের কাজ শিখলেন ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে। সবই পাশ্চাত্য রীতির ছবি। এরপর শিখতে ইচ্ছে হল জলরঙের কাজ। কলকাতার আর্ট স্কুল পত্তনের সময় থেকে শুধুমাত্র পাশ্চাত্যের ধারায় শিল্পকলার তালিম দেওয়া হত। ওই সময় দক্ষিণ ভারতের শিল্পী রবি বর্মার ছবি জনপ্রিয় হতে শুরু করে। কিন্তু তার মধ্যে কোথাও যেন ভারতীয়ত্ব আর প্রাণের অভাব ছিল। আর্ট স্কুলে ই বি হ্যাভেল অধ্যক্ষ হয়ে এসে তৎকালীন শিল্পচর্চার ছবিটা বদলে দিলেন। ভারতবর্ষকে ছবির ভিতর খুঁজে পেতে অবনীন্দ্রনাথ তাঁকেই গুরু হিসেবে স্বীকার করেছেন। হ্যাভেল তাঁকে আর্ট কলেজের উপাধ্যক্ষ নিয়োগ করলেন আর উৎসাহ দিলেন ভারতীয় প্রথায় শিল্পচর্চা করার। দেশীয় কায়দায় ছবি আঁকতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ গুরু হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন পটুয়াদের মতো গ্রামীণ শিল্পীদের। মুঘল চিত্রকলার আদলে অনেক ছবি এঁকেছেন। ছোট মেয়ের অকাল মৃত্যুর যন্ত্রণা উজাড় করে দিয়ে এঁকেছিলেন ‘শাহজাহানের মৃত্যু’। অবনীন্দ্রনাথ এবং হ্যাভেলের যোগাযোগ গড়ে ওঠার ভিতর দিয়েই শুরু হয় নব্যবঙ্গ চিত্রকলার নতুন এক আন্দোলন।
১৯০২-এ স্বামী বিবেকানন্দকে জাপানের এক ধর্ম মহাসভায় আমন্ত্রণ জানাতে কলকাতায় এলেন জাপানি ভাবুক, নন্দনবেত্তা, শিল্প-প্রশাসক, শিল্প-ইতিহাসবিদ কাকুজো ওকাকুরা। তিনি এশিয়ার জেগে ওঠা এবং এশিয়ার একতায় বিশ্বাসী ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের আইরিশ শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতার মাধ্যমে ওকাকুরার সঙ্গে কলকাতায় অবনীন্দ্রনাথের যোগাযোগ ঘটে। ওকাকুরার সঙ্গে বাংলার শিল্পীদের যোগাযোগ বাংলার চিত্রকলায় বিপুল প্রভাব ফেলেছিল। জাপানে ওকাকুরা ছিলেন চিত্রকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ‘টোকিও বিজুৎসু গাক্কো’-এর অধ্যক্ষ। সেখান থেকে নানা বিতর্কে জড়িয়ে তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামীদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন নতুন প্রতিষ্ঠান ‘নিহোন বিজুৎসুইন’। ওকাকুরা, ‘নিহোন্গা’ অর্থাৎ আধুনিক জাপানি ছবি চর্চার উপর জোর দিচ্ছিলেন। তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়া শিল্পীদের কয়েকজন প্রবর্তন করেছিলেন এক নতুন ধারার ছবির, যাকে বলা হয়েছিল ‘মোওরোওতাই’, বাংলায় যার মানে ‘ঝাপসা আকার’। ধূসর রঙে আঁকা, প্রথা-ভাঙা এই ধরনের ছবি জাপানে প্রথমে খুব গ্রহণযোগ্য হয়নি। ভারত থেকে দেশে ফিরে, ১৯০৩-এ এই চিত্রধারার দুই বিশিষ্ট শিল্পী তাইকান য়োকোয়ামা আর শুনসো হিশিদাকে কলকাতার ঠাকুরবাড়িতে চিত্রকলার পদ্ধতি বিনিময়ের জন্য পাঠালেন ওকাকুরা। তাঁরা প্রায় ছয় মাস ভারতে ছিলেন। গগনেন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁদের ভাবনার গুরুত্বপূর্ণ আদান-প্রদান হয়।
১৯০২-এ ওকাকুরার প্রথম ভারত ভ্রমণের সময় তাঁর সঙ্গে অবনীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি, যতটা বন্ধুত্ব হয়েছিল সুরেন্দ্রনাথনাথ ঠাকুরের সঙ্গে। রানী চন্দের সঙ্গে কথোপকথনে অবনীন্দ্রনাথ জাপানি শিল্পীদের বিষয়ে স্মৃতিচারণ করেছিলেন। ওকাকুরাকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘মাঝে মাঝে যেতুম, দেখতুম বসে আছেন তিনি একটা কৌচে। সামনে ব্রোঞ্জের একটি পদ্মফুল, তার ভিতরে সিগারেট গোঁজা; একটি করে তুলছন আর ধরাচ্ছেন। বেশি কথা তিনি কখনোই বলতেন না। বেঁটেখাটো মানুষটি, সুন্দর চেহারা, টানা চোখ, ধ্যাননিবিষ্ট গম্ভীর মূর্তি। বসে থাকতেন ঠিক যেন এক মহাপুরুষ। রাজভাব প্রকাশ পেত তাঁর চেহারায়।’ ওদিকে ওকাকুরা সুরেন্দ্রনাথকে খুব পছন্দ করতেন আর বলতেন সুরেন্দ্রনাথ রাজা হবার যোগ্য।
১৯১২ সালে যখন দ্বিতীয়বার কলকাতায় এলেন ওকাকুরা, তখন তাঁর শরীর ভেঙে গেছে। জোড়াসাঁকোর স্টুডিওয় তিনি প্রায়ই শিল্প নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন। অবনীন্দ্রনাথের ছাত্র নন্দলালদের তিনটে দেশলাই কাঠি দিয়ে তিনি বোঝাতেন শিল্পের পরম্পরা, পর্যবেক্ষণ এবং নিজস্বতা। সাধারণ জাপানিরাও ওকাকুরাকে যে দেবতার মতো ভক্তি করত, তার প্রমাণ পেয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। তিনি বলেছেন, ওই সময় তাঁদের বাড়িতে এক জাপানি মালী কাজ করত। সেই মালীর নাম জানা যায় না। তখনও রবীন্দ্রনাথ জাপানে যাননি। সেই মালী কী সূত্রে জোড়াসাঁকোয় কাজ করতে এসেছিলেন, কী কাজ করেছিলেন, কতদিন ছিলেন, সেই বিষয়ে তথ্য নেই। অবনীন্দ্রনাথ বলছেন, ওকাকুরা এসেছেন শুনে মালীর খুব দেখা করার ইচ্ছে। কিন্তু কিছুতেই সে আর ঘরের ভিতরে আসে না। ‘কিছু পরে ওকাকুরার নজরে পড়তে তিনি ডান হাতের তর্জনী তুলে ভিতরের দিকে নির্দেশ করলে পর সে হাঁটু মুড়ে সেখান থেকেই মাথা ঝুঁকতে ঝুঁকতে ঘরে এল। ওকাকুরাও দু-একটা কথা জিজ্ঞাসাবাদ করলেন। সে আবার সেইভাবেই হাঁটু মুড়ে বেরিয়ে গেল। যতক্ষণ ঘরে ছিল সোজা হয়ে দাঁড়ায়নি।… সে বলল ‘বাবা! আমাদের দেশে ওঁর কাছে যাওয়া কি সহজ কথা? আমাদের কাছে উনি যে দেবতার মতো।’ এরকমই এক ছবি পাওয়া গিয়েছিল সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায়। সুরেন্দ্রনাথকে জাপানি মদ খাওয়াবেন বলে ওকাকুরা বম্বেতে এসে দাঁড়ানো এক জাপানি স্টিমারে জাপানি মদ ‘সাকে’র খোঁজে উঠেছিলেন তাঁকে নিয়ে। নিজের পরিচয় দিয়ে ওকাকুরা মাথা অল্প ঝোঁকাতেই, সুরেন্দ্রনাথ লক্ষ করলেন, সেই স্টিমারের সমবেত জাপানিদের মাথাগুলো শ্রদ্ধায় নুইয়ে গেল, দমকা বাতাসের অভিঘাতে আপাত তুচ্ছ, বিনীত ঘাসেদের মতো। ওকাকুরাকে কোনারকে ঘুরতে পাঠিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ এবং সম্ভবত কোনারক ঘুরে এসেই ওকাকুরার এই ধারণা দৃঢ় হয় যে, ভারতবর্ষ ছবির দেশ নয়, ভারতবর্ষ ভাস্কর্যের দেশ।
গগনেন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসুর, মুকুলচন্দ্র দে-র মতো জাপানি শিল্পীদের সাহচর্য অবনীন্দ্রনাথকেও অনেক কিছু শিখিয়েছিল। একবার তাঁর এক ছাত্র ছবি আঁকবে বলে, সামনে কাগজ নিয়ে কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে। অবনীন্দ্রনাথ তাকে বললেন কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কেননা তিনি দেখেছিলেন, ছবি আঁকার সময় তাইকান কেমন কাগজের সামনে ধ্যানস্থ হয়ে থাকেন, তারপর তুলি হাতে নিয়ে কালিতে ডুবিয়ে কয়েকটা আঁচড়ে একটা ছবি ফুটিয়ে তোলেন। যে-ছবি আঁকা হবে তার পুরোটা যেন তাইকান তাঁর ধ্যানে ওই একখণ্ড কাগজে দেখতে পেতেন।
তাইকান আর হিশিদার চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে অবনীন্দ্রনাথ লক্ষ করেছিলেন তাইকানের চেহারা ছিল কিছুটা কাঠ-কাঠ আর হিশিদার মধ্যে একটা কোমলতা। মিষ্টি মুখ, কালো চোখ, আপেলের মতো লাল টুকটুকে গাল— একেবারে জাপানি মেয়েদের মতো। অবনীন্দ্রনাথ ঠাট্টা করে হিশিদাকে বলতেন ‘মিসেস তাইকান’, আর এসব শুনে হেসে খুব মজা পেতেন জাপানি শিল্পীরা।
তাইকান আর হিশিদা থাকতেন সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতেই। ঘুরে ঘুরে তাঁরা স্কেচ করতেন। অবন-গগনের স্টুডিওয় এসে কাজ করতেন এই দুই জাপানি শিল্পী। সেইসব ছবির প্রদর্শনী যেমন হত, তেমনই সেগুলো বিক্রি করে তাঁদের খরচ চলত। অবনীন্দ্রনাথ কখনও দেখতেন, গাড়িতে যেতে যেতে কিছু একটা দেখে তার ফর্মটা মনে রাখার জন্য বাঁ-হাতের তালুর উপর ডান হাত বোলাচ্ছেন তাইকান। কখনও জামার আস্তিনেই এঁকে রাখছেন ছবি। তাইকান মাথায় একটা খড়ের টুপি পরে হাটে-বাজারে রোদের মধ্যে ঘুরতেন। ছিলেন কিছুটা খ্যাপাটে গোছের।
নানা রং দেখে অভ্যস্থ অবনীন্দ্রনাথ প্রথমে জাপানি শিল্পীদের ছবি দেখে কিছুটা হতাশ হয়েছিলেন। তাইকানকে প্রথমবার আঁকতে দেখার স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘… কোত্থেকে একটু কয়লার টুকরো কুড়িয়ে এনে তাই দিয়ে প্রথমে সিল্কে আঁকলে, তার পর পালক দিয়ে বেশ করে ঝেড়ে তার উপরে একটু হালকা কালি বুলিয়ে দিলে, হয়ে গেল ছবি। মন খারাপ হয়ে গেল। সুরেনকে বললুম, ‘ও সুরেন, ছবি যে দেখতেই পাচ্ছি নে স্পষ্ট।’ সুরেন বললেন, ‘পাবে পাবে, দেখতে পাবে, অভ্যেস হোক আগে।’ সত্যিই তাই। কিছুদিন বাদে দেখি, দেখার অভ্যেস হয়ে গেল; তাদের ছবি ভালোও লাগতে লাগল। অনেক ছবি এঁকেছিল তারা। আমাদের দেবদেবীর ছবি আঁকবে, বর্ণনা দিতে হত শাস্ত্রমতে। টাইক্বান এঁকেছিল সরস্বতী ও কালীর ছবি দুটি; সরলার মা কিনে নিলেন।’
বাড়ির দেওয়ালে বিলেতের শিল্পীর তেলরঙের ছবি রাজেন্দ্রলাল মল্লিককে বিক্রি করে দিয়ে অবনীন্দ্রনাথ সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করতে তাইকানকে দিয়ে ছবি আঁকালেন। রাসলীলার ছবি। ছবির জন্য, তাইকানের অনুরোধে রাসলীলার বর্ণনা দিলেন অবনীন্দ্রনাথ। একটি ছোট মেয়েকে মডেল করে তাকে শাড়ি পরিয়ে বোঝালেন শাড়ির রহস্য। মেঝেতে কাগজ বিছিয়ে এরপর তাইকান শুরু করলেন আঁকা। অবনীন্দ্রনাথের নিজের কথায় তাইকানের সেই রাসলীলার ছবি আঁকার বর্ণনাও যেন একটি ছবি— ‘প্রথমে কয়লা দিয়ে সিল্কে ড্রইং করে তার পর একটা আসন পেতে চেপে বসল ছবির উপরে। রঙ লাগাতে লাগল একধার থেকে। দেখতে দেখতে কদিনের মধ্যেই ছবি শেষ হয়ে এল। আকাশে চাঁদের আলো ফুটল, সবই হল, কিন্তু টাইক্বান ছবি আর শেষ করছে না কিছুতেই। বালিগঞ্জের দিকে থাকত, সকালেই চলে আসত, এসেই ছবির উপরে ঢাকা দেওয়া কাপড়টি সরিয়ে ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে দেখে আর কেবলই এ দিকে ও দিকে ঘাড় নাড়ে, কী যেন মনের মতো হয় নি এখনো। রোজই দেখি এই ভাব। জিজ্ঞেস করি, ‘কোথায় তোমার আটকাচ্ছে।’ সে বলে, ‘বুঝতে পারছি নে ঠিক, তবে এইটে বুঝছি এতে একটা অভাব রয়ে গেছে।’ এই কথা বলে, ছবি দেখে আর ঘাড় দোলায়। একদিন হল কি, এসেছে সকালবেলা, স্টুডিয়োতে ঢুকেছে— তখন শিউলি ফুল ফুটতে আরম্ভ করেছে, বাড়ির ভিতরে থেকে মেয়েরা থালা ভরে শিউলি ফুল রেখে গেছেন সে-ঘরে, হাওয়াতে তারই কয়েকটা পড়েছে এখানে ওখানে ছড়িয়ে— টাইক্বান তাই-না দেখে ফুলগুলি একটি একটি করে কুড়িয়ে হাতে জড়ো করলে। আমি বসে বসে দেখছি তার কাণ্ড। ফুলগুলি হাতে নিয়ে ছবির উপরে ঢাকা দেওয়া কাপড়টি একটানে তুলে ছবির সামনে জমিতে হাতের সেই ফুলগুলি ছড়িয়ে দিলে, দিয়ে ভারি খুশি। থালা থেকে আরো ফুল নিয়ে ছবির সারা গায়ে আকাশে মেঘে গাছে সব জায়গায় ছড়িয়ে দিলে। এবারে টাইক্বানের মুখে হাসি আর ধরে না। একবার করে উঠে দাঁড়ায়, দূর থেকে ছবি দেখে, আর তাতে ফুল ছড়িয়ে দেয়— এই করে করে থালার সব কটি ফুলই ছবিতে সাজিয়ে দিলে। সে যেন এক মজার খেলা। ফুল সাজানো হলে ছবিটি অনেকক্ষণ ধরে দেখে এবারে ফুলগুলি সব আবার তুলে নিয়ে রাখলে থালাতে। শুধু একটি শিউলি ফুল নিলে বাঁ হাতে, আসন চাপালে ছবির উপরে, তার পর সাদা কমলা রঙ নিয়ে লাগল ছবিতে ফুলকারি করতে। একবার করে বাঁ হাতে ফুলটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে আর ফুল আঁকে। দেখতে দেখতে ছবিটি ফুলে ফুলে সাদা হয়ে গেল— আকাশ থেকে যেন পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে, হাওয়াতে ফুল ভেসে এসে পড়েছে রাসলীলার নাচের মাঝে। রাধার হাতে দিলে একটি কদমফুল, গলায়ও দুলিয়ে দিলে শিউলিফুলের মালা, কৃষ্ণের বাঁশিতে জড়ালে একগাছি। ফুলের সাদায় জ্যোৎস্না রাত্তির যেন ফুটে উঠল। এইবার টাইক্বান ছবি শেষ করলে, বললে, ‘এই অভাবটাই মেটাতে পারছিলুম না এতদিন।’ সেই ছবি শেষে একদিন দেয়ালে টাঙানো হল। টাইক্বান নিজের হাতে বাঁধাই করলে, বালুচরী শাড়ির আঁচলা লাগিয়ে দিলে ফ্রেমের চার দিকে। বন্ধুবান্ধবদের ডেকে পার্টি দেওয়া হল স্টুডিয়োতে, রাসলীলা দেখবার জন্য। বড়ো মজায় কেটেছে সে-সব দিন।’
তাইকানের স্কেচ-খাতা যেহেতু খুব বেশি পাওয়া যায় না, তাই জাপানে একটা ধারণা রয়েছে যে, তাইকান বোধ হয় স্কেচ করতেন না। অবনীন্দ্রনাথ উল্টো কথা বলেছেন। ভারতে তাইকান নিজে প্রচুর নেচার স্টাডি করতেন। ভারতীয়দের মুখের গড়ন, ভঙ্গি, পাতা, ফুল এঁকে এঁকে খাতার পর খাতা ভরিয়ে ফেলতেন তাইকান। অবনীন্দ্রনাথকে তিনি শেখাতেন লাইন ড্রইং। ক্ষিপ্র গতিতে এঁকে অভ্যস্থ অবনীন্দ্রনাথ দেখতেন, কত ধীরে একটা রেখা আঁকতে হয়! অবনীন্দ্রনাথের থেকে তাইকান শিখে নিতেন মুঘল চিত্রকলার অঙ্কনশৈলী।
‘সেই সময়ে টাইক্বানের ছবি আঁকা দেখে দেখেই একদিন আমার মাথায় এল, জলে কাগজ ভিজিয়ে ছবি আঁকলে হয়। টাইক্বানকে দেখতুম ছবিতে খুব করে জলের ওয়াশ দিয়ে ভিজিয়ে নিত। আমি আমার ছবিসুদ্ধ কাগজ দিলুম জলে ডুবিয়ে। তুলে দেখি বেশ সুন্দর একটা এফেকট্ হয়েছে। সেই থেকে ওয়াশ প্রচলিত হল।’
তাইকানের তুলনায় কলকাতায় তুলনায় কম কাজ করতেন হিশিদা। কখনও হয়তো এক টুকরো মাটি ঘষে রং বের করলেন তিনি, ঘুরতে ঘুরতে বাগানের শিমগাছের পাতা ছিঁড়ে হাতে ঘষে হয়তো সেই রং লাগিয়ে দিলেন ছবিতে। কখনও আবার পড়ে থাকা কুলগাছের ডাল পুড়িয়ে কাঠকয়লার কাঠি বানিয়ে তাই দিয়ে হিশিদা এঁকে ফেললেন ছবি। অকালে মৃত্যু হয় হিশিদার। তাঁর আঁকা একটা ছবি খুব ভাল লেগেছিল অবনীন্দ্রনাথের।
‘একটি ছবি এঁকেছিল— দূরে সমুদ্রে আকাশে মিলে গেছে, সামনে বালুর চর, ছবিতে একটি মাত্র ঢেউ এঁকেছে যেন এসে আছড়ে পড়ছে পাড়ে। সে যে কী সুন্দর কি বলব। পান্নার মতো ঢেউয়ের রঙটি, তার গর্জন যেন কানে এসে বাজত স্পষ্ট। বড়ো লোভ হয়েছিল এই ছবিতে। হিশিদা তো মরে গেল, টাইক্বান ছিল বেঁচে। খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল তাদের সঙ্গে, অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো। বরাবর চিঠিপত্র লিখে খোঁজখবর রাখত।’
অবনীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত সঞ্জামের ভিতর জাপানি তুলি দেখে ধারণা হয়, তিনি জাপানের তুলি ব্যবহার করতেন। হয়তো ব্যবহার করতেন জাপানের কাগজও, কেননা জানা যায় গগনেন্দ্রনাথ জাপান থেকে ছবি আঁকার কাগজ আনাতেন। অবনীন্দ্রনাথের ছবিতে জাপানের আদলে লাল কালিতে ‘সিল’ ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ১৯১২-’১৩ সালে আঁকা সূর্য বন্দনারত সাধকের প্রতিকৃতিতে চিনা অক্ষরের খোদিত যে ‘সিল’ ব্যবহৃত হয়েছে তা দেখে মনে হয় এই ‘সিল’ সম্ভবত জাপান থেকে দ্বিতীয়বার কলকাতায় আসার সময় ওকাকুরা এনে দিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথকে। জাপানি লিখনশৈলী (‘তাতেগাকি’) অনুসরণ করে উপর থেকে নীচে নিজের নামের অক্ষর লিখে ছবিতে সই করতে দেখা যায় অবনীন্দ্রনাথকে। ১৯২০ সালের মাঝামাঝি অবনীন্দ্রনাথের আঁকা গাছের ডালে বসা পাখি আর চাঁদের ছবি একেবারে জাপানি ছবি বলে ভুল হতে পারে।
১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম জাপানে গেলেন। তার তিন বছর আগে প্রয়াত হয়েছেন ওকাকুরা। কিন্তু তাইকান ছিলেন। জাপানে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝলেন কীভাবে সৌন্দর্যের চর্চা গভীর আবেশে ভরিয়ে রেখেছে এশিয়ার ছোট্ট আর প্রাচীন এই দেশটাকে। বুঝেছিলেন জাপানি চিত্রকলার বিশালতা যদি বাংলার শিল্পীরা দেখার আর বোঝার সুযোগ পান তাহলে নব্যবঙ্গের চিত্রকলায় একটা নতুন যুগের সূচনা হবে। রবীন্দ্রনাথ জানতেন নিশ্চিন্ত গৃহকোণ ছেড়ে কোথাও নড়বেন না গগন-অবনরা। মাসে তিনশো টাকা বেতনের ব্যবস্থা করে তিনি তাঁর প্রথম জাপান ভ্রমণের সময় আর এক জাপানি শিল্পী কাম্পো আরাইয়ের কলকাতায় গিয়ে ছবি আঁকা শেখাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে এবং জাপানের সম্পন্ন রেশম ব্যবসায়ী ও শিল্পবেত্তা সানকেই হারার ব্যবস্থাপনায় তাইকান য়োকোয়ামা এবং কান্জান শিমোমুরার দুটো গুরুত্বপূর্ণ ছবি কপি করে শান্তিনিকেতনে নিয়ে এসেছিলেন আরাই যা এই সময় বিশ্বভারতীর কলাভবনের সংগ্রহভুক্ত। জাপানি শিল্পী শ্যোকিন কাৎসুতাও কিছু দিন এসেছিলেন কলকাতায়। অবনীন্দ্রনাথ অথবা গগনেন্দ্রনাথকে জাপানে যেতে রাজি করাতে না পারলেও ১৯১৬ সালে মুকুলচন্দ্র দে আর ১৯২৪ সালে নন্দলাল বসুকে জাপানে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছাত্র নন্দলালের হাতে তাইকান আর তাঁর স্ত্রীর জন্য উপহার পাঠিয়েছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। পরবর্তীকালে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ও গিয়েছিলেন জাপানে। জাপানের প্রথম সারির শিল্পীদের সঙ্গে যোগাযোগ অবনীন্দ্রনাথের সামনে যেমন খুলে দিয়েছিল চিত্রকলার নতুন এক ভুবন, তেমনই তৈরি করে দিয়েছিল জাপানি ছবি দেখবার চোখ।
ঋণ:
১. Paintings of Abanindranath Tagore, R.Sivakumar
২.Taikan- His Heart and Soul: Modern Japanese Painting, Tokyo National Museum
৩.What’s in a name? Rethinking Critical Terms used to discuss Mōrōtai, Victoria Weston
৪. ‘ভারতভ্রমণ দিনপঞ্জি’, কাম্পো আরাই। কাজুও আজুমা অনূদিত।
৫. ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রানী চন্দ।
৬. ‘ভারতশিল্পী নন্দলাল’, পঞ্চানন মণ্ডল।