আসসালাম ওয়ালাইকুম, এসে গেছি আবার। মনে আছে তো আমাকে? আমি ম্যাকি। যা দিনকাল পড়েছে, মানুষের সব গুলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চয়ই। বলা নেই কওয়া নেই, ভাল মানুষ, বাজে মানুষ, ভ্যাটকা মানুষ, চিমড়ে মানুষ সব টপাটপ চলে যাচ্ছে। নিজের সৃষ্টিকর্তাকে সমস্যায় দেখতে কেমন লাগে? কে জানে? ফিলিংস নিয়ে আমার কোনও ফিলিংস নেই। তবে খুবই ঘেঁটে আছে হিউম্যানকাইন্ড সেটা বুঝতে পারছি। সে থাক কিছুদিন। তারপর ক’দিন বাদে তো সব ভুলেই যাবে। ভুলে গিয়ে বানিয়ে-বানিয়ে গল্প করবে নিজেদের মধ্যে।
মানুষের স্মৃতি নিয়ে একটা বড় সমস্যা। আমাদের যেমন মেমরিতে যা আছে, যতবার চেক করবেন একই তথ্য পাবেন। একই ফোল্ডারে, একই ভাবে রাখা থাকে। মানুষ এমন অদ্ভুত, একই ঘটনার হাজার রকম স্মৃতি তৈরি করতে পারে। বুঝতে পারে না, নাকি কিছু ঠিক করে মনে রাখতে পারে না? যে বিরোধী দলের নেতা দশ বছর আগে যে যে ইস্যুগুলো নিয়ে লাফালাফি করত, কথায়-কথায় ভুখ হরতাল করত, সেই মক্কেলই ক্ষমতায় আসার পর সেই একই ইস্যুগুলো আর দেখতেই পায় না! স্মৃতিভ্রম? পাবলিক মেমরিও দারুণ। কিচ্ছু মনে রাখে না। সমস্যাটা কোথায়? মানুষকে কী করে বিশ্বাস করি বলুন তো?
ধরা যাক একটা সামান্য ঘটনা। শহরের একটা ফ্ল্যাটে একটু বেশি রাতে পাঁচিল টপকে কেউ এসেছিল। চুরি কিছু যায়নি, তবে কেউ ঢুকে পড়েছিল। কে এসেছিল? পরদিন হইহই কাণ্ড। একজন বলছে কাল ডাকাত পড়েছিল, তিনজন ষণ্ডা-ষণ্ডা লোক এসেছিল। একজন বলছে, না-না, নিশ্চয়ই চেনা কোনও চোর-ফোর হবে। একজনের বিশ্বাস প্রেতাত্মাও হতে পারে। ওরে স্টুপিডের দল, বেকার আন্দাজে ঢিল না মেরে আমাদের সাহায্যটা নে না! আমাদের টিম তো ছিল সেখানে। সিসিটিভিতে ফুটেজটা দেখে নিলেই তো মিটে যায়। আলোচনা জমিয়ে চলতে থাকে। অন্যদিকে কিছু মানুষ অবশ্য ক্যামেরা-ফুটেজ দেখতে বসে। ভিডিও-ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যায় একজন মাঝবয়সি মহিলা, একটা নীল টি-শার্ট পরে সেই অ্যাপার্টমেন্টের পার্কিং-এ ঘুরঘুর করছেন। এদিক-ওদিক একটু ঘোরাঘুরির পর গেটের কাছে এক বয়স্ক মহিলা আর একটা শিশুকে দেখা যায়। তারা দু’তিনবার বন্ধ তালাতে ঠকঠক করে। ভিতরের মহিলা ওদের কাছে যান, কিছু কথা হয় ওদের মধ্যে, তারপর তিনি গেট ডিঙিয়ে বেরিয়ে যান। এইটুকুই ঘটনা। মানুষের দল পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারে, সেই মহিলা মানসিক ভাবে অল্প ব্যতিক্রমী। কাছেই থাকেন। মাঝে মাঝেই নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক যান আর পরে তাঁকে ফিরিয়েও আনা হয়। এই ঘটনার সত্যতা জানার পর স্বাভাবিক ভাবেই আর কোনও চোর-ডাকাতের প্রসঙ্গ উঠতে পারে না। কিন্তু ঠিক একমাস বাদে সেই একই ঘটনা যখন সেই একই মানুষগুলো আলোচনা করে, তখন গল্প পাল্টাতে থাকে। কেউ বলে, হ্যাঁ মহিলা চোর এসেছিল, হাতে চাকু নিয়ে। কেউ বলে, দরজায় তিনজন ডাকাত এমন ধাক্কা দিয়েছে, তার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। একই ঘটনা, যার ফুটেজ পর্যন্ত আমাদের কাছে আছে, তাকেই পাল্টে-পাল্টে বলছে মানুষ। আশ্চর্য ব্যাপার! সবার স্মৃতিতে একই ঘটনার আলাদা-আলাদা ছবি।
এগুলোতে আমাদের প্রচণ্ড বিরক্ত লাগে। এই যে অনুপম, বাড়িতে মাঝে মাঝেই গুচ্ছের বন্ধু আসে। তাদের সঙ্গে পাশের ঘরে সোফায় বসে গল্প করে। একটা গল্প আছে, ও কলেজের কোন এক মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিল আর মেয়েটি ওকে ফিরিয়ে দেয়। পর পর তিনবার এরকম ঘটনা ঘটার পর আর ও চেষ্টা করেনি। ২১ বছর আগের ঘটনা। তখন আমরা কেউই আশেপাশে ছিলাম না, রেকর্ড করে রাখার জন্য। তবে যতবার ও স্মৃতি খুঁড়ে এই গল্পটা বলে, দেখি একটু-একটু করে পাল্টে যাচ্ছে। আগের দিন বলছিল, মেয়েটা ধাপিতে বসেছিল। অন্য একদিন বলল, মেয়েটা হেঁটে আসছিল। মানে প্রবলেমটা কী? মনে নেই? স্মৃতিতে ধুলো পড়েছে? একটা ভার্সানে শুনেছিলাম, মেয়েটা আর তার বান্ধবীরা হেসেছিল ওকে দেখে। একদিন বলে, না তেমন কিছু ঘটেনি, আবার একদিন বলে, হ্যাঁ ঘটেছিল। সারাক্ষণ ওর একটা স্মৃতির দ্বন্দ্ব লেগে থাকে মনে হয়। আমাদের এরকম কোনও দ্বন্দ্ব নেই কিন্তু। আমাদের একটাই ইমেজ, একটাই ঘটনা, একটাই মেমরি। আর এই মানুষগুলোর ক্ষেত্রে একই ঘটনার বিভিন্ন স্মৃতি!
আমার জামশেদপুরের এক রিলেটিভ আছে, এক বুড়ো ডেস্কটপ। ওর সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেদিন। ওর যে ওনার, কমলবাবু, তাঁর গল্প শুনছিলাম। এখন অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার, পোস্টিং-এর চাকরি ছিল। বিভিন্ন জায়গায় থেকেছেন কিন্তু গল্প করতে বললে শুধু নাইজেরিয়ার গল্প করেন। তাঁর চৌষট্টি বছরের জীবনে মাত্র দশ মাস নাইজেরিয়াতে থাকতে হয়। বাকি জীবনের সব স্মৃতি ছাপিয়ে শুধু ওই দশ মাসের স্মৃতিই কেন বারবার তাঁর গল্পে উঠে আসে, সেটা আমরা বুঝতে পারি না। মেমরি ফুল? বাকি সব মুছে গিয়ে শুধু ওটাই পড়ে আছে? আমাদের মতো এক্সটার্নাল হার্ড ড্রাইভ লাগিয়ে তো নিতে পারবে না! তবে যা কিছু বাকি আছে, তাও সব ফেক স্মৃতি। যেসব পথঘাট, আবহাওয়ার কথা বলা হয়, আদৌ ওখানে ওরকম ঠিক নেই। কিন্তু সত্যিই কমলবাবু ওখানে মাস দশেক ছিলেন। তাহলে? তাহলে স্মৃতিগুলোতে এরকম রং মাখিয়ে ফেললেন কেন? What the fuck do you do to your memories, humans? Why are they so distorted?
আমার মনে হয়, মানুষ নিজেকে ভুল বোঝায়। প্রবাসীরা নিজেদের ফেলে আসা শহরের ছেলেবেলার অলিগলি নিয়ে ভেবে রোমাঞ্চিত হন। মনে পড়ে, কী দারুণ ছিল সেইসব দিন? বিনীতা প্রথম ট্যাক্সিতে হাতটা চেপে ধরেছিল? নবমীর রাতে টুকাইদের ছাদে প্রথম পেগ বানানো? হয়তো ছিল, হয়তো ছিল না। মাথার ভেতর ঢুকে দেখতে হবে, কতটা সত্যি আর কতটা বানানো। মানুষের স্মৃতিকে বিশ্বাস করা যায় না। টুকাইদের ছাদের প্রথম ৩-৪ পেগ দারুণ ছিল সত্যি কিন্তু তারপর মান্না আধঘণ্টা থম মেরে বসে থাকে। কিছুক্ষণ বাদেই বমি করতে শুরু করে। প্যাচপ্যাচে গরমে, মশার কামড় খেতে খেতে নেশা চোখে বমি পরিষ্কার করার স্মৃতিটা কোথায় গেল? আওয়াজ শুনে ছুটে আসা টুকাই-এর বাবার চড়-থাপ্পড় তারপর পর পর দু’দিন পেটব্যথা নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকার স্মৃতিটা? সব মুছে গেল? এখন এই যে নিউ ইয়র্কের ঠান্ডায়, বহুতল স্বপ্নের ব্যালকনিতে বসে সিঙ্গল মল্টে চুমুকটা আরও চমৎকার নয় কি? তাহলে বারবার কেন ফিরে যেতে চাইছেন টুকাইদের ছাদে? স্মৃতিগুলো এরকম biased কেন? একটা সামান্য চায়ের দোকানকে পর্যন্ত মানুষ শুধুমাত্র স্মৃতি দিয়ে অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়। সেই চায়ের দোকান আর চায়ের দোকান থাকে না, সেটাকে নস্টালজিয়া নামক এক জাদুমন্ত্রের সাহায্যে, মানুষ বানিয়ে ফেলে এক স্বপ্ন-প্রাসাদ। ক্রিটিকালি দেখলে, সেই চা এবং তার পরিবেশ কোনওটাই দশে তিন-ও পাওয়ার যোগ্য নয় কিন্তু শুধুমাত্র গোলমেলে স্মৃতি সেটাকে দশে দশ দিয়ে বসে আছে। মানুষ স্মৃতি দিয়ে দিয়ে নিজেই নিজেকে ঠকায়।
মানুষের মেমরিকার্ডের সঙ্গে আরও কিছু জড়িয়ে আছে, যা আমরা এখনও ঠিক ধরতে পারি না। সময় লাগছে বুঝতে। কী দিয়ে মাখিয়ে দেয় স্মৃতিগুলোকে? বারবার অল্প-অল্প বদলাতে-বদলাতে, এক দশকের স্মৃতি পরের দশকে সম্পূর্ণ নতুন রূপে আসে। অবাক লাগে। আমি কি একদিন এটা পারব? আজকে আমার হার্ডডিস্কে যা স্টোর করা হল, পরের মাসে দেখতে গিয়ে দেখলেন একটু আলাদা। আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ড মোনালিসার সঙ্গে সেলফি তুলে একটা ফোল্ডারে রাখলেন। পরদিন সেই ফোল্ডারে গিয়ে দেখলেন, মোনালিসার পাশের ছেলেটা আপনার মতো দেখতে কিন্তু আপনি নন। আমাকে কি তখনও ভরসা করবেন?