নিউজিল্যান্ডের জয়ে সর্বপ্রথম বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট জনপ্রিয়, সুযোগ্য এবং সঠিক বিজেতার মাথাতেই শোভা পেয়েছে। সব দিক থেকেই যেরকম ভাল খেলা তারা এই ফাইনালে খেলেছে, সেরকমটা অবশ্য তাদের কাছ থেকে আজকাল গোটা দুনিয়াই প্রত্যাশা করে। ভারতীয় হিসেবে বিরাট কোহলি এবং তার ছেলেদেরই সমর্থন করছিলাম বটে, তবে ভারতের হেরে যাওয়ার দুঃখের মাঝেও খানিকটা সান্ত্বনা পাচ্ছি, কারণ খেলার শেষে ওই মুগুর-আকৃতির ট্রফিটি যার হাতে উঠল, বিগত কয়েক বছরে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের সূত্রে সে আমার বড় কাছের মানুষ হয়ে উঠেছে— কেন উইলিয়ামসন।
বুধবার রস টেলর যখন শেষ রানগুলো করে নিজের দলকে জেতাচ্ছেন, তখন কেন-এর মার্জিত, পরিশীলিত প্রতিক্রিয়া দেখে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০১৯ বিশ্বকাপের শেষ বেলার দৃশ্যগুলো। ফাইনালে না হেরেও নিউজিল্যান্ড তখন বিশ্বকাপ হেরেছে, ম্যাচের কিছুক্ষণ পরেই কেন-এর সঙ্গে মাঠে আমার দেখা। আমার কাঁধে হাত দুটো রেখে বলল, ‘ওহ, ল্যাক্স!’ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, গলায় জমে আছে হেরে যাবার যন্ত্রণা, কিন্তু ওইটুকুই, তার বেশি নয়। পরাজয়ের ক্ষোভে একদমই ভেঙে পড়েনি বা দমে যায়নি, ঠিক যেমন নিজের দল টেস্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বলে কোনও বাড়াবাড়িও ওর মধ্যে দেখলাম না। কেন একজন অসামান্য অধিনায়ক, এক দল আশ্চর্য খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে ও। একটা দল তার সদস্যদের নিছক যোগফলের চেয়েও আসলে অনেক বড়, ওদের খেলার মধ্যে একটা নিষ্ঠা, সংকল্পের দৃঢ়তা রয়েছে। আমার মতে নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলার, বস্তুত নিউজিল্যান্ডের মানুষের গোটা জীবনবোধেরই নিদর্শন ছিল খেলার শেষ দিন নিজের অনামিকা ভেঙে যাওয়া সত্ত্বেও বি জে ওয়াটলিঙ-এর উইকেটকিপিং করে যাওয়ার অদম্য, লড়াকু জেদ।
ভারত দলের মন খারাপ নিশ্চয়ই, বিশেষ করে দ্বিতীয় ইনিংসে অমন অসামান্য ব্যাটিং করেও এই ফলাফলে মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। প্রথম ইনিংসে ঢের বেশি প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে ওরা অনেক বেশি মুন্সিয়ানা দেখাল। অথচ ষষ্ঠ দিনে ব্যাটিং করার ভাল পরিস্থিতি পেয়েও শেষরক্ষা করতে পারল না, এমনকী ম্যাচটা ড্র করেও আনতে পারল না, যাতে অন্তত বিজয়ের পুরস্কারটুকু ভাগাভাগি করে নেওয়া যেত। যে-দল বিপদের সামনে বুক চিতিয়ে পালটা মার মারতে পারে বলে নিজেদের নিয়ে গর্ব করে, এইভাবে হার স্বীকার করে নেওয়াটা পরাজয়ের চেয়েও তাদের নিশ্চয়ই বেশি পীড়া দিচ্ছে। হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডের বোলাররা কোনও বেসামাল ভুল করেনি, ক্রমাগত ব্যাটসম্যানদের সমস্যায় ফেলে গিয়েছে, এ কথা ঠিক, কিন্তু এই ভারতের খেলোয়াড়দের মতো দাপট যে দলের লাইন-আপের, তারা সে সমস্যার অন্তত আর একটু জুতসই মোকাবিলা করতে পারবে, এটুকু আশা ছিল।
টপ অর্ডারের যে শৈলীগত গাফিলতিগুলো নিউজিল্যান্ড চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, তা ইংল্যান্ডের চোখ এড়ায়নি নিশ্চয়ই। অতএব আজ থেকে শুরু করে ৪ঠা আগস্ট পাঁচটি টেস্ট ম্যাচের সিরিজ শুরু হওয়ার মধ্যে ভারতের অনেকগুলো ভুলত্রুটি নিয়ে রীতিমতো ঘষামাজা করার প্রয়োজন আছে। কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে হবে, তার ইঙ্গিত বিরাট নিজেও দিয়েছে। কিন্তু ওকে এবং ওর দলের বাকিদের আমি যতদূর চিনি, সাউদ্যাম্পটন টেস্ট থেকে শিক্ষার রসদ নিয়ে ওরা যে দ্বিগুণ উৎসাহে এবং একাগ্রতার সঙ্গে দ্বিতীয় বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপকে পাখির চোখ করে ঝাঁপিয়ে পড়বে, সে-বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই।