ইউরো কাপের সাম্প্রতিক ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচে, হঠাৎই ডেনমার্কের ফুটবলার এরিকসেন মাঠে লুটিয়ে পড়েন। আর গোটা বিশ্বের ফুটবল-ধর্মাবলম্বী মানুষ উদ্বেগে আর ভয়ে ছটফট করতে থাকে। একজন বছর-তিরিশের টগবগে ফিট যুবক, যিনি কিনা আগের মুহূর্ত পর্যন্ত মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎই স্তব্ধ হয়ে মাঠে পড়ে আছেন? বোঝা যায়, অতর্কিতে তাঁর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছে।
প্রশ্ন হল, কেন এমন ঘটল? এত আচমকা, কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হার্ট স্তব্ধ হয়ে গেল একেবারে! অথচ এইসব খেলোয়াড়দের ফিটনেস তো প্রশ্নাতীত। বিদেশের অধিকাংশ ফুটবলার একেবারে জুনিয়র স্তর থেকে ফিটনেসের যে প্রশিক্ষণ এবং পরিচর্যা পান, তা খুব উচ্চ মানের। আমি যখন ইংল্যান্ডে ছিলাম, তখন ম্যাঞ্চেস্টার-এ বা অন্য কোথাও খেলা দেখতে গেলে দেখতাম, প্রতিটি সূক্ষ্ম স্তরের প্রতি ওঁরা অত্যন্ত নজর দিয়ে তৈরি করেন প্রশিক্ষণ প্ল্যান এবং সেই অনুযায়ী শরীরচর্চার ধারা। কিন্তু তা সত্ত্বেও এমন সব ঘটনা ঘটে। কেন? কারণ, শরীরেরও এমন অজানা সব কাণ্ডকারখানা থাকে, যা কেবল ফিটনেস দিয়ে উতরে দেওয়া যায় না। এরিকসেনের ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা সেরকমই হয়েছিল।
ফুটবল মাঠে আঘাত সাধারণত দু’রকম হয়। এক, ট্রমা, অর্থাৎ, দু’জনের মধ্যে ধাক্কা লেগে গেল, হেড করতে গিয়ে লাগল, কিংবা বারপোস্টে কোনও ভাবে লেগে গেল। এই ধরনের আঘাতের ফলে ক্ষতির প্রকাশটা তক্ষুনি হয় না। যদি মাথায় লাগে, তা হলে মস্তিষ্কে চোটজনিত কারণে ফুলে যাওয়া বা রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা এবং তা থেকে নানা রকম শারীরিক সমস্যা একটু পরে দেখা যায়। কিন্তু হঠাৎ কোনও কারণ ছাড়া এরিকসেনের মতো ঘটনা যদি ঘটে, তাহলে সেটা নিশ্চিত ভাবে কার্ডিয়াক সমস্যা। বয়স্ক মানুষদের হার্টে সমস্যা হলে, সাধারণত দেখা যায়, হার্ট অনিয়মিত ভাবে কাজ করছে, হার্টের পেশি দুর্বল হয়ে পড়েছে, হার্ট-রেট ধীর হয়ে গেছে। তখন পেসমেকার দেওয়া হয়, বা অন্যান্য ওষুধ দেওয়া হয়। এই ধরনের সমস্যাকে বলে হার্টের কন্ডাকশন অ্যাবনর্ম্যালিটি। হার্টের মধ্যে পেশি আছে, রক্তনালী আছে, নার্ভ আছে। এই নার্ভগুলো গণ্ডগোল করলে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়। অনেক সময় কমবয়সিদের মধ্যেও এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়, অনেক তরুণীর বুক ধড়ফড় করার রোগ থাকে। এগুলো থাকে জন্মের সময় থেকে। এই সমস্যা ধরাও খুব সহজ ব্যাপার নয়। কারও হয়তো ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাম হল এবং দেখে মনে হল, এই হার্ট তো একেবারে টগবগ করে চলছে, তেল দেওয়া ইঞ্জিনের মতো। কিন্তু হার্টের পেশিগুলো ঠিক আছে কি না, নার্ভ ঠিক আছে কি না, খুব অভিজ্ঞ চোখ না হলে, শুধু ইসিজি বা ইকোকার্ডিওগ্রাম দেখে ধরা খুব মুশকিল। হার্টের পেশি যদি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পুরু হয়, তা হলে রক্তসঞ্চালন করতে সমস্যা হয়, হাঁফ ধরে যায় সহজে, হার্ট-রেট বেড়ে বা কমে যেতে পারে। এই হার্টগুলো ভারী তিরিক্ষি মেজাজের হয়, খুব ইরিটেবল। ডাক্তারি পরিভাষায় একে বলা হয় হাইপারট্রফিক কার্ডিওমায়োপ্যাথি। খুব বিরল নয় এই সমস্যা। ভারতেও এইরকম সমস্যা নিয়ে অনেকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আমরা কম জানি, কারণ ভারতে পরীক্ষানিরীক্ষা কম হয়। আমেরিকার আদি অধিবাসী বা ইন্ডিয়ানদের মধ্যে এই সমস্যা খুবই দেখা যায়। আর এই সমস্যা জিন-বাহিত। অর্থাৎ জন্মসূত্রে মেলে এই কন্ডিশন।
এরিকসেনের ক্ষেত্রেও সমস্যাটা সম্ভবত তা-ই। এখনও আমার কাছে নিশ্চিত করে কোনও তথ্য নেই, কিন্তু মাঠের ধারে সেদিনের সেই তৎপরতা এবং যে চিকিৎসা চলছিল, তা দেখে মনে হয়েছে, এরিকসেনের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়েছিল। তবে একটা কথা না বললে অন্যায় হবে, তা হল, সেদিন খেলা যত না ভাল হয়েছিল, তার চেয়েও দেখার মতো ছিল, যেরকম অত্যাশ্চর্য ভাবে প্যারামেডিকরা এরিকসেনকে বাঁচালেন। এরিকসেন পড়ে যাওয়ার মাত্র এক মিনিটের মধ্যে ওঁরা মাঠে ওঁকে যেভাবে মুহূর্তের সিদ্ধান্তে সিপিআর (কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিয়েশন) বা হার্ট মাসাজ দিয়েছেন এবং তারপর একটা বা দুটো শক দিয়ে ওঁকে জাগিয়ে তুলেছেন, তা কুর্নিশযোগ্য, মিরাকল-ও বটে। ওই সময়ের মধ্যে যদি ওঁকে জাগিয়ে তোলা না যেত, তা হলে ওঁর ব্রেন-ডেথ হয়ে যেত। ওঁর স্তব্ধ হার্টকে সচল করা যেত হয়তো, কিন্তু মস্তিষ্ক জবাব দিয়ে দিত।
যখন ওঁকে মাঠের বাইরে নিয়ে আসা হচ্ছিল, তখন ধারাভাষ্যকাররা বারবার বলছিলেন, টুইটে অনেকে লিখছিলেন, ‘he is awake, he is awake.’ অর্থাৎ কিনা, এরিকসেন-এর ব্রেন-ডেথ হয়নি। এরিকসেন-এর যেটা হয়েছে সেটাকে বলে ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া। মানে, হঠাৎ হার্ট-রেট খুব অনিয়মিত হয়ে গিয়েছিল এবং আর কিছুক্ষণ এমন থাকলে, ওঁকে বাঁচানো কঠিন হয়ে যেত। প্যারামেডিকরা দুর্ঘটনার সঙ্গে-সঙ্গে এরিকসেন-এর বুকের ওপর মনিটর বসিয়ে দেখেছেন সমস্যা কী, সিপিআর দিয়েছেন, হয়তো মাউথ-টু-মাউথ রেসপিরেশন-ও দিয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা শক দিয়ে ওঁর হার্টবিট ফিরিয়ে এনেছেন এবং ওঁকে ব্রেন ডেথ থেকে বাঁচিয়েছেন। সেটা ব্রিলিয়ান্ট। যদি দু’মিনিটের বেশি দেরি হয়ে যেত, তা হলে হয়তো এরিকসেন প্রাণে বেঁচে যেতেন, কিন্তু স্বাভাবিক হতে পারতেন না। তাই সেদিনের ঘটনাটায় নায়ক প্যারামেডিকরাই। গোলকিপার যেমন কয়েক সেকেন্ড মাত্র সময় পান পেনাল্টি বাঁচানোর, ওঁদের কাছেও, মেন্টাল অ্যালগরিদমটাকে কাজ করানোর জন্য এই কয়েক সেকেন্ড সময়ই ছিল। ওঁরা যে পেরেছেন, এটা নিয়মিত ট্রেনিং এবং রিফ্লেক্স বা তৎপরতার ফল। সৌভাগ্য, এরিকসেন বেঁচে গেলেন, কিন্তু উনি আর ফুটবল মাঠে নামতে পারবেন কি না সন্দেহ। পারবেন না-ই ধরে নেওয়া যায়।
খেলতে খেলতে এই ধরনের বিপর্যয় ফুটবলের ক্ষেত্রেই বেশি দেখা যায়। ক্রিকেটে বা অন্য খেলায় এত আচম্বিতে কিছু হয় না। সেটা হয়তো ফুটবল এতটা পরিশ্রম করে খেলতে হয় বলেই। আমার মনে আছে, ২০০৪ সালে ফেডারেশন কাপের মোহনবাগান আর ডেম্পোর মধ্যে খেলায়, ডেম্পোর একজন স্ট্রাইকার, ক্রিশ্চিয়ানো জুনিয়র, মোহনবাগানের গোলকিপার সুব্রত পালের সঙ্গে ধাক্কায় মাটিতে পড়ে যান, আর ওঠেননি। মাঠে ডাক্তার তো ছিলেনই না, কারণ ফুটবল ফেডারেশন-এর নাকি ম্যাচ-প্রতি ১০০০ টাকা ফি দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না ডাক্তারকে। মাঠে দু’জন ফিজিয়োথেরাপিস্ট আসেন, তাও সাত মিনিট পর। কারণ রেফারি মাঠে ঢোকার অনুমতি দেননি। কেন দেননি? কারণ তিনি ভেবেছিলেন, ওখানে সবাই গোল করার আনন্দে ক্রিশ্চিয়ানোকে ঘিরে রয়েছে। এরপর যখন তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন তিনি কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট-এর শিকার হয়ে গিয়েছেন।
মাঠের এমন ঘটনা আরও আছে, দেবজিৎ ঘোষ নামে একজন ফুটবল খেলোয়াড়ের এইরকম অবস্থা হয়েছিল, কিন্তু তিনি প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। ক্যামেরুনের খেলোয়াড় মার্ক ভিভিয়েন ফো ঠিক একইভাবে হাইপারট্রপিক কার্ডিওমায়োপ্যাথির শিকার হয়ে মাঠেই মারা যান।
এই তালিকায় নিশ্চয়ই আরও নাম যোগ করা যায়, কিন্তু সেসব ভেবে মনকে ভারাক্রান্ত করার দরকার নেই। তার চেয়ে বরং, এরিকসেনের ঘটনা থেকে সারা পৃথিবীর সঙ্গে ভারতও কিছু শিক্ষা নিক, কীভাবে একজন প্লেয়ারকে সুরক্ষিত রাখতে হয়, যত্ন করতে হয়। এটুকু তো তাঁদের প্রাপ্য। এই লেখা যখন প্রকাশ পাবে, ততদিনে নিশ্চয়ই এরিকসেন আরও খানিকটা ভাল হয়ে উঠবেন। খেলতে না-পারুন, খেলা দেখতে পারবেন, গলা ফাটিয়ে নিজের দলকে সমর্থন করতে পারবেন, উদ্বুদ্ধ করতে পারবেন। আর হ্যাঁ, হয়তো লুকিয়ে কাঁদতেও থাকবেন। কেউ একটা দুরন্ত পাস দেওয়ার পর হয়তো মনে হবে, এই বলটা তো আমারই ধরার কথা ছিল।