ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • আহারে গুজরাত


    সুকন্যা দাশ (Sukanya Das) (June 19, 2021)
     

    গুজরাতে এসে কাজের প্রথম দিনেই সহকর্মী বিক্রম আয়েঙ্গারের সাফ কথা, ‘এখানে এসে উন্ধিউ-ই খাব, বিরিয়ানি খুঁজব নাকি?’ ঠিকই তো। আমার আগের আহমেদাবাদ বেড়ানোর সঙ্গে জুড়ে ছিল ঘি-জবজবে রোটলা, ভাকরি উন্ধিউ, মিঠে পুরান পোলি আর টুকটাক মুখ চালাতে নরম ঢোকলা, সুস্বাদু থেপলা আর মুচমুচে ফাফড়া। কিছু উপদেশ, কিছু স্মৃতিতে বলীয়ান হয়ে আমরা আহমদাবাদী খানার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম। 

    কিন্তু এবারের প্রথম খাওয়াটাই আমাদের প্রত্যাশা আর সযত্নে লালিত ধ্যানধারণাগুলোকে আমূল পাল্টে দিল। মধ্যাহ্নভোজ হয়নি, তাই স্থানীয় আলোকচিত্রী এবং আমাদের গাইড কুশল বাটুঙ্গেকে বলেছিলাম, আমরা কিন্তু আমিষাশী। এর পরেই দেখা গেল আহমেদাবাদের গরম বিকেলে অটোয় গাদাগাদি করে আমরা চলেছি আমিষ সিঙারা ভক্ষণ অভিযানে। পুরনো শহরের ঠিক মাঝখানে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলের ঠিক উল্টো ফুটে আমাদের গন্তব্য ফেমাস সামোসা। 

    জায়গাটা লম্বা আর সরু। সেখানেই সার-সার গ্রানাইটের টেবিল আর কাঠের বেঞ্চি পাতা। ফেমাস সামোসা দেখে মনে পড়ে গেল কলকাতার বিখ্যাত মুঘলাই রেস্তোরাঁ আলিয়ার কথা। প্রত্যেকটা টেবিল ভর্তি। সেখানে সামনের হাইকোর্ট থেকে আসা উকিল যেমন রয়েছেন, তেমনই রয়েছেন ট্যাক্সিচালক। আর পথচলতি টুরিস্ট তো আছেনই। 

    ফেমাস সামোসায় পরিবেশিত হয় মাত্র দুটি পদ— বিফ পকোড়া আর বিফ সামোসা। অর্ডার দিতে হয় ওজনমাফিক। দুটি পদ মিশিয়েও খাওয়া যায়। একে লাঞ্চ হয়নি তাই কুশল পাওয়ের অর্ডারও দিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে টেবিলে হাজির ঝকঝকে স্টিলের থালায় পকোড়া আর সামোসার কম্বোমিল। আর একটা প্লেটে এল পাও। পরের কয়েক মিনিট আমাদের কারও মুখে কোনও কথা নেই। 

    এমন খাবার সম্পূর্ণ মনোযোগ দাবি করে। সেটা দিলামও। ময়দার নরম আস্তরণে ঢাকা, ধনে আর লঙ্কায় মোড়া সামোসা ছিল অতীব উপাদেয়। পকোড়াগুলো কিমার চপের মতো হলেও, কিছুটা মুচমুচেও বটে। আবার সাধারণ পাওয়ের তুলনায় এই পাও গড়নে, স্বাদে একেবারে আলাদা। গুজরাতিরা চিনির ভক্ত, তাই গোল-গোল পাওয়েও চিনির ভাগ বেশি। কিন্তু পকোড়ার সঙ্গে জমে গেল বেশ! ওয়েটারকে ডাকতেই টেবিলে চলে এল আর এক প্লেট পকোড়া-সামোসা। খেতে-খেতেই কানে ভেসে এল ওজন করার শব্দ ত্রাণ-সৌ আর পাঁচ-সৌর (তিনশো, পাঁচশো) সাউন্ডট্র্যাক। আর ছিল দফায়-দফায় টেবিলে সশব্দে প্লেট রাখা। 

    পুরনো আহমেদাবাদের অভিনব খাবারের দোকান:ফেমাস সামোসা হাউস

    খাবার তো সুস্বাদু বটেই, কিন্তু দেখার মতো ছিল সেটি খাওয়ার গতি। আন্দাজ করলাম, প্রতি পাঁচ থেকে সাত মিনিটের মধ্যে, আট থেকে দশ কিলো মাংসমিশ্রিত আহারটি উধাও হয়ে যাচ্ছে। রেস্তোরাঁর মালিক জবির শেখও এই বিষয়ে সহমত। বললেন, ‘প্রতিদিন গড়ে দুটি পদ মিলে আমরা ১২৫ থেকে ১৫০ কেজি বিক্রি করি। পরিবেশন দ্রুত, দামে কম, গরম-গরম খেতেও ভাল। কর্মব্যস্ত লোকেদের অত তারিয়ে তারিয়ে খাওয়ার সময় কোথায়?’

    ওই ১৫০ কিলোর পিছনে আমার স্বাদমুকুলেরও অবদান আছে জেনে যেমন ভাল লাগল, একই সঙ্গে একটা দুশ্চিন্তাও মনে দানা বাঁধল। আচ্ছা, হঠাৎ যদি উন্মত্ত জনতা আমরা বিফ-খাদক জানতে পেরে আমাদের মেরে ফেলে? বা পুলিশ যদি জায়গাটায় হানা দিয়ে, বিফ খেয়েছি বলে আমাদের গ্রেপ্তার করে? গুজরাত তো শুনেছি ভয়ানক ভাবে শাকাহারী। কিন্তু দেখলাম এই বিষয়ে গবেষণার ফলাফল একেবারেই আলাদা। 

    শাকাহারী গুজরাত নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে যে-ধারণা, তা আদতে গল্পকথা। যদিও এটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানির অনেক দিনের সাধ। কিন্তু এই স্বপ্ন সফল করতে হলে তাঁকে রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে আমিষাশী থেকে নিরামিষাশীতে রূপান্তরিত করতে হবে। কত ভাগ? জানলে সবাই অবাক হবেন।  

    সেন্সাস অফ ইন্ডিয়ার সাম্পল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম বেসলাইন সার্ভে ২০১৪ অনুযায়ী গুজরাতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ আমিষাশী। এটি পাঞ্জাব (২৮ শতাংশ) এবং রাজস্থানের (২৭ শতাংশ) তুলনায় যথেষ্ট বেশি। এর পরেও গুজরাতে আমিষাশীদের প্রতি অনেকেই বিতৃষ্ণার ভাব দেখান। এর সঙ্গে জাত, ধর্ম, মত নিয়ে অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন তো আছেই। 

    কাঁচা মাংস অল্প হলেও তথাকথিত হিন্দু এলাকাতে পাওয়া যায়। যদিও একে ‘মুসলিম’ খাবার বলে ছাপ মেরে দেওয়া হয়েছে, গুজরাতের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন আমিষাশীরা। এঁরা মূলত ওবিসি, দলিত, রাজপুত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। তবে ‘নতুন’ আহমেদাবাদে আমিষ খাবারের বিশেষ চল নেই। শহরের এই অংশে বর্ধিষ্ণুদের বাস। এখানেই এলাকার গর্ব, বহুচর্চিত সবরমতী নদীতীরের শোভা যা টিভির পর্দায় আমরা প্রায়ই দেখে থাকি। 

    একদিক থেকে আহমেদাবাদ এক ‘বিরল’ কৃতিত্বের অধিকারী। এখানেই পিৎজা হাট, বিশ্বে তাদের প্রথম শাকাহারী রেস্তোরাঁ খোলে। যেসব এলাকায় জৈন সম্প্রদায়ের লোকজন বেশি, সেখানকার রেস্তোরাঁর পিৎজা ও ডাল মাখানিতে পেঁয়াজ পড়ে না। আবার মুসলিম অধ্যুষিত জায়গায় এর অন্যথাও হয়। তবে জৈনদের পবিত্র পরয়ুশান উৎসবের সময় সব কসাইখানা বন্ধ রাখা হয়। ভারতের মধ্যযুগের ইতিহাসে এর উল্লেখও আছে। শোনা যায় মুঘল সম্রাট আকবর, জৈন ভিক্ষুদের এক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের পর, মহাবীর জয়ন্তী ও চতুর্মাসের কয়েকটি দিন প্রাণীহত্যা নিষিদ্ধ করেন। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এই সময় সব কসাইখানা ও আমিষ ভোজনালয় বন্ধ থাকে। যদিও জৈন ধর্মাবলম্বীরা গুজরাতে সংখ্যালঘু (রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশেরও কম)।     

    রাজ্যের যে চল্লিশ শতাংশ মানুষ আমিষাশী, যাঁদের মাংস ছাড়া চলেই না, তাঁরা খাদ্যাভ্যাস টিকিয়ে রাখবেন কীভাবে? শুধু মাছ, মুরগি, মাটন তো নয়, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিফও। এদের মধ্যে বিফই সব থেকে সস্তা— কিন্তু যাঁরা অর্থাভাবে এর থেকে দামি মাংস খেতে পারেন না, তাঁদের স্বাস্থ্যের কথাও ভাবা উচিত। 

    শাকাহারী গুজরাত নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে যে-ধারণা, তা আদতে গল্পকথা। যদিও এটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানির অনেক দিনের সাধ। কিন্তু এই স্বপ্ন সফল করতে হলে তাঁকে রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে আমিষাশী থেকে নিরামিষাশীতে রূপান্তরিত করতে হবে। কত ভাগ? জানলে সবাই অবাক হবেন।  

    কুশলের মতো, চেতনা রাঠোরও ছারা সম্প্রদায়ভুক্ত। এটি ওবিসির আওতায় পড়ে। তিনি বললেন, ‘অন্যান্য যাযাবর সম্প্রদায়ের মতো আমাদের খাদ্যাভ্যাসও গড়ে উঠেছে শিকার ও খাদ্য সংগ্রহের উপর ভিত্তি করে। যখন যে-মাংস, যে-শাকসবজি পাওয়া যেত তাই হাঁড়িতে চাপিয়ে কাঠের আগুনে রান্না করা হত। নাগরিক সমাজে এসে আমরা ফ্রিজ, প্রেশার কুকার, গ্যাসের উনুনের সঙ্গে অভ্যস্ত হলেও, আমাদের খাদ্যাভ্যাস কিন্তু একই থেকে গিয়েছে। আমরা নিম্নবর্গের সম্প্রদায় বলে আমাদের প্রয়োজনগুলোকে গুরুত্ব তো দেওয়া হয়ই না, বরং এইসব কারণ দেখিয়ে আমাদের অপরাধী বলে দেগে দেওয়া হয়।’ 

    অপরাধের কথা যখন উঠলই, তখন এই নিয়ে আইনগুলি খতিয়ে দেখা যাক। গুজরাতে গরু, বাছুর বা ষাঁড় হত্যা বা তাদের মাংস বিক্রি কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এই আইন অমান্য করলে দোষীকে পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হয়। সম্প্রতি গোহত্যার শাস্তি বাড়িয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়েছে। এক বিজ্ঞপ্তিতে পশুপালন দপ্তরের অধিকর্তা এ জে কাচ্ছি প্যাটেল বলেছেন, ‘গোহত্যা আমরা একেবারেই অনুমোদন করি না। এখান থেকে বিফ রপ্তানিও হয় না। কিছুটা নিয়ন্ত্রিত ভাবে মোষহত্যা চলে, কিন্তু সেটার ব্যবহারও স্থানীয় মানুষদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।’   

    তার মানে যতই আপত্তি থাক, স্থানীয় খাদ্যাভ্যাসের জন্য বিষয়টা মেনে নিতেই হল। রাজ্যে তেইশ বছর ধরে ক্ষমতাসীন দলের বিচারধারার সঙ্গে তাল মেলাতে  গিয়ে খাদ্যাভ্যাসে আপোস না করে উপায় কি? ফেমাস সামোসা পরিবেশন করে কারাবিফ, যা আদতে বিফ নয়। মোষের মাংস কারাবিফের কেনাবেচা চললেও এর জন্য খুব অল্প কসাইখানাকেই লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। 

    তাই বলে মাংস খাওয়া কি কমে গিয়েছে? ‘তা কী করে হবে?’ প্রশ্ন চলচ্চিত্র-পরিচালক, নাট্যকর্মী ও খাদ্যরসিক দক্ষিণ বজরঙ্গীর। তাঁর ডাব্বা থেকে আমাদের রোটলা, সবজি আর ছারাদের বিশেষ পদ মাটন কাঞ্জির ভাগ দিয়ে বললেন, ‘মদ বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা থাকলে যেমন মদ পাচার বেড়ে যায়, এখানেও ঠিক তাই। বিনা লাইসেন্সের কসাইখানা থেকে কাঁচা মাংস পৌঁছে যায় রাজ্যের বহু বাড়িতে আর ধাবায়। ফ্রাই সেন্টার আর তাওয়া থেকে দেদার বিক্রি হয় চিকেন, মাটন দানা, মাটন সামোসা আর বিরিয়ানি। সব সম্প্রদায় এদের পৃষ্ঠপোষক, কেউ খোলাখুলি ভাবে, কেউ আড়ালে-আবডালে, এই যা।’

    এ-কথা মানলেন ফেমাস সামোসার জবির শেখও। ‘আমাদের স্থানীয় খরিদ্দারের শতকরা আশি ভাগই অ-মুসলিম। গুজরাতি-ভাষীদের একটা বড় অংশ আমিষ খান। কিন্তু আপনি তাঁদের পাবেন পুরনো আহমেদাবাদেই। আর এই স্বাদ পেতে হলে আসতে হবে এই এলাকার রেস্তোরাঁতেই। তবে পেশাগত কাজে আসা লোকজন বা পর্যটক সবরমতীর এই পাড়ে বড় একটা দেখা যায় না। পশ্চিম আহমেদাবাদে কিছু দেখনদার হোটেল আর রেস্তোরাঁ ছাড়া আমিষ খাবার পাবেনই না। আর রাস্তা থেকে তো এসব একেবারে ভ্যানিশ।’

    ফেমাস সামোসা হাউস-এর মালিক জবির শেখ

    চেতনা বললেন, ‘শুধু দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়াতেই নয়, মদ ও মাংস ছাড়া আমাদের যে কোনও উৎসবই অসম্পূর্ণ। এবং সেটা সব অর্থেই। যেমন ধরুন হোলির সময় কাঠ-কয়লার আগুনে গোটা ছাগল রান্না করা হয়। বছর যাতে ভাল যায়, তাই আমাদের সম্প্রদায়ের কাছে এটা করা বাধ্যতামূলক। একে আমরা ‘ভারি’ বলি। সেই সময় কসাইখানা বন্ধ থাকলে আমাদের অসুবিধা তো হয়ই।’

    কুশল দুষ্টু হেসে বললেন, ‘দুশ্চিন্তার কিছু নেই। ও আমরা ঠিক ব্যবস্থা করে নিই। সমস্যাটা বেশি হয় ‘বাধ্য’ নাগরিকদের।’ সমাজ যে পিছিয়ে-পড়া সম্প্রদায়ের কিছু মানুষকে ‘বরাবরের অপরাধী’ হিসাবে দেখে, সে তো জানা কথা।   

    দক্ষিণ অবশ্য মনে করিয়ে দিলেন, ‘জৈন সম্প্রদায়ের কোনও উৎসবের সময় কসাইখানা বন্ধ রাখা মোটেই কাম্য নয়। জনসংখ্যার একটা বড় অংশের উপর এর প্রভাব পড়ে। এটাকে কখনও ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ বলা হয় কি? সবাই জানে উত্তরটা ‘না’ই হবে, কারণ জৈন সম্প্রদায় একই সঙ্গে অর্থবান ও প্রভাবশালী।’  

    মানুষের রোজকার খাবার ছিনিয়ে নেওয়া, সেটা তৈরির পদ্ধতির উপর বিধিনিষেধ আরোপ কিন্তু এক অর্থে তাদের পরিচিতি সত্তার উপরেই আঘাত। এই আঘাত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সবুজ স্বপ্নের সঙ্গে এবং ক্ষমতাসীন দলের বিচারধারার সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যায়। সেই বিচারধারা, যা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। 

    গুজরাতি রান্নার ক্ষেত্রে তেতারনিকাড়হি (তিতির পাখির কারি), বোকলো নো কলেজো (ছাগলের মেটে) আর মাটন নু শাক এক সময় উন্ধিউ আর শ্রীখণ্ডের মতোই জনপ্রিয় ছিল। এখন এসব জনমানস থেকে হারিয়েই গিয়েছে। এর কারণ শিকারের উপর বিধিনিষেধ এবং এই ধরনের রান্না করার লোকের অভাব। তবে সব থেকে বড় কারণ গোটা গুজরাতেই আমিষ খাওয়ার অভ্যাসকে অবিশ্বাসের চোখে দেখার রেওয়াজ। সর্বত্র এক রকম জোর করেই বলা হচ্ছে শাকাহারী থাকা অবশ্যপালনীয় কর্তব্য।  

    প্রথম দিনের বিফ সামোসা আর শেষ দিনের মাটন কাঞ্জি মিলের মাধ্যমে গুজরাতি খাওয়া-দাওয়া নিয়ে প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে গিয়ে অনেক নতুন জিনিস চিনলাম, জানলাম। সব থেকে বড় পাওয়া নিম্নবর্গের সম্প্রদায়ের খাদ্যরুচি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হওয়া। 

    বিফ সামোসা

    গুজরাত যাত্রার দ্বিতীয় দিনে, দর্পণা অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টসের সদস্য পিনাকিনের কাছে নতুন খাবারের হদিস চাইতে, তার উত্তর শুনে আমরা তো হতবাক। ‘আহমেদাবাদে এসে আমাদের মোগলাই খানাই চেখে দেখোনি! বলো কী!’ আমরা কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, আমরা কিন্তু আহমেদাবাদে রয়েছি। আর এটা লখনউ বা দিল্লি নয়।’

    পিনাকিনের কথা শুনে মনটা ফিরে গেল সেই কবে ভুলে যাওয়া স্কুলের ইতিহাস ক্লাসে। সেখানেই তো পড়েছিলাম ৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের পশ্চিম উপকূলে মসজিদ প্রতিষ্ঠার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল। গুজরাত সুলতানাত প্রায় ২০০ বছর রাজত্ব করার পর মুঘল সম্রাট আকবরের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে গুজরাতের ইসলাম যোগ একই সঙ্গে গভীর ও সন্দেহাতীত। কাজেই মোগলাই খানা তো খেতেই হবে। 

    কিছুটা না জেনেই আমরা আমিষ যাত্রা শুরু করেছিলাম একেবারে ধ্রুপদী ধাঁচে। ফেমাস সামোসার মালিক জবির শেখ এক শাহিপরিবারের সদস্য। এঁরা এমন এক খানদানি খানসামা পরিবারভুক্ত, যাঁদের সঙ্গে যোগ ছিল মুঘল সাম্রাজ্যের। তিনি বললেন, ‘রেস্তোরাঁয় তো আমরা ফাস্ট ফুড পরিবেশন করি। আসল গুজরাতি খানা খেতে হলে আমাদের বাড়ি আসুন। এখানে পাবেন দম বিরিয়ানি, কোফতা, শিক কাবাব, মাটন কোর্মা, দানা চিকেন। হলফ করে বলতে পারি এমন খাবার আপনি কোথাও খাননি।’

    আরও ভাল সময়ে তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করব, এই আশ্বাস দিয়ে আবার ঢুকলাম পুরনো শহরে। এক জায়গা থেকে নিলাম দানা চিকেন, আর এক জায়গা থেকে শিক কাবাব। সুস্বাদু শিরমল আর মুর্গমুসল্লম দিয়ে আহমেদাবাদে শেষ নৈশভোজটা যা হল, তা দিল্লির করিম’স-এর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। 

    রাত ন’টা থেকে কারফিউ আর এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও আমরা কোনও রকমে গুজরাতি থালি, খিচুড়ি, খমনঢোকলা আর ফাফড়াও নিয়ে নিতে পেরেছিলাম। 

    পুরনো আহমেদাবাদের রাস্তা যতই এলোমেলো হোক, তার চারপাশ থেকে আসা দানা চিকেন, কাবাব, হান্ডিতে দম বিরিয়ানির সুগন্ধ মনকে পাগলপারা করে দেয়। আগে ঘ্রাণ, তারপর তো ভোজন! কম সুবিধাভোগী আহমেদাবাদবাসীদের কাছ থেকেই তো পেলাম খাবারকে শোষণ, অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং পরিচিতি সত্তা হিসাবে চেনার শিক্ষা। 

    একটা জিনিস পরিষ্কার হল। শাকাহারী খাবারের যতই গুণগান হোক, আহমেদাবাদে গুজরাতের আমিষ আহার বহাল তবিয়তে আছে, থাকবেও। এটা ঠিক, কিছু এলাকায় কাঁচা বা রান্না করা মাংস পাওয়া কঠিন। এত বাধার মধ্যেও আমিষ আহারের সঙ্গে যুক্ত মানুষজন তাঁদের লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হননি। এই বৈশিষ্ট্য ও হার-না-মানা মনোভাবই পুরনো আহমেদাবাদকে অনন্য করে রেখেছে। বৈচিত্র্য যেমন রয়েছে খাবারের নানা পদে, ঠিক তেমনই রয়েছে পরিচিতি সত্তায়।

    সব জায়গায় যেমন হয়ে থাকে, নতুন প্রজন্মের গুজরাতিরাও আমিষ আহারের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিন আসবে যখন একজন গুজরাতির খাদ্যাভ্যাস অন্য এক গুজরাতির ধর্মের অবমাননা হিসাবে মনে করা হবে না। একদিন হয়তো খাবারই এই সব বেড়া ভেঙে না দিক, সরিয়ে দেবেই।

    ছবি তুলেছেন: কুশল বাটুঙ্গে

    Read in English

     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook