আমার মনে হয়, জীবনের একটা পর্যায় থেকে আর একটা পর্যায়ে উত্তরণের মাঝে একটা ঠিকঠাক ফেযারওয়েল দরকার। জীবনের প্রতিটা স্তরেরই শেষটায় পৌঁছে, একটা স্বীকৃতি দরকার হয়। কীভাবে ওই অধ্যায়টাকে শেষ করলাম, তার গভীর প্রভাব থাকে পরের পর্যায়টায়। আমাদের জীবনের অন্যতম একটা তীব্র পরিবর্তন ঘটে, যখন আমরা স্কুল পেরিয়ে সত্যিকারের একটা বড় জীবনে পা রাখি। মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়, এবং ক্লাস ইলেভেনের শুরু থেকেই আমাদের এর জন্য তৈরি করা হয়। বোর্ডের পরীক্ষা আসছে, প্রজেক্টগুলো শেষ তারিখের মধ্যে জমা দিতে হবে, কলেজে অ্যাপ্লিকেশন পাঠাতে হবে, স্কুলে আমরাই সবচেয়ে সিনিয়র ব্যাচ এবং আমাদের দেখে জুনিয়ররা শিখবে বলে আমাদের বেশ একটা উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে— এই সবগুলো মিলিয়েই একটা মঞ্চ তৈরি হয়, যা আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের দিকে যেতে সাহায্য করবে। শুনলে মনে হচ্ছে খুব ভয়ের ব্যাপার, কিন্তু আমার স্মৃতি অনুযায়ী, এই সময়টা অসম্ভব উত্তেজক। অনেকগুলো অনুভূতির একটা আশ্চর্য মিলমিশ: আশা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কৌতূহল, আবার তার সঙ্গে অনাগত জীবনের ভয়, এবং যে-প্রতিষ্ঠানকে দ্বিতীয় বাড়ি বলে ভেবেছিলাম তা চিরকালের মতো ছেড়ে যেতে হওয়ার হৃদয়বিদারক বাস্তব।
নতুন একটা শুরুর জন্য একটা ধুকপুকে অপেক্ষা, স্বাধীনতার প্রথম স্বাদের জন্য প্রতীক্ষা, এই অনুভূতিটাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। বোধহয় প্রজাপতি যখন তার গুটি-খোলসের মধ্যে থেকে
বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে প্রথম ডানা মেলে দেয়, তার এরকম মনে হয়। প্রাপ্তবয়স্কতার সঙ্গে প্রথম মুখোমুখি হওয়ার এই আনন্দটার মধ্যে বড্ড বেশি সারল্য আছে, কিন্তু সেটাই কি এই অনুভূতিটার আসল সৌন্দর্য নয়? অবশ্য ভ্রম খুব চট করেই ভেঙে যায়, কিন্তু ওই প্রথম উত্তজনাটা অনুভব করার মাদকতাটা আমাদের সব্বার চেখে দেখা উচিত। এই অবধি এসেই, এখনকার বিষাক্ত বাস্তবের আঘাতে, আমার স্মৃতির গোলাপি অভিযানের রেশটা চুরমার হয়ে যায়। স্কুলের শেষ আর অন্য জীবনের শুরু— জীবন-বদলে-দেওয়া ওই সন্ধিক্ষণটা থেকে সব আনন্দ শুষে নিয়েছে এই অতিমারী, আর তার ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে শুধু অনিশ্চয়তার দাহ্য পদার্থ। আমি এখন কলেজে পড়ি, তাই অতিমারীটা আমাদের কী পরিমাণ মোহভঙ্গ আর হতাশার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে, তা তো বুঝতেই পারি। এটা তো আমাদের দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। একটা ক্লাসরুম ভর্তি ছেলেমেয়ে থাকবে, ঘরটা গমগম করবে, এর যে-এনার্জিটা, সেটা খুব মিস করি।
কিন্তু এই যে এটার অভাব বোধ করি, তার কারণ সমস্ত আন্ডারগ্র্যাজুয়েট বছরগুলো জুড়ে তো এই ব্যাপারটা উপভোগ করতে পেরেছি। অনায়াসে মনে করতে পারি প্রথম সিমেস্টারের কথা, যে নতুন বন্ধুদের পেয়েছিলাম তাদের কথা। পড়ানোর নতুন ধরন, শেখার ধরন, রুটিন বদলে যাওয়া, নতুন পরিবেশে নিজের মানিয়ে নেওয়া এবং নিজের প্রতিক্রিয়াগুলো বেশ নজর করে দেখা— সব মিলিয়ে আগের থেকে কতটা বদল হয়েছে তা বেশ বুঝতে পারতাম। শেষ যারা স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে গেল, এটার স্বাদই পেল না। বিনাদোষে কী আশ্চর্য একটা রূপান্তরের অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে— সেটাও বুঝতে পারল না। খুব খারাপ লাগছে ওদের কথা ভেবে।
কিন্তু এখন যারা স্কুল-ছাড়ার চৌকাঠে, তদের কথা ভেবে আরও খারাপ লাগছে। নতুন জীবনে প্রবেশ করার যতরকম আবেগের টানাপড়েন, তার কথা যদি বাদও দিই, এই নিরালম্ব অবস্থায় আটকে থাকার চেয়ে বিশ্রী ও ক্লান্তিকর আর কী হতে পারে? পরীক্ষার তারিখ একবার এগোনো হচ্ছে, একবার পিছোনো হচ্ছে। বারবার একই জিনিস পড়ে যেতে হচ্ছে, প্রবল উদ্বেগ নিয়ে, ঠিক করে মন দেওয়াও যাচ্ছে না, অনলাইন পরীক্ষা না অফলাইন— তা নিয়ে অবধি কেউ নিশ্চিত নয়। এ যেন একটা অত্যাচারের বিবরণ। এই দেশে বোর্ডের পরীক্ষাকে এবং অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাকে যে-পরিমাণ গুরুত্ব দেওয়া হয়, সে কথা ভাবলে অত্যাচারের মাত্রাটা আরও বুঝতে পারা যায়। এইসব পরীক্ষার ফলের উপরেই চাকরি নির্ভর করে, বিশেষত ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর কলেজে।
এই তো ক’দিন আগেই ঘোষণা হল, সব বোর্ড-পরীক্ষাগুলো বাতিল। এর ফলে ঠিক কী হবে, তা নিয়েও ছাত্রছাত্রীরা ধন্দে। আমার নিজের ক্ষেত্রে বোর্ড-পরীক্ষার ফলের উপর পরের ধাপের পড়াশোনা নির্ভর করেনি, আমার সৌভাগ্য হয়েছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রবেশিকা পরীক্ষাটায় পাশ করার। তখন বোর্ড-পরীক্ষার ৬০% পেলেই এই পরীক্ষায় বসা যেত। এখনকার সঙ্কটের সময়, ভেবে দেখতে হবে, স্কুলগুলো সিমেস্টার সিস্টেম-টাকে গ্রহণ করবে কি না।
যদিও আমার স্নাতকোত্তর পড়াশোনাটা বাড়ি থেকে করতে হল, এটা কোনও ভাল ব্যাপার নয়, তবু বলব, এখন স্কুলে যে-পদ্ধতিতে পরীক্ষা হয়, সিমেস্টারের বন্দোবস্তটা অন্তত তার চেয়ে ভাল। শিক্ষকদের পক্ষেও, ছাত্রছাত্রীদের পক্ষেও। এখনকার সিস্টেমটা, যাকে বলে, ভেঙে পড়ছে। ছাত্রছাত্রীরা বুঝতেই পারছে না, অদূর ভবিষ্যতে কী হবে। সরকার সারাক্ষণ মত বদল করছে, আর স্বাভাবিক ভাবেই ছাত্রছাত্রীদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থাও ভাল থাকছে না। শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে সরকারের সত্যিই সঙ্কট মোকাবিলার দৃঢ়তা ও দক্ষতা আর একটু বেশি থাকা দরকার। অনলাইন ক্লাস ও পরীক্ষা হচ্ছে বটে, কিন্তু অনেকের তো সারাক্ষণ ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগই নেই। বহু ছাত্রছাত্রীর ক্ষেত্রে সেটাই একটা বিরাট বাধা।
কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে বুঝলাম, এইগুলোই তাদের মূল সমস্যা। সব্বাই একটা কথা বলল, তারা বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত। ‘এক পড়া বারবার রিভাইজ দিতে দিতে আমরা ক্লান্ত আর হতাশ। এই অনিশ্চয়তার চোটেও ঠিক করে পড়াশোনা হচ্ছে না। পড়া শুরু করার আগে, একটা কোনও নিশ্চিত সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলে ভাল হত, ঠিক করে ফোকাস করা যেত। একটা নিশ্চিত তারিখ বলে দিলে, সেদিকে তাকিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া যায়’, লিখছেন জিগনেশ প্যাটেল, তাঁর স্কুল আইএসসি বোর্ড অনুসরণ করে।
এইখানে এ কথাটাও যোগ করতেই হবে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা কী নিপুণ ভাবে এই নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন। যে কোনও বয়সের শিক্ষক-শিক্ষিকা, আগে প্রযুক্তিগত ভাবে কতটা দক্ষ ছিলেন, তার তোয়াক্কা না করেই নতুন পদ্ধতিটায় অসামান্য কাজ করে চলেছেন। ব্যাপারটা সহজ ছিল না অবশ্যই। আমি আমার মা’কেই দেখতাম, ক্লাস নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইন্টারনেটের ঝঞ্ঝাটের জন্য ক্লাস বন্ধ করে দিতে হত, ইন্টারঅ্যাক্টিভ ক্লাসগুলো তো বটেই। আসলে শেখানে আর শেখা এই দুটো এখন এমন বিযুক্ত হয়ে গেছে, অনেকেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। আমি ছাত্রী হিসেবে এসব অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গেছি, তাও তো আমি সৌভাগ্যবান যে আমাদের সব প্রযুক্তি-ব্যবস্থা আছে, আর শহরের মধ্যিখানেও থাকি। যাদের এত সৌভাগ্য নেই, তাদের দুরবস্থা কত, ভেবে কূল পাওয়া যায় না।
স্কুল ছাড়ার আগে, শেষ সপ্তাহটার কথা আমার বেশ মনে পড়ে। আমি আর আমার বন্ধুরা এত বাড়াবাড়ি করতাম (আমি এখনও করি) যে আমরা সব ‘শেষ’-গুলো গুনতাম। মানে, শেষ অ্যাসেম্বলি, শেষ সিক্সথ পিরিয়ড, শেষ পি.টি. ক্লাস, এইরকম। সারা ব্যাচের সবাই কেঁদে ভাসিয়ে দিতাম। আমি হয়তো একটা করিডোর পেরোচ্ছি, আর কিছু একটা মনে পড়ে গেল, এইখানেই ঘটেছিল, ব্যস, জলসঞ্চার শুরু। আমার প্রিয় লুকোবার জায়গাগুলোকে বিদায় জানালাম। এ-ওর স্কুল-ইউনিফর্মের পিছনে মার্কার দিয়ে মেসেজ লিখে দিলাম। স্টাফরুমের সামনে লাজুক ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলাম, যাতে প্রিয় টিচারদের বলতে পারি, তাঁদের কতটা মিস করব। ছাত্রী হিসেবে শেষ যেদিন ক্লাস করলাম, সবাই মিলে স্কুল-সং’টা একবার গাইলাম, শেষবারের মতো। এখনও ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। এই কথাগুলো এতবার বলছি, কারণ কী অসামান্য একটা বিদায়বেলা থেকে, একটা টা-টা করা থেকে এখনকার ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হল, তা বারবার বলেও বোঝানো যাবে না। আশা করি স্কুলগুলো কিছু একটা ধরনের ফেয়ারওয়েলের পরিকল্পনা করছে। যাতে এদের সকলের জীবনের একটা অধ্যায়ের শেষকে মনে রাখার মতো একটা চিহ্ন থাকে। ওদের তো বুঝতে হবে, শেখার একটা পর্যায় শেষ হল, এবার সাইকেলের ‘ট্রেনিং হুইল’, মানে সহায়ক চাকাগুলো ছাড়াই চালাতে হবে। এই ফেয়ারওয়েল-টা একেবারে না-হওয়ার চেয়ে, জুম বা গুগল মিট-এ করাও ভাল। আমার তরফ থেকে সবাইকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই। ঠিকই, মনে হচ্ছে আমাদের চারপাশের পৃথিবীটা টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের এই সময়েই পরস্পরকে জোড়ে আঁকড়ে থাকতে হবে। কারণ, এই দুঃসময় কেটে যাবে। যেতেই হবে।