সায়েবদের ইতিহাসে উইলিয়াম পিট দুজন— একজন বাবা, অন্যজন ছেলে। দুজনেই ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হলেও, ছোট পিট সায়েবের কথা আমরা একটু বেশিই শুনি, কারণ ভারতে কোম্পানির শাসন-সংস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তাঁর নাম। ১৮০৬ সালে, ইংল্যান্ড যখন শিল্পবিপ্লব আর নেপোলিয়নের ফ্রান্সের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধের ঝামেলা পোয়াচ্ছে একইসঙ্গে, তখন মারা যান তিনি। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে তিনি নাকি বলেছিলেন: ‘Oh, my country! How I love my country!’ কিছুদিন আগে এক বইয়ে পড়ে চমৎকৃত হলাম যে পিট মোটেই তা বলেননি, তাঁর অন্তিম উচ্চারণ ছিল: ‘আহা, কচি বাছুরের মাংসের (veal) ‘পাই’ একখানা খেতে বড় সাধ হচ্ছে।’ রসনার তাড়না, দেখাই যাচ্ছে, নিবিড় দেশপ্রেমকেও ছাপিয়ে যেতে পারে অনায়াসে।
কীভাবে যেন ছোটবেলাতেই আমরা জেনে গেছিলাম, খাঁটি ইংরেজ খাওয়ার বেলায় ষাঁড়ের ডালনা পেলে আর কিছু চায় না। এমনকী ষাঁড়ের ‘লেজ’ও তারা বাদ দেয় না, দিব্যি স্যুপ (অক্সটেল) বানিয়ে খেয়ে ফেলে। আর ষণ্ডভুক বলেই না তাদের অমন দোর্দণ্ড প্রতাপ, নয়তো সবাই তাদের ‘জন বুল’ বলবে কেন? কেনই বা বাকিংহ্যাম প্যালেস বা টাওয়ার অফ লন্ডনের সামনে অমন কেঁদো চেহারার পাহারাদারদের নাম দেওয়া হবে ‘বিফ-ইটার’?
আজ বুঝি, পাষণ্ড ইংরেজের সেই ষণ্ডবিলাসের কাহিনিতে অতিরঞ্জন ছিল বিস্তর। কিন্তু তাই বলে ইংরেজ জীবনের কড়চা থেকে গোমাংসকে বাদও দেওয়া যায় না। তাদের অনেক উচ্ছ্বাস সংহত হয়েছে ফিশ অ্যান্ড চিপস, বেকন অ্যান্ড এগস, বা রোস্ট বিফ অ্যান্ড ইয়র্কশায়ার পুডিংকে নিয়ে। এদের মধ্যে রোস্ট বিফের কথা আলাদা, সে-কথা লিখতে গেলে একখানা আস্ত মহাভারত হয়ে যাবে। ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’-এর পাঠকদের মনে থাকতে পারে লন্ডনের রিফর্ম ক্লাবের ব্রেকফাস্টে আপাদমস্তক ইংরেজ শ্রীযুক্ত ফিলিয়াস ফগের ভোজ্যতালিকা: ‘আ বয়েল্ড ফিশ উইথ রেডিং সস, আ স্কারলেট স্লাইস অব রোস্ট বিফ গার্নিশড উইথ মাশরুমস’ ইত্যাদি ইত্যাদি। টম জোনসের স্রষ্টা হেনরি ফিল্ডিং তাঁর ‘গ্রাব স্ট্রিট অপেরা’য় আক্ষেপের সুরে লিখেছেন, ‘Oh! The roast beef of England / And old England’s roast beef’— যেন সেই অপূর্ব খাদ্যবস্তুটি উধাও হলে ইংল্যান্ডের আর কিছুই থাকবে না। সত্যিই তো, গোমাংস ইংরেজের বড় প্রিয় বলেই না তারা নার্সারি রাইমে শুয়োরছানাকে দিয়েও রোস্ট বিফ খাইয়ে থাকে।
তো বিলেতের সায়েবরা কথায় কথায় যাকে সালিশি মানে, গোমাংসে সেই খোদ শেক্সপিয়রেরও আসক্তি কারও থেকে কম ছিল বলে মনে হয় না। তাঁর ‘টেমিং অব দ্য শ্রু’ নাটকের এক দৃশ্যে সদ্য-বিবাহিতা নায়িকা ক্যাথারিনা স্বামী পেত্রুচিওর কান্ট্রিহাউসে খিদেয় কাতর হয়ে যখন ভাবছে— না খেয়ে তাকে মরতে হবে কি না, তখন পেত্রুচিওর চাকর গ্রুমিও তাকে নানান খাবারের লোভ দেখিয়ে উত্ত্যক্ত করে। একটু ঝলসানো ট্রাইপ চলবে নাকি? কিংবা সেই অদ্ভুত নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন প্রশ্ন: ‘What say you to a piece of beef and mustard?’ ইংরেজ সৈন্য যে বিফ খেলে তার বুদ্ধিশুদ্ধি শিকেয় তুলে স্রেফ গন্ডারের গোঁ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে পড়ে, সে দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। ‘কিং হেনরি দ্য ফিফ্থ’-এর সেই দৃশ্য কল্পনা করুন, যেখানে অ্যাজিনকোর্টের যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছে ইংরেজ আর ফরাসি শিবির। ইংরেজদের রণসজ্জা দূর থেকে দেখে ডিউক অব অর্লিয়ঁ তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলে, ত্রস্ত ফরাসি সেনাধ্যক্ষ তাঁকে মনে করিয়ে দেন ‘গিভ দেম গ্রেট মিলস অব বিফ, অ্যান্ড আয়রন অ্যান্ড স্টিল; দে উইল ইট লাইক উলভস, অ্যান্ড ফাইট লাইক ডেভিলস।’
তবে এমন নয় যে আমরা গোমাংস খেতে শিখেছি সায়েবদের কাছ থেকে। শুধু বৈদিক যুগেই নয়, তার পরেও বহু শতাব্দী গোমাংস আমরা খেয়েছি সানন্দে, তার উল্লেখ ছড়িয়ে রয়েছে ‘গৃহ্যসূত্র’-এ, যাজ্ঞবল্ক্যের ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ, চরক বা সুশ্রুতের সংহিতায়, বিস্তর বৌদ্ধ টীকাগ্রন্থে। সদ্যপ্রয়াত ইতিহাসবিদ দ্বিজেন্দ্রনারায়ণ ঝা বছর কুড়ি আগেই তাঁর ‘দ্য মিথ অফ দ্য হোলি কাউ’ বইটিতে এই ব্যাপারটি বিশদে দেখিয়েছিলেন, তার জন্য তাঁকে রক্তচক্ষু হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে কম দুর্ভোগ পোয়াতে হয়নি। অনেক পরে, মধ্যযুগে সুলতানি আমলে, হিন্দু বাঙালির মধ্যে গেড়ে বসল গোমাংস-ভক্ষণ নিয়ে বিতৃষ্ণা, আর সেই খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মুসলমানদের মিলিয়ে দেখা। বিজয়গুপ্তের ‘মনসামঙ্গল’ আর কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’— দুই কাব্যেই রয়েছে মুসলমানদের গরু খাওয়ার কথা। মুকুন্দরাম তো সাফ জানিয়েছিলেন, গোমাংস বিক্রি করে যে-কসাইরা, নরকেও তাদের ঠাঁই হবে না। তা সত্ত্বেও, আর এক বরেণ্য ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর লেখায় যেমন পড়ি, আকবর আর জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলায় বাছুর, বুনো শুয়োর, খরগোশ, হরেক রকমের পাখি দিব্যি চলত, ছুঁৎমার্গ ছিল খালি মোরগ, হাঁস-মুরগির ডিম আর গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে।
সায়েবরা এসে পড়ার পর অবশ্য তর্কবিতর্ক জমে উঠেছিল আরওই। রাজা রামমোহন রায় খাইয়ে লোক ছিলেন, ব্রহ্মসঙ্গীত লিখতে লিখতে অন্যমনস্ক ভাবে একটা গোটা পাঁঠা খেয়ে ফেলতে পারতেন, এ কথা আমরা জানি। কিন্তু অনেকেই জানি না, বিলেত যাওয়ার অল্প আগেই, ১৮৩০ সালে, তিনি একটি পুস্তিকা লেখেন, যার নাম ‘Hindu Authorities in Favour of Slaying the Cow and Eating its Flesh’। আর হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর নব্যবঙ্গ ছাত্রদের কথা আর কী বলব, নিছক পাঁঠায় তাঁদের মন উঠত না, রাধানাথ শিকদার তো ছিলেন গোমাংসে সমর্পিতপ্রাণ, আর রাজেন্দ্রলাল মিত্র কী খেতেন জানি না, কিন্তু এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার এক প্রবন্ধে দেখিয়েছিলেন যে প্রাচীন আর্যরা ছিলেন উদ্দণ্ড বিফখোর। শোনা যায়, এই ছাত্রগোষ্ঠী লোকেদের বাড়িতে হাড় ছুড়ে দিয়ে ‘আমরা গরু খাই গো, গরু খাই গো’ বলে চেঁচাতেন। আজ মনে হয় এরকম হোক কলরবের (বা ‘খেলা হবে, খেলা হবে’) স্টাইলে কাজটা করে ওঁরা ভাল করেননি। বরং এর দেড়শো বছরেরও বেশি পরে ওই একই কলেজে পড়ার সময় আমরা যখন মেট্রোয় সিনেমা দেখে কারওকে না ঘাঁটিয়ে নিজাম-এ চুপচাপ সস্তায় বিফরোল খেতাম, সেটা আমাদের সুভদ্র ও পরিশীলিত বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে অনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ।
সেই ঐতিহাসিক নিজামের মুঘল গার্ডেনসে হায়, এখন ‘নো বিফ’। বন্ধ হয়ে গেছে মির্জা গালিব স্ট্রিটের ‘কালমানস’ কোল্ড কাটের ঐতিহাসিক দোকানটির পসরা। তাহলে আমরা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কোথায় খুঁজে পাব আমাদের নিজস্ব ‘দ্যাট টেরিবল ওল্ড বিফের’ খুশবু? বো ব্যারাকস অঞ্চলের বড়দিন পালনের অপরিহার্য অঙ্গ সেই নুন-লেবু-আদা-ভিনিগার-গুড় আর সোরা বা সল্টপিটারে মজানো ‘সল্ট বিফ’— মীনাক্ষী দাশগুপ্তের ‘ক্যালকাটা কুকবুক’-এ যার অনবদ্য রেসিপি রয়েছে— তৈরি করা এখন কতখানি চালু, জানি না। এমনকী বাংলাদেশের রান্নার বইতেও বিফের রেসিপি খুব বেশি খুঁজে পাই না, যদি না তা হয় সায়রা হ্যামিলটনের মতো অনাবাসী বাঙালির লেখা বই (‘মাই বাংলাদেশ কিচেন’, ২০১৯)। জাপানের মহার্ঘ ওয়াগিউ বিফ না-হয় না হল, না-ই বা পেলাম সির্লয়েন, সিলভারসাইড, হরেক রকম কাটের বৈচিত্র, কিন্তু কোথায় পাব স্বাস্থ্যসম্মত, পরিচ্ছন্ন, বৈধ, অ্যাফোর্ডেবল গোমাংস? ভাবতে ভাবতেও থমকে যাই। কয়েক বছর আগে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গোমাংস ভক্ষণের ‘অপরাধ’-এর সন্দেহে নৃশংস ভাবে খুন হওয়া মহম্মদ আখলাকের মুখটি মনে পড়ে। আমার ভারতবর্ষের মুখ। আমার বাংলার মুখ। সেই মুখ তুলে বাকি পৃথিবীর কাছে আর সোজা তাকাতে পারব কি? এ লেখা যখন বেরোবে, আপনারা জেনে যাবেন।