সত্যিই সে কটা দিন বেশ কাটল। আমি, আমার স্ত্রী, গীতা আর গুরু। আমি আর গুরু সকালবেলাই স্টুডিওতে চলে যাই। আমার মনটাও তখন হালকা। মাথার মধ্যে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর বোঝা আর নেই। সেই-ই প্রথম খোলা মন দিয়ে সব দেখতে লাগলাম, সঙ্গে থাকে বিমল দত্ত। স্ক্রিপ্ট লেখা হয়। সকালবেলা আর কেউ যাবার আগে আমরা গিয়ে স্টুডিওতে ঢুকি। রতন গিয়ে আগে-আগে ঘরের চাবি খোলে। পাখা চালিয়ে দেয়। এয়ারকন্ডিশন প্ল্যান্টের সুইচ খুলে দেয়। চা আনে, ব্যাগ থেকে সিগারেট বার করে দেয়। তারপর একটা ধূপ জ্বালিয়ে দেয়।
তখন শুরু হয় গল্পের কথা! স্ক্রিপ্টের কথা। ভবিষ্যৎ প্ল্যানের কথা! গুরুকে খুব সুখী মনে হয়। আগের ছবি ‘চৌধবী কা চাঁদ’ (চতুর্দশীর চাঁদ) ছবিটা থেকে প্রচুর টাকা উপার্জন হয়েছে। গুরুর সুখ্যাতি হয়েছে প্রোডিউসার হিসেবে। তারপর শরৎচন্দ্রের ‘বৈকুন্ঠের উইল’ ছবিটাতে ‘গোকুল’-এর অভিনয় করেছে, তাতেও খ্যাতি হওয়ার আশা আছে। তারপর আরো অনেক ছবিতে অভিনয় করবার জন্য ডাকছে।
গুরু বললে— জানেন, এখন সবাই আমাকে ছবির জন্য ধরছে— কে. আসিফ একটা নতুন ছবি করবে, তার নাম ‘লাভ অ্যান্ড গড’— তাতেও আমাকে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করতে বলছে—
বললাম— ভালোই তো—
কিন্তু এর শেষ কোথায়? এই খ্যাতি, এই অর্থ, এই প্রতিষ্ঠা, এই প্রতিপত্তি, এর কি কোথাও শেষ নেই? কোথায় ছিল একজন গরিব ঘরের সন্তান, তারপর আস্তে-আস্তে পার্থিব সুখের চরম শিখরে গিয়ে উঠল গুরু। তারপর অর্থ প্রতিপত্তির সঙ্গে এল লোভ, অমিতব্যয়িতা, এল শত্রু, এল বন্ধু। তখন আর বিশ্রাম বলে কিছু রইল না। খোশামুদের দল এসে জুটল। তারা গুরুর চারপাশে এসে দিনরাত গুন গুন করতে লাগল। এই-ই হল গুরু।
এই ট্র্যাজেডিই গুরু দত্ত ট্র্যাজেডি। এ ট্র্যাজেডি গুরুকে অস্থির করে তুলল। চারপাশের লোকজনদের সকলের দিকে চেয়ে গুরু শুধু দেখলে শুধুই স্তাবক। গুণগ্রাহীর সংখ্যা আছে বটে, কিন্তু বড় কম। লক্ষ-লক্ষ টাকার আকর্ষণে জুটতে থাকল সবাই। সামনে মিষ্টি কথার মোহ। কেবল মিষ্টি কথা। তুমি জিনিয়াস, তুমি গ্রেট, তুমি মহান। তোমার মতো মানুষ হয় না— এ কথা বলবার লোক ভিড় করে এসে দাঁড়াল গুরুর সামনে। ঠিক সেই সময়ে আমি গিয়ে হাজির হলাম বোম্বাইতে।
গুরু একদিন বললে— বিমলবাবু, আপনি বোম্বাইতে চলে আসুন—
বললাম— কিভাবে বম্বে আসব?
গুরু বললে— এককালে আমি অভিনয় করতে চেয়েছিলাম, তখন কেউ সে সুযোগ দেয়নি— আমি ছিলাম শুধু ডাইরেক্টর। শুধু পরিচালক। তাও আবার দেবানন্দ আমার বিশেষ বন্ধু বলেই আমাকে চান্স দিয়েছিল—
বললাম— কিন্তু আপনি গল্প সম্বন্ধে এত জিনিস জানলেন কি করে?
গুরু বললে— ছোটবেলায় আমার বাবা অফিস থেকে বই আনতেন। বাবার খুব পড়ার ঝোঁক ছিল। আমাদের চার ভাইয়ের মধ্যে আমি আর আত্মা এই দুজনেরই শুধু পড়বার ঝোঁক, আর কারো এদিকে নেশা নেই। সেই ছোটবেলাতেই মোপাসাঁর সব গল্প পড়ে শেষ করে দিয়েছিলাম—
তারপর যা কিছু পড়ত গুরু একটু ভালো লাগলেই মনে থেকে যেত। এককালে টাকা ছিল না বই কেনবার। সিনেমা সম্বন্ধে জানবার ইচ্ছা থাকলেও জানতে পারতুম না কিছু। এখন আমি সবগুলো সিনেমা-জার্নাল কিনি। বিলেত থেকে আনিয়ে নিই। সব রাখা আছে বাড়িতে কিন্তু কেউ কিছু পড়ে না। দেখে দুঃখ হয়—
তেমনি করেই হঠাৎ একদিন ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে একটা গল্প নজরে পড়ে। অখ্যাত লেখক, কাঁচা লেখা। কিন্তু গল্পটা মাথার মধ্যে রইল বহুকাল। অনেক বছর কেটে গেল। কিন্তু গল্পটা মাথা থেকে গেল না। সেইতে নিয়েই ছবি করলাম— ‘পিয়াসা’। সেও এক সার্থক ছবি। বহু সুনাম, অর্থ, প্রতিষ্ঠা পেয়েছি সে ছবিতে!
— যেভাবে আপনার খুশি। পে-রোলে গেস্ট হয়ে থাকতে চান থাকুন, নয় তো অন্যভাবে? আপনার জন্য আমি একটা ফ্ল্যাট জোগাড় করে দেব—
বললাম— এখন আর তা হয় না— আগে হলে হত—
গুরু বললে— আপনি কাছে থাকলে ভালো হত, এখানে বোম্বাইয়ের গল্প-লেখকদের বড় অভাব। আমি এখানকার সকলকে দিয়ে লিখিয়ে দেখেছি। মাসে-মাসে টাকা দিয়ে গিয়েছি, কিন্তু যখন লিখে এনে দেখিয়েছে, তখন গল্প পড়ে হেসেছি— অনেক গল্প লেখকের নাম করলে গুরু। সে সব লেখকদের নাম করা উচিত নয়।
আমি গুরুকে বাঙালি সেরা গল্প লেখকদের বই পড়তে বললাম।
গুরু বললে— আপনি একটা লিস্ট করে দিন আমি কিনিয়ে আনব—
আমি লিস্ট করে দিয়েছিলাম। বাংলা দেশের কোনও লেখক বাদ দিলাম না। সকলের শ্রেষ্ঠ গল্প, সকলের সেরা বই-এর তালিকা। প্রায় পাঁচশো টাকা খরচ করে উজ্জ্বল বুকস থেকে কিনে গুরুর ডিস্ট্রিবিউটার সব বই একদিন পাঠিয়ে দিলে।
গুরু বললে— আমি সমস্ত পড়ব একে-একে—
যে কদিন ছিলাম, খুব আনন্দ দিয়ে গুরুকে মাতিয়ে রাখবার চেষ্টা করলাম। তারপর ফিরে আসার আগেই একটা বিপর্যয় ঘটে গেল। বড় মর্মান্তিক বিপর্যয়। দুর্ঘটনার কথা বলবার আগে আর একটা ঘটনার কথা বলে নিই।
আগের দিন কেউ কিছু বুঝতে পারিনি। কোথাও কোনো লক্ষণই ছিল না তার। বেশ আরাম করে গল্প করা গেছে। গুরু অনেক গল্প করেছে। শুধু শেষ দিনটাই নয়। ১৮ মার্চ থেকেই আমরা চারজনে একাকার হয়ে গিয়েছিলাম। গীতা কয়েকদিন ধরেই বলছিল— বউদি এসেছে, আপনি কোথাও ওদের বেড়াতে নিয়ে গেলেন না।
গুরুও অনেকদিন পরে বেশ খুশি ছিল। আমাদের সবাইকে নিয়ে একদিন বেরোল। দুখানা গাড়ি চলল লোনাভালার পথে। একটা গাড়িতে গুরুর মা বাসন্তী দেবী, আমার স্ত্রী, গীতা, আর বেবী। বেবী ‘অমৃতা রায়’ নামে ‘গুলমোহর’ ছবিতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিল। আর সামনের গাড়িতে আমি আর গুরু।
মাঝপথে একটা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে দুপুরবেলার খাবার কিনে বাক্সভর্তি করা হল। তারপর যখন গাড়ি পৌঁছোল গন্তব্যস্থলে তখন বেশ বেলা পড়ে এসেছে। ধাঙ কাটা হয়ে গেছে। সমস্ত ক্ষেত খাঁ-খাঁ করছে। বিরাট খামার বাড়ি। চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। মুরগির পাল চরে বেড়াচ্ছে। মালী এসে সেলাম করল। চা তৈরি হতে লাগল স্টোভে। খামার বাড়িতে সবরকম ব্যবস্থা আছে। ইলেকট্রিক লাইট, টেলিফোন, খাট-বিছানা, এমন কি ট্র্যাক্টর পর্যন্ত। একেবারে কোণের দিকে বিরাট একটা ইঁদারা। তার ভেতরে মাছ পুষেছিল গুরু। কিন্তু তখন সব মরে গেছে।
গুরু আমাকে দেখাতে লাগল। বলল— দেখুন, এত বড় খামার করেছি, এ-সব দেখবার কেউ নেই। গীতা যদি এসব দেখত তো ভালো হত—
পাশেই একটা নদী, মেয়েদের সবাই নদীতে চলে গেল স্নান করতে। আমি আর গুরু দুজনেই বাথরুমে স্নান করে নিলাম। জীবনে এই খামার বাড়িটাতে এসেই যা শান্তি পেত গুরু। যখনই অশান্তিতে অস্থির হয়ে উঠেছে, তখনই দৌড়ে পালিয়ে এসেছে এখানে। এখানে এসে এই ফাঁকা আবহাওয়ার মধ্যে গুরু তার অনিদ্রা-অশান্তি-অসন্তোষ সব ভুলতে চেয়েছে।
আমার হঠাৎ মনে পড়ল— আজ ১৮ই মার্চ— আজ আমার জন্মদিন। গুরুর জন্মদিন ৯ জুলাই। সে অনেক দেরি। কিন্তু ঠিক এই জন্মদিনেই কেন গুরু এখানে আসবার ব্যবস্থা করলে। এও বোধহয় এক দুর্ঘটনা। আজ যদি ভালোয়-ভালোয় দিনটা কাটে তো মনে একটু শান্তি পাই। কারণ গুরুর ব্যাপারে কিছুই বলা যায় না। যে কোনও মুহুর্তে যে কোনও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আগে থেকে কোনও আভাস পাবার উপায় থাকে না।
বিকেলবেলায় বললাম— চলুন, একটু হেঁটে বেড়িয়ে আসি—
গুরু বললে— চলুন—
সামনে পুনা রোড। বিরাট লম্বা-চওড়া পিচ ঢালা রাস্তা। তার দুপাশে বড়-বড় গাছ বসানো। মাঝে-মাঝে দু একটা প্রাইভেট গাড়ি বা লরি কিংবা বাস চলেছে। সুদূর দিগন্তে মিলিয়ে গেছে রাস্তার সামনেটা। তার ওপর দিয়ে আমরা চলেছি। আসলে গুরুকে হাঁটানোই ছিল আমার উদ্দেশ্য। গুরু সমস্ত দিনই বসে থাকে কিংবা গাড়ি চড়ে বেড়ায়। এটা ছিল ওর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই হাঁটলে যদি ওর স্বাস্থ্যটা ভালো হয়, এই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
কিন্তু অত রাত জাগায় যে এতদিন শরীর বেশি খারাপ হয়নি, এইটেই ছিল আশ্চর্য ঘটনা। বললাম— এমনি মাঝে-মাঝে আপনার হাঁটা উচিত—
গুরু বললে— সত্যি, হাঁটা উচিত—
তাহলে বোম্বাইতে হাঁটেন না কেন? সকালবেলা জুহু বিচ-এ গিয়ে তো হাঁটতে পারেন—
— পারি তো সবই, কিন্তু হয়ে ওঠে কই?
বললাম— আপনার কষ্ট হলে বলবেন, তখন ফিরব—
গুরুর বোধহয় এই হাঁটা ভালো লাগছিল। এত বছর ধরে এখানে বাড়ি, কখনও এ-রাস্তায় এভাবে হাঁটেনি। বলতে লাগল— এবার গীতাকে নিয়ে কাশ্মীর গিয়েছিলাম। সেখানে খুব হেঁটেছি। খুব বেড়িয়েছি। সেখানে একটা সাধুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল বিমলবাবু। সে কি বলেছিল জানেন?
— কি?
— আমার আর গীতার বহুদিন থেকে একটা মেয়ের শখ আছে। আমার দুটি ছেলে, একটা মেয়ে থাকলে খুব ভালো হত! তা বললে— এবার নাকি গীতার একটা মেয়ে হবে।
— আপনার কি সাধু-সন্ন্যাসীতে বিশ্বাস আছে?
— বিশ্বাস? আমার কিসে বিশ্বাস নেই বলুন? আমি বিশ্বাস করি এমন অনেক জিনিস আছে সংসারে, যা মানুষের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বাইরে। আমার নিজের জীবনেই তেমন ঘটনা ঘটেছে। কয়েক বছর ধরে যে যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে জীবন কেটেছে, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ঘটছে সবগুলো। প্রচুর অশান্তি আবার তার সঙ্গে প্রচুর টাকা। এত অশান্তিই বা দেয় কে? আবার এত টাকাই বা আসে কেন? তারপর এখন ভাবি আমার এমন কি অশান্তি হয়েছিল যে আমি আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম? এখন ভাবলে ভয়ে আঁতকে উঠি! কিন্তু সেদিন তো নির্বিবাদে স্লিপিং পিলগুলো গিলতে আমার বাধেনি?
এমনি অনেক কথা হতে লাগল রাস্তাময়। চলতে-চলতে একেবারে দুমাইল দূরে চলে গিয়েছিলাম। আবার ফিরতে লাগলাম।
লোনাভালা থেকে ফেরার সময় আশি মেইল রাস্তাতেও সেই একই কথার জের চলতে লাগল। ছোটবেলার ছোট-ছোট স্মৃতি। কলকাতার বাড়ির সামনে গলি রাস্তায় লাট্টু খেলবার কথা। বললে— জানেন, একবার কি হয়েছিল? পাড়ার একজন ছেলে হঠাৎ আমায় বলল— তুই তোর বাবার পোষ্যপুত্তুর—
— সে কি?
— কথাটা ঠাট্টা করেই বলেছিল সে। কিন্তু আমার যে কদিন ধরে কি মনোকষ্ট তা আমি কি বলব! আমি মা’র কথা, মা’র ব্যবহার, সব কিছু আলোচনা করতে লাগলাম নিজের মনে-মনে। মনে হল ঠিকই বলেছে ছেলেটা। আমি তো সারা জীবন মা’র কাছ থেকে কখনও ভালো ব্যবহার পাইনি! আমার যেন দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গেল আমি আমার বাবা-মা’র পোষ্যপুত্র!
— তারপর?
— তারপর অবশ্য সব স্পষ্ট হয়ে গেল। আসলে সেই ছেলেটা আমাকে ক্ষেপাতে চেয়েছিল!
বললাম— এটা নিয়েই তো ভালো গল্প হয়!
— লিখুন না।
বললাম— লিখব—
বোম্বাইয়ের কাছে চলে এসেছি ততক্ষণে। পেছনে-পেছনে ওদের গাড়িটাও আসছে চেয়ে দেখলাম। গীতা, গুরুর মা, আমার স্ত্রী আর বেবী। সারাটা দিন সকলেরই আনন্দে কেটেছে। গুরুর মা বাসন্তী দেবী আমাকে আড়ালে বলেছিলেন— অনেক দিন পরে গুরুর মুখে হাসি দেখলাম—
আর আমার আনন্দটাই কিন্তু ছিল সবচেয়ে বেশি। সারাটা দিন সত্যিই এমন আনন্দে কাটল। গাড়িটা প্রায় তখন বোম্বাইতে ঢুকছে। আর কোনও অশান্তি হওয়ার আশঙ্কা নেই। শেষে আর থাকতে পারলাম না। বললাম— একটা কথা আপনাকে বলি। সকাল থেকে বলিনি। কিন্তু এখন আর বলতে দোষ নেই। জানেন, আজকে আমার জন্মদিন—
— তাই নাকি? গুরু অবাক হয়ে গেছে, বললে— হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ। আগে বলেননি কেন?
বললাম—বললে যদি কোনও বিপদ হত আমার যে আফশোশে শেষ থাকত না—
এতক্ষণে গাড়িটা নির্বিঘ্নে পালি হিল-এর বাড়িতে এসে ঢুকল।
পুনঃপ্রকাশ
মূল বানান অপরিবর্তিত