টোকিও অলিম্পিক্স নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। কোভিড-পরবর্তী সময়ে দুনিয়া জুড়ে আনন্দে মেতে ওঠার প্রধান কারণ হয়ে উঠতে পারত পৃথিবীর এই শ্রেষ্ঠ ক্রীড়া উৎসব। কিন্তু অতিমারীর প্রকোপ রয়ে যাওয়ায়, প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যাওয়ায়, তা সম্ভব হচ্ছে না।
অলিম্পিক্স এই বছর অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত ছিল কি না, এই নিয়ে বিশেষজ্ঞেরা দ্বিমত পোষণ করছেন। এই টালমাটাল অবস্থার মাঝে, ১০,৫০০জন অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষ ও মহিলা জাপানে মাত্র আর কয়েক দিনের মধ্যে তাঁদের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ মুহূর্তের জন্য নিঃশব্দে তৈরি হয়ে চলেছেন। শুধুমাত্র ক্রীড়া উৎসব তো নয়, যেন মারণ ভাইরাসের সঙ্গে সংঘর্ষে মানবজাতির প্রতীকী জয়, যার জন্য সারা পৃথিবী রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে! ইতিমধ্যেই জাপানে পৌঁছে গেছে নানা দেশের টিম; টিকাকরণ সম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও উগান্ডার দলের ক্ষেত্রে একটা কোভিড আতঙ্ক দেখা দিয়েছিল।
অলিম্পিক্স যে হচ্ছেই, সে বিষয়ে বিশ্ব অলিম্পিক কমিটির অবস্থান খুব পরিষ্কার ছিল। জাপানি অ্যাথলিটদের টিকাকরণ শুরু হয়ে গেছে; ওসাকা এবং টোকিওয় অরক্ষিত নাগরিকদের ইমিউনাইজেশন প্রক্রিয়ার কাজ তড়িঘড়ি শেষ করার পালা চলছে। স্বীকৃত মিডিয়া-টিমের সদস্যদের জাপানে ঢোকা ও বেরোনোর যাবতীয় তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছে, এর অন্যথা হলে জাপানে ঢুকতেই দেওয়া হবে না।
সত্যি বলতে, ২০২১-এ অলিম্পিক্স হওয়া উচিত কি না, এই প্রশ্নের কোনও সোজাসাপ্টা উত্তর হয় না। যেখানে বহু বিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গেছে, যেখানে বহু দেশের ক্রীড়াসংস্থা সহ বিশ্ব জুড়ে খেলার ইকো-সিস্টেমটাই অলিম্পিকের ফান্ডিং-এর মুখাপেক্ষী, সেখানে অলিম্পিক্স অনুষ্ঠিত হওয়ার জোরালো কারণ রয়েছে। যে অ্যাথলিটরা পাঁচ বছর ধরে তৈরি হয়েছেন, অলিম্পিক্স না হলে তাঁদের জীবনের ওই বহুমূল্য সময় নষ্ট হবে। অন্যদিকে, সংবাদমাধ্যমের ৩০,০০০ সদস্য এবং ১০,০০০-এরও বেশি খেলোয়াড় জাপানে ঢোকায়, দেশে ভাইরাস ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও অমূলক নয়। বায়ো-বাবল কাজ করবে কি না, টোকিও বায়ো-সিকিওর ক্রীড়ানুষ্ঠান হয়ে উঠতে পারবে কি না, এই সব বিলিয়ন-ডলার প্রশ্নের কোনও উত্তর এখনও অবধি নেই।
ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, টোকিও অলিম্পিক্স হোক, এটা আমরা চাই। অলিম্পিক্স এবং প্যারালিম্পিক্স-এ ভাল ফল করলে, ভারতীয় ক্রীড়া অনেকদূর এগিয়ে যাবে। চার বছর আগে রিও-তে মাত্র চারটে মেডেল পেয়েছিল ভারত। এই বছর আশা আছে, এই প্রথম ভারত ১০টা মেডেল জিতে ইতিহাস রচনা করবে।
ভারতীয় শুটাররা (অলিম্পিক্সের জন্য ক্রোয়েশিয়ায় অনুশীলন করেছেন) এখন পৃথিবীর সেরা, আর ভাল ফর্মে থাকার দিনে, ১৫জনই পদক জেতার সামর্থ্য রাখেন। বর্তমান ফর্ম মাথায় রাখলে, শুটিং-এ একটাও সোনা না পাওয়াটা বিস্ময়ের কারণ হবে। সদ্যসমাপ্ত শুটিং ওয়ার্ল্ড কাপে ভারত একটা সোনা, একটা রুপো এবং দুটো ব্রোঞ্জ মেডেল জেতে, এবং টোকিওয় অংশগ্রহণ করছেন যে শুটাররা— প্রায় সকলেই ফাইনাল রাউন্ড অবধি গিয়েছিলেন। শেষ পর্যায়ে মনঃসংযোগ নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে মানু ভাকরের মতো কেউ-কেউ সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও বেরিয়ে গেছেন। শুটিং-এ এটাই ভারতের সোনালি প্রজন্ম, তাই ভারতের এই খেলায় পদক জেতার সম্ভাবনা খুব বেশি।
এর সঙ্গে আমাদের কুস্তিগির এবং বক্সারেদের যোগ করলে, হঠাৎই ভারতের খেলার জগতের চিত্রটা ঝলমলে, আশাজনক হয়ে ওঠে। বজরং পুনিয়া হোন বা ভিনেশ ফোগাত, আমাদের এই অ্যাথলিটদের পক্ষে না-জেতাটাই খবর হয়ে উঠবে। অলিম্পিক্সে ভারতীয় জয় এখন আর ‘মিরাকল’ নয়। বরং উল্টোটাই সত্যি, আমরা জানি যে আমাদের অ্যাথলিটরা জয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম। এবার ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এ ভারতীয়দের সফল হওয়ার পালা।
আমাদের কিছু অ্যাথলিটদের ক্ষেত্রে টোকিও অলিম্পিক হয়ে উঠতে পারে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার গেমস। পি ভি সিন্ধু এমনই একজন। রিওতে তিনি তারকা ছিলেন না এবং তাঁর জয় একটা গোটা দেশকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। কিন্তু এখন পরিস্থিতি আলাদা। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন সিন্ধু এখন ভারতীয় ব্যাডমিন্টনের পোস্টার গার্ল। এক সময়ের কোচ পুল্লেলা গোপীচাঁদের সঙ্গে সিন্ধুর আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত বেশ কিছুদিন ধরে আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছে। সিন্ধুর ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বারের জন্য অলিম্পিক পদকপ্রাপ্তি এই সব আলোচনার অবসান ঘটাবে এবং তাঁকে ভারতীয় খেলার ইতিহাসে অন্যতম সফল মহিলা ক্রীড়াবিদ হিসাবে তুলে ধরবে।
পুরুষদের ডাবলসে পদক জয়ের সম্ভাবনা আছে সাত্ত্বিক এবং চিরাগ জুটির। ভারত কখনও ডাবলসে অলিম্পিক পদক জেতেনি। গোপীর কথা অনুযায়ী, সাত্ত্বিক এবং চিরাগের এই চিত্রনাট্য লেখার একটা বাস্তবসম্মত সম্ভাবনা আছে।
ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রকোপ এসে এই পদক জয়ের প্রবল সম্ভাবনাকে অনেকটা বিপন্ন করে তুলেছে বটে, কিন্তু এইসব বাধা টপকে আমাদের খেলোয়াড়েরা জিততেই পারেন এবং সেই জয় অবশ্যই দেশের সমগ্র মেজাজকে হাসিখুশি করে তুলবে। ক্রীড়া মন্ত্রক এবং ক্রীড়া সংস্থাগুলিতে একটা উন্নত পেশাদারিত্বের ফলে, নীরজ চোপড়ার মতো প্রতিভাবান অ্যাথলিটেরা বিদেশে ট্রেনিং নিতে যেতে পেরেছেন, পেয়েছেন বহু-প্রতীক্ষিত এক্সপোজার। কোভিডের ভয়ানক দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণে ভারত ‘রেড লিস্ট’-এর অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও, আমাদের তিরন্দাজ, বক্সার, কুস্তিগির, শুটারেরা এবং হকি দল দেশে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং পেয়েছেন, যা আমাদের অলিম্পিক কাহিনির ক্ষেত্রে একটা সম্পূর্ণ আলাদা মানসিকতার পরিচয় দেয়। নীরজের ক্ষেত্রে, ভারতীয় ক্রীড়া মন্ত্রক এবং জে এস ডব্লিউ (অলিম্পিক ক্রীড়ার উন্নয়নে একটা প্রথম-সারির কর্পোরেট সংস্থা), যুগ্মভাবে তাঁকে ইউরোপে অনুশীলনের জন্য পাঠান। অতিমারীর কথা মাথায় রাখলে, এটা সহজ কাজ ছিল না, কিন্তু কোনও সময়েই কেউ হাল ছাড়েননি, এবং এই অসম্ভবও সম্ভব হয়।
আসন্ন অলিম্পিক-আলোচনার অনেকটাই পূর্ণ শরীরের অ্যাথলিটদের নিয়ে হলেও, প্যারালিম্পিক্স কাহিনি কোনও অংশে কম আকর্ষণীয় নয়। দীপা মালিক, ভারতীয় প্যারালিম্পিক্স কমিটির সভাপতি, সরাসরি কিছু বলে দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ভারত ১০টা বা তার বেশি পদক পেতে পারে, যা এক বৈপ্লবিক কাণ্ড হয়ে উঠতে পারে!
২০২১ হল ভারতের অলিম্পিক্সে অংশগ্রহণের শতবার্ষিকী। এই টোকিও গেমসটা ভারতের ক্ষেত্রে একটু আলাদা, কারণ, এর আগে পর্যন্ত আমাদের অ্যাথলিটরা সফল হয়ে এসেছেন একটা সুচারু ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’ ছাড়াই। ‘জুগাড়’ মানসিকতাতেই আমরা বিশ্বাসী, এবং খেলোয়াড়েরা সাফল্য পেয়েছেন অনেকটাই ব্যক্তিগত প্রতিভার কারণে। অভিনব বিন্দ্রা-র কথাই ধরা যাক; শুটিং-এ তাঁর সোনা যেন তাঁর অসাধারণ, একক জিনিয়াসের প্রমাণ। দেশের ক্রীড়া সংসদ নয়, অভিনবের বাবা তাঁর জন্য সর্বোচ্চ মানের ট্রেনিং এবং অন্যান্য ব্যবস্থার আয়োজন করেন। মুশকিল হল, সুপরিকল্পিত পরিকাঠামো ছাড়া একজন অভিনব বিন্দ্রা বা একজন দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া পাওয়া যেতে পারে, তার বেশি কিছু হওয়া শক্ত। ঠিক এই কারণেই আমাদের মেডেলের সংখ্যা কম। কিন্তু টোকিওয় আমরা এই মানসিকতা, এই উদাহরণের আমূল পরিবর্তন দেখতে চলেছি। ভারতের অলিম্পিক স্পোর্টের ইতিহাসে এই প্রথম আমাদের ক্রীড়াব্যবস্থায় কোচিং, পরিকাঠামো, এক্সপোজার এবং অবশ্যই আর্থিক শক্তি সঠিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গো স্পোর্টস, ও জি কিউ, জে এস ডব্লিউ-র মতো কর্পোরেট সংস্থা ভারতীয় অ্যাথলিটদের সম্পূর্ণরূপে সাহায্য করছে এবং সেই কারণেই ঘটছে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন। আমাদের বিশ্বাস, টোকিওয় ভারত সর্বাধিক সাফল্য পাবে। মেডেল দেওয়ার সময় ১০বারেরও বেশি ভারতীয় পতাকা উড়তে দেখা গেলে, ভারতীয় ক্রীড়ায় বিপ্লব ঘটে যেতে পারে। মাত্র আর কিছুদিন— তারপরেই সারা বিশ্বের মিলনসভা শুরু টোকিওয়, ভাইরাসকে হারিয়ে দিতে।