ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • লুকোনো প্রদীপের আলো


    পৃথ্বী বসু (May 8, 2021)
     

    অনেকদিন আগের কথা। একটা ছোট্ট মেয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখত, সব ধরনের গাছই তার দিদিমার সঙ্গে কোনও এক অজ্ঞাত ভাষায় যেন কথা বলছে। সেই সময় থেকেই নানা ফুলের নানা রং, মনের ক্যানভাসে ছবি হয়ে ফুটে উঠতে চাইত তার। দাদা মুকুল দে ছিলেন আর্টিস্ট। তাই কিছু না বুঝলেও, ছোটবেলায় ছবির বইয়ের পাতা উলটে যেত সে আপনমনে। মা চমৎকার গল্প বলতে পারতেন। সেসব গল্প শুনেও সে মনে মনে তৈরি করে নিত অপূর্ব সব ছবি। আর দেখত, তাদের বাড়িতে রোদে মেলে দেওয়া হয়েছে রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথের ছবি, পোস্টকার্ড…

    শিল্পী রানী চন্দ-র জীবন শুরু হয়েছিল এভাবেই। তারপর সারা জীবন ধরে অনেক শৈল্পিক বেলা-অবেলার সাক্ষী থেকেছেন তিনি। সান্নিধ্যে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গান্ধীর মতো ব্যক্তিত্বের। ছবি এঁকেছেন। লিখেছেন। ‘আলাপচারী রবীন্দ্রনাথ’, ‘শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ’, ‘গুরুদেব’, ‘আমার মা’র বাপের বাড়ি’ কিংবা ‘জেনানা ফাটক’-এর মতো একের পর এক বই উপহার দিয়ে গেছেন পাঠকদের। আর মনপ্রাণ দিয়ে ভালবেসেছেন শান্তিনিকেতনকে। মাঝের কুড়ি বছর দিল্লিবাসের পর শান্তিনিকেতনে ফিরে এসে তাই তাঁর মনে হয়েছিল, ‘দিগন্তছোঁয়া-আকাশ কত দেশে কত জায়গায় দেখেছি, কিন্তু শান্তিনিকেতনের আকাশের যেন তুলনা নেই। এ আকাশের মন আমরা বুঝতে পারি, কখন কী ভাব নিয়ে থাকে, ধরতে পারি। যেমন পারি আপনার জনকে।’

    কিছুদিন আগে, হাতে এসে পড়েছিল ছোট্ট একটা বই। নাম, ‘রানী চন্দ: জীবন, কুড়োনো কথায়’। লেখিকা, কবিতা চন্দ। ফলে, গত কয়েকদিন ধরে এই রানী চন্দ-ই আবার নতুন করে আমার ‘আপনার জন’ হয়ে উঠেছেন। এ-বইয়ের সবচেয়ে বড় গুণ হল, এখানে ‘জীবনী’ লেখা হয়েছে ঠিকই, তবে তা টীকার ভারে নুয়ে পড়েনি। রানীরই (চন্দ) বলা কথা থেকে লেখিকা শুধু কুড়িয়ে এনেছেন তাঁর যাত্রাপথের রূপরেখা। তাঁর আনন্দময় যাপনের দিন-রাত্রি। সুতরাং, তথ্যপঞ্জীর আড়ম্বরে কোনও ভাবেই আড়াল হয়ে যায়নি আলোচ্য ব্যক্তির ‘মন’। কবিতা একেবারে শুরুতে লিখেছেন, ‘জন্মলগ্নেই রানী বুঝি পেয়েছিলেন জীবনভর নদীর মতো এক চলার ছন্দ। নদী যেমন ঘাট থেকে ঘাটে জল ছুঁয়ে ছুঁয়ে, তীরকে আত্মীয়তার বাঁধনে বেঁধে চলে, তেমনি ছিল যেন রানীরও চলার জীবন। আর পদ্মাপারের মেয়ে রানীর সুন্দরী পদ্মার মতোই যেন ছিল স্বভাবখানি। অঢেল তাঁর পাওয়া, অঢেল তাঁর দেওয়া।’

    ঠিকই তাই। রানী চন্দ তাঁর জীবদ্দশায় পেয়েছিলেন অনেক। কখনও দিনের পর দিন রবীন্দ্রনাথকে ছবি আঁকতে সাহায্য করেছেন, তাঁর এক-একটা কথা সযত্নে লিখে রেখেছেন— অন্যদিকে অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছবি এঁকেছেন, তাঁর হয়ে লিখেছেন ‘ঘরোয়া’। এমনকী স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরই পৌরাহিত্যে তাঁর সঙ্গে অনিল চন্দের বিবাহ সম্পন্ন হয়। চলার পথে, বিচিত্র ঐশ্বর্য কুড়োতে কুড়োতে তিনি এগিয়েছেন সারা জীবন। কিন্তু এত বছর পরে, কবিতা চন্দ যখন তাঁর জীবন-কথা কুড়োতে গেলেন, তখন কী কুড়োলেন? কুড়োলেন সেই সব আশ্চর্য মুহূর্তগুলোকেই, যা জুড়ে জুড়ে কেবল মালিন্যহীন একটা রঙিন জগৎ তৈরি করা যায়। কেন তিনি রানী চন্দকেই বেছে নিলেন? কবিতা জানাচ্ছেন, ‘রানী চন্দর আঁকা ছবি বহুকাল হলো, সর্বসাধারণ কোথাও একটি-দুটিও দেখতে পান না।… ভাষাশিল্পী রানী চন্দও কি, ঠিক আগের মতো আছেন, বাংলাসাহিত্যের প্রাঙ্গণ মাতিয়ে!’ একদিকে এই আক্ষেপ, অন্যদিকে পূর্বের ব্যক্তিগত যোগাযোগের ক্ষীণ স্মৃতি— এই দুই কারণ মিলিয়েই, এই বইয়ের জন্ম।             

    আমরা যারা অল্প বয়সেই রানী চন্দের গদ্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম আর দূর থেকে ঈর্ষা করেছিলাম ওঁর জীবনকে, এই বই পড়ার পর আবার কোথাও যেন মন খারাপ হতে থাকে। বারে বারে মনে হয়, যে-সম্মান ওঁর প্রাপ্য ছিল, তা কি সত্যিই আমরা দিতে পেরেছি? ওঁর কথা কেউ তো কই সেভাবে বলে না! ওঁর লেখা পড়ে যেমন বরাবরই মনে হত, উনি দুঃখকে চিরকাল উপেক্ষা করতে জানেন (‘ঘূর্ণি হাওয়া মাটিতে দুপাক আছড়ে ঘুরে উপরে উঠে মিইয়ে যেত’), এখন মনে হয় ওই ‘উপেক্ষা’ আসলে একরকমের ‘আড়াল’। নইলে ছবি আঁকার প্রতি কেনই বা একসময়ে অনীহা তৈরি হবে তাঁর? কিংবা ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’-এ তাঁর জড়িয়ে পড়ে জেলযাত্রা? মন কি কোথাও এলোমেলো হয়ে পড়েছিল? কবিতা একজায়গায় লিখেছেন, ‘‘বাইরের হাওয়া’ ইতিহাস জানে। কিন্তু রানীর জীবনের ‘ভেতরের হাওয়া’, আর ‘মনের হাওয়া’র খবর নীরবে শুধু থাকবে কালের বুকে। কিংবা, সে কথা জানতে হবে, হয়তো শুধু অনুমানে।’

    আরও একজায়গায় তিনি লিখছেন, ‘শিল্পী রানীর পরিচয়ের কতটুকুই-বা একালের কাছে এসে পৌঁছেছে? রানীই ভারতের প্রথম মহিলা শিল্পী, যাঁর একক ছবির প্রদর্শনী হয়েছে দিল্লী এবং বম্বেতে।… সেইসব ছবির সূত্রে পেয়েছেন তিনি বেশ কটি সোনার পদকও।… এমনও তথ্য পাওয়া গেছে যে, একসময় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে চিনের চাংকিং সরকারকে রানীরব আঁকা একটি ছবি উপভার পাঠানো হয়েছিল।… অথচ নিজের ছবির প্রসঙ্গ উঠলে রানী শুধু বলতেন: ‘নন্দন-কে ঘিরে ছিল সেই জগৎ— ছিল মুক্তির জগৎ।’’  

    এই বইয়ে আরও এমন নানান ঘটনার উল্লেখ আছে, যা কখনও পুরনো হবে না। যেমন, নিজের ছবি আঁকা প্রসঙ্গে রানীকে বলা রবীন্দ্রনাথের সেই উক্তি, ‘… আমার সব ছবিই এই রকম। হাসিখুশি ভাব হয় না কেন, বলতে পারিস? অথচ আমি নিজে হাসতে ও হাসাতে ভালোবাসি, কিন্তু আমার সব ছবির ভাব কেমন যেন বিষাদমাখা। হয়তো ভিতরে আছে আমার ওটা।’ কিংবা নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে বলা তাঁর এই কথাগুলো, ‘কী গো, মুখ ভার করে আছ কেন। আর একটু রং চাই তোমার? কালো রঙটা তোমার পছন্দ হল না বুঝি? আচ্ছা, এই নাও লাল। দেখো তো কত করে তোমার মন পাবার চেষ্টা করছি, তবু তোমার চোখ ছলছল করছে। তা থাকো ছলছল চোখেই, আমি আবার একটু জলভরা চোখই ভালোবাসি দেখতে।’

    আর এই বইয়ের একদম শেষে, শঙ্খ ঘোষ ও সব্যসাচী ভট্টাচার্যকে লেখা কিছু চিঠি যুক্ত হয়েছে, যার কিছুটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। শেষ জীবনে অসুস্থ রানী তাঁর কাছে সংরক্ষিত রবীন্দ্রসম্ভার নিয়ে কী ভেবেছিলেন, চিঠিগুলোয় তার আভাস মেলে। যেমন অর্থাভাবে পড়ে বিশ্বভারতীর উপাচার্যকে একজায়গায় লিখছেন, ‘এসব উপকরণের মূল্য নিরূপণ কি করে হয় আমার জানা নেই। তাহলেও ভরসা করি, তা অন্ততঃ তিন লক্ষ টাকার কম হওয়া উচিত নয়।’ অন্যদিকে ৭.৬.৯২ তারিখে শঙ্খ ঘোষকে লেখা একটা চিঠিতেই তিনি আবার লিখছেন, ‘… আমি পারলাম না। গুরুদেব নিজের হাতে আমাকে যা দিয়েছেন— দেবার সময়ে তাঁর কৌতুকভরা মুখের হাসি,— কপট অভিনয়… সেই রূপটি যে স্পষ্ট ভেসে উঠলো আমার চোখের সামনে।’ এখানে বলে রাখা ভাল, ১৯৯৭ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত কিন্তু সেসব জিনিস রবীন্দ্রভবনে এসে পৌঁছয়নি!  

    খুবই স্বল্প পরিসরে, অপূর্ব গদ্যশৈলীর মধ্যে দিয়ে পাঠকের সঙ্গে যেভাবে আত্মীয়তা তৈরি করতে পেরেছেন এই বইয়ের লেখিকা, তার কোনও তুলনা চলে না। কিন্তু আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে। যে স্বর্ণপ্রদীপের মতো জীবন আমাদের সবার সামনেই ধুলোয় ঢাকা পড়ে লুকিয়ে ছিল, তাকে তিনি আবার নতুন করে আমাদের সামনে এনে প্রজ্বলিত করলেন! 

    রানী চন্দ: জীবন, কুড়োনো কথায়
    কবিতা চন্দ
    দে’জ পাবলিশিং, ১৬০/-
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook