ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ২২


    বিমল মিত্র (July 23, 2021)
     

    পর্ব ২১

    নিজের আনন্দের সাথে যদি অন্যের আনন্দ মেলে, তাহলে সে-আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে মহা-আনন্দের কারণ হয়ে ওঠে। আমার মনেও আনন্দ হয়েছিল এই ভেবে, গুরু তার হাজার কষ্টের মধ্যেও একটু আনন্দ পেয়েছে। গুরুর মা বাসন্তী দেবীও দেখলাম মনে মনে খুব খুশি। গীতাও তাই, বেবীও তাই। এমন পরিপূর্ণ ছুটি ভোগ করবার অবসর জীবনে কদিনই বা আসে! 

    এতদিলে স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ হয়ে গেছে। আমি আর বিমল দত্ত দুজনে মিলে সব শেষ করে ফেলেছি। এবার কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পালা। 

    কলকাতা থেকে চিঠি এসেছে জরুরি। ১৯৬২ সালের মার্চ মাস সেটা। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’র শারদীয় সংখ্যার জন্য একটা উপন্যাস লিখে দিতে হবে। বড় কড়া তাগাদা, কিন্তু তখন বড় ক্লান্ত। সবে মাত্র ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ শেষ করেছি। আর কোনও কাজ হাতে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু তবু উপায় নেই। যাবার আয়োজন সম্পূর্ণ। আর দুদিন তখনও বাকি, হঠাৎ সেই দুর্ঘটনাটা ঘটল। 

    আগের দিনও বেশি রাত পর্যন্ত গল্প করেছি চারজনে। খাওয়ার সময় গোল হয়ে বসে সেই রোজকার আসর। তারপর রাত্রে ঘুমোতে গিয়েছি নিজের বিছানায়। তারপর ভোরে উঠে ইজিচেয়ারটায় হেলান দিয়ে বসেছিলাম। আমার ঘরটার সামনে একটা বাগান। বাগানে বড়-বড় গাছ। অনেক পাখি এসে বসে সেই গাছে। বেশ ভালো লাগছিল। এর পরেই প্রতিদিন রতন চা নিয়ে এসে হাজির হয়। বাড়ির ভেতর থেকে কথাবার্তার শব্দ কানে আসে। সংসারের দৈনন্দিন কাজ-কর্ম শুরু হয়ে যায় বাড়িতে। তারপর আসে গীতা। গীতার ছেলেরা সকালবেলায় স্কুলে যায়। তাদের তৈরি করিয়ে দেয় গীতা নিজের হাতে। তারপর গুরুর স্টুডিওতে যাবার পালা। লুঙ্গিটা পরে গায়ে পাঞ্জাবি চড়িয়ে পান খেতে-খেতে গাড়ি চালায়। আর পাশে থাকি আমি। এ হল নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার। 

    কিন্তু সেদিন সব চুপচাপ। কোনও শব্দ নেই কোথাও। আমরা একটু অবাক হয়ে গেলাম। কই, এখনও তো চা দিতে এল না রতন। তবে কি আজকে গুরুরা অনেক দেরি পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে? আটটা বাজল, নটা বাজল, সাড়ে নটা বাজল, হল কি এদের?

    অনেক পরে রতন চা নিয়ে এসে হাজির। বললাম— রতন তোমার সাহেব উঠেছে ঘুম থেকে— 

    রতনের মুখে সেই এক কথা— জি, হাঁ—

    রতন চলে গেল। আমরা অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম গীতা আসছে না কেন? তবে কি গুরু আজ স্টুডিওতে যাবে না। 

    হঠাৎ এক কান্ড হল। দেখি গীতার বড় গাড়িটা ঢুকল গীতার বাগানের ভেতর। 

    গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার এসে আমার স্ত্রীকে বললে— বউদি, দিদিমণি আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন— 

    দিদিমণি! আমরা অবাক হয়ে গেলাম কথাটা শুনে! দিদিমণি মানে তো গীতা! গীতা তাহলে কোথায়? 

    ড্রাইভার আবার বললে— দিদিমণি সান্তাক্রুজে— 

    গুরুর মনের মধ্যে দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে, দেখলাম। এই এত আনন্দ, হাসি, এত মিল, হঠাৎ এমন করে সব নষ্ট হয়ে গেল। কেন হল বুঝতে পারলাম না। কেন এমন হয়, তাও বুঝতে পারলাম না। ঐশ্বর্যের কেন্দ্রে বসে এত অশান্তি ঝড় সহ্য করা— এ কেন হয়? 

    সান্তাক্রুজেই গীতার বাপের বাড়ি। সেখানেই গীতার ভাই, মা, বোন সবাই থাকে! কিন্তু কাল রাত বারোটা পর্যন্ত তো গীতা এই বাড়িতেই ছিল! সেখানে আবার কথন গেল? সবই যেন রহস্যময় বলে মনে হল।

    বললাম— কখন গেল দিদিমণি সেখানে? আজ সকালে? 

    ড্রাইভার বললে— কাল রাত দুটোর সময় এ-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে— 

    —সে কি? কেন?

    ড্রাইভার সে কথার উত্তর দিলে না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি আমার স্ত্রীর মুখের দিকে চাইলাম। বললাম— সাহেব কোথায়?

    —এই বাড়িতে! 

    —ঘুমোচ্ছে? 

    —না, জেগে আছে—

    আমার মনে পড়ল অনেক দিন আগে গীতার বলা কথাগুলো। 

    গীতা খাবার টেবিলে বসে একদিন আমাকে বলেছিল, বিমলদা, আপনার ‘সাহেব বিবি গোলাম’ আপনি যে গল্প লিখেছেন, আমাদের এ-বাড়িটাও তাই—

    আমার স্ত্রী ড্রাইভারকে বললে— তুমি আধঘন্টা পরে ফিরে এসো, আমি ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিই, তারপর যাব—

    ড্রাইভার সে-কথা শুনে আবার গাড়ি নিয়ে চলে গেল বাইরে। গাড়ি চলে যেতেই গুরু এসে হাজির। গুরুর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম মুখখানা আবার গম্ভীর হয়ে গেছে। গুরু আমার স্ত্রীকে দেখে অবাক হয়ে গেল। 

    বললে— কি হল বউদি সান্তাক্রুজ যাননি? দেখলাম গাড়িটা এল? 

    গুরু হয়তো ভেবেছিল গাড়িটা যখন বাইরে বেরিয়ে গেল তখন আমার স্ত্রীও সেই গাড়িতে চলে গেছে। বললাম— হঠাত গীতা চলে গেল কেন? 

    গুরু শুধু বলল— শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে— 

    উল্টোপাল্টা কথা। ঠিক বুঝতে পারলাম না। গীতার ড্রাইভার এক রকম বললে, গুরু আর একরকম বললে। কোনটা, কার কথাটা বিশ্বাস করব? 

    খানিক পরে আমার স্ত্রীও তৈরি হয়ে নিলে। তারপর গাড়িটা যখন আবার এল, তখন চলে গেল। 

    গুরুর মনের মধ্যে দিয়ে যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে, দেখলাম। এই এত আনন্দ, হাসি, এত মিল, হঠাৎ এমন করে সব নষ্ট হয়ে গেল। কেন হল বুঝতে পারলাম না। কেন এমন হয়, তাও বুঝতে পারলাম না। ঐশ্বর্যের কেন্দ্রে বসে এত অশান্তি ঝড় সহ্য করা— এ কেন হয়? 

    একবার মনে আছে গুরুর বাড়িতে আমি আছি। একজন জ্যোতিষী এসে হাজির হয়েছিল। গুরু আর গীতা দুজনের কোষ্ঠি দেখে অনেক কিছু বলেছিল। অনেক্ষণ ধরে বিচার করেছিল। আমি নিজের ঘরে বসে বুঝতে পারছিলাম না, কিসের এত কাজ! পরে শুনলাম জ্যোতিষী এসেছে। 

    সেদিন আমি একলাই খাওয়া-দাওয়া করে নিয়েছি। যখন জ্যোতিষী মোটা বখশিশ নিয়ে চলে গেল, তখন দুজনে এল আমার ঘরে। 

    আমি জিজ্ঞেস করলাম— জ্যোতিষী কি বলে গেল? 

    গুরু বললে— আমার মঙ্গলটা নাকি খুব খারাপ— 

    — তার মানে? 

    বললে— মঙ্গলবার যেন কোনও কাজ না করি। কিন্তু আমি দেখেছি, মঙ্গলবার দিনটা আমার বরাবর খারাপ যায়। আমার জীবনে যত খারাপ ঘটনা ঘটেছে সমস্ত মঙ্গলবার—

    গীতাও কথাটা শুনে বললে— মঙ্গলবার দিন আমাকে বিয়ে করলে কেন?

    সে কথার কে আর জবাব দেবে! অনেকদিন ধরে গুরু গীতাকে বিয়ে করবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছে। প্রায় দু’তিন বছর। শেষকালে যখন বিয়ের তারিখ স্থির হল, সেটা সেই কুখ্যাত ‘মঙ্গলবার’। হয়ত গুরুর ললাটে ওইটেই ছিল লিখন। কে-ই বা খন্ডাবে সেই অবধারিত নিয়তি! তারপরে যতবার ওই নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে কথা হয়েছে, ততবারই নিজের কৃতকর্মের কোনও জবাব গুরু দেয়নি, কে বলতে পারবে কেন সে বেছে-বেছে মঙ্গলবারে বিয়ে করবার জন্য পীড়াপীড়ি করেছিল। অথচ দুজনের কত মধুর সম্পর্ক। একজনকে ছেড়ে আর একজন যে থাকতে পারে না, তার নজিরও পেয়েছি বহুবার। এমন আকর্ষণ সাধারণত স্বামী-স্ত্রীতে থাকে না। গীতা না থাকলে গুরু একলা অসহায় বোধ করে, তবু দুজনেই এটা মন খুলে বলতে পারে না। 

    একজনের আড়ালে অন্যজন আমাকে পেয়ে তার দুঃখের কথাগুলো শোনাতো, আমিও মন দিয়ে শুনতাম সে সব। কিন্তু সান্ত্বনা বা প্রতিকারের ভাষা আমি খুঁজে পেতাম না। ঈশ্বরের কাছে একান্তে প্রার্থনা করতাম— ভগবান, তুমি যদি সত্যিই থাকো তো এদের সব অসঙ্গতি দূর করে দাও— কিন্তু দুর্জ্ঞেয় ভবিতব্যের আর এক নাম বোধহয় ‘নিয়তি’। সেই নিয়তির অমোঘ বিধানের শুধু নীরব সাক্ষী হয়েই রইলাম, এইটেই আমার দুঃখ। গুরুর ছোট ভাই আত্মা বলেছিল— আমি জীবনে আর কিছু চাই না, শুধু একটা আকাঙ্ক্ষা আছে এই যে, গুরু যেন সুখী হয়—

    সকলের এত শুভেচ্ছা, এত শুভাকাঙ্ক্ষা সব কিছু ব্যার্থ করে নিয়তি যে এমন মর্মান্তিক পরিণতিতে পৌঁছবে, তা সেদিন কে জানত? 

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook