আর একটা এপিসোড দেখে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ব’— এই কথাটা ভেবে অনেক রাত, ভোরবেলায় পরিণত হয়েছে। তার কারণও আছে, সিরিয়াল বা সিরিজ এতটাই চমকপ্রদ এবং আকর্ষণীয় যে আঠা দিয়ে আটকে রাখার মতো দর্শকদের বসিয়ে রাখে স্ক্রিনের সামনে। সাম্প্রতিক কালে বহু ‘ওটিটি’ প্লাটফর্মের উত্থানের কারণে ভারতীয় দর্শকরা স্বাদ পাচ্ছেন ভিন্ন দেশের, ভিন্ন ভাষার কাজের। সেই কাজের গুণগত মান তাদের বাড়িতে চলা, মা-দিদা-ঠাকুমার দেখা সিরিয়ালের চেয়ে অনেক ভাল বলেই দাবি করেছেন অনেকে। কিন্তু এই বিপুলসংখ্যক কাজের মধ্যে আলাদা করে জায়গা করে নিয়েছে একটি বিশেষ ধরনের সিরিজ, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘সিট-কম’ অর্থাৎ ‘সিচুয়েশনাল কমেডি’।
আমি নিজেও সিট-কমের ভক্ত, বহু দেশি-বিদেশি সিরিজ দেখার ফলে একরকম বুঝতে পেরেছি এই ধরনের কাজের সাফল্যের কারণ। সবকটি সিট-কমের মূল বৈশিষ্ট্য হল তার হালকা মেজাজের কাহিনি, সহজ সরল গল্পের চলন, মার-প্যাঁচহীন প্লট ও সোজাসাপ্টা চরিত্র। মুখ্য চরিত্রদের জীবনের প্রেম-ভালবাসা-বন্ধুত্ব-জীবনযাপন নিয়েই গড়া সিরিজে, বেশ মজার কিছু সংলাপ লিখলেই হৈ-হৈ রব, প্রচুর হাততালি ও হি-হি করে হাসি। এইসব কিছু নিয়ে সিট-কমের পৃথিবী এক আকর্ষণীয় ফাঁদ তৈরি করে। টিভিতে দেখা ওই চকচকে জীবনের মোহে পড়ে যেতে বাধ্য হয় দর্শক। ইংরেজি বহু সিরিজের অতিসরলীকরণ যেমন বহু ভিউয়ার নিয়ে আসে, তেমনই এক বিভীষিকাময় ‘ওপারে যা আছে সব ভাল’-র বোধ তৈরি করে।
আমেরিকান প্রচুর সিট-কমে আছে নিউ ইয়র্কে থাকা বন্ধুদের কথা, যাদের জীবনযাপন বেশ অদ্ভুত। চরিত্রেরা বিরাট বিরাট বাড়িতে থাকেন অথচ চাকরিবাকরি কাজ অমাবস্যার চাঁদের মতো, প্রায় দেখাই যায় না। তাহলে অমন বিলাসবহুল জীবন এল কোথা থেকে, এই প্রশ্ন কেউ করে না, বলা যায় ‘সাসপেনশন অফ বিলিফ’। এবার যে কিশোর বা কিশোরী এই জীবনের গল্প দেখে বড় হচ্ছে, তার কোনও ধারণাই নেই, ওই শহরে রোজগার করে বেঁচে থাকা কী কঠিন। সেই অনেক আগে পড়া ‘আমেরিকান ড্রিম’-এর মতোই একটা ঝাঁ-চকচকে প্রতিচ্ছবি তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে দেখা যায়, মূল চরিত্রদের জীবনের গুরুতর সমস্যা শুধু প্রেম নিয়েই, অন্য কোনও অসুবিধে নেই। আর তাই তারা বেশিরভাগ সময় মদ্যপান বা কফি/চা পান করে, গল্প করে, গানবাজনা করে কাটিয়ে দেয়।
এগুলো সত্যি দেখলে আনন্দ হয়, চতুর সংলাপে দারুণ হাসি পায়। সারাদিনের অনেক মানসিক চাপের পর এই সিরিজের যে কোনও পর্ব আপনাকে প্রশান্তি দেবে। বাস্তবের থেকে খানিকটা কম কঠোর একটি জগৎ সৃষ্টিকর্তারা নির্মাণ করেন। সেই পৃথিবীর সারল্য খুব কাম্য মনে হয়। তবে কোথাও গিয়ে আবারও দিনের আলোর বাইরে রাতের অন্ধকারকে অস্বীকার করার মধ্যে দিয়ে অনেকের কাছে একটাই চমৎকার ও জ্বলজ্বলে মিথ্যে তৈরি হয়। তাই আমাদের অনেক বন্ধুরা ভাবতে শুরু করে, বিদেশের মাটিতে জীবনটা ওই সিট-কমের মতোই সহজ। যে নিউ ইয়র্কের বন্ধুদের গল্প দেখে তারা রাত জাগছে, সেই একই নিউ ইয়র্কের মানুষের ওপর নেমে আসা পুঁজিবাদের চেহারা, প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে বেঁচে থাকার কোনও উল্লেখ না দেখে অভ্যস্ত অনেকগুলো প্রজন্ম।
সিট-কমে দেখা অফিসে কাজ কম, থানায় মামলা রয়েছে কিন্তু সহজেই সমাধান হয়ে যায়, লোনের টাকা শোধ হয়ে যায়, শুনশান বরফের মধ্যেও আগন্তুক এসে সাহায্য পৌঁছে দেয়। তাই আমরা যারা সিট-কম উপভোগ করছি, তারা মাথাটাকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছি বলেই মনে করি। রোজের বাস্তবের বাইরে গিয়ে একটা অতি সরল চরিত্রের সঙ্গে নিজের মিল খোঁজার চেষ্টা করছি, সেই অলীক সম্পর্কে নিজেদের কয়েক বছর পর দেখতে চাইছি, বা আমার প্রিয় চরিত্রের মতো কোনও এক নারীর সান্নিধ্যে জীবন জলাঞ্জলি দিতে চাইছি। যখন ঘুমোতে যাচ্ছি, স্বপ্নে চলে যাচ্ছি বিদেশের সেই প্রেক্ষাপটে। এটা যেমন সত্যি, তেমন এটাও সত্যি, সত্যিকারের মানুষদের পরিশ্রমের কথাটাও জানতে হবে, বাস্তবকেও স্বীকার করতে হবে। বন্ধুদেরও বলেছি। নিজেকেও বলছি। মনে করাচ্ছি ওই বিখ্যাত উক্তিটি: শিল্পের কাজই হল, যে আরামে আছে তাকে ডিস্টার্ব করা, আর যে অস্বস্তিতে রয়েছে তাকে আরাম দেওয়া।