রামকিঙ্করের শিল্পকাজ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে তাঁর পূর্বস্মৃতি এড়িয়ে যাওয়া খুবই শক্ত। শিক্ষক এবং বন্ধু হিসাবে তাঁর প্রচুর প্রভাব ছিল আমাদের কারো কারো উপর। কারণ আমাদের নিপুণতাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি। প্রবল প্রাণশক্তি নিয়ে কাজ করবার জন্য আমাদের উৎসাহিতও করেছিলেন তিনি। এসব বাদ দিয়েও তিনি ছিলেন আমাদের কাছে এক উজ্জ্বল আদর্শের দৃষ্টান্ত স্বরূপ।
শিল্পের একজন তরুণ ছাত্র হিসাবে রোম্যান্টিকতায় টইটম্বুর আমাদের হৃদয়ে তখন এসে পড়ছে আপাদমস্তক শিল্পভাবনার গভীরে ডুবে থাকা ভূতগ্রস্ত আর তন্ময় শিল্পীদের ছায়া। বাস্তবে খুঁজে চলেছি অবিকল সেই রকমেরই কোনও একজন। খুব অল্প শিল্পীর মধ্যেই খুঁজে পেয়েছি তা। কারণ তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন খুব বেশিরকম ভাবে পরিকল্পিত, ভদ্র পেশাদারি। মেয়েলি আর নাটকীয়তায় ভরা ছিল তাঁদের ভবঘুরেপনা। কিন্তু যখন শান্তিনিকেতনে এলাম, তখন সত্যিকারের তিনজন শিল্পী আমাদের নজরে এলেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে রামকিঙ্করই আমাদের তরুণ বয়সের রক্তে কিছুটা তরঙ্গ তুলতে পেরেছিলেন। কারণ নন্দবাবু এবং বিনোদবাবুর চেয়ে নিভৃতচারিতায় তিনি ছিলেন অনেক কম, ছিলেন বহির্মুখী আর কাছাকাছি আসার মানুষ। কোনওরকমের ভান ছিল না তাঁর, সম্পূর্ণভাবেই ছিলেন একজন খাঁটি শিল্পী। সমস্ত কিছুই উদ্দীপিত করত তাঁকে আর সেই উদ্দীপনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার খোরাক জুগিয়ে যেতেন ক্রমাগত।
তাঁকে কাজ করতে দেখা এবং সঙ্গে স্কেচ করতে যাওয়াটাও ছিল আমাদের কাছে বড় রকমের শিক্ষা। মধ্যাহ্নের ভরা সূর্যের মধ্য দিয়ে খোয়াই পার হয়ে যেতে যেতে আমরা কেউ কেউ সেই শিক্ষা পেয়েছিলাম। আমার মতো একজন তরুণ ছাত্রের শৈশব কেটেছে কেরালায় আর পরবর্তী সময় কেটেছে শান্তিনিকেতনের অসম্ভব রিক্ত নিসর্গতায়। আর যেখানে নিসর্গের এমন রিক্ততা, তাকে আর ছবির মধ্য দিয়ে প্রকাশ করা যাবে কীভাবে ? সুতরাং নিসর্গের এই বিপুল রিক্ততা বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আমার আর উপায় ছিল না কোনও। পরে আমি দেখেছি এবং ছবির মধ্য দিয়ে প্রকাশও করেছি তাকে। কিন্তু যখন রামকিঙ্কর স্কেচখাতা নিয়ে এই নিসর্গমালার মুখোমুখি বসলেন, দেখলাম একই দৃশ্যাবলী, একই জায়গা কেমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। দেখলাম, প্রত্যেক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ স্পন্দিত জীবনের মধ্যে ফিরে আসছে। পাতায় পাতায় উজ্জ্বলতা আর উৎফুল্লতা নিয়ে নম্র গাছ কেমন আদিম প্রাণশক্তিতে ভরপুর হয়ে উঠছে। স্বচ্ছ আকাশ ঊষর মাটির সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে এইমাত্র একরাশ নীল মেঘ এসে দ্রুততায় ঢেকে দিল তাকে, আবার এইমাত্র তারা ধূসর মেঘের ঘোমটায় গিয়ে মুখ লুকালো দ্রুত। এইভাবে ঋতুরা তাঁর ছবিতে এল খুব প্রামাণিক ভাবে। এইভাবে তাঁর ছবিতে আমরা প্রকৃতিকে আবিষ্কার করলাম নতুন ভাবে। এই রূপান্তর, যা আমাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে তুলল। শিল্প ও জীবন সম্বন্ধে, সৃষ্টিপদ্ধতি সম্বন্ধে তার শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি আর উদ্দীপনা আর অবসাদ যেন আমাদের চোখ খুলে দিল। এই সমস্ত কিছুর ভিতর দিয়ে তিনি আমাদের মধ্যে একটি জীবনদর্শনের সীমারেখা টেনে দিলেন। এবং যা ব্যক্তিগত হয়েও এক উন্নততর চেতনার শিখরপুঞ্জে নিয়ে যেতে সাহায্য করল।
রামকিঙ্কর ও তাঁর ড্রয়িং
ড্রইং করাটা প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজ ছিল তাঁর। চার বছর ধরে আমি তাঁকে খুব কাছ থেকে জেনেছি যে, তিনি গড়ে একটি করে জলরঙের ড্রইং করেছেন প্রতিদিন। গোড়ার দিকে ইতিমধ্যেই প্রচুর ড্রইং করেছিলেন। এবং আমার বিশ্বাস, তাঁর এই ধারা মধ্যপঞ্চাশ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ছুটি কিংবা অল্পসময়ের জন্য যখনই তিনি শান্তিনিকেতনের বাইরে কোথাও গেছেন— কাঠমান্ডু, শিলং, রাজগীর, ভীমবাঁধ কিংবা বৈজনাথ, গয়া, পুরী প্রভৃতি জায়গা থেকে সঙ্গে করে বয়ে এনেছেন গাদা গাদা ড্রইং এবং জলরঙের কাজ। এগুলি রোজনামচা (diary) লেখার মতো ছিল তাঁর কাছে। যেগুলির মধ্য দিয়ে তিনি চিহ্নিত করে রাখতেন তাঁর আবেগ, তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। এবং বিবেচনা ও বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে কাজ করতে করতে এগিয়ে যাবার কথা। সেগুলির খুব অল্প কয়েকটিই একসঙ্গে দেখতে পাওয়া যায় আজ। তাদের বেশির ভাগই সময়ের ছোবলে কোথাও মিলিয়ে গেছে, কিছু কিছু দান করা হয়েছে অথবা বিক্রি হয়ে চলে গেছে অন্য কোথাও। যদি সেগুলি জড়ো করে একসঙ্গে আনা যায়, তবে তার মধ্যে পাওয়া যাবে শক্তিশালী একটি শিল্পাবয়ব।
এমনকী ক্রেয়ন এবং পেন্সিলে আঁকা তাঁর একেবারে প্রথমদিককার ড্রইংগুলিতে এক শক্তিশালী ছন্দময়তায় জেগে উঠতে দেখেছি তাদের। একজন স্বতঃস্ফূর্ত শিল্পী হিসাবে কোনও জিনিসের উপর তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল তাৎক্ষণিক। শিকারি যেমন ভাবে তার শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেইভাবে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন তাঁর কাজের উপর। এখানে একটি উপমার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে, এটা হয়তো তাঁর নিজেরই অথবা তিনি প্রায়ই যাঁর কথা বলতেন, হতে পারে সেই রবীন্দ্রনাথেরও, একবার যিনি তাঁকে বলেছিলেন, ‘কোনও কাজ একহাতে একমনে করা প্রয়োজন।’ সেই কথা ছন্দবদ্ধতায় সুসংগঠিত হয়ে তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছিল। এটা অনেকেরই জানা যে, নন্দবাবুর ড্রইং-এর প্রধান গুণই হল টানটান ছন্দ এবং যা ক্যালিগ্রাফির স্বাদ এনে দিয়েছিল তাঁর অনেক কাজে। রামকিঙ্কর এই ছন্দ কাঠামোকেই পুনরায় ব্যবহার করলেন নতুনভাবে, যা কিউবিস্টদের কাছাকাছি নিয়ে যায় তাঁকে। একেবারে প্রথমদিককার, সম্ভবত মধ্য তিরিশের, কালিতে করা তাঁর কিছু কিছু সাদা ও কালো ড্রইং-এ এই প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেখানে একঝাঁক পাখিদের উড়তে দেখা গেল। এবং যাদের গতিকে ধরবার জন্যই যেখানে পাখিদের থেকেও জোর দেওয়া হল তাদের ওড়া এবং তাদের উড়ে যাবার ছন্দময় ধ্বনি-প্রতিধ্বনিকে। তাদের গতিকে আরও গভীর ভাবে মেলে ধরবার জন্য সেখানে কিছু কিছু পাখিকে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িঘরের উপর দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হল। অন্য আরও কিছু কিছু ড্রইং-এ দেখা গেল গাছগাছালির ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িঘর। ড্রইং, চিত্র, ভাস্কর্য যাই হোক না কেন, পরবর্তী তাঁর সমস্ত কাজেই কিউবিজমেব প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়।
কিন্তু এই প্রভাব ছিল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যতায় সমুজ্জ্বল। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, তা কেমন? তাহলে বলব যে, তা মূল কিউবিস্ট এথিক্সকে এড়িয়ে গিয়ে অবজেক্ট এবং স্পেসের সঙ্গে একটা স্টিরিও-ভিজুয়াল সম্পর্ক তৈরি করে। এবং অবজেক্ট স্পেস কমপ্লেক্সের ইমেজকে বিশ্লষণ করতে করতে যা পুনর্গঠিত করে অবজেক্ট ইমেজ অথবা স্পেস ইমেজ, যা পূর্বাপর সমস্ত ভিজুয়াল লজিককে অস্বীকার করে সম্পূর্ণ এক নতুন ধারার সৃষ্টি করে। এবং মাত্রা ও অভিব্যক্তিকতায় তাকে এক নতুন জায়গায় পৌঁছে দেয়। যদিও রামকিঙ্কর পিকাসোর মতো শক্তিশালী কিউবিস্ট-এর কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন এবং রামকিঙ্করের অনেক কাজে গঠনের বা আকৃতির ভাঙন লক্ষ করা যায়। তবুও তাঁর বেশির ভাগ কাজ পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, তিনি কিউবিজমের পাঠ গ্রহণ করেছিলেন ঠিকই তবুও তাঁর সেই সমস্ত কাজ যা একমাত্র তাঁর কাজের সঙ্গেই তুলনীয়। এবং তা মৌলিকতায় উজ্জ্বল।
আধুনিক ইউরোপীয় শিল্প-আন্দোলন ও রামকিঙ্কর
এখানে বিশেষভাবে জানার প্রয়োজন যে, আধুনিক শিল্প-আন্দোলনের কোন দিকগুলির সঙ্গে শান্তিনিকেতনের একেবারে প্রথমদিককার ছাত্ররা কখন ও কীভাবে পরিচিত হয়েছিলেন। প্রাপ্ত নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, বিশ-এর গোড়ার দিকে ডঃ স্টেলা ক্রামরিশ শান্তিনিকেতনে আসেন এবং গড়ে তোলা নতুন ছাত্রদের সঙ্গে ইউরোপীয় শিল্পধারার একটা আত্মীয়তা ঘটান। প্রায় সেই সময়েই কলকাতায় আধুনিক জার্মান শিল্পের একটি প্রদর্শনী হয়, যার থেকে শিল্পীর স্বাধীনতা এবং স্বাতন্ত্র্যতার একটা স্বচ্ছ ও স্পষ্ট ধারণা করতে পেরেছিলেন সেই সময়ের শান্তিনিকেতনের শিল্পের ছাত্ররা। এই প্রতিক্রিয়া ছিল সবিশেষ, যেহেতু তখন শান্তিনিকেতনের শিল্পের ছাত্ররা অন্যানা কেতাবি শিল্প বিদ্যালয়ের মতো কোনও বাঁধাধরা নিয়মের পথে চলত না। সুতরাং সেখানে কোনও বিরোধী চেতনার সম্মুখীন হতে হত না তাঁদের। এবং সেই কেতাবি সীমাবদ্ধ শিক্ষার অনুপস্থিতির জন্যই বাস্তব-পরবর্তী ইমপ্রেশনিস্ট বা কিউবিস্ট কোনও বিশেষ ঢঙ তাঁদের চেতনার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়নি। বরং তাঁদের শিল্পের অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করবার জন্যই, বিস্ময়কর কিছু সৃষ্টি করবার জন্যই তারা ইমপ্রেশনিস্ট এবং কিউবিজমের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। ইপ্রেশনিস্ট কাজের সঙ্গে এই যোগাযোগ তাঁদের খুলে দিল এক নতুন পথ ও উদ্দীপনায় ভরা এক নতুন জগৎ। পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট কাজের সঙ্গে যোগাযোগ পরম্পরাগত দৃশ্যভাষার সূক্ষ্ম তারতম্যের দিকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করল তাঁদের। বিভিন্ন রকম কিউবিস্ট কাজের সঙ্গে যোগাযোগ তাঁদের মনোযোগী করে তুলল ছবির ইমেজের একটা ক্রম-পরিবর্তন এনে দেবার। সেজান এবং ভ্যান গঘ-এর মতো শিল্পীর কাজের সঙ্গে যোগাযোগ গঠন এবং রং ব্যবহারের ধারণায় নিয়ে এল নতুনত্ব। এইভাবে ভারতীয় পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন না হয়ে পুনর্বিবেচনার ভিতর দিয়ে এবার তাঁরা একেই ব্যবহার করলেন নতুনভাবে। এবং এটা নিশ্চিত যে এই অনুপ্রেরণা যেমন বিভিন্ন শিল্পীর ক্ষেত্রে বিভিন্নরকম, ঠিক তেমনি একে ধরবার বা আত্মসাৎ করবার ক্ষমতাও পরস্পর পরস্পরের থেকে আলাদা রকমের।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন যে, আধুনিক ইউরোপীয় শিল্পের প্রতি রামকিঙ্করের আগ্রহ ছিল সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এবং যার ফলে তাঁর এই অনুপ্রেরণা অক্ষম অনুকারকের দলে চলে যেতে পারেনি। তাঁর ছন্দোময় ড্রইংগুলিতে, যেগুলি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে, দেখা যায় যে কিউবিস্ট ধারণার পাশাপাশি তিনি সেগুলিতে নিয়ে এসেছেন ইমপ্রেশনিস্টিক বা পয়েন্টেলিস্টিক রঙের প্রয়োগ। এর একটি সুন্দর উদাহরণ হল তাঁর করা একটি বিরাট জলরঙের ছবি, যেটি খুব সম্ভবত দিল্লির কলেজ অব আর্টের সংগ্রহে আছে, যেখানে দেখা যায় পাখার মতো একটি গাছের নীচে চা পানরত কতকগুলি মানুষ।এই পথ ধরেই পরবর্তী কতকগুলি বছরে ওয়াশ এবং বুদ্ধিদীপ্ত রঙের প্রয়োগে বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি গঠনসমৃদ্ধ ছন্দপ্রধান অনেকগুলি ল্যান্ডস্কেপ করেন। যেখানে মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য জোর দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন রকম সারফেস এবং ডেনসিটি ট্রিটমেন্টের ওপর। বিষয়বস্তু হিসাবে তাদের বেছে নেওয়া হয়েছে শান্তিনিকেতনের চারপাশের দৃশ্য, নেপালের প্রাকৃতিক দৃশ্য আর শিলং-এর হ্রদ ও পার্বত্য অঞ্চল। সাবজেক্ট এবং লোকেশানের ভিন্নতার সঙ্গে সঙ্গে ছন্দেরও পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এখানে টেকনিক হয়েছে কিছু পরিমাণে সেজানীয়। এক-একটি জায়গাকে সামগ্রিক ভাবে তুলে আনার জন্য মাধ্যম হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে বিশুদ্ধ ওয়াশ এবং দুটি জায়গার মধ্যবর্তী স্থানে পশ্চাৎ এবং সম্মুখগামী রং প্রয়োগের উপর ঝোঁক ও তীব্রতা লক্ষ করা যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও রঙের সমান্তরাল প্রয়োগই স্পষ্টভাবে ধরা দেয়।
বছরের পর বছর ধরে তিনি এই টেকনিকেই অনেক অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য হয়েছেন। বীরভূমের রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া গরুর গাড়ি অথবা খেজুর গাছের সারির ভিতর দিয়ে ছুটে যাওয়া ধোঁয়াময় ট্রেন অথবা রাজগীর বাজারের মালবোঝাই ঘোড়ার গাড়ি অথবা কোপাই-এর ঢালু পাড়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি শিমুল প্রভৃতি যে কোনও বিষয়ই হোক না কেন, একজন অনুশীলনরত ভোজবাজিকর বা একজন ভারসাম্য পটু খেলোয়াড় বা একজন দড়ি-হাঁটিয়ে (rope walker) দড়ির উপর দিয়ে স্বচ্ছন্দে হেঁটে যাওয়াকে যেমনভাবে সহজেই আয়ত্ত করেন, তিনিও ঠিক তেমনি ভাবেই অনায়াসেই আয়ত্তে এনেছিলেন এইসব। এই স্বাচ্ছন্দ্য রীতিমতো উল্লেখযোগ্য, যা দেখতে দেখতে আমাদের উৎপীড়িত স্নায়ুতন্ত্রীগুলি টনটন করে ওঠে। এবং একসময় ছবির উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য করে আমাদের। জলরং বা তেলরং বা ভাস্কর্য যাই হোক না কেন, তাঁর সবচেযয়ে ভাল কাজগুলির একটি স্থির বৈশিষ্ট্যই হল আবেগময় উত্তেজনা এবং গঠনবিন্যাসের মধ্যে একটি ডায়নামিক ব্যালেন্স। কিন্তু মাঝে মাঝে গভীর আবেগময়তা তাঁর ছবিকে শক্তির প্রাচুর্যতায় ভরে দিতে দেখা যায়। সেখানে রং হয়ে ওঠে বাধ্যবাঁধনহীন, রেখা বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে যায় চারদিকে আর খুব বেশিরকম নাটকীয়তায় ভরে ওঠে তাদের ভঙ্গিমা। কিন্তু এসব সত্ত্বেও কদাচিৎ গাঠনিক মালিকানার সীমা ছড়িয়ে যেতে দেখা যায় তাদের।
রামকিঙ্কর ও তাঁর ছবি
তুলনামূলক ভাবে রামকিঙ্করের ছবি, ড্রইং অপেক্ষা মোটেই ভালভাবে সংরক্ষিত হয়নি। তিনি তো বটেই, তাঁর নিকটতম কেউই এদিকে নজর দেননি কোনওদিন। এ ব্যাপারে তাঁর দোষই ছিল বেশি। কারণ কোনও কাজ শেষ করার পর ভালভাবে সংরক্ষণ করা তো দূরের কথা, খুব অল্পই তাকিয়ে দেখতেন তা। সেই সমস্ত কাজের সম্পূর্ণ কোনও তালিকা আজ পর্যন্ত তৈরি হয়নি। এইভাবে তাঁর অনেক কাজ অদৃশ্য হয়ে গেছে। সুতরাং তাঁর সমস্ত ছবির সম্পূর্ণ কোনও তালিকা প্রস্তুত করা সহজসাধ্য কাজ নয় আজ আর।
তাঁর শান্তিনিকেতন জীবনের প্রথম পর্বের ছবিগুলিতে, অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে, পদ্ধতি হিসাবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন ওয়াশ এবং টেম্পারা। যদিও সূচনায় তিনি পুরাণাশ্রিত বিষয়ের উপর কিছু কাজ করেছিলেন তবুও নিসর্গদৃশ্য, গ্রামের নারী ও পুরুষ, কর্মমুখর মাঠ, চারণরত গরু-ছাগল, গোরুর গাড়ির উপর চেপে যাওয়া মানুষজন— চারদিকে ছড়িয়ে থাকা এই দৃশ্যাবলীই তাকে টানত বেশি। মোহিত করা আদিবাসী সাঁওতালের রূপ, তাদের অদম্য আনন্দ-উল্লাস, তাদের পরিবেশ আর আশ্রমের চারদিক ও আশ্রমবাসী মানুষ— তাঁর ওপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু যখনই তিনি কোনও উত্তেজক দৃশ্যের মুখোমুখি হয়েছেন, তখনই তাঁর ছবি নন্দনতাত্ত্বিক অথবা আবেগীয় অনুষঙ্গকে ছাড়িয়ে গেছে। এভাবেই তাঁর তেলরঙের কাজ জলরঙের কাজ থেকে ভিন্ন ধরনের হয়ে গেছে।
তাঁর প্রত্যেক তেলরঙের ছবিই নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে নিশ্চিত ভাবে আরম্ভ করে প্রায়ই কিছুদূর এগিয়ে তা আবেগের ভারে নুয়ে এসেছে। তবুও ছাড়বার পাত্র নন তিনি। দিনের পর দিন অসীম পরিশ্রমে অন্য অভিজ্ঞতার আলোকে জারিত করে স্বাধীনসত্তায় ফিরিয়ে এনেছেন তাদের। তবে তা সময় নিয়েছে। এবং তা রূপান্তরিত হতে হতে ছবির মূল বিষয় থেকে সরে গেছে। তিনি যেন বাধ্যবাঁধনহীন কাউকে তাঁর খাচায় পুরতে চেয়েছিলেন, এ যেন ঠিক সেই প্রবাদের সোনার হরিণ ধরা। এক্ষেত্রে আপোসের কোনও দাসখত লিখে দেননি তিনি। প্রত্যেকদিন একটি তেলরঙের ছবি সম্পূর্ণ করেছেন আবার প্রত্যেকদিন তিনি তা মুছেও ফেলেছেন। কারণ হিসাবে তিনি যা বলতেন, তা ছিল খুব টিপিক্যাল, যেমন— ‘কাজটা ছিল খুব বেশি সেন্টিমেন্টাল’, ‘খুব বেশি চমৎকার’, ‘খুব বেশি ফ্যাকচুয়াল’। কিন্তু এগুলি আমাদের কাছে খুব বেশি জীবন্ত বলেই মনে হত। এই ভেবে হয়তো কেউ কেউ দুঃখিত হবেন যে, সেই সমস্ত ছবির মধ্যবর্তী পর্যায়গুলি, যে সমস্ত ছবির প্রত্যেক অংশই ছিল অপূর্ব, কেন নথিভুক্ত বা সংগ্রহ করে রাখা হয়নি, যেমন করা হয়েছিল পিকাসো বা মাতিসের ক্ষেত্রে। কিন্তু তিনি তাঁর নিজের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত বেশিরকমের নির্দয়। তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছড়িয়ে পড়া আবেগের ঝরনাধারকে সুবিন্যস্ততায় বেঁধে ফেলে তাকে পুরোহিতের মতো শাসন করতে। কিন্তু হায়! যাঁর আবেগ তাঁর মতোই শক্তিশালী, তাঁকে দেবতা ও দানব দুজনের সঙ্গেই সমান ভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়।
রামকিঙ্করের ছবিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করা যায়। তাদের কিছু কিছু কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতিকৃতি। প্রত্যেকটিই স্বকীয় এবং অপূর্ব। ‘স্বপ্নময়ী’, ‘সোমা যোশী’, ‘বিনোদিনী’, ‘নীলিমা দেবী’— এগুলির প্রত্যেকটিরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয় অনন্য। পেশাদারি ছবির মতো এদের কোনওটাই ঘষে মেজে পরিষ্কার করা ঝকঝকে মুখোশ নয়। আবার এগুলিকে ঠিক ক্যারেক্টার স্টাডিও বলা যাবে না। প্রত্যেকটি বিষয় বদলে গেছে প্রতিমায় এবং যার সঙ্গে মিলেমিশে গেছে ব্যক্তিগত নিরিখ। ‘স্বপ্নময়ী’ যেন দীর্ঘ চোখের অভিসারিকা, ‘বিনোদিনী’ চকিত বিহ্বলতার ছবি— যেন নারী হ্যামলেট, ‘নীলিমা দেবী’ চৌকোমুখের আদিবাসী দেবীর কাছাকাছি, ‘সোমা যোশী’ হৃষ্টপুষ্ট সুগোল অবিকৃত যেন একটি পুতুল।
এগুলির পাশাপাশি আরও কিছু ছবি আছে, যেগুলির বিষয়বস্তু স্থানীয় পরিবেশ। যেমন ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম, সান্ধ্য বাতাসের মধ্যে দিয়ে ছাগল টেনে নিয়ে যাওয়া একটি মেয়ে, খামারবাড়ির শ্রমরত আর বিশ্রামরত মজুর, ঘরামি, ফসলকাটা এবং এইরকম আরও কিছু। কিন্তু এই সাধারণ বিষয়বস্তুর প্রত্যেকটিতেই একটি প্রতীক বা মিথিক্যাল বিমূর্ততার মাত্রা যোজনা করেছেন তিনি। ‘ঝড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম’— এক গভীর বিমূর্ততার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যেতে দেখি। যেখানে ঝলকে ওঠা আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎরেখার ভিতর দিয়ে রাত্রি-ঘেরা বাড়িগুলির চাল আলোকিত হয়ে উঠতে দেখা যায়। মেয়েটির ছাগল টেনে আনার মধ্যে দিয়ে মূর্ত হয়ে ওঠে বীরাঙ্গনার ভাবভঙ্গি। ঘরামি বা বিল্ডার্স-এ দেখা যায়— নারী, পুরুষ, শিশু-সহ খুঁড়ে বার করা একটি কঙ্কাল। জন্ম, জীবন এবং মৃত্যু নিয়ে ঠিক যেন মধ্যযুগীয় প্রতীক এটি। এমনকী ‘ধান কাটা’ এবং ‘ধান ঝাড়া’র মধ্যেও একটি এপিক মাত্রা যোজনা করেছেন তিনি।
এছাড়াও তাঁর অনেকগুলি ছবিতে চিত্রকল্পের আধিক্য লক্ষ্য কর যায়। যেমন শিরীষ গাছের নিসর্গ দৃশ্য অথবা কিউবিস্ট ধাঁচের উদ্ভট নারী এবং মা ও ছেলে অথবা বৃক্ষ এবং আঁটোসাঁটো যৌবনদীপ্ত একদল রোম্যান্টিক মেয়ে (ছবিটির নাম ‘পিকনিক’)। এই যে আঁটোসাঁটো যৌবনদীপ্ততা, এখানে তা সেক্স-সিম্বলকে তুলে না ধরে বরং পরোক্ষভাবে তাঁদের শারীরিক উর্বরতাকেই মেলে ধরে।
মহিলাবেষ্টিত ছবিগুলিতে রামকিঙ্করের বিশেষ এক মানসিকতার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। এখানে তাঁর দুটি বিপরীতধর্মী মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায় । দেখা যায়, মেয়েরা যেমন তাঁকে আকর্ষণ করছে, তেমনই ভয়-বিজড়িত উৎসাহও দিচ্ছে তাঁকে। তিনি যেমন মনোরম ও সুন্দর প্রতিকৃতি আঁকছেন তাদের তেমনি কলহ ও শঙ্কায় ভরিয়ে দিচ্ছেন তাকে। তাঁর অনেক ছবিতে, এমনকী ভাস্কর্যেও, লক্ষ করা যায় তারা তাদের মনোরম সৌন্দর্য নিয়ে জেগে উঠে আবার কেমন হারিয়ে যাচ্ছে আসন্ন আতকের অপচ্ছায়ায়। মোহময় হাসির মধ্য দিয়েই কেমন বেরিয়ে আসছে তাদের সারিবদ্ধ বিপদজনক দাঁত। তাদের সুন্দর দেহ আস্তে আস্তে কেমনভাবে ভরে যাচ্ছে নাটুকেপনায়। এ সমস্ত কিছুই তাঁর ছবিকে ক্রমশ করে তুলেছে রহস্যময়। আর রক্তমাংসে ভরা নারী ক্রমশ ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে তা হয়ে উঠছে মাতৃরূপী দেবী। এইভাবে যা তার ছবিকে ক্রমশ করে তুলেছে সুন্দর ও ভয়াল। বলা বাহুল্য, এখানে দৃষ্টিভঙ্গি এবং চিত্রকল্প উভয়ক্ষেত্রেই সাবেকি চিন্তাধারার সাযুজ্য লক্ষ করা যায়।
পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায়, তাঁর কিছু ছবি খুব বেশি বিষয়মুখীনতার দিকে সরে গেছে। সামাজিক প্রশ্নে তিনি সবসময় ছিলেন অনুভূতিপ্রবণ। মানুষের সঙ্কট খুব তাড়াতাড়িই তাঁর মধ্যে প্রতিক্রিয়া নিয়ে এসেছে। দুর্ভিক্ষ, বন্যা, দারিদ্র্য অথবা মৃত্যু প্রভৃতির বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া দিয়েছেন তিনি। এইভাবে সমাজবাস্তববাদীদের একটা ছোট গোষ্ঠী এবং কাগজের কিছু সমালোচকদের সুনজরে পড়েছিলেন তিনি। এবং প্রতীক-বৈভবের চেয়ে সাময়িক ঘটনাপ্রবাহের চিত্রমত্ত রূপকেই অধিক সুবোধ্য মনে করেছিলেন তাঁরা। এদের স্তুতিবাদে রামকিঙ্কর এক ধরনের সাহিত্যধর্মী বা বিষয়মুখী ছবি করেছিলেন বটে কিন্তু সেগুলিতে যতই গ্রাফিক বেগ আর গাঠনিক সংবদ্ধতা থাকুক না কেন, তাতে পাওয়া যায় না পুরনো অনুষঙ্গবহ সেই আমেজ।
আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্য ও রামকিঙ্কর
রামকিঙ্করের ছবি এবং অন্যান্য নানা কাজ অপেক্ষা তাঁর ভাস্কর্য আরও অনেক বেশি স্বতন্ত্র এবং বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। কোনওরকম বিরোধের অপেক্ষা না রেখে এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আধুনিক ভারতীয় ভাস্কর্যের ইতিহাসে তিনিই প্রথম শক্তিশালী শিল্পী। তাঁর আগে পৃষ্ঠপোষকের পৃষ্ঠপোষণার বাধ্যবাধকতায় বাঁধা ভাস্কর্য ছিল খুব বেশি রকমের পেশাদারি। তা সত্ত্বেও, হয়তো যোগ্য ছিলেন কেউ কেউ। কিন্ত তাঁরা মূলত ছিলেন পৃষ্ঠপোষকের রুচি এবং নির্দেশরই দাস। সুতরাং ভারতীয় শিল্পমঞ্চে, সম্ভবত রামকিঙ্করই হলেন এমন একজন প্রথম ভাস্কর, যাঁকে ‘ক্রিয়েটিভ স্কাল্পটর’ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। যিনি কোনও পৃষ্ঠপোষকের তাঁবেদারি না করে সম্পূর্ণ নিজের সন্তুষ্টির উপরেই কাজ করে গেছেন। বস্তুত কয়েকটি অর্ডারি কাজে তাঁকে দুর্দশায় পড়তে দেখা যায়। সেই অসমাপ্ত কাজ তিনি শেষপর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর সহকারীদের হাতে। তিনি পৃষ্ঠপোষকের পৃষ্ঠপোষণার অত্যাচার সহ্য করেননি কোনওদিন। তাঁর করা সেই আবক্ষ প্রতিকৃতিগুলির, যেগুলির কিছু কিছু এসময়ে একটি অতিরিক্ত মাত্রা যোজনা করেছে, কোনওটিই অর্ডারি কাজ ছিল না। তিনি সেগুলি করেছিলেন কারণ সেই বিষয়গুলি কোনও কারণে অথবা অন্য কোনওভাবে তাঁর ভাল লেগেছিল।
যদিও তিনি রঁদা এবং এপস্টাইনের কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন তবুও তিনি আঙ্গিকগত উদ্ভাবনীর দিক দিয়ে আরও বড় কোনও এক সীমানার দিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন তাকে। তাঁর আঁকা প্রতিকৃতিগুলিতে যেমন, তেমনই এক্ষেত্রেও প্রত্যেকটি মডেলের মধ্যে আবেগের অলৌকিক আভা ছড়িয়ে দিয়ে এক বিশেষ দৈবী মহিমায় রূপান্তরিত করেছিলেন তাদের। এখানে একজন তাঁর করা আবক্ষ প্রতিকৃতিগুলিকেই তুলনা হিসাবে উপস্থিত করতে পারেন। যেমন ‘গাঙ্গুলী মশায়’, ‘প্রীতি পাণ্ডে’, ‘মীরা চ্যাটার্জী’, ‘মধুরা সিং’, ‘ইরা ভাকিল’ এবং ‘রবীন্দ্রনাথ’। এদের প্রত্যেকটিই বিভিন্ন উপায়ে জীবন্তভাবে উপস্থিত করেছেন তিনি। এবং মডেলের গঠন ও চরিত্র অবিকল রেখে এদের প্রত্যেকটিই দৃশ্যবস্তুকে ছাড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে কিছু কিছু নারীর চোখ হয়েছে দীর্ঘ এবং তারা রোম্যান্টিক। যেমন ‘প্রীতি পাণ্ডে’। অন্যরা কেউ কেউ ফুটন্ত আর পার্থিব, যেমন ‘মধুরা সিং’। ‘ইরা ভাকিল’-এর মাথা, যার কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না এখন, ঠিক যেন রোমান বালক। ‘আলাউদ্দিন খাঁ’র মাথা সন্তের বৈশিষ্ট্যত্যয় উজ্জ্বল। রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি তাঁর করা একটি অত্যন্ত দক্ষ কাজ। যেটিকে কেন্দ্র করে তাঁর জীবনের একেবারে শেষের দিকে তাঁর দক্ষতা নিয়ে নানা বিতর্ক উঠতে দেখা যায়, অথচ যেখানে সমস্ত জনপ্রিয় নকল মূর্তিকে দূরে সরিয়ে রেখে তাঁর সমস্ত শক্তি ও অনুভূতিকে একসঙ্গে নিয়ে এসে কবিকে অত্যন্ত মর্যাদার সঙ্গে উপস্থিত করেছেন তিনি। ভক্ত উপাসকের কুলুঙ্গিতে রাখা খেলনা পুতুলের সঙ্গে একে মেলানো যায় না কখনওই। রক্তমাংসে ভর৷ সর্ব অর্থে সজীব মানুষেরই জীবন্ত দলিল এটি। যেখানে তাঁর মুখ, তাঁর একেবারে শেষের কবিতার মতোই ভেসে আসে আমাদের কাছে। শত সাধ-ইচ্ছার মোহভঙ্গ আর যন্ত্রণাকাতর কবির মুখই দেখা যায় সেখানে।
এইসব প্রতিকৃতিগুলি তাঁর ভাস্কর্যের সামান্য অংশ মাত্র। তিনি এর চেয়ে আরও অনেক বেশি কাজ করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত যার খুব সামান্য অংশই অবশিষ্ট আছে, এমনকী তা ফোটোগ্রাফেও ধরে রাখা হয়নি। একেবারে প্রথম দিকে, চারপাশের দৃশ্যমান ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু কাজ করেছিলেন তিনি। যেমন— ঘাসের মধ্যে চরে বেড়ানো খরগোশ, ঠেলাগাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়া মেয়ে, এছাড়াও রঁদার টোনে কর আরও কিছু রোম্যান্টিক কাজ। বছরের পর বছর বহু কাজ করে তিনি সরাসরি এই রোম্যান্টিক বিবরণধর্মিতাকে পেছনে ফেলে যেতে পেরেছিলেন। এবং তাঁর কাজ ক্রমশ হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি কিউবিস্টিক, অনেক বেশি এক্সপেশনিস্টিক। প্রত্যেকটি কাজই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছাবার আগে অনেকগুলি রূপান্তরিত পর্যায় অতিক্রম করে যেতে হয়েছিল তাদের। পরীক্ষার পর্যায়েই হয়তো বা রয়ে গিয়েছিল কেউ কেউ। যেমন ‘মা ও ছেলে’ কাজটি প্রথমে সৌন্দর্যময়ী ম্যাডোনার মতো আরম্ভ করে কিছুদূর এগোবার পরই স্নেহময়ী মা হয়ে যায় একজন উৎপীড়িতা রাক্ষসী আর তার স্নেহময় পুত্রটি রূপান্তরিত হয়ে যায় নিষ্ঠুর এক অপদেবতায়। এইভাবে প্রেম আর ভালবাসা পরিবর্তিত হয়ে যায় অপ্রচ্ছন্ন হিংসায়। আর যার মধ্য দিয়ে ক্রমশ মূর্ত হয়ে ওঠে গ্রাস করতে উদ্ধত নতুন পুরাতনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। প্রেমদীপ্ত একটি মিথুনমূর্তিকে ‘বাই-ভালভ’-এর মতো প্রকাশ করেছেন তিনি, যার মাঝ বরাবর তুলে দেওয়া হয়েছে লিঙ্গের মতো একটি থাম। শস্যদানা ফেটে বেরিয়ে পড়া অঙ্কুরিত গাছ বলে মনে হয় যেন। এইভাবে অনুভূতিময় মেয়ে মূর্তিগুলি আবেগ-উদ্দীপনায় ভরা ধাবমান মেঘের মতো সুন্দর আর ভয়ঙ্করতার মধ্য দিয়ে ভেসে যেতে থাকে। এখানে তাঁর কল্পনা কিছুটা পারম্পর্যতার মধ্যে দিয়ে এসে তা হয়েছে কাব্যিক আর মৌলিক। এই সমস্ত কাজগুলিতে একজন কিউবিস্ট-এর সব কলাকৌশলই ব্যবহারই করেছেন তিনি। প্রত্যেকটি ইমেজকেই গঠনবিন্যাসের মধ্যে আছড়ে ফেলে আবার নতুন অভিব্যক্তির অস্তিত্বে ফিরিয়ে এনেছেন তাদের। এদের অনেকগুলি নিঃসন্দেহে নাটকীয়। কিন্তু এই নাটুকে ভঙ্গিমাই ভালবাসা বনাম ঘৃণা, সৃষ্টি বনাম ধ্বংস, পাপ বনাম পুণ্য এবং এইরকম আরও কিছু বিরোধিতার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে রহস্যময়তার প্রতিধ্বনি নিয়েই যেন বার বার ঘুরে আসে আমাদের কাছে।
রামকিঙ্করের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ভাস্কর্যের একটা বড় অংশই হল শান্তিনিকেতনের মুক্ত আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা সিমেন্ট-কংক্রিটের বিশাল আর প্রভাবশালী ভাস্কর্যগুলি। এই পর্যায়ে তাঁর করা প্রথম ভাস্কর্য হল ছিপছিপে লম্বা ‘সুজাতা’ (যখন আমি এটিকে প্রথম দেখি সারিবদ্ধ লম্বা ইউক্যালিপ্টাসের ভিতর রহস্যজনক ভাবে আবিষ্কার করি একে)। তারপর কলাভবন এলাকায় একে একে আসে ‘সাঁওতাল পরিবার’ (তখন খুব সুন্দরভাবে লম্বা লম্বা ঘাসের জঙ্গলে এর অবস্থান ছিল ), শান্তিনিকেতনের প্রধান প্রবেশদ্বারের কাছে সবুজবর্ণের খোদিত মণির মতো উজ্জ্বল ও রঙিন সিমেন্টের ভাস্কর্যটি (যাকে সাধারণত ‘বাতিদান’ নামে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে), বিতর্কিত ‘ধান ঝাড়া’ (যেটি এর উন্মুক্ত শারীরিক গঠনের জন্যই গোঁড়া আশ্রমিকদের কাছে রহস্যময় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু গ্রামবাসী সাঁওতালদের ভাললাগার কারণ ছিল এর পরিষ্কার খোলামেলা ছন্দ) এবং হাসিখুশি আর প্রাণচাঞ্চল্যতায় ভরা ‘কলের বাঁশি’।
এই জনপ্রিয় মূর্তিগুলি ছাড়াও আছে ‘বুদ্ধ’ এবং ‘গান্ধী’ মূর্তি। তাঁর অন্যান্য কাজের মতো এগুলিও পরিবেশের সাধারণ ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে তা আরও কোনও এক গভীর সম্পর্কের মধ্যে চলে গেছে। প্রবেশদ্বারের কাছে মহিলা ও উড়ন্ত পাখির আদলে করা সিমেন্টের ভাস্কর্যটিকে মনে হয় যেন আঁকাবাঁকা অঙ্গে উড়ে আসা নব্যপ্রস্তর যুগের ভেনাস। জীবন্ত মানুষী মূর্তি অথবা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরা লম্বা গাছের মতো মনে হয় ‘সুজাতা’কে। মাধুর্য, বলিষ্ঠতা আর নিদারুণ দারিদ্রের মধ্যে ভেঙে না পড়া ভারতীয় গ্রামজীবনের স্থায়ী প্রতীক সাঁওতাল পরিবার। সমৃদ্ধির দেবীর খুব কাছাকাছি চলে আসে ‘ধান ঝাড়া’। ‘কলের বাঁশি’ গ্রামবাসী সাঁওতালদের অদম্য জীবন উচ্ছ্বাসের কথাই মেলে ধরে, আনন্দ-কলতান যখন দূরে দূরে রয়ে যায় তখন গানের মধ্য দিয়েই যারা খুজে পায় জীবনের গভীর তলদেশ। দৃশ্যময়তা, অবস্থান, মাত্রা সমস্ত কিছু বিচারেই এই সমস্ত মূর্তিগুলি তাঁর নিখুত সৃষ্টি। এইরকম আরও কিছু কাজ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তিনি, যেমন— পিয়ার্সন পল্লীর পটভূমিকায় ‘ঠাকুর-গান্ধী’র বিশাল মূর্তি। এবং একেবারে নতুনভাবে ‘গান্ধী’ মূর্তি, যেখানে ভেঙে পড়া টুকরো পৃথিবীর উপর দিয়ে লম্বা-লম্বা পা ফেলে বিজয়ীর উন্মত্ততায় হেঁটে যাবেন তিনি। পরিকল্পিত এই কাজের খসড়া স্কেচটিও ছিল তাঁর করা একটি শক্তিশালী কাজ। কিন্তু এর কোনওটিই আর করা হয়ে ওঠেনি।
মানুষ রামকিঙ্কর
এটা রামকিঙ্করের কাজের একটা দ্রুত আলোচনা বলা যায় মাত্র। তাঁর ক্ষমতা, ভিন্নতা এবং কাজের ভিতরের জটিলতা আরও অনেক বেশি বিচার এবং বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। ভারতীয় শিল্পমঞ্চ থেকে তিনি খুব দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিদায় নিয়েছেন। এত বহুমুখী প্রতিভা এবং চরিত্র নিয়ে এইরকম শিল্পী আমরা আর সহজে ফিরে পাব না। তাঁর অবদান ছিল প্রচুর কিন্তু তিনি তা কোনওদিনই প্রচার করেননি চারদিকে। তিনি তাঁর কাজে একনিষ্ঠ ছিলেন কিন্তু উদাসীন দার্শনিকের মতো গ্রহণ করতেন তার ফল। অর্থ, মান ও যশের প্রতিধ্বনিময়তার ভিতরে তিনি ছিলেন একক, অসংসারী আর খেয়ালি। পার্থিব সুখভোগে উদাসীন কঠোর তপস্বীর মতো ছিল তাঁর জীবনযাপন। পৃথিবীর ঘ্রাণ, মুক্ত আকাশের আলো আর প্রকৃজ্ঞি চলমান দৃশ্যাবলীই ছিল তাঁর জীবনের প্রিয় সঞ্চয়।
পরস্পর বিরোধী নানান ভাবের সমন্বয়ে তিনি ছিলেন একজন বৈচিত্রময় মানুষ। গ্রামের মানুষ হিসাবে একদিকে যেমন ছিলেন গর্বিত, অন্যদিকে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একটি পরিশীলিত মন ছিল তাঁর। জেমস জয়েস-এর ‘ইউলিসিস’-এর কোনও কোনও অংশ কিংবা লোকসঙ্গীতের ভিতর দিয়েই তিনি খুঁজে পেতেন তাঁর অন্তর্দৃষ্টি আর অনুভব। অদম্য প্রাণশক্তিতে ভরা ছিলেন তিনি কিন্তু বাক্সংযমেরও গভীর বোধ ছিল তাঁর। যদিও তিনি প্রচলিত রীতিনীতির প্রতি মনোযোগী ছিলেন না তবুও সংযত রুচিবোধের বাইরে চলে যাননি কখনওই। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ যেমন ছিল তীব্র, তার প্রতি বিদ্রোহও ছিল ঠিক সেইরকমেরই। তাঁর দার্শনিক সহিষ্ণুতাই এই বিদ্রোহকে করে তুলেছিল সংযত। তিনি ভবঘুরে ছিলেন কিন্তু সন্তের মতো ছিল তাঁর সেই ভবঘুরেপনা। তিনি ছিলেন খুব বেশিরকম ভাবে অনুভূতিশীল আর আবেগপ্রবণ কিন্তু সেই অনুভূতি আর আবেগকে শাসন করেছিলেন তিনি। এইভাবে তাঁর কাজ এবং তাঁর ব্যক্তিত্বের গভীরতা আর জটিলতা ক্রমাগত পরস্পর বিরোধিতায় ঠেলাঠেলি করে বেরিয়ে আসতে থাকে। কারণ তিনি খুব বেশিরকম ভাবে মানুষই ছিলেন কিন্তু চিরাচরিত পার্থিব মানুষের একটু উপরেই চলে গিয়েছিলেন।