ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • নীল কেটলি: পর্ব ৬


    শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় (July 10, 2021)
     

    পর্ব ৫

    পরস্তাব এক অপরূপ ডিপার্চার

    বাঙালরা আত্মীয়তাকে বড্ড বেশি মূল্য দেয়। আর সেইজন্যই আমাদের বাড়িতে সারা বছর লতায়পাতায় আত্মীয় এবং জ্ঞাতিদের গমনাগমন ছিল অবাধ এবং অবিরল। এত লোকসমাগম হত যে, বাড়ি সর্বদাই সরগরম। আর এইসব অতিথিদের তেমন বায়নাক্কাও কিছু ছিল না, বড় ঘরের মেঝে বা দাদুর কাছারিঘরে ঢালাও বিছানায় তাঁরা নিঃসঙ্কোচে রাত্রিবাস করতেন। রান্নাঘরে (আমরা বলতাম পাকঘর) বা বড় ঘরের বারান্দায় সার সার পিঁড়ি পেতে ভাত পরিবেশন করা হত তাঁদের, আমাদের সঙ্গেই। কারও জন্য কোনও আলাদা আয়োজনের ব্যাপার নেই। আর এই অতিথি সমাগমের জন্য কখনও ঠাকুমা বা আর কারো মুখে কোনও বিরক্তির প্রকাশ দেখিনি। এমনকী অতিথিদের জন্য খরচ বেশি হয়ে যাচ্ছে বলেও কারো কোনও আক্ষেপ কখনও কানে আসেনি। যেন এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। বরং অতিথি কেউ এলেই বাড়িতে বরং একটা আনন্দের লহরী বয়ে যেত। আর যাঁরা অল্পসময়ের অভ্যাগত, তাঁরা বাড়িতে এলেই ছোটদের পয়সা দিয়ে পাঠানো হত মিষ্টির দোকানে। খাঁচাভর্তি মালাইকারি, চমচম, বালুসাই, রসগোল্লা, অমৃতি। প্লেটভর্তি মিষ্টি সাজিয়ে দেওয়া হত অতিথিদের। তখনকার লোকজন এখনকার মতো এত ক্যালোরি-সচেতন ছিলেন না, তাঁরা অম্লানবদনে সব মিষ্টি দিব্যি খেয়েও ফেলতেন। কেউ এলে তাঁকে মিষ্টি না দেওয়াটা ছিল চূড়ান্ত অভদ্রতা এবং বিশেষ নিন্দনীয় ব্যাপার। একটু বড় হওয়ার পর আমাকেও অতিথি আপ্যায়নের জন্য দোকানে দৌড়তে হত। আর তখন তো এখনকার মতো গায়ে গায়ে দোকানপাট থাকত না। মিষ্টির দোকান ছিল বড় কালীবাড়িতে, আর সেটা বেশ একটু দূরে। দিনে চার-পাঁচবার অতিথি এলে ওই চার-পাঁচবারই দৌড়তে হত। আর আমরা, ছোটরা অম্লানবদনেই দৌড়তাম। মিষ্টি বাড়তি হলে সেটা কপালে জুটেও যেত। তখন মিষ্টির মতো ভাল জিনিস আর কীই-বা ছিল আমাদের কাছে! 

    আমাদের বারবাড়ি, অর্থাৎ বাড়ির বাইরের দিককার মাঠটা বেশ বড়। মাঠটা যেখানে শেষ হয়েছে, সেখানে মাঠের দু’দিকে নাবাল জমিতে বছরভর জলকাদা জমে থাকত, দু’দিকের জলাজমির মাঝখান দিয়ে একটা সুড়কির পথ গিয়ে বড় রাস্তায় মিশেছে। জলাজমির দু’দিকেই ছিল জমিদার বীরভদ্রবাবুর প্রজারা। ধোপা, নাপিত, দু’ঘর বোষ্টম, আরও নানা ধরনের খেটে খাওয়া মানুষ। আমাদের সঙ্গে এদের ভারি সদ্ভাব ছিল। বাড়ির পিছনে ছিল পুকুর, আর পুকুরের পিছনে আরও বেশ অনেক ঘর প্রজা। তারা নিতান্তই গরিবগুর্বো মানুষ। তবে তাদের ছেলেপুলেরা ছিল বেজায় ডানপিটে এবং মারদাঙ্গাবাজ। দাদু দাপুটে এবং তেজি মানুষ ছিলেন বলে এরা দাদুকে ভারি সম্ভ্রম করত। 

    বাড়ির দু’পাশে দু’দুটো বড়সড় জমিদারবাড়ি। ডানধারে গোলোকপুরের জমিদারবাড়ি, বাঁ-ধারে ভবানীপুরের জমিদারবাড়ি। দুটো বাড়িই উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা, ভিতরে পাম গাছের সারি, বিশাল বাগান, কাছারিবাড়ি, লোকলস্কর। কেতাই আলাদা। তবে আমাদের সঙ্গে বিশেষ সদ্ভাব ছিল গোলোকপুরের। তেমন দেমাক ছিল না তাঁদের, ধর্মভীরু এবং অমায়িক ছিলেন তাঁরা। তাঁদের বাড়িতে আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল। সেই বাড়িতে তাঁদের পোষা ময়ূরটা ছিল আমার বিশেষ আকর্ষণের বিষয়। পেখম যখন ধরত, তখন অবাক আর মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখতাম তাকে। শুধু ময়ূরটাকে দেখব বলেই কতবার ছুটে গেছি ও-বাড়িতে! 

    জমিদারবাড়ির সেই পোষা ময়ূর

    দুই জমিদারবাড়ির মাঝখানে আমাদের নিতান্তই সাদামাটা টিনের চালের বাড়ি। কিন্তু তখনও আমার কখনও ইচ্ছে হয়নি যে, দালানকোঠায় গিয়ে থাকি। বরং নিজেদের ওই টিনের চালের বাড়িকেই মনে হত রাজপ্রাসাদ। আজও হয়। আজও মাঝে মাঝে ওই বাড়িটিতে ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়। 

    আর ব্রহ্মপুত্র। ব্রহ্মপুত্র সেই জন্ম থেকেই আমার সত্তায় ঢুকে বসে আছে। একটা নদী, তা সে যেমনই হোক, ছোট বা বড়, দুষ্টু বা শান্ত, ভাঙনশীল বা রক্ষণশীল, এমন প্রাণবন্ত মনে হয় তাকে! যেন আপনমনে কত কথা কইতে কইতে বয়ে চলেছে। কার সঙ্গে কথা তার? কীসের এত কথা? কে জানে! কিন্তু তার মিষ্টি মুখরতা বরাবর আমাকে মুগ্ধ করে এসেছে। আর ব্রহ্মপুত্র আমার প্রথম নদী, যাকে না বুঝে না জেনেই ভালবেসে ফেলেছিলাম। আজও সেই ব্রহ্মপুত্র আমার ভিতরে কোনও না কোনও ভাবে বহমান। সন্ধের পর ব্রহ্মপুত্রের ওপারে শম্ভুগঞ্জে আলেয়ার আলো দেখে কী ভয়ই যে পেতাম! বেশির ভাগ মানুষই বলত, আলেয়া হল ভূত। শুধু দাদু সেই আমলের মানুষ হয়েও অনেকাংশে সংস্কারমুক্ত ছিলেন। দাদু আমাকে বুঝিয়ে বলতেন, ‘না রে দাদা, ভূত-টুত না, ওইগুলি হইল গিয়া এক রকমের গ্যাস, তুমি ভয় পাইও না।’

    ভয় তবু করতই। আর কত রকমের ভয়ই না ছিল তখন! ঠাকুমার ছিল বিস্তর ভূতের গল্পের স্টক। ঠাকুমা আবার জয়দেবপুরের মেয়ে। ভাওয়ালের রাজবাড়ির কাছেই বাড়ি। ভাওয়ালের মেজোকুমারকে নাম ধরে ডাকতেন। সেই মেজোকুমার ঘটনাক্রমে দেশবিখ্যাত হয়েছেন, তাঁকে নিয়ে সিনেমা অবধি হয়েছে। ঠাকুমার সঙ্গে আমিও বারকয়েক জয়দেবপুরে গেছি। স্টেশন থেকে ভাওয়াল অনেকটা পথ। হেঁটে যেতে হত। কেমন যেন গা ছমছমে গাঁ! সেই গ্রামে ভূত নেই, তাও কি হতে পারে? সেই ভাওয়ালের কত যে ভূতের গল্প ঠাকুমার কাছে শুনেছি! আমরা অবশ্য গল্পকে বাঙাল ভাষায় বলতাম ‘পরস্তাব’। সন্ধের পরই ঠাকুমার কাছে পরস্তাব শোনা ছিল এক অপরূপ ডিপার্চার। 

    আমাদের বাড়িরই এক কোণে আমাদের এক জ্ঞাতি পুরোহিতকে একটু বাস্তুজমি দেওয়া হয়েছিল। দারিদ্র পীড়িত সংসার ছিল তাঁর। তাঁর শিশু মেয়েটি ছিল ফর্সা আর ফুটফুটে। সে আমাদের উঠোনেই সারাদিন ঘুরঘুর করত, তার বন্ধু-খেলুড়িদের সঙ্গে খেলত। নাম তুলারাণি। আর আমার বমা অর্থাৎ জেঠিমা আমাকে বলতেন, ‘তর লগে তুলারাণির বিয়া দিমু।’ কিন্তু বিয়ে আমার মোটেই পছন্দসই জিনিস নয়, মেয়েদেরও তেমন পছন্দ করতাম না। ফলে তুলারাণিকেও আমার মোটেই পছন্দ হত না। তবে সবাই শুনে হাসাহাসি করত। ফলে আমি অপ্রস্তুত এবং বিরক্ত হতাম। 

    তখন আমি কী সাংঘাতিক পেটুক ছিলাম তা কহতব্য নয়। সকালে জামবাটি ভরা দুধ, তাতে চুড়ো করা মুড়ি আর আস্ত মর্তমান (সবরি) কলা চটকে একটা ভোজ হল তো, ফের সকালে বমার হাতের ভাগাভাগির কয়েক গরাস, দুপুরে ফের ভাত, বিকেলে ফের মুড়ি-চিনি-ঘি একসঙ্গে মাখা কিংবা জামবাটি ভর্তি দুধে পরিমাণমতো মুড়ি আর মর্তমান কলা। মর্তমান কলার ঝাড় ছিল আমাদের বাড়িতে। বড় ঘরের চাল থেকে দড়িতে বাঁধা মস্ত কলার কাঁদি ঝুলে থাকত, যার যখন দরকার ওই কাঁদি থেকে কলা ছিঁড়ে নিত। বিকেলের জলখাবারের পর রাতে ফের ভাত। আর ফাঁকে ফাঁকে ফলটা-পাকুড়টা, আম-জাম-করমচা-কুল-কামরাঙা চালান হয়ে যেত পেটে। ওইটুকু পেট আর কত মোট বইতে পারে! তার ওপর মামাবাড়ি গেলে তো কথাই নেই। ঘিয়ে ভাজা পরোটা, হিং দেওয়া আলুর দম, পোস্ত, ঘন ছোলার ডাল বা ডালপুরি। ফলে প্রায়ই পেট ছাড়ত। 

    বাঙালদেশে বিয়ের নেমন্তন্ন কলকাতার কালচারের সঙ্গে মেলে না। মনে পড়ে বিয়েবাড়ির নেমন্তন্নে গেলে প্রথমেই ভাত এবং শাক বা ভাজা দেওয়া হত বটে, কিন্তু তারপরই পর পর তিন-চার রকমের ডাল দেওয়া হত পাতে। প্রথমে ‘তিতা’র ডাল, তারপর বুটের (ছোলা) ডাল, তারপর মাছের মাথা দেওয়া মুগডাল। ডালের পর ডাল খেয়ে ছোটদের পেট এত ভরে যেত যে, পরে আর অন্য পদ দিয়ে খেতে পারত না। বলে রাখি তখন কিন্তু মাংসের চলন ছিল না। আর পেঁয়াজরসুন দেওয়া মাংস নৈব নৈব চ। বছরে এক-আধদিন বলির মাংস রান্না হত বটে, তবে তা ধনেজিরে দিয়ে। আর নেমন্তন্ন বাড়িডে মুড়িঘণ্ট খুব হত। পাঁপরভাজা আর চাটনির তেমন প্রচলনই ছিল না। আর শেষপাতে দই-মিষ্টির জায়গায় বেশির ভাগ সময়েই দেওয়া হত পায়েস (মিষ্টান্ন)। তবে দই-মিষ্টিও থাকত। পাঁপড় জিনিসটা আমি প্রথম খাই মামাবাড়িতে, আর পোস্তও। আমাদের বাড়িতে পাঁপড় বা পোস্তর রেওয়াজ ছিল না। ভাতের পাতে যে কেউ পাঁপড়ভাজা খায়, সেই অভিজ্ঞতা আমার অনেক বড়বেলায় হয়েছে। 

    আমার বমা বা জেঠিমা ছিলেন রান্নায় অতীব পটিয়সী, বিক্রমপুরের রান্না তাঁর হাতে বিশেষ খোলতাই হত। বিশেষ করে মুড়িঘণ্ট আর পোলাও। তবে আমাদের বাড়ির মহিলাদের প্রায় সকলেই রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। আমার মা আবার বাঙাল আর ঘটি দু’রকম রান্নাই রাঁধতে পারতেন। সেই একরত্তি বয়স থেকেই কী জানি কেন, ডাল আমার বিশেষ প্রিয় জিনিস। শুধু ডাল দিয়েই আমি একথালা ভাত খেয়ে নিতে পারি, আজও পারি। কে জানে সেই কারণেই আমি একটু ডালহেডেড কি না!

    ছবি এঁকেছেন শুভময় মিত্র

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook