ছেলেবেলা কখন শেষ হয়? অন্যদের কথা জানি না, আমার মনে আছে যেদিন ম্যাট্রিক পরীক্ষার শেষ পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে এসে টেবিলের ওপর থেকে মেকানিক্স-এর বইটা তুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হয়েছিল, আমি আর ছোটো নেই, এরপর কলেজ, এখন থেকে আমি বড় হয়ে গেছি’— ‘যখন ছোট ছিলাম’-এ এমনটাই লিখেছেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়।
‘আমি যখন ইস্কুলে ভর্তি হই, তখন আমার বয়স সাড়ে আট। … একদিন সকালে লেবুমামার সঙ্গে গিয়ে হাজির হলাম বালিগঞ্জ গভঃ হাই স্কুল-এ। যে ক্লাসে ভর্তি হব— ফিফ্থ ক্লাস— সেই ক্লাসের মাস্টার আমাকে কয়েকটি প্রশ্ন লিখে দিলেন, আর গোটা চারেক অঙ্ক কষতে দিলেন। আমি অন্য একটা ঘরে বসে উত্তর লিখে আবার মাস্টারের কাছে গিয়ে হাজির হলাম। মাস্টার তখন ইংরেজির ক্লাস নিচ্ছেন। আমার উত্তরের দিকে চোখ বুলিয়ে তিনি মাথা নাড়লেন। তার মানে উত্তরে ভুল নেই। আর তার মানে আমার ইস্কুলে ভর্তি হওয়া হয়ে গেল।’
বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল নিয়ে আরও প্রচুর স্মৃতি রোমন্থন করেছেন সত্যজিৎ রায়। কিন্তু আজ আমরা আলোচনা করব এমন একটা স্কুল নিয়ে, যার গোড়াপত্তনে সত্যজিতের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
চিত্র পরিচালক, সাহিত্যিক, অসাধারণ আঁকিয়ে, প্রচ্ছদ প্রস্তুতকারক, সঙ্গীতজ্ঞ— এইসব পরিচয়ের পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের আর একটি পরিচয়, তিনি ছিলেন একজন দূরদর্শী শিক্ষাবিদ। কীভাবে শুরু হল এই কর্মকাণ্ড? শুরু থেকেই শুরু করা যাক।
দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুল থেকে পদত্যাগ করলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ উমা সেহানবীশ সহ আরও ছ’জন শিক্ষক-শিক্ষিকা। এর ঠিক আগেই মতপার্থক্যের কারণে পাঁচজন শিক্ষক-শিক্ষিকা ওই একই স্কুল থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। সত্যজিৎ রায় তখন অভিভাবকদের প্রতিনিধি হিসেবে সেই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটিতে বিশেষ পদাধিকারী। স্কুলের কিছু গণ্যমান্য কর্তাব্যক্তি সত্যজিৎ রায়ের কাছে উমা সেহানবীশের নামে এক গুরুতর অভিযোগ নিয়ে এলেন। তাঁদের বক্তব্য, উমা সেহানবীশ স্কুলের একতা ভঙ্গ করছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সুন্দর সম্পর্কে ভাঙন ধরাচ্ছেন। তাতে স্বাক্ষর করেছেন মোট ৭২ জন। বাহাত্তর বনাম এগারো। কিন্তু মানুষটির নাম সত্যজিৎ রায়। ‘ঠিক ঠিক ঠিক’ নয়, তাঁর পরিচিতি উদয়ন পণ্ডিত হিসেবেই। তিনি বললেন— ‘I believe in Uma’s integrity’। অর্থাৎ, ২০২১-এর বহু বছর আগে, উমা সেহানবীশ সহ আরও বেশ কয়েকজন দায়িত্ববান মানুষ ‘দলে থেকে কাজ করতে না পারা’র তাগিদে দল ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। যাই হোক, শুধু স্বপ্ন দেখলেই তো হবে না, তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। বেসরকারি স্কুলের চেহারা তাঁরা দেখে এসেছিলেন। এ-ও বুঝেছিলেন, স্কুল স্থাপন করতে গেলে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে অর্থ বিনিয়োগের। কিন্তু সেই অর্থ যেন শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রাস না করে ফেলে। সেই কারণে স্থাপিত হল পাঠ ভবন সোসাইটি। সেই সোসাইটির পক্ষ থেকে প্রতিষ্ঠিত হল পাঠ ভবন স্কুল। ২৮ জুন, ১৯৬৫ সালে বিভিন্ন ক্লাসের ১৬ জন ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে শুরু হল পাঠ ভবন। স্কুলের প্রথম দিকের রেজিস্টারে অভিভাবকদের নাম ও সই দেখলে শিহরিত হতে হয়। অভিভাবক হিসেবে সই করেছেন সত্যজিৎ রায়, কিশোর কুমার গাঙ্গুলি ও মৃণাল সেন। ভর্তি হয়েছেন সন্দীপ রায়, অমিত কুমার গাঙ্গুলি ও কুণাল সেন। একদম আনকোরা নতুন স্কুল, অ্যাফিলিয়েশন পাওয়া নিয়ে সংশয়, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত— তাও স্রেফ বিশ্বাস ও ভরসাকে সম্বল করে তাঁদের সন্তানদের হাত ধরে এই স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন অভিভাবকরা।
স্কুল তো হল। এবার দরকার ম্যানেজিং কমিটি বা পরিচালনা সমিতি। সত্যজিৎ রায় এগিয়ে এলেন। বললেন, আমি থাকব। এঁকে দিলেন পাঠ ভবনের লোগো। জ্বলন্ত মশাল। যে মশালের আলোয় দূর হয়ে যায় অশিক্ষা ও অজ্ঞানতার অন্ধকার। যাই হোক, স্কুল তৈরি হওয়ার পর পরই স্কুল ফান্ড-এর প্রয়োজন হল। আবার এগিয়ে এলেন সেই মানুষটি। পাঠ ভবনের ব্যানারে অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস-এ সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল উদযাপিত হল। সেই ফিল্ম ফেস্টিভ্যালকে কেন্দ্র করে উঠে এল বেশ কিছু অর্থ এবং সেটাই ছিল পাঠ ভবনের প্রথম ফান্ড। সারা পৃথিবীতে সেটিই ছিল প্রথম সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল।
শোনা যায়, চোখের সামনে শিশুপুত্রকে দেখে সুকুমার রায় লিখেছিলেন— ‘পান্ত ভূতের জ্যান্ত ছানা!’ পাঠ ভবন শুরু থেকেই নিজের ছাত্রছাত্রীদের ‘রামগরুড়ের ছানা’ গড়ে তোলার ঘোর বিরোধী। বরং ‘বাপ রে কী ডানপিটে ছেলে’ হলে স্কুল বড় আনন্দিত হয়! সেই উদ্দেশ্য খানিক সাধন করতে পাঠ ভবনে অনুষ্ঠিত হল বিরাট সুকুমার মেলা। সেই মেলার ওয়ার্কিং কমিটিতে ছিলেন স্কুলের প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক, দীপঙ্কর সরকার। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে মাস্টারমশাই বলছেন— ‘একটা মজার ঘটনা বলি। সুকুমার মেলার জন্য কিছু স্পনসর দরকার ছিল। সত্যজিৎ রায় ফোন করলেন লালবাজারে, রশিদ খানকে। রশিদ খান তৎকালীন ডিসিডিডি, মানিকদার খুব ভাল বন্ধু। ও-প্রান্ত থেকে ফোন ধরে একজন অফিসার বললেন, ‘হ্যালো, কে বলছেন?’, মানিকদা বললেন, ‘একটু রশিদ খানকে দিতে হবে, ডিসিডিডি।’ ও-প্রান্ত থেকে কী বলা হল শুনতে পেলাম না। আবার এই প্রান্তে সেই ব্যারিটোন গমগম করে উঠল, ‘আপনি দিন না। বলুন সত্যজিৎ রায় কথা বলবেন।’ মুহূর্তে নাটকীয় স্তব্ধতা। তারপরেই বাজখাঁই গলায় বলে উঠলেন, ‘আপনি সত্যজিৎ রায়ের নাম শোনেননি?’ বলতে বলতে নিজেই উচ্চহাস্যে ফেটে পড়লেন স্যার। হাসি থামিয়ে বললেন, ‘কত স্পনসর, কত বিজ্ঞাপন উনি জোগাড় করে দিয়েছিলেন ভাবতে পারবি না। মেলাপ্রাঙ্গণ সাজিয়েছিলেন রঘুনাথ গোস্বামী। হুঁকোমুখো হ্যাংলা, কাঠবুড়ো সহ নানান চরিত্রদের কাট-আউট দিয়ে সেজে উঠেছিল রবীন্দ্র সদন আর অ্যাকাডেমি প্রাঙ্গণ। সুকুমার রায়ের বিভিন্ন চরিত্রের মুখ আর কবিতার লাইন দিয়ে বানানো হয়েছিল শার্ট। তোদের আজকের এই গ্রাফিক-টি’র বহু যুগ আগে। মঞ্চস্থ হয়েছিল আবোল-তাবোল।’ একটু গর্ব ও পরিতৃপ্তির হাসি নিয়ে স্যার যোগ করলেন, ‘আমি ডিরেকশন দিয়েছিলাম, বুঝলি! সেই ‘আবোল-তাবোল’ দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন শম্ভু মিত্র। প্রথম দিন থেকেই মানিকদা বারবার বলছিলেন, ‘ওফ! তোমরা এত ভেবেছ? আমি তো ভাবতেই পারছি না। পারবে তো এতগুলো সামলাতে?’ টাকা তুলে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছেন সত্যজিৎ রায়, এ প্রায় ভাবাই যায় না। ওঁর লিখে দেওয়া চিঠি সঙ্গে করে বহু জায়গায় গেছি। আর সত্যজিৎ রায়ের চিঠি সঙ্গে নিয়ে গেলে যে বাড়তি খাতির পাওয়া যেত, সে তো বলাই বাহুল্য!’
যে মাস্টারমশাইয়ের কথা এতক্ষণ শোনালাম, তাঁর নামের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘হীরক রাজার দেশে’র কৃতজ্ঞতা স্বীকারের তালিকায়। ছবিতে পাঠশালার ছাত্রদের অনেকেই ছিল পাঠ ভবন স্কুলের। আর অভিভাবক হিসেবে তাঁদের স্কুল থেকে নিয়ে গেছিলেন দীপঙ্কর স্যার। পুরনো স্মৃতি হাতড়াতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন চুলে পাক-ধরা মাস্টারমশাই— ‘জানিস, যে শটটায় উদয়ন পণ্ডিত ঘুরে দেখেন মুখে কাপড় বাঁধা ছাত্ররা অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, সেই শটটা কীভাবে নেওয়া হয়েছিল? মানিকদা কোনওদিনই বাচ্চাদের খুব একটা ডিরেকশন দেওয়া পছন্দ করতেন না। বলতেন, ‘নিজেদের কল্পনায় ওরা আকাশকে লাল রঙে রাঙিয়ে তুলতে পারে দীপঙ্কর। আমি বা তুমি কখনও এরকম পারব, বলো?’ শটটা নেওয়ার আগে উনি ক্যামেরার পাশে দাঁড় করিয়ে দিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। আর বাচ্চাদের বলে দিলেন, ‘যখন অ্যাকশন বলব, তোমরা সবাই একসাথে চোখ তুলে ফেলুদার দিকে তাকাবে, কেমন?’ ব্যাস, প্রথম টেক-এই কেল্লা ফতে! আরও একটা ঘটনা বলি। উত্তরের বনের সিকোয়েন্স শুট হচ্ছে জঙ্গলে। বাচ্চারাও এসেছে। কিন্তু সেদিন তাদের কোনও সিন নেই। এবার বাচ্চারা তো বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না। শটের ফাঁকে মানিকদা এসে বসলেন তাদের মাঝে। বললেন, ‘চলো, একটা মজার খেলা খেলি। কেউ একজন যে-কোনও একটা জিনিসের নাম ভাববে, আর একজন দশটা প্রশ্নের মাধ্যমে সেই নামটা গেস করবে। তবে উত্তর হবে শুধু হ্যাঁ বা না-এ। প্রথম রাউন্ডটা আমিই খেলি চলো। কেউ একজন গেস করো। করেছ? আচ্ছা। তুমি যে জিনিসটার কথা ভাবছ সেটা কি এখানে আছে?
— হ্যাঁ।
— বেশ, তুমি যে জিনিসটার কথা ভাবছ, সেটা কি নন-লিভিং?
— হ্যাঁ।
— তুমি কি ওই বিরাট দেখতে জেনারেটরের কথা ভেবেছ, যা থেকে এত আওয়াজ বেরোচ্ছে?
বিশ্বাস কর অগ্নিজিৎ, আমরা স্তম্ভিত। কী অসামান্য চাইল্ড সাইকোলজি বুঝলে, দুটো প্রশ্ন করেই বাচ্চাদের মনের কথা জেনে নেওয়া যায়। ঠিক যেমন ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ ফেলুদার মগজাস্ত্র ঘ্যাচাং করে রুকুর মনের মধ্যে ঢুকে গিয়ে জেনে ফেলেছিল, সে হেঁয়ালিতে কথা বলতে ভালবাসে।’
দীপঙ্কর স্যারের সঙ্গে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট আড্ডা মেরে উঠে পড়লাম। এক অদ্ভুত মুগ্ধতা তখন আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। চলে গেলাম আমার নিশ্চিন্দিপুর, পাঠ ভবনে। মনে পড়ে গেল ‘যখন ছোট ছিলাম’-এর কয়েকটা লাইন—
‘… এটাও জানি যে যে-সব জায়গার সঙ্গে ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, সেসব জায়গায় নতুন করে গেলে পুরোনো মজাগুলো আর ফিরে পাওয়া যায় না। আসল মজা হল স্মৃতির ভাণ্ডার হাতড়ে সেগুলোকে ফিরে পেতে…’
যদি একটা সত্যজিৎ রায় বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি হয়, তাতে কারা কারা পড়াবেন? আমার তো ভাবতে বেশ মজাই লাগে! সাইন্সের ক্লাস করাচ্ছেন প্রোফেসর শঙ্কু, বাংলা পড়াচ্ছেন লালমোহন গাঙ্গুলি আর ফেলুদার মতো অঙ্কের শিক্ষক তো সত্যিই পাওয়া দুষ্কর! তবে প্রধান শিক্ষক অতি অবশ্যই উদয়ন পণ্ডিত।