ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার: সত্যজিৎ রায়


    মাসায়ুকি ওনিশি (June 26, 2021)
     

    ১৯৮৬ সালের অক্টোবর মাসে, জাপানে টোকিও শহরের ‘ইওয়ানামি হল’-এ সত্যজিৎ রায়ের ছবি ‘ঘরে-বাইরে’ প্রথমবার দেখানো হয়েছিল। সেই উপলক্ষে আমার উপর ভার পড়েছিল ছবিটা সম্বন্ধে তাঁর মতামত নিয়ে প্রোগ্রামে কিছু লেখার এবং রবীন্দ্রনাথের মূল উপন্যাসের অনুবাদ করার। সত্যজিৎ রায়ের অন্যান্য ছবি, বিশেষ করে অপু-ট্রিলজি (‘পথের পাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’), ‘চারুলতা’, ‘অশনি সংকেত’ ইত্যাদির তুলনায় ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিটি আমার ততটা ভাল লাগেনি। ছবিটি বড্ড কৃত্রিম লেগেছিল। সাধারণ জাপানি দর্শকের কাছেও ছবিটি ততটা আদর পেয়েছিল বলে মনে হয় না।

    আমার সমবয়সি যাঁরা ১৯৭০-’৮০-র দশকে ভারতে গিয়েছিলেন, অপু-ট্রিলজি তাঁদের সকলেরই দেখা। শুধু দেখা নয়, অনেকেই বলেন, ছবিগুলি দেখার পর ভারতে বেড়াতে যাওয়ার, ভারতের জীবনযাত্রা চিনে নেওয়ার প্রবল ইচ্ছা জেগেছিল তাঁদের। আমারও সেই অবস্থা— ছবিগুলির কিছু কিছু দৃশ্য আমার মনের গভীরে ছাপ রেখে গিয়েছিল। তিনটে ছবির মধ্যে শেষ ছবিটি (‘অপুর সংসার’) আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছিল। আমি অন্তত তিনবার দেখেছি ছবিটি— অপুর কলকাতার জীবন, নৌকাযাত্রা, অপর্ণার সঙ্গে মিলন— এসব সিন আজও ভুলতে পারি না। জাপানে টোকিও শহরে তখন ইউরোপ ও আমেরিকার ফিল্ম দেখার প্রচুর সুযোগ ছিল, কিন্তু এশিয়ার ছবি দেখার সুযোগ তেমন ছিল না, হয়তো ভাল ছবি তখনও তেমন তৈরি হয়নি। হয়তো এ জন্যই সত্যজিৎ রায়ের এসব ছবির বিশেষ আকর্ষণ ছিল— ছবিতে যেসব জীবনের বর্ণনা পেতাম, সেসব বর্ণনা জাপানি দর্শকদের পক্ষে খুব কাছের, অথচ একেবারে নতুন।

    আমি সেই সময়ে টোকিওতে Silkroad Cultural Institute নামে একটা সংস্থায় নিয়মিত বাংলা পড়াতাম। পাঠ্য হিসাবে রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’ এবং ‘লিপিকা’, ‘টুনটুনি পাখির গল্প’ ইত্যাদি ব্যবহার করতাম। আমার এক বন্ধু আমাকে সত্যজিৎ রায়ের ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ বইটা দিয়েছিলেন, সেই বই থেকেও কিছু কিছু গল্প বেছে নিয়ে পড়াতাম। ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ বেছে পড়ানোর বিশেষ কোনও কারণ ছিল না। তবে আমার বাংলা ভাষার কোর্সে ব্যাকরণ পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সহজ ভাষায় লেখা ছোট ছোট লেখা পড়ানোর দরকার ছিল— সত্যজিৎ রায়ের ওই লেখাটি সেই কাজের উপযুক্ত ছিল মাত্র।

    আমি তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলাম ১৯৮৫ সালের ৫ই আগস্ট। তখন তিনি তাঁর শরীরের দুর্বলতা হেতু বাড়ি থেকে বেরোতেন না, ফলে আমার জন্য আধ ঘণ্টার বেশি সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবে সাক্ষাৎকারটি খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে চলেছিল, নানান বিষয়ে তিনি খোলাখুলি ভাবে কথা বলেছিলেন।

    সাক্ষাৎকারে তিনজন জাপানির কথা এসেছে— মিসেস কাওয়াকিতা, শ্রীমতী মাৎসুওকা এবং মিঃ তাকাগাকি। এই প্রসঙ্গে তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে রাখি—

    ১. মিসেস কাশিকো কাওয়াকিতা (১৯০৮-১৯৯৩) এবং তাঁর স্বামী নাগামাসা কাওয়াকিতা (১৯০৩-১৯৮১) বিদেশ থেকে ভাল ভাল ফিল্ম জাপানে আনার এবং জাপানি ফিল্ম বিদেশে প্রচার করার বিশেষ উদ্যোক্তা ছিলেন। ‘পথের পাঁচালি’ থেকে শুরু করে সত্যজিৎ রায়ের আনেক ছবি তাঁদের প্রচেষ্টায় জাপানে দেখানো হয়েছিল। তাঁদের স্মরণে Kawakita Memorial Film Institute এবং Kawakita Film Museum প্রতিষ্ঠিত।

    ২. শ্রীমতী তামাকি মাৎসুওকা এশিয়ান ফিল্ম, বিশেষ করে ভারতীয় ফিল্ম জাপানে প্রচারের জন্য অনেক দিন থেকে চেষ্টা করে চলেছেন।

    ৩. মিঃ শিন্‌জো তাকাগাকি (১৮৯৮-১৯৭৭) হলেন বিখ্যাত জুজুৎসু কুস্তিগির। প্রোফেসার কাজুও আজুমা তাঁর ‘Rabindranath Tagore: His Poetry, Philosophy and Life’ (২০০৬) বইতে লেখেন, রাসবিহারী বসুর সুপারিশে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ করেন ১৯২৯ সালে। তিনি দু’বছর শান্তিনিকেতনে থেকে ছাত্রছাত্রীদের জুজুৎসু শিখিয়েছিলেন। তাঁর অন্যতম ছাত্রী ছিলেন অমিতা সেন— ক্ষিতিমোহন সেনের মেয়ে এবং অমর্ত্য সেনের মা। তিনি সেই সময়ে শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে ভারতবর্ষের নানান জায়গায় জুজুৎসুর প্রচার করতে যেতেন। তাঁদের প্রচেষ্টায় ভারতবর্ষে জাপানি জুজুৎসুর নাম ছড়িয়ে পড়ে। শোনা যায় যখন কাশীতে তাঁদের প্রদর্শন হয়েছিল, তখন দর্শকদের মধ্যে যুবতী ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন।


    সত্যজিৎ রায়-মাসায়ুকি ওনিশি-র কথোপকথন:

    মা: সামনের বছরে আপনার ‘ঘরে-বাইরে’ জাপানে দেখানো হবে। তার সম্বন্ধে যদি কিছু বলেন…

    স: আপনি কী জানতে চান, বলুন?

    মা: যতদূর জানি, আপনি ‘পথের পাঁচালী’র আগে, এই ছবিটাই করতে চেয়েছিলেন…

    স: হ্যাঁ, আমার একটা করার কথা ছিল। একটা চিত্রনাট্যও আমি তৈরি করেছিলাম। তারপর সেটা নানান কারণে আর হয়নি। তখন আমি পরিচালনা করতে যাচ্ছিলাম না। আমি শুধু লিখতে যাচ্ছিলাম। আমি সিনারিওটা লিখতাম, আর তখন আমার এক বন্ধু ডিরেক্ট করত। এইরকম একটা কথা ছিল। কেননা তখন আমার একটা চাকরি ছিল। আমি বিজ্ঞাপন অফিসে কাজ করতাম। কাজেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা আমার মনে হয়নি তখনও। কিন্তু যে প্রোডিউসার ছিল, তার সঙ্গে একটু গোলমাল হয়ে যায়। গোলমাল হয়ে যায় বলতে, তার সঙ্গে মতভেদ হয়ে যায়। সে কতগুলো অদল-বদল করতে বলে, কিন্তু আমি রাজি হইনি। বলি যেরকম আছে সেরকমই থাকবে। ফলে সেই জিনিসটা আর হয়ে ওঠেনি। বন্ধ হয়ে গেছিল। তারপর তো তিন-চার বছর আমি বিজ্ঞাপনের কাজই করলাম। তারও পরে ‘পথের পাঁচালী’ করেছিলাম। কাজেই ওটা আর কোনওদিন হয়নি। এবারে আমি ওই চিত্রনাট্যটা খুলে দেখলাম যে, ওটা ভাল হয়নি। খুব কাঁচা কাজ। তখন আমি তো অত ভাল জানতাম না, অত ভাল শিখিনি। সেই চিত্রনাট্যটা আর ব্যবহার হয়নি। ওটা আমি ফেলে দিয়েছি। আমি নতুন করে আবার লিখলাম। নতুন করে লিখে, সব করে, এইবারে করলাম।

    মা: সেই ছবি সম্বন্ধে আপনার কি কিছু বলার আছে?

    স: ছবি সম্বন্ধে বলার আছে মানে, এটা আমার অনেকদিনের প্রিয় উপন্যাস। আমার মনে হত, খুব ভাল ছবি হবে। খুব জোরালো ছবি হবে। কেননা এটা একটা প্রেমেরও গল্প, আবার এটা একটা রাজনীতিরও গল্প। দুটো জিনিস একসঙ্গে এমনভাবে ব্লেন্ডেড আছে, অঙ্গাঙ্গি ভাবে এমন জড়িয়ে রয়েছে, খুব চ্যালেঞ্জিং পুরো ব্যাপারটা। তবে তিনটে চরিত্র, তিনটেই ভীষণ ভাল অভিনেতা হওয়া দরকার। তিনজনকে একসঙ্গে আমি পাচ্ছিলাম না। একজনকে পাচ্ছিলাম তো বাকি দুজনকে পাচ্ছিলাম না, আবার দুজনকে পাচ্ছিলাম তো একজনকে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু রিসেন্টলি (recently) স্বাতীলেখা চট্টোপাধ্যায় বলে একজনকে আমি স্টেজে দেখি। তাকে দেখে আমার মনে হয় যে, এ বিমলা হতে পারে। আর তা ছাড়া ভিক্টর ব্যানার্জির সঙ্গে আমি তো কাজ করেছি। ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’তে কাজ করেছি, তারপর আমার একটা ছোট ছবি আছে ‘পিকু’— সেখানেও কাজ করেছি। কাজেই আমার মনে হয়েছিল, ভিক্টর ব্যানার্জি ওর স্বামীর চরিত্রটা করতে পারবে। আর সৌমিত্র তো আমার পুরনো অ্যাক্টর আছেই! এই তিনজনকে নিয়ে আমার মনে হল যে, এইবারে এতদিনে কাস্টিংটা ঠিক হবে। কাস্টিং নিয়ে আমার আর কোনও চিন্তা থাকবে না। আর তাছাড়া অনেকদিন সিরিয়াস ছবি করিনি। তার আগে যা করার করেছিলাম, ‘সদ্‌গতি’, ‘পিকু’— ‘পিকু’ তো কনটেম্পোরারি ছবি। তারপর ফ্যান্টাসি ছবি করেছিলাম, ‘হীরক রাজার দেশে’। আমার খুব ইচ্ছে করছিল আর একটা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু করি। অনেকদিন হয়নি। সেই তো ‘চারুলতা’ শেষ করেছি! এই সব মিলিয়েই আর কি, তারপর যখন টাকা দেবার লোকও জোগাড় হয়ে গেল, আমি স্থির করলাম যে এইটেই আমি করব। যদিও এটা প্রধানত প্রেমের গল্প, কিন্তু এতে পলিটিক্সেরও প্রায় সমান ভূমিকা রয়েছে। দুটো জিনিস একসঙ্গে ফুটিয়ে তোলার একটা ইচ্ছে আমার ছিল এবং সেটা এবারে আমি পেলাম।

    মা: এই ছবিটা কি শেষ পর্যন্ত আপনি করতে পেরেছিলেন?

    স: আমি শেষ পর্যন্ত করতে পারিনি, আমার অসুখ করে গেল। কিছু আউটডোর বাকি ছিল, সেই আউটডোরগুলো আমার ছেলে করেছে। আমার ছেলে তার আগে একটা ছবি করেছিল ‘ফটিকচাঁদ’ বলে, আমারই একটা গল্প থেকে। ছেলে তো এখন তৈরিই হয়ে গেছে, ও আমার সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে, দেখেছে আমার কাজ— কাজেই আমি কী করি না করি, সেটা ও বোঝে। ওর ওপর আমার ভরসা ছিল, আমি নির্ভর করতে পারছিলাম আর কি। সেইজন্য আমি ওকে বুঝিয়ে দিলাম, আমার এই-এই জিনিস চাই— ওই শুটিংটা করল। বেশ ইম্পর্ট্যান্ট শুটিং ছিল। আউটডোরে রায়টের দৃশ্য ছিল, বক্তৃতার একটা জায়গা ছিল, আরও অন্যান্য কিছু জায়গা ছিল। অ্যাবাউট টেন টু ফিফটিন পারসেন্ট ফিল্ম আমার ছেলে করেছে।

    সত্যজিৎ রায় পরিচালিত ‘ঘরে-বাইরে’ চলচ্চিত্রের জাপানি পোস্টার
    ছবি সৌজন্যে: মাসায়ুকি ওনিশি

    মা: আচ্ছা, এবারে জাপানে ‘পিকু’ আর ‘সদ্‌গতি’ও দেখানো হবে। এই ছবিদুটো সম্বন্ধে কিছু বলুন…

    স: হ্যাঁ, ‘পিকু’ আমি করেছি ফ্রেঞ্চ টেলিভিশনের জন্য। আমার কাছে ফ্রেঞ্চ টেলিভিশন থেকে এক ভদ্রলোক এসছিলেন। তাঁরা বললেন যে, আপনি আমাদের জন্য একটা ছবি করে দিন। এনি সাবজেক্ট— ডকুমেন্টারি হোক, গল্প হোক, যা হোক একটা করে দিন। তা আমার একটা গল্প লেখা ছিল প্রায় পনেরো-কুড়ি বছর আগে ‘পিকুর ডায়েরি’ বলে। একটা বাচ্চা ছেলে ডায়েরি লিখছে, তার দাদুও ডায়েরি লেখে সেই দেখাদেখি… তার কত বয়স হবে, ওই সাত-আট বছর বড়জোর। সেই ডায়েরি ফর্মে আমি গল্পটা লিখেছিলাম। তাতে বানান ভুল আছে, ব্যাকরণে ভুল আছে, আরও অনেক ভুল-টুল আছে কিন্তু ও যা দেখছে চোখের সামনে, যা করছে, বাড়িতে যা ঘটছে, সবই লিখে গেছে তার মধ্যে পরিষ্কার ভাবে। এবং তার মধ্যে ঘটনাগুলো দেখা যাচ্ছে অ্যাডাল্ট। তার মা’র একটা বন্ধু আছে, তার মা’র সঙ্গে অন্য একজন পুরুষের অ্যাফেয়ার চলছে, সেটাও সে লিখেছে। ‘কাকা-কাকা’ বলে বলছে— কাকা আসে আমার বাড়িতে, দুপুরবেলা আসে, বাবা যখন থাকে না তখন কাকা আসে… এইরকম সব অ্যাডাল্ট ঘটনা। তারপরে ওর দাদুর অসুখ, হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, শেষকালে ওর দাদু মারা যাচ্ছেন…  এ-সমস্ত ঘটনা, সবই সে লেখে। এইটার থেকে আমি একটা সিনারিও করলাম ফর আ টোয়েন্টি ফাইভ মিনিটস ফিল্ম। এইটা হল ‘পিকু’।

    মা: সেই গল্পটা কি বাংলাতেই লিখেছেন?

    স: হ্যাঁ, গল্পটা বাংলাতেই লিখেছিলাম।

    মা: আচ্ছা। কোন বইতে আছে?

    স: এটা ‘তিনরকম’ বলে একটা বই বেরিয়েছে… তিনটেই অ্যাডাল্ট স্টোরি। আমি তো অ্যাডাল্ট স্টোরি বেশি লিখি না, ছোটদের জন্যই লিখি। তিনরকম বলে তিনটে গল্প আছে তাতে। না, না একটা গল্প আছে ‘পিকুর ডায়েরি’ নামে, আরও একটা বড় গল্প আছে, আর আরেকটা আনফিনিশড চিত্রনাট্য আছে। সেটা বেশ বড়। তো ওই গল্পটা থেকেই আমি আমার ফিল্মের ট্রিটমেন্টটা করে ভদ্রলোককে দেখাই। উনি খুব খুশি হন, বলেন আমাদের ইন্ডিয়ান টেলিভিশন থেকে একটা এক ঘণ্টার ছবি করতে বলা হয়েছিল। গল্পটা আমার আগেই পড়া ছিল। প্রেমচাঁদ-এর গল্প। প্রেমচাঁদ খুব বড় একজন হিন্দি রাইটার। প্রেমচাঁদের এই গল্পটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের মনে হয়েছিল। ছোটগল্প কিন্তু ছোটগল্পের মধ্যে ভীষণ একটা পাওয়ারফুল গল্প। এবং খুব ফান্ডামেন্টাল একটা গল্প। গল্পটা তিরিশের দশকে লেখা হয়েছিল, কিন্তু এখনও এরকম ঘটনা ঘটে। অস্পৃশ্যদের ওপরে এক্সপ্লয়টেশন (exploitation), সেটা এখনও অনেক স্টেটে চলছে। বাংলাদেশে চলছে না, কিন্তু অন্যান্য জায়গায় রয়েছে, আমরা খবরের কাগজে পড়ি। ব্রাহ্মণ আর আনটাচ্‌বেল-এর একটা সিচুয়েশন। খুবই সিম্পল সিচুয়েশন আর কি! তো, এটা করি ইন্ডিয়ান টেলিভিশনের জন্য। দুটোরই লেন্থ এমন, হাউসে দেখানো যায় না। সেইজন্য এখানে কতগুলো প্রাইভেট ছবি হয়েছে একসঙ্গে এই দুটো ছবি নিয়ে। মিসেস কাওয়াকিতা যখন দেখলেন এই ছবি, তখন ওঁরা বললেন যে, আমরা এই দুটো ছবি একসঙ্গে দেখাব। দুটো মিলিয়ে ওই নব্বই মিনিটের মতো।

    টেপরেকর্ডার হাতে নিয়ে কৌতূহলী সত্যজিৎ রায়, সঙ্গে মাসায়ুকি ওনিশি
    ছবি সৌজন্যে: মাসায়ুকি ওনিশি

    মা: এরপরে আপনার কোনও প্রোগ্রাম আছে?

    স: আমার প্রোগ্রামের ব্যাপারটা এখন হচ্ছে কী, আমার মুশকিল হয়েছে… আমার ডাক্তাররা ডিসাইড করবে। কেননা যে-গল্প আমার ভাবা ছিল, সেটা কমপ্লিটলি আউটডোর। এখন ডাক্তার বলছে যে, তোমার আউটডোরে কাজ করা অসুবিধে হবে, তুমি স্টুডিওতে কাজ করতে পারলে সুবিধে। এখন তাহলে আমাকে অন্য গল্প দেখতে হবে। ইন এনি কেস, ফেব্রুয়ারির আগে কিছু করছি না। তবে সেটা কী গল্প করব, সেটা আমার এখনও ঠিক হয়নি। যেটা আমি পারব, মানে যেটা করতে কেপব্‌ল (capable) হব, সেইটাই করব।

    মা: ফিল্ম ছাড়া নিশ্চয়ই আপনার লেখালিখিও রয়েছে…

    স: হ্যাঁ, এখন তো লেখা নিয়েই আছি। লিখছি, আঁকছি। গল্পের জন্য ইলাস্ট্রেশন করতে হয় তো! লেখার কাজ আমি সবসময়ই করে যাচ্ছি। গল্প লিখে যাচ্ছি। এছাড়া অন্যের গল্পতেও আমি ইলাস্ট্রেট করে থাকি। আমার একটা পত্রিকা আছে তো, ‘সন্দেশ’— সেখানে অনেক লেখা-টেখা আসে, তাতে আমায় ছবি আঁকতে হয়।

    মা: আপনার লেটেস্ট (latest) লেখা বই কী?

    স: আমার লেটেস্ট লেখা বলতে, একটা বেরিয়েছে বই ‘মোল্লা নাসিরুদ্দিনের গল্প’ নামে।

    মা: ওই বইটা আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে পেয়েছি। ছোট বইটা তো? ওটা আমি আমার বাংলা ক্লাসে পড়াই…

    স: আচ্ছা! তাই নাকি? (হাসি)

    মা: আগে ‘সন্দেশ’-এর ওই বড় বইটা ছিল না? ওখান থেকে পড়াতাম। এখন এই ছোট বইটা পেয়ে গেছি।

    স: আচ্ছা, আমার একটা reminiscences আছে, ‘যখন ছোট ছিলাম’…

    মা: পড়েছি। তাতে একজন জাপানি ভদ্রলোকের কথা লেখা আছে, যার কাছে আপনি ছোটবেলায় জুজুৎসু শিখেছিলেন… উনি তো বোধহয় শান্তিনিকতনে ছিলেন, তাই না?

    স: হ্যাঁ, তাকাগাকি। উনি শান্তিনিকতনে ছিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় এসে পরে সেটল (settle) করেন। ছোটবেলায় আমি ওর কাছে জুজুৎসু শিখেছিলাম (হাসি)। আমার তখন চোদ্দ বছর বয়স। আমার সেই ‘Judo’ লেখা জামা ছিল। এখন আর নেই!

    মা: অনেকদিন ছিলেন নাকি তাকাগাকি?

    স: তা বোধহয় তিন-চার বছর ছিলেন। তারপর চলে গেলেন। ওঁর কাছে যেতাম, শিখতাম। সপ্তাহে দু’দিন না ক’দিন শিখতাম! তারপর ওভালটিন খাওয়াতেন। ওঁর কাছে এক সাহেব লড়তে আসতেন, খুব ভাল। অনেকক্ষণ ধরে আমরা দেখতাম দুজনের জুজুৎসু। ওই একটা জাপানিজ কানেকশন আমার ছিল ছেলেবেলায়। তাকাগাকির নাম আপনারা শুনেছেন?

    মা: আমি রবীন্দ্রনাথের বইতে পড়েছি। তারপরে আপনার বইতেও পেয়েছি। মনে পড়ল। আচ্ছা, তার পরে আর কোনও জাপানির সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হয়নি?

    স: না, তারপরে আমার তো ভীষণ বন্ধু হচ্ছেন কাওয়াকিতা। আমার একেবারে ভেরি ক্লোজ ফ্রেন্ড। শান্তিনিকেতনে থাকতে জাপানি কেউ ছিল না, চাইনিজ ছিল। জু বিয়ং, ছবি আঁকত। তারপর ওখানে প্রোফেসর তান ইয়ুন-সান রয়েছেন। কিন্তু জাপানির সঙ্গে আর আলাপ হয়নি, একেবারে মিসেস কাওয়াকিতা। ১৯৫৭ সালে আলাপ।

    মা: এখন তো শান্তিনিকেতনে অনেক জাপানি ছাত্রছাত্রী!

    স: আছে, না? আমি শুনেছি আছে বলে। দু’একজন ছেলে এসেছে আমার কাছে, ওখান থেকে একটি মেয়েও এসেছে। তারা আমার ভীষণ ভক্ত, তারা আমার ছবি দেখেছে টোকিওতে। আমাকে কী সুন্দর পেইন্ট-বক্স দিয়ে গেছিল। প্যালেট রয়েছে, কালি রয়েছে, স্টিক রয়েছে। আমরা তো আগে শান্তিনিকেতনে থাকতে জাপানি ব্রাশই ব্যবহার করতাম!

    মা: গত বছর থেকে জাপানে নানা রকম ইন্ডিয়ান ফিল্ম দেখানো হচ্ছে। হিন্দি, মালায়লম, বাংলা এইরকম। বাংলা ছবির মধ্যে যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘নিম অন্নপূর্ণা’, গৌতম ঘোষের ‘দখল’ আর ‘পাড়’, মৃণাল সেনের ‘খারিজ’ দেখানো হয়েছে। এবারে ‘ভুবনসোম’ দেখানো হবে।

    স: এগুলো কি কমার্শিয়ালি দেখানো হচ্ছে?

    মা: কমার্শিয়ালিও দেখানো হচ্ছে। আর আপনাকে যার কথা বলেছিলাম শ্রীমতী মাৎসুওকা, উনি একার চেষ্টায় এখান থেকে আনছেন। এ বছরে তো দুটো ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেল।

    চিন্তামগ্ন সত্যজিৎ
    ছবি সৌজন্যে: মাসায়ুকি ওনিশি

    স: হ্যাঁ, একটা তো জানি, যেখানে কুরোসাওয়ার ‘Ran’ ছবিটা দেখানো হয়েছিল।

    মা: ওখানেই ‘খারিজ’ দেখানো হয়েছিল। হিন্দি পরিচালকের মধ্যে শ্যাম বেনেগাল। এখনকার ইন্ডিয়ান ফিল্মের যে পরিস্থিতি, সে সম্পর্কে আপনার কীরকম মনে হয়?

    স: আমার মনে হয়, ভাল কাজ হচ্ছে। মৃণাল তো আর নতুন না, মৃণাল পুরনো। আমাদের কনটেম্পোরারি। নতুনদের মধ্যে বুদ্ধদেব দাশগুপ আর গৌতম ঘোষ, এই দুজনই ভাল। গৌতম বোধহয় আরও ভাল, আমার মনে হয়। বাইরে বোম্বেতে আর কেরালাতে বেশ কিছু নতুন ছেলে এসেছে। সকলের ছবি আমার দেখা হয়নি, কিন্তু টেলিভিশনে বা এমনিতে যেটুকু দেখেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে এরা সিরিয়াস ছবি করছে। আর অনেকেই পুনা ইনস্টিটিউট থেকে বেরিয়েছে। কাজেই তারা সিনেমার ক্রাফট-টাও জানে। তারা যে শুধু কিছু ইন্টারেস্টিং বলছে তা না, যেভাবে বলছে সেটাও ইনটারেস্টিং। স্টাইলটা আর কি! শ্যামও তো পুরনো হয়ে গেল। ও প্রায় কুড়ি বছর হল কাজ করছে। কিন্তু নতুনদের মধ্যেও বেশ ভাল কাজ হচ্ছে, আমার মনে হয়।

    মা: আপনি কিছু নাম বলুন…

    স: নামের মধ্যে বলতে গেলে আদুর গোপালকৃষ্ণন, কেরালার— যে ওই ‘মুখামুখম’ ছবিটা বানিয়েছে। তারপরে সৈয়দ মির্জা বেশ ভাল। কেতন মেহতাও খুব ভাল। এইরকম কয়েকটা নাম এখন আমার মনে পড়ছে। আর বাংলার ওই দুজনের নাম তো করলামই, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর গৌতম ঘোষ। এরা দুজনেই বেশ ভাল ছবি করছে। অনেকদিন পরে এই জিনিসটা হল। আমরা তো ছবি করেছি আগে থেকে। আমার প্রথম ছবির পর কুড়ি বছর বিশেষ কিছু হয়নি। হয়নি মানে, যা হয়েছে বাংলাদেশে হয়েছে। ঋত্বিক করেছে, মৃণাল করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাইরে সেরকম কিছু হয়নি। তবে গত দশ বছরে, সমস্ত ভারতবর্ষ থেকেই অনেক ভাল ভাল, নতুন নতুন ইয়ং পরিচালক বেরিয়েছে।

    মা: জাপানি অডিয়েন্সদের প্রতি আপনার কোনও মেসেজ আছে?

    স: জাপানি অডিয়েন্স সম্বন্ধে তো আমি কিছু জানি না, তবে জাপানি ক্রিটিকরা আমার ছবিকে খুব ভাল লিখেছে। এবং খুব ভাল ক্রিটিসিজম হয়েছে। ভারতবর্ষে যা হয়, তার চেয়ে অনেক ভাল। সেটা আমাকে পাঠিয়ে দেন মিসেস কাওয়াকিতা। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে যে, কুরোসাওয়ার আমার ছবি খুব ভাল লাগে। কুরোসাওয়া নিজে আমাকে বলেছেন, তাছাড়া উনি দু’একটা ইন্টারভিউতেও বলেছেন। আমার আর কিছু চাই না, শুধু ওইটা হলেই হল। কেননা আমি নিজে কুরোসাওয়ার ভীষণ ভক্ত। আর আমার মনে হয় একজন ডিরেক্টরই আরেকজন ডিরেক্টরের ছবি সবচেয়ে ভাল বোঝে। মানে সাধারণ দর্শকের চেয়েও বেশি বোঝে, আর সমালোচকের চেয়েও বেশি ভাল বোঝে। ডিরেক্টরের কাছ থেকে যদি প্রশংসা পাওয়া যায়, সেটাতে সবচেয়ে বেশি আনন্দ হয়। বিশেষত কুরোসাওয়ার মতো ডিরেক্টর।


    মাসায়ুকি ওনিশিকে লেখা সত্যজিৎ রায়ের দুটো চিঠি:

    পত্র :১
    পত্র : ২

    প্রসঙ্গকথা: ওঁর প্রথম চিঠিতে দেখা যায়, আমি ওঁকে একখানা চিঠি দিয়েছিলাম, তাতে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ঘরে -বাইরে’ ফিল্মের প্রোগ্রামে ওঁর সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে আমার একটা লেখা প্রকাশ করার জন্য আমি যে মুনাফা পেয়েছিলাম সেটা ওঁকে কীভাবে পাঠানো যাবে। তারপর যখন ছবিটির প্রোগ্রাম এবং পোস্টার ছাপানো হয়েছিল তার এক-একটা কপি, আর জাপানি ছবি আঁকার সরঞ্জাম, আইয়ুকোকে (আমার স্ত্রী) দিয়ে ওঁকে পাঠিয়েছিলাম। 
    এছাড়া ‘ঘরে -বাইরে’ ছবিটি টোকিও শহরে প্রথমবার দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার করা মূল উপন্যাসের একটা অনুবাদ বেরিয়েছিল। সম্ভবত সেই বইয়ের একটা কপি অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সত্যজিৎ রায়কে উপহার দিয়েছিলাম। তিনি হয়তো সেই বইয়ের কথাই দ্বিতীয় চিঠিতে উল্লেখ করেছেন।

    কভারের ছবি সৌজন্যে: মাসায়ুকি ওনিশি

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook