অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এমন একজন মানুষ ছিলেন যাঁকে নিত্য যাপন করতে হয়। তাঁর জীবনের প্রতিটি দিক, তাঁর জীবনযাপন অনুসরণ করলেই জীবনের আসল শিক্ষা পাওয়া যায়। তবু তাঁর জীবনকে কয়েকটা ভাগে দেখা যায়, তাহলে জীবনের বহু দিক প্রতিভাত হয়।
অবনীন্দ্রনাথ— ভারতীয় চিত্রকলার আধুনিক শিল্পী
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ভারতীয় চিত্রকলার একজন আধুনিক শিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। যদিও আমরা জানি যে প্রতিটি যুগেই সে-যুগের তুলনায় আধুনিক কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা জীবনকে অন্য একটা খাতে বইয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ধরেন। অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন সেইরকম এক মানুষ।
অবনীন্দ্রনাথ ও ভারতের আধুনিক চিত্রকলা
সাহেবরা তাদের শিক্ষা-সংস্কৃতির সঙ্গে শিল্পের ধারাটাও ভারতে বইয়ে দিয়েছিল। উনিশ শতকের আগে ভারতের চিত্রকলা বিদেশি ধারাতেই চর্চিত হত। যদিও গ্রিক আর্টের ধরন ভারতে বিবর্তিত হয়ে গান্ধার আর্টের প্রবর্তন হয়েছিল। অজন্তার চিত্রকলা আমাদের সামনে এসেছিল। কিন্তু তার মধ্যে ভারতীয়তার বড় অভাব ছিল। ভারতীয়তা মানে, তখন অবধি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের সম্পর্কের কথা আমি বলছি না। যাকে বলে ‘ইন্ডিয়ানাইজ্ড’ ছিল না চিত্রকলার ধারাটি। অবনীন্দ্রনাথ প্রথম শিল্পী, যিনি চিত্রকলার ধারাকে ভারতীয়তার ছাঁচে ঢেলে এক নতুন রূপ দিলেন। তিনি হ্যাভেল সাহেবের সঙ্গে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। হ্যাভেলই তাঁকে বলেছিলেন— তোমাদের আঁকায় তোমাদের ভারতীয়ত্বের অভাব। সবই তোমরা বিদেশের অনুসরণ করে করো। বিদেশ থেকে শেখার হয়তো অনেক কিছু আছে, কিন্তু যদি ভারতের মতো করে ভারতীয় চিত্রকলা তৈরি হয়, তবেই সেটাই হবে ভারতীয় শিল্প ও চিত্রকলার সত্যিকারের অভিজ্ঞান। অবনীন্দ্রনাথ সেই কথা মেনে তাঁর আঁকায় ভারতীয় ভাব নিয়ে আসেন এবং এক নতুন ধারার চিত্রকলার জন্ম দেন। হ্যাভেল সাহেবের কথা নিয়ে খুব সমালোচনা হয়েছিল তখন। বলা হয়েছিল, সাহেবরা আমাদের কিছু শেখাতে চায় না বলে এইসব কথা বলছে। কিন্তু অবনীন্দ্রনাথ সে কথায় কান না দিয়ে নতুন ধারার চিত্রকলায় মনোযোগ দিয়েছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মত ছিল, পাশ্চাত্য শিল্পের চরিত্র অনেক বেশি বস্তুবাদী। তাই আধ্যাত্মিক মূল্যবোধগুলি পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতের নিজস্ব ঐতিহ্যগুলিকে বিকশিত করা প্রয়োজন৷
হ্যাভেল সাহেব, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সঙ্গে নিয়েই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজকে একটা নতুন জন্ম দেন। তার আগে অবধি কেবল ব্রিটিশ সার্ভের জন্য ছবি আঁকার ছাত্র তৈরি আর বিদেশি চিত্রশিল্পীদের ধারায় ছবি আঁকা শেখানো হত। অবনীন্দ্রনাথ বহু বছর সেই কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। এবং পার্সি ব্রাউন ও হ্যাভেল সাহেবের অনুপ্রেরণায় অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শৈলীকে তাঁর ছবিতে স্থান দিয়ে নতুন এক ঘরানার চিত্রশৈলী তৈরি করেন, যে ঘরানার নাম হয় বেঙ্গল স্কুল অফ আর্ট, যা পরবর্তীকালে চিত্রকলার জগতে একটি বিশেষ সম্মানের স্থান গড়ে নেয়। যে স্কুলের সঙ্গে নন্দলাল বসুর নাম জড়িয়ে, মুকুল দে-র নাম জড়িয়ে।
এই মানসিকতাই হচ্ছে আধুনিকতা। একটা নতুন কিছু সৃষ্টি করার, ভেঙে-গড়ে নতুন ধারা তৈরি করার, নতুন ভাবনাকে গ্রথিত করার যে সাহস, ইচ্ছে, তা-ই আধুনিকতার জন্ম দেয়। সেই অর্থে অবনীন্দ্রনাথ সত্যিই ভারতের প্রথম আধুনিক চিত্রশিল্পী।
অবনীন্দ্রনাথ— ভারতীয় চিত্রকলায় তাঁর স্থায়িত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা
অবনীন্দ্রনাথ হলেন বেঙ্গল স্কুল অব আর্ট-এর জনক। পরে যাঁরা এসেছেন, বা আমরা যারা এসেছি, তাঁরা সবাই এক অর্থে তাঁর সন্তান। সন্তানদের মধ্যে পিতার অনেক ছাপ থাকে। হাবভাব-ব্যবহারে মিল থাকে। কিন্তু ভাবনাচিন্তার ধরন ও তা প্রকাশের ভঙ্গি অন্যরকম হয়। তখন সে পিতার শেখানো সমস্ত জিনিসকে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করলেও, বাকি খোলনলচে নিজের মতো করে বদলে নেয়। এবং সেটাই দস্তুর। কারণ, অনেক ক্ষেত্রে মিল থাকলেও, সব ক্ষেত্রে পিতা-পুত্রের মিল থাকবে সেটা হয় না, সেটা হওয়া কাম্যও নয়। যদি প্রকাশভঙ্গি বা ভাবনা আলাদা না হয়, তাহলে নতুন কিছু তৈরি হয় না। একটা বীজ ভিন্নদিকে তার ডালপালা বিস্তার করে বৃহৎ এবং ব্যাপ্তিময় হয়ে উঠতে পারে না। তখন তার বিবর্তন থেমে যায়। বিবর্তন থেমে গেলে বিকাশ বন্ধ হয়ে যায় এবং এক সময় তা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু ক্রমাগত বিবর্তিত হতে থাকলে, তার উপস্থিতি সর্বক্ষণ অনুভূত হয়। তবে বিবর্তনের মানে এই নয় যে, তার আদি বিস্মৃত হয়ে যাবে। আদি না থাকলে এই বিবর্তন সম্ভব হত না। অবনীন্দ্রনাথ আদি, তিনি না থাকলে বেঙ্গল স্কুল অব আর্টের প্রতিষ্ঠা হত না। ফলে অবনীন্দ্রনাথের স্থায়িত্ব অক্ষয়।
যিনি একটা নতুন ধারার জন্ম দিয়েছেন, তিনি তো সব সময়ই প্রাসঙ্গিক থাকবেন। হ্যাঁ, একথা সত্যি, তাঁর আঁকার ধরনের প্রভাব তাঁর অনুসারী শিল্পীদের মধ্যে প্রকট না হলেও, প্রচ্ছন্ন থাকবে। আমরা তো সবাই অবনীন্দ্রনাথের অনুসারী। সবাই আমরা তাঁর আঁকা, তাঁর ছবি দেখে অনেক কিছু শিখেছি এবং পরবর্তী প্রজন্মও শিখবে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাঁর প্রভাব আমার ছবিতে প্রতিভাত হবে বা অন্য কারও ছবিতে প্রতিভাত হবে। গণেশ পাইনের মতো বিখ্য়াত শিল্পীও কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের অনুসারী। তাঁর আঁকার মধ্যেও কোথাও না কোথাও অবনীন্দ্রনাথ প্রচ্ছন্নভাবে রয়ে গিয়েছেন। কিন্তু একজনের থেকে অন্যজনের মনের ভাব, জীবনবোধ আলাদা বলেই প্রত্যেক শিল্পী তাঁর নিজের মতো। এবং এখানেই অবনীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক। তিনি এমন এক শিল্পী যে, তাঁর পরবর্তী শিল্পীরা অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার প্রভাব থেকে দূরে থেকেও তাঁর অনুসারী।
অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর জীবনবোধ
অবনীন্দ্রনাথের মতো একজন সম্পূর্ণ শিল্পী পাওয়া খুব দুষ্কর। আসলে তিনি তাঁর ভাবনা ও প্রকাশকে কেবল ব্যক্তিসত্তার গণ্ডিতে বেঁধে রাখেননি। তাঁর আঁকায় যেমন ইতিহাস প্রকাশ পেয়েছে, তেমনই প্রকাশ পেয়েছে তৎকালীন বর্তমান। পরাধীন ভারত এবং সমকালীন সমাজের অবস্থাও তাঁর ছবিতে প্রকাশ পায়। ‘ভারতমাতা’ তার জ্বলজ্বলে নিদর্শন।
আবার তিনি যখন ছোটদের জন্য কলম ধরেছেন, তাঁর লেখায় আমরা পাই শিশুর মতো একটা মন। ছোটদের মনের মতো করে লেখালিখি করে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় শিশু-সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি যখন ‘নালক’, ‘শকুন্তলা’, ‘রাজকাহিনী’ লিখছেন, তখন এক রকমের সংবেদনশীল মন থেকে লিখছেন, আবার যখন তিনি ‘বাগেশ্বরী’ বক্তৃতা দিচ্ছেন তখন সম্পূর্ণ ম্যাচিওর এক শিল্পীর মনোভঙ্গিমা প্রকাশ পাচ্ছে। বারবার পড়েছি আমি বাগেশ্বরী বক্তৃতামালা। এগুলি পড়লে বোঝা যায়, তাঁর মনের দরজা-জানলা কতটা খোলা ছিল। এবং সেই জন্যই তাঁর যে কোনও স্তরে অনায়াস যাতায়াত ছিল। আর্টকে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করার জন্য যে সমালোচকের মন দরকার, তা অবনীন্দ্রনাথের ছিল। তা না থাকলে তিনি ক্রমাগত নতুন জিনিসকে গ্রহণ করে তাকে নিজেক শিল্পশৈলীর মধ্যে মিশতে দিতে পারতেন না।
তাঁর জীবনবোধও কিন্তু একটি মহৎ শিক্ষণীয় বিষয়। সেই জীবনবোধ আমি কিছুটা বোঝবার চেষ্টা করেছি। সেই জীবনবোধটারই কিন্তু অনুসারী আমরা। সেই জীবনবোধটাই তাঁর ছবিতে প্রকাশিত আর আমাদের মনের মধ্যে প্রোথিত।
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে আমরা ১৫০ বছর আগের একজন মানুষকে কেন উদযাপন করব, কেন মনে রাখব তাঁকে এত বছর পরেও? আমি বলব, যদি বাড়ি থেকে কোনও একটি মনোরম নদীর ধারে আমি পৌঁছতে চাই, তা হলে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ফেলে আসা পথটাই কিন্তু আমায় এই মনোরম নদীর ধারে পৌঁছে দিয়েছে। ওই পথটা না থাকলে কিন্তু আমি মনোরম নদীটির ধারে পৌঁছতে পারতাম না। অবনীন্দ্রনাথও সে-ই। তিনি না থাকলে ভারতীয় চিত্রকলা কৃষ্টির জগতের শীর্ষে পৌঁছতে পারত না।