২০২০-তে অনেকেই প্রথমবার দেখল, থমকে যাওয়ার চূড়ান্ত অবস্থা কেমন হতে পারে। আমরা অনেকেই দেখলাম কর্মহীনতা, ব্যর্থতা ও নিরাশার চরম সীমা। কিন্তু আশ্চর্য হলাম না, শিল্পের প্রতি মানুষের অগাধ অনাস্থা এবং এক প্রকার ঘৃণা দেখে।
একটি খবরের কাগজের দ্বিতীয় পাতায় একটি প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য ছিল, একটি সমীক্ষা করে সাধারণ মানুষের থেকে জেনে নেওয়া, কোন কাজগুলোকে তাঁরা জরুরি ও কোনগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করেন। সেই প্রয়োজনীয় কাজ বা ‘এসেনশিয়াল সার্ভিস’-এর তালিকায় ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্র, যাদের অবদান রোজের দিনযাপনে অনস্বীকার্য। খাবার বিতরণ, চিকিৎসা, যানবাহনের সঙ্গে যুক্ত কাজ ইত্যাদি এই তালিকায় উল্লিখিত।
তারপর এল অপ্রয়োজনীয় কাজ বা ‘নন-এসেনশিয়াল সার্ভিস’-এর তালিকা। শীর্ষ স্থান পেল শিল্প। অর্থাৎ শিল্পীদের কাজ গুরুত্বপূর্ণ নয়, জরুরি নয়, সহজ ভাষায় বেকার, বাজে, ফালতু। এটা মানুষের কাছে ‘সার্ভে’ করে, তাঁদের প্রশ্ন করে, জনমত থেকে উঠে আসা একটা কথা।
এই তালিকা ঘিরে হইহই পড়ে গেল, পড়াই উচিত। শিল্পীরা অপমানিত হলেন, কেউ কেউ ভেঙে পড়লেন এবং অন্যেরা গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে স্থানান্তরিত হওয়ার পরিকল্পনায় ব্যস্ত হলেন। কিন্তু সমীক্ষার এই ফল আমাকে বা আমার মতো অনেককেই আশ্চর্য করল না।
শিল্পের প্রতি সাধারণ মানুষের এই অবজ্ঞা নতুন নয়। তবে এটা শুধু অবজ্ঞা নয়। একে রাগ বলব, না ঘৃণা বলব, বুঝতে পারছি না। আদতে যে পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে নিজের সংসারের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে আসে, সেখানে ক্ষুধা নিয়ে লেখা চারটে কবিতার লাইন আমার দেশের মানুষের সুমধুর বা হৃদয়স্পর্শী মনে হয় না। যে দেশের মানুষের জন্য শিক্ষাদান ও অন্নদানের বদলে থাকে শুধুই ভিক্ষাদান ও খুদকুঁড়ো ছুড়ে দেওয়া, সেই দেশের মানুষের ঝড়ের দিনে মেঘের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে ইচ্ছে করছে না। তাঁরা একরকম নিজেরাই তা জানিয়েছেন।
তাই এটাও স্বীকার করতে হবে, শিল্পীদের যে ‘এক্সক্লিউসিভ’ বা ‘আলাদা’ হওয়ার প্রচেষ্টা, তার দরুন আমরা মানুষকে ক্রমে দূরে সরিয়েছি, এবং তাঁরাও তাই আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত নন।
এইসব ভাবার পরেও প্রশ্ন করতে হয়, তাহলে কি শিল্প অতদূর পৌঁছল না, যেখানে মানুষকে সে আঁকড়ে ধরে? অথচ এই নন-এসেনশিয়াল সার্ভিস প্রদান করা লোকেরাই নিজেদের কাজ দিয়ে বাড়িতে আটকে থাকা মানুষদের টেলিভিশনে, রেডিওতে, বইয়ে লেখা শব্দে, আঁকা ছবিতে, গাওয়া গানে, খবরের কাগজের ছোট প্রবন্ধে, গণমাধ্যমে আশাবাদী ভিডিওতে প্রশান্তির ছোঁয়া ছুঁড়ে দিয়েছেন। তাহলে এবার একটা চ্যালেঞ্জ দিতে হয়— সত্যি যদি শিল্প অপ্রয়োজনীয় হয়, তাহলে হীরক রাজের আদেশ দিয়ে সব বন্ধ হোক! তখন মানুষ পারবে তো, ঘরে লুকিয়ে ‘এসেনশিয়াল’ কাজে নিমজ্জিত থাকতে? আনন্দে নাচা যাবে না, কষ্টে গাওয়া যাবে না। সমস্ত ‘বেকার, বাজে, অযথা’ কাজে তালা দিলে প্রগতি সম্ভব তো?
এইসব প্রশ্ন নতুন নয়। শিল্পীরা দিনের পর দিন এমন কাজ করছেন, যা শুধুই মাংসের ছিবড়ের মতো। এই ‘ম্লেচ্ছ ওরা’ বলে দেওয়া সভ্যতার মধ্যে থেকেই শিল্পীরা কাজ করছেন। তাহলে কি এসেনশিয়াল হওয়ার জন্য আমাদের কাজের গুণগত মান বাড়াতে হবে? হতে পারে, পৃথিবীর ও সময়ের পরিবর্তনের সাথে গতির লড়াইয়ে নেমে শিল্পীকে উন্নততর কিছুর জন্য এগোতে হবে। তবুও, আবার যদি ১০ বছর পর এই একই সমীক্ষা পুনর্বার করা হয়, তাহলেও ফল একই আসবে।
তার কারণ সহজ, শিল্পকে ব্রাত্য করেই রাখা হয়। কখনও কৌশলে, কখনও অভ্যাসে। কারণ আমরা ছাদে উঠে নাচের ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করি, কিন্তু শিল্পীদের গালাগালি দিতে ছাড়ি না। কারণ আমরা আনন্দ হলে ঘরোয়া আড্ডায় গান গেয়ে উঠি, কিন্তু ভাইবোনদের ‘শিল্পকর্মের’ থেকে দূরে রাখি। কারণ আমরা ভেঙে পড়লে চলচ্চিত্র দেখে আবার এগিয়ে যাওয়ার আশা পাই, কিন্তু অভিনেতার গায়ের রং ফর্সা না হলে তাঁকে ‘খিস্তি’ করতে ভুলি না। কারণ আমরা জন্মমুহূর্ত থেকেই কাউকে শেখাই না যে হৃদয়ের, মস্তিষ্কের, সমাজের, পৃথিবীর সাথে সৃষ্টির মিশে যাওয়াই শিল্প। আমরা সভ্য নাগরিকদের সমাজ, যারা নাকি একটি সার্ভেতেই পরিশ্রম, মেধা, বোধ ও সৃষ্টিকে নস্যাৎ করতে পারি।
অতিমারী এসে শিল্পীদের আয়ে থাবা বসিয়েছে, তা কষ্টের। কিন্তু আরও দুঃখজনক, যে, আমাদের রাষ্ট্র-শিল্প-দেশ-মানুষ মিলিয়ে যে পরিকাঠামো, তা এখনও শিল্পীদের মর্যাদার স্থান দেয়নি।
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী