এ কথা সত্যি, খুব মন দিয়ে সময়-সুযোগ করে রোজ আয়না দেখা হয় না পরিতোষের। যদি বা দ্যাখে, জ্যাকসন পোলকের প্রসিদ্ধ পাগলামির মতো খসে পড়া চুন-সুরকির দেওয়ালের ঠিক মধ্যিখানে একফালি অণ্ডকোষের ঢঙে ঝুলে থাকা আয়নার তেমন একটা গুরুত্ব নেই পরিতোষের জীবনে। এ চাঁদ-বদন পালিশ করে দেখালেই তার জীবনে যে আইভরি আসবাবের মতো সুললিত কোনও নারী কোনওদিন পা পিছলে আছাড় খেয়ে কাতরাবে ও ঢুকে পড়বে— তেমন উচ্চমর্যাদা সে নিজেকে দেয়নি কখনও। বরং আয়নাটার প্রতি কিছুটা অশ্রদ্ধাই ছিল পরিতোষের। এই আয়নায় আপন প্রতিবিম্ব দেখতে-দেখতে রাসপুটিনের থেকেও বদখত দেখতে তার কাঠখোট্টা বাবা যে তার নগ্ন মৃগনয়না মা’কে কাঁধে তুলে ঘুরপাক খেয়ে অকালবোধনের মতো ঢাকঢোল পিটিয়ে হঠাৎ গর্ভবতী করে ফেলেছিল— তা নিয়ে আজকাল বেশ বিরক্তি বোধ করে পরিতোষ।
অপ্রাসঙ্গিক রকম নগণ্য পরিতোষকে বিষ্ণুর চারশোবাহান্নকোটিতম কল্কি অবতার হিসেবে ডেকে এনেই বা কোন অতীন্দ্রিয় কর্পোরেশনের খাতায় নাম তুলল মা-বাবা! সে না এলেও এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ বা ঘোরাঘুরি কি কমে যেত? ছেঁড়া যেত মানব অভিজ্ঞতালোকের। পরিতোষের দাড়ি না গজালে কি নিকোল কিডম্যানের উইগের চুল কম পড়ত হলিউডে? না কি তার লেখা অভিধান ছাড়া সঠিক শব্দের অভাবে আত্মঘাতী হতেন নোয়া হারারি? কিংবা তার কাছে নৈতিকতার পাঠ পড়ে ইস্তফা দিতেন ব্রাজিলের বলসোনারো? কিস্যু হত না। অযুত-লক্ষ-নিযুত-কোটি সহনশীল মৃতমেধার ভিড়ে সে আরও একখান ফুটকি মাত্র। তাই পরিতোষ বিরক্ত।
এমনও হতে পারে, পরিতোষের বাবা লোকটা ছাপিয়ে যেতেই চেয়েছিলেন নিজেকে। ভেবেছিলেন একটা নাম, দুটো ডাক, তিনটে বৌ, চারটে গাড়ি, পাঁচটা বাড়ি, ছ’টা মন্ত্রিত্ব পাবেন! তাই সাত পাকে বাঁধা পড়ে পরিতোষের বাবা অকালে শহিদ ঘটোৎকচ হয়ে গেলেন অন্য অনেকের মতো। দ্বিধান্বিত কয়েকজন অর্জুন তাঁকে স্নেহের ভ্রাতুষ্পুত্র হিসেবে ভেবে, হেসে, খেলে এবং ভালবেসে অবলীলায় ব্রহ্মাস্ত্রে বধ করল। আর সর্বগ্রাসী কৃষ্ণরা উদ্বাহু হয়ে নাচল। পরিতোষ বুঝেছিল, ‘বাবা লোকটা গান্ডু’।
অবশ্য পরিতোষের মা ঠিক উল্টো কথা বলতেন। ‘তোর বাবা ছিল গর্ব করার মতো একটা মানুষ। সবাই যে ভালবাসত লোকটাকে— তাদের দেখতে হবে না!’ আসলে ‘সবাই পরিতোষের বাবাকে ভালবাসে’— এই কথাটা বলে পরিতোষের মা খুব ভরসা পেতেন— যেমন রবি ঠাকুর সব কালো মেয়ের থোবড়ায় ‘কালো হরিণ চোখ’ দেখতে পেতেন ভেবে সব কালো মেয়েই ভরসা পেয়ে থাকে। পরিতোষের মা এ কথাও বারবার বলতেন যে, তিনিও খুব ভালবাসতেন তাঁর স্বামীকে। পরিতোষের মতে, আসলে ‘ভালবাসা’ কথাটার আদ্যোপান্ত না বুঝেই অনেক কথা বলতেন মা, যাতে নিজেকেও ওই ভালবাসার রাংতা-মোড়া প্যাকেটে নিরাপদ রাখা যায়। আর মিথ্যে বিশ্বাস অচেতন মানুষকে দিয়ে অনেক মিথ্যে কথা বলায়। মিথ্যেবাদীর যুক্তির বা উদাহরণের অভাব হয় না বড় একটা— তা তো স্বয়ং আর্যভট্টকে দিয়েই বোঝা যায়। মূর্ত কোনও আয়ত নেই— সময়ের ভগ্নাংশ নেই— এমন একটা অনিত্য অনস্তিত্বের নাম দিয়ে ফেললেন শূন্য। আর তার ওপর দাঁড়িয়ে দুনিয়ার সবাই যত সব মনগড়া অঙ্ক কষে ফেলল! এই ভালবাসা বিষয়টা যে কিছুটা শরীরের খিদে— কিছুটা লৌকিক বিধান— কিছুটা টাকাপয়সার নির্ভরতা আর কিছুটা মায়া পড়ে যাওয়া— এই সহজ সত্যিটা মেনে নিলে গোটা সভ্যতাটাই দু’সপ্তাহ পুরনো খবরের কাগজের মতো বাতিল বাণ্ডিল হয়ে ভাঁড়ারঘরে ঢুকে যাবে যে।
ইদানীং পরিতোষের বিরক্তি বেড়েছে আরও। কারণ আছে। গত সপ্তাহে তার পছন্দের ফুটবল-দল মাঠে হেরেছে আর তার পছন্দের রাজনৈতিক দল ময়দানে হেরেছে। আর এই দুটো পক্ষপাতিত্ব তার বাবারই প্রদত্ত। কেন যে লোকটা সাধারণের মতো সাধারণ হতে পারেনি বা চায়নি!
বাকি বিরক্তিগুলো ছিল-আছে-থাকবের মতোই নিত্য এবং গা-সওয়া হয়ে গেছে। পরিতোষ মাছের বাজারে মহার্ঘ সব পোয়াতি পাবদার কাছে হেরে গেছে। বাড়িতে ইলেকট্রিক তারের অববাহিকার মধ্যে লুকিয়ে হাসা এনার্জি কনসাম্পশন মিটারের বিলের কাছে হেরে গেছে। অফিসে চেক-শার্টের বোতাম ছিঁড়ে বেরিয়ে আসা বড়বাবুর কুদৃশ্য নাভিমূলের কাছে হেরে গেছে। মেট্রোরেলের জনারণ্যে আলতো করে ভাসতে থাকা আফ্রোদিতির নাতনি-সমা কোনও বহ্নি-রমণীর আদিগন্ত কামানো বগলের কাছে হেরে গেছে।
সে জানত সে রোজ হারে, যতক্ষণ না বাইরের জানলা খুলেই রাস্তায় চোখ পড়ল পরিতোষের। কেঠো পানসে গলির পোশাকি নাম জোছনাসিন্ধু পালধি বাইলেন। পাড়ার লোক মেঠো নামেই ডাকে— পোড়া বস্তির গলি বলে। বস্তি কবে এবং কেন পুড়েছিল তা কেউ জানে না। তবে এটা জানে— যখন বস্তি পুড়ছিল, তখন অনেক সহনাগরিক যথাক্রমে স্বস্তি এবং মস্তিতে ছিল। বস্তির অন্তঃদেশে যে ক’টা শক্ত, সামর্থ্যসম্পূর্ণ আত্মনির্ভর দোতলা বাড়ি আছে— পরিতোষ সেগুলোর একটায় থাকে। না, এক্ষেত্রে পরিতোষ তার বাবার কৃপায় হারেনি। হেরেছে ওই পোড়া বস্তির নিখাগিগুলো। যদিও তারা আবার আজকাল আপাতসুখী গৃহকোণের হাড়গিলে চালায় নীহারিকার দিকে তাক করা ডিশ অ্যান্টেনা লাগিয়ে গাজা স্ট্রিপে ঘটে চলা ইসরায়েল-প্যালেস্টাইনের কুস্তি দেখে কামোত্তেজিত হয় বা জমকালো ধারাবাহিকের পরকীয়াক্রান্ত গৃহবধূর অবসাদে চোখের জল সাঁতরে ডুবে যাওয়া ইউ.এস.এস স্করপিয়ন সাবমেরিনের মতো ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
কিন্তু এই মুহূর্তে রাস্তার ছবিটা অন্য। অন্যদিন, এ যক্ষ্মা-ধূসর দুনিয়ায় বিমূর্ত চাঁদের কোনও আলো জীবনানন্দের ‘কমলা রঙের রোদ’ হয়ে পোড়া বস্তির গলিকে রাঙায়নি— বিশেষ করে বিকেলের দিকে। বিদগ্ধ নর্দমার আশেপাশে কয়েকটা ‘কাকাতুয়া-পায়রা-মেহগনির ছায়াঘন’ পল্লব দেখা যাবে কি? জানে না পরিতোষ। পরিতোষ শুধু দেখতে পাচ্ছে— দুটো লোককে। মিথেন গ্যাস উপচে পড়া ঝড়িয়ার কোনও ডোলি-খাদের অন্ধকারের থেকেও কালো তারা। চকচকে কালো। যেন বোকো হারামের হুমকিতে আতঙ্কিত দুই নষ্ট নাইজেরীয় ভ্রূণ অতলস্পর্শ কৃষ্ণগহ্বর থেকে পৃথিবীর সতীচ্ছদ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে মহাজাগতিক কৃষ্ণগহ্বরে। না, এসব লেখকের অত্যুক্তি। দুই দিনমজুর ম্যানহোলের চিকন কাঁচুলি সরিয়ে শহরের শরীরে দড়ি বেয়ে ঢুকে পড়ছে আর বেরোচ্ছে। শহরের শিরা জুড়ে আমাদের বর্জ্য যেসব উৎকণ্ঠা, আকাঙ্ক্ষা, ক্রিয়া-বিক্রিয়া, অপরাধবোধ এবং যত অসামাজিক আবেদন ঘুরপাক খেতে-খেতে নিয়মিত অসুখ ছড়ায় তার পরিচর্যায় নেমেছে দুই চিকিৎসক। এ-শহরের প্রাণশক্তি ভেসে যায় যে-ধমনীতে অর্থাৎ কর্পোরেশনের নির্মল নবধারা জলের পাইপ— তা ছুঁয়ে দেখার অধিকার এদের নেই। এরা ধাঙড়। যাক গে। আচ্ছা রাস্তার মাঝে এই সরকারি ফুটোর নাম ম্যানহোল কেন? ওম্যানহোল হলে খারাপ শোনাত বলে? নাকি এখানেও সেক্সিজমের ঝাঁঝ পাবেন বেটি ফ্রিডনরা? ছোটবেলায় পরিতোষ ঠিক অ্যানুয়াল পরীক্ষার আগে ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে অনেক অবান্তর কথা ভাবত। তার মধ্যে একটা ছিল— রাস্তার এই ম্যানহোল বেয়ে নেমে গেলে কি কোনও দীঘল সুড়ঙ্গ বেয়ে পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে পৌঁছে যাওয়া যায়? নাকি সেই সুড়ঙ্গ সরাসরি পৃথিবীর সুডৌল নিতম্ব ভেদ করে বিপরীত প্রান্তে অন্য কোনও ম্যানহোলের ফুটোয় শেষ হয়? এই কারণেই মাঝেমধ্যেই ছেলেবেলায় জুতোর বাড়ি খেত পরিতোষ।
পরিতোষের বাবা ছিলেন সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর। নির্লজ্জ অঙ্কের কম মাইনে পেতেন ভদ্রলোক— হয়তো শুধু হাসিমুখে থাকার ভনিতায়। তাঁর ঘুষ নেবার ইচ্ছে বা স্বভাব ছিল কি না তা অবশ্য পরিতোষ জানত না। তবে তাঁকে ঘুষ দেবার লোক যে ছিল না, তা সে জানত বিলক্ষণ। সুতরাং ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে ‘স্বাস্থ্যই সম্পদ’ গোছের স্লোগান জারি রেখে তেলাপিয়া-বাটি চচ্চড়ি-ডাল-ভাত-উচ্ছে ভাজার বিপ্লবী চক্করে পরিতোষকেও পড়তে হয়েছে। আর বাড়িতে ছিল হো চি মিন বুড়োর ছবি, যাঁর আদলে আজও দাড়িখান বানিয়ে রেখেছে পরিতোষ। না আছেন হো— না আছে সেই ভিয়েতনাম। তবে দাড়ির ফ্যাশনটা চলে গিয়েও আবার ঘুরে ফিরে এসেছে।
তো এহেন পরিতোষের বাবা হঠাৎ একদিন অফিস ইউনিয়নের নেতাদের কুবুদ্ধিতে তুমুল বাড় খেয়ে জেদের বশে সরকারি দপ্তরে স্ট্রাইক ডেকে বসলেন। পোড়া বস্তির পাঁজরসর্বস্ব চায়ের দোকানে যেন মুসর্গস্কির ‘নাইট ওভার বল্ড মাউন্টেন’-এর প্রথম চলন বেজে উঠল, হাতির নাদের মতন। বাপের সার্ভিস বুকে জোরাল লাল কালির দাগ পড়ল। সরকারি সাসপেনশন অর্ডার শিরোধার্য করে বাবু বাড়ি ফিরে বললেন— ‘বিছানা পাতো— কাল হেকে অফিস যাচ্ছি না মাস তিনেক। এই সুযোগে কালী সিংহীর মহাভারতটা শেষ করব। আর ক’দিন আধখানা ডিম খেয়ে কাটাও— মাছের দাম আকাশ ছুঁয়েছে। তাছাড়া ওদেরও তো দেখতে হবে!’ উত্তমকুমারের মতো ব্যারিটোন ভয়েস ছিল লোকটার— পাড়ায় বলত সবাই। তাই ভদ্রলোকের অচেতনে প্রায়শই মহানায়ক চুপিচুপি হানা দিতেন— বদলে দিতেন হাঁটা-চলা, কথা বলার কায়দা। পরিতোষের বিশ্বাস, ওই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়াতেও কিছুটা ‘নায়ক’-এর ইনফ্লুয়েন্স ছিল। কীসের লড়াই? কেন সাসপেনশন? কাদের দায়িত্ব নিতে হবে? এসব খবর পরিতোষের মা না জানলেও, বুঝেছিলেন তাঁর মরদ বিছানায় শুয়েই দুনিয়ার রং বদলে ফেলবেন— আর তিনি হবেন ব্রেশটের মহিয়সী ‘মাদার কারেজ’। আসলে দেশের তৎকালীন সরকার হঠাৎ করে ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি জারি করার প্রতিবাদেই অফিস না গিয়ে দল পাকিয়ে, লাল পিঁপড়ের সারির মতো শহর জুড়ে হেঁটে বেরিয়ে এই বিপত্তি বাঁধিয়েছিলেন পরিতোষের বাবা। টিফিনে সবাইকে বিনি পয়সায় ব্রহ্মজ্ঞান দিয়ে ও গুড় দেওয়া চা খাইয়ে লোকটা সত্য সাঁইবাবার মতো ক’টা ভক্ত প্রহ্লাদ জুটিয়ে ছিলেন। অফিসের অনেকেই তাই পাশে দাঁড়িয়েছিল লোকটার— কেউ বুক চিতিয়ে— কেউ বা আলগোছে। ওই অফিসেই যারা ‘আদিম হিংস্র মানবিকতা’য় দু’চারখান আধলা ইঁট ছুঁড়ে স্বাস্থ্য সচিবের গাড়ির কাঁচ ভেঙেছিল, তাদের তো টারমিনেশন নোটিশ নিয়েই বাড়ি ফিরতে হয়েছিল,পত্রপাঠ। ফলে তাদের সাংসারিক দায়ভার কিছুটা হলেও এসে পড়েছিল পরিতোষের আপাত-উত্তম বাপের ওপর। তারপর বছর দুয়েক ধার-দেনা করে তাদের সংসারও চালিয়েছিলেন বটে পরিতোষের গান্ডু বাবা। এই তাঁর একমাত্র কীর্তি বা কেচ্ছা— যা নিয়ে সে-যুগের সাংবাদিকরা মদের আসরে এক লহমাও সময় নষ্ট করেননি। তাঁরা তখন অমিতাভ-পারভিন কিস্সায় বিমোহিত ছিলেন। মুশকিল হয়েছিল, লোকটা সরকারি সাসপেনশনের আচমকা ধাক্কাটা ঠিক নিতে পারেননি। অবিকল উত্তমকুমারের হৃদ্রোগের ধাঁচে ভদ্রলোকের ক্রমান্বয়ে দু’তিনটে হার্ট অ্যাটাক হওয়ায়, বেছে-বেছে লোকটার প্রয়াণ হয়েছিল বাঙালির মহানায়কেরই মৃত্যুদিনে। ফলত পরিতোষ আজও বুঝে উঠতে পারেনি— সেদিন তার মা ঠিক কার শেষযাত্রায় ঠোঁট ফুলিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন।
এসব কথা ভাবতে-ভাবতেই পরিতোষ হঠাৎ ফিরে এসেছিল আজকের পোড়া বস্তির গলির কিনারায়। হ্যাঁ। জোছনা এখনও লিপস্টিকের মতো লেগে রয়েছে সেই ম্যানহোলের ঠোঁটে। ম্যানহোলের সেই অন্তহীন বিস্ময়মাখা কালো গভীরতাও রয়েছে ওঁত পেতে। লোকদুটো শুধু নেই— নেমেছিল বটে অনেকক্ষণ আগে— আর ওঠেনি। দড়িখানও এখনও বাঁধা রয়েছে ল্যাম্পপোস্টের সাথে— টানটান নেমে গেছে গর্তের ভেতরে। লোকদুটো গেল কোথায়? সন্ধে গড়িয়ে রাত ছুঁইছুঁই আকাশ। ওরা বাড়ি যাবে না? এত নাগরিক ক্লেদ মেখেছে গায়ে— স্নান করবে না? কন্ট্রাক্টরের কাছে ফিরে দু’চার খিস্তি শুনে দিনের মজুরি গুনবে না? তিন-চার গ্লাস চোলাই ভিজে ঘুমোবে না? পাশেই শুয়ে ঘুমন্ত সহচরীর অগোচরে নেবে না আলতো হস্তমৈথুন করে? কোথায় গেল বুট-পালিশ গায়ে মাখা জানোয়ার দুটো? যে-মল, যে-মূত্র, যে-বীর্য, যে-বমন মানুষের শরীর বিচ্যুত হলেই মানুষের কাছে পর হয়ে যায়— সেই পরের উচ্ছিষ্ট আবার নিজের গায়ে মেখে পরের পরিচ্ছন্নতার দায়ভার নিল যারা— তারা গেল কোথায়?
ভাবতে-ভাবতেই আনমনে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নীচে গলিতে নেমে এসেছিল পরিতোষ। না, সে আপাতত পরিতুষ্ট নয়— পরিতৃপ্ত নয়— পরিব্রাজক হয়ে পড়েছে সহস্র শতকের। সে শুধু জানতে চায়— লোকদুটো কালো সুড়ঙ্গের অন্তরীপে খুঁজে পেল কি কোনও হারিয়ে যাওয়া অতলান্ত সভ্যতা— যেখানে হেমন্তের সন্ধ্যায় আপন পরিসরে বসে নিজের সঙ্গে কথা বলা যায় কিছুক্ষণ?
এরই মধ্যে ঝিরঝিরে বৃষ্টি নেমেছে নগরের উত্তপ্ত সব না-পাওয়াকে কিছুটা মসৃণ করে দেবে বলে। সকাল থেকেই কেমন গুমোট ছিল আবহাওয়া। যেন অতীতের গুমঘরে আটকে পড়েছিল অনেক ঘর্মাক্ত দলিল-দস্তাবেজ। এবার আরশি সরিয়ে দিল কেউ। বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই এক দৌড়ে পৌঁছে গেছিল পরিতোষ ম্যানহোলের মুখ-বরাবর। কালো গর্তে চোখ রাখতেই পরিতোষ বুঝেছিল— না, এ অন্ধকার সুড়ঙ্গ স্বার্থপর পৃথিবীর পেট চিরে দেয় না। দেখায় না কোনও মুক্তির পথ অন্য কোনও পৃথিবীর নিতম্ব ফুঁড়ে জেগে উঠে। লোকদুটো নির্বিষ অথবা নীলকণ্ঠ পাখি হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ওই কৃষ্ণগহ্বরের চেনা শূন্য আবর্তে— ওরা কেউ বাড়ি ফিরে যাবে না। সুধা ধবলিত কোনও বাড়ির ঠিকানা ওদের জানা নেই। লোকদুটো মরে গেছে নিঃসাড়ে।
এখন একটা মিষ্টি মাংস-পচা গন্ধ বেরোচ্ছে ম্যানহোলের উন্মুক্ত বিবরে। বোধ হয় মিথেন-এর গন্ধ। আর তাতেই মোহিত হয়ে পচে মরেছে মাউস্ট্রাপের ইঁদুরদুটো। পরিতোষ আগেও খবরে দেখেছে— এরা রোজ মরে। দেখেছে, কিন্তু কাউকে বলেনি কিছু। আজ মনে হল বলবে— গলা ফাটিয়ে চেঁচাবে। ‘কোথায় তোরা বেজন্মা বিজ্ঞের বাল! তোদের অজান্তে, তোদেরই গলগলে অধর্ম চুমুক দিয়ে খেয়ে, তোদেরই দুটো ভোটার কিংবা ক্লায়েন্ট কিংবা কাস্টমার আর নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। দৌড়ে আয় তোরা!’
ঝিরঝিরে বৃষ্টি পরিতোষের চোখের সামনে একটা জলজ আয়না তৈরি করেছে তখন। আয়নায় পরিতোষ গোটা শহরটাকে দেখছে— সবাই যেন নিজেকে নিয়ে কোথাও চলে গেছে! এ-শহর জনশূন্য— কাউকে ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছে না! পাড়ার আড্ডাবাজ, কেচ্ছাবাজ, ঢপবাজ, মাগিবাজ, প্রতিবেশী-উপনিবেশী, আত্মীয়-বন্ধু, পরিবার-পরিজন কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না পরিতোষ! নিরুপায় হয়ে, বারবার সবাইকে ফোন করছে পরিতোষ। সরকারি দপ্তরে, থানায়, ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিসে, হাসপাতালে, মর্গে। সব ফোন বেজে যাচ্ছে, কেউ তুলছে না ফোন। কেন তুলছে না ? কীসের এত কাজ, কীসের এত ঘুম, কীসের এত ফুর্তি সবার? কেউ কি দেখতে পাচ্ছে না, ওই খোলা ম্যানহোলের গাঢ় মিষ্টি মাংস-পচা গন্ধের মতো একটা প্রশ্ন পরিতোষকে তাড়া করেছে? পরিতোষ ছুটছে পোড়া বস্তির গলি ধরে ওই মানুষখেকো গর্তটা থেকে পালাতে। পরিতোষ কি এই শহরে একা ও অদ্বিতীয়? বা নির্বান্ধব!
হঠাৎ, কে যেন পেছন থেকে খপ করে ধরে ফেলল পরিতোষের জামার কলারটা। আসলে প্রশ্নটা খুবই কাছাকাছি এসে পড়েছিল যে। যতই পালাক, পরিতোষ জানে প্রশ্নের গতিবেগ আলোকে হার মানায়। এখন সে-প্রশ্নটাকে কাঁধে নিয়েই ছুটে চলেছে আরও দ্রুত। প্রশ্ন একটাই, ‘বাবা লোকটা কি সত্যি গান্ডু ছিল?’
ছবি এঁকেছেন সায়ন চক্রবর্তী