ক্রিকেট ইদানীং অনেক ধরনের হয়। খেলাটা শুরু হয়েছিল একরকম ভাবে, তারপর মানুষ নিরীক্ষার নেশায়, ব্যবসার তাগিদে ক্রিকেটকে চার-পাঁচ রকমের করে নিয়েছে। আগে কেবল শীতকালে খেলা হত, এখন প্রবল গরমের দুপুরবেলাও তারিখ খালি পড়ে থাকে না। পৃথিবীর কোনও না কোনও স্টেডিয়ামে খেলা হয়ে চলতে থাকে ক্রিকেট। কিন্তু ক্রিকেটের এই নানান মুনাফাদার ধরন থেকে একটি ধরন একেবারে আলাদা। পৃথিবীর কোনও টেক্সট বুক বা ইতিহাসে তার নাম লেখা থাকবে কি না জানি না, কিন্তু আমাদের মতো ছোট ছোট মধ্যবিত্ত পাড়ায় বড় হয়ে ওঠা মানুষজনের জীবনে তার চেয়ে সার্থক খেলা আর কিছুই ছিল না। তা হল ছোটবেলার ক্রিকেট।
খামোকা ছোটবেলার ক্রিকেট কেন? সাদামাটা ক্রিকেট বললেই তো হয়। ছোটবেলার ক্রিকেট কি আলাদা হয় নাকি? সেই তো বল, সেই তো ব্যাট, সেই তো উইকেট, সেই তো রান তোলা। তাহলে? উঁহু, আলাদা তো বটেই। সে যখন খেলা হত, তাকেই ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটের সেরা রূপ বলে মনে হত ঠিকই, কিন্তু একটু দূর থেকে দেখলে, সময়কে পিছিয়ে নিয়ে দেখলে, তার চেয়ে আলাদা ক্রিকেট খেলা হতেই পারে না।
আমাদের এইসব পাড়ায়, মনে আছে, যে যতই আলাদা হোক না কেন, সকলের মধ্যে একখানা ভারি মিল ছিল। আর তা হল, আর্থিক সামর্থ্যের অভাব। এমন নয় যে খাওয়া-পরা নিয়ে টানাটানি, কিন্তু এমন বটেই যে হুট বলতে ডিউস বল আর গ্লাভস-প্যাড কিনে ওঠা যাবে না। এমনকী চাঁদা তুলেও নয়। ফলে, অবধারিত রাবারের বল। ক্যাম্বিস বলও কেনা হত কদাচিৎ অন্য পাড়ার সঙ্গে ম্যাচ পড়লে, চাঁদা করে। কিন্তু ক্যাম্বিস বলের সমস্যা ছিল এই যে, দু’তিনবার নর্দমায় পড়ার পর সে তার জাত্যাভিমান খোয়াত। সেই আধভেজা নরম ন্যাতানো বলে তখন না মিলত উইকেট, না উঠত রান। তার চেয়ে পাতি আটানা দামের রাবারের বল যুগ যুগ জিও। গরিবের মানইজ্জতের অত ভাল রাখওয়ালা আর আসেনি। নর্দমায় পড়ুক, ইটে ঘষা খাক, পরমুহূর্তে ধূসর রাবারের বল আবার ধেয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত।
এখন কথা হচ্ছে, ধেয়ে আর যাবে কোথায়? পাড়ায় একটা কি দুটো বড় মাঠ ছিল, সেখানে সদ্য চাকরি পাওয়া দাদারা প্যাড-গ্লাভস পরে, সাধের চকচকে উইকেট বসিয়ে ডিউস ম্যাচ খেলত। তাদের আমরা শ্রেণীশত্রু ভাবতাম। আমরা তাহলে খেলব কোথায়? তাছাড়া ওই অত বড় মাঠ দেখলে আমাদের ভয় হয়। চার মারতে হলে যত জোরে ব্যাট হাঁকড়াতে হবে, কারও রোগা চেহারাতেই সে-দম নেই। আমাদের তাই ছোট মাঠই ভাল।
মাঠ বলছি বটে, আসলে সেসব বাড়ির সামনেকার চিলতে বাগান, বা পিছন দিককার পোড়ো জমি। এদিকে ঝাঁকড়া লেবু গাছ, ওদিকে ইয়া দু’খানা নারকেল গাছ, অজস্র পাতাবাহারের বাচ্চা ঝাঁক, এসবের মধ্যে ঘাস উঠে যাওয়া, ধুলো-ওড়া এক চিলতে জমি হয়তো, চারপাশ যার পাঁচিল-ঘেরা। ব্যাস, ওইটাই লর্ডস, ওইটাই ইডেন, ওইটাই স্বর্গ। সেখানেই আমরা কেউ হয়তো ঝাঁট দিয়ে ধুলো সরালাম কিছু (আসলে বাড়ালাম), কেউ হয়তো ঝরে যাওয়া পাতার দল সরিয়ে মাঠের আউটফিল্ড প্রসারিত করলাম, কেউ স্কুল থেকে লুকিয়ে আনা চকগুঁড়ো ছড়িয়ে ক্রিজের দায়রা বোঝালাম, আবার কেউ কোত্থেকে তিনটে মরা ডাল কুড়িয়ে এনে মাটিতে সার বেঁধে পুঁতে উইকেট বানালাম। ব্যাস, পিচ তৈরি, স্টেডিয়াম গরম, খেলা শুরু!
ছুটির দিনগুলোতেই খেলা হত বেশি, মনে আছে। স্কুল থাকলে পড়ি কি মরি করে ফিরে বাড়িতে ব্যাগটা নামিয়েই মাঠে, আর না-থাকলে সাড়ে তিনটে বেজেছে কি বাজেনি, পাড়ায় ক্রিকেট বাহিনীর টহল শুরু। একে-তাকে বাড়ি থেকে ডেকে ডেকে বার করা, তারপর মাঠে হাজির। বেশ কয়েকজন জড়ো হতে পারলে টিম ভাগ, নইলে প্রত্যেকে একাই টিম। মাটিতে এক থেকে পাঁচ দাগ কেটে তার ওপর ব্যাট উপুড় করে শুইয়ে বেছে নেওয়া, লটারি। যার ব্যাট, সে অবশ্য খাতির পেত বেশি। অনেক সময়ে এলবি বা রান আউট জাতীয় ব্যাপারে তাকে একটু বেশি ছাড়ও দেওয়া হত। কেননা আউট না মেনে ব্যাট বগলে বাড়ি ফিরে গেলে খেলা মাটি হবে। ফলে গোটা দুনিয়ার পুঁজিবাদের মূল কথা আমরা ওই ছোটবেলার একচিলতে ক্রিকেটীয় জমিতেই শিখে নিয়েছিলাম। যার ব্যাট, তাকে তোয়াজ করে রাখতে হবে বাপু।
যে-সময়টার কথা বলছি, তখন বোলিং-এর দিকে তেমন নজর ছিল না আমাদের। ক্রিকেট মানে ব্যাটিং। মানে সোজা কথায় চার ছয়। এছাড়াও যে ব্যাট করার একটা আদবকায়দা আছে, যা শিল্পেরই পর্যায়ে পড়ে, সেসব বোঝার বয়স আমাদের তখন হয়নি। আমরা তখন পাড়ার কোনও এক দাদার বাড়িতে ভিড় করে সাদা-কালো দরজা-টানা টিভিতে ক্রিকেট ম্যাচ দেখি। আমাদের কারও নায়ক ইমরান খান, কারও গাভাসকার, আবার কারও বা ভিভ রিচার্ডস। স্বাভাবিক ভাবেই, কেউ চুল বড় করার চেষ্টা করে বাড়িতে বকুনি খায়, কেউ চেয়ে-চিন্তে একটা হ্যাট জোগাড় করে খেলার সময়ে পরবে বলে, আবার কেউ চ্যুইং গাম না-চিবিয়ে ক্রিজেই দাঁড়ায় না, সে তার হাতে দু’পয়সার রান থাকুক না থাকুক।
এই যখন হাবভাব, তখন বল-করিয়েরা ভারি বিরক্ত হত। আমি অবশ্য লেগ স্পিন করতে ভালবাসতাম, কিন্তু হাত ঘোরানোর উপায় নেই যে। গোটা ছোটবেলাটাই আমাদের আন্ডারহ্যান্ড। তার মধ্যেই যতটুকু হাতযশ দেখানো যায় আর কী! এত কেতার পর অবস্থা কী? না, লেবুগাছে লাগলে এক রান, পাশের পাঁচিলে লাগলে দুই, নারকেল গাছে লাগলে তিন রান, আর দূরের পাঁচিলে লাগলে চার। ওই পাঁচিলেই এক ড্রপে লাগলে ছয়, আর পাঁচিলের বাইরে বল গেলে আউট। শুধু আউট নয়, যার হাতের মার খেয়ে বল বাইরে যাবে, তাকেই খুঁজে আনতে হবে। এরই মধ্যে পাড়ায় নতুন এক বাসিন্দা এসে বাড়ি তুলে ভারি সাধ করে কাচের জানলা লাগিয়েছেন, আমাদের ওপর তাঁর কড়া নজর, কেননা বারকয়েক আমরা তাঁকে ঝনাৎঝন উপহার দিয়েছি। না, ভাঙেনি, তবে ভাঙলে যে আমাদের খেলা তিনি বন্ধ করিয়ে ছাড়বেন, সে-হুমকি দিয়ে গেছেন। তাই লেগ সাইডে যতই লোভনীয় বল আসুক না কেন, তুলে মারা নেই। অন্য বাড়িতে বল পড়লে খুঁজে আনতে যাওয়া একরকম, কিন্তু কাচ ভাঙার দায়ে পড়লে পাড়াময় কেলেঙ্কারি।
তা একবার হয়েছে কী, পাশের পাড়ার সঙ্গে ম্যাচ। ব্যাট আর সত্যিকারের উইকেট তারা আনবে, বলের দায়িত্ব আমাদের। প্রথমে ডিউস ম্যাচ ফিক্সড হয়েছিল, আমরাই দরাদরি করে ব্যাপারটাকে নামিয়েছি। একে তো অত দামি বল কেনার পয়সা নেই, তার ওপর প্যাড-গ্লাভস ছাড়া খেলতে গেলে গোটা শরীরে কালশিটে হতে বাধ্য। ঠিক হল, রাবার ডিউসে খেলা হবে। আমাদের ছোটবেলায় এ-জিনিস খুব নাম করেছিল, এখন আর পাওয়া যায় কি না জানি না। ঠাসা রাবার দিয়ে তৈরি বেশ ভারী আর শক্ত বল, মেরুন রঙের পাওয়া যেত বেশিরভাগ। চাঁদা তুলে সেই বলই কেনা হল একখানা, জয়গুরু স্পোর্টস থেকে।
এদিকে রাবার ডিউসে খেলারও তো অভিজ্ঞতা নেই আমাদের। বলের ওজন বদলে গেলে বোলিং প্যাটার্ন বা ব্যাটিং টেকনিকও বদলাতে হবে বৈকি। তাই ম্যাচের আগে কষে প্র্যাকটিস হবে, এরকমটাই ঠিক হল। তখন শীতকাল, তাড়াতাড়ি সন্ধে নেমে আসছে। রোববার বেলা তিনটে নাগাদ নেমে পড়া হল মাঠে। পরের রোববার ম্যাচ। এইদিন ঠিক হল, সকলেই এক-আধবার বোলিং করবে, ব্যাটিংও পাবে প্রত্যেকে। কেননা অন্য পাড়ার সঙ্গে ম্যাচে কাকে কখন কী ভূমিকা নিতে হয়, বলা দুষ্কর।
আমাকে নামানো হলো সাত নম্বরে। এই সম্মান আমি জীবনে পাইনি। ভিভ রিচার্ডসের আদ্যন্ত ভক্ত, সেদিন চ্যুইং গাম ছাড়াই ক্রিজে গিয়ে দাঁড়ালাম। ততক্ষণে সন্ধে হয়ে আসছে, পাড়ার আলোগুলো টিমটিম করে জ্বলে উঠেছে, ফিল্ডিং বা ব্যাটিং-এর জন্যে একটু দাঁড়িয়ে থাকলেই মাথায় মশার মুকুট। এহেন অবস্থায় একটা লোপ্পা বল পেয়ে, আমার এতদিনের জমানো ব্যাটিং প্রতিভা খুলে গেল এক লহমায়। কী যে হল আমার, হাঁকিয়ে ছয় মারতে গেলাম। সত্যিকারের গ্রাউন্ড হলে ছয়ের কাছাকাছিই হত নির্ঘাত, কিন্তু এখানে পাঁচিল টপকে উড়ে গিয়ে পাশের পোড়ো জমিতে ঝুপ করে তলিয়ে গেল আমাদের সদ্য-কেনা সাধের রাবার ডিউস বল। নিস্তব্ধতা নেমে এল মাঠ জুড়ে। এক তো এই কারণে যে, এ-বল খুঁজে না পেলে দুর্ভোগ আছে, আরেক এই কারণে যে, আমি এমন শট মারতে পারি, তা কারও ধারণায় ছিল না। সত্যি বলতে কী, আমারও ছিল না। এর সঙ্গে আমার নিজের মধ্যে একখানা তৃতীয় নিস্তব্ধতা যোগ দিল। আর সেটা হল এই যে, এবারে ওই অন্ধকার পোড়ো জমিতে বল খুঁজতে যেতে হবে আমাকে।
খুঁজে পাইনি আর সেই বল, সেদিন। কোনওদিনই পাইনি। শীতের অন্ধকার নেমে আসা মধ্যবিত্ত ছোট পাড়ায়, আগাছায় ভর্তি একটা পোড়ো জমিতে কুঠারের মতো ব্যাট চালিয়ে চালিয়ে খুঁজেছিলাম যদিও খুব। মাথার ওপর নেমে আসছিল অন্ধকার, পা ঝাঁঝরা করে দিচ্ছিল মশার ঝাঁক, ঝিঁঝির ডাক আরও দ্রুত নামিয়ে আনছিল সন্ধেকে, দূরে কাদের বাড়ি যেন গলা সাধার আওয়াজ, এদিক-ওদিক নানা ঘরের জানলায় টিভি জ্বলে উঠছে, মা হয়তো ডাকতে বেরিয়ে পড়েছেন এতক্ষণে, আর আমি মরিয়া হয়ে খুঁজে চলেছি মেরুন, ধুকপুক করতে থাকা একটা বল… আজও খুঁজছি, বহুজন্মের ওপার থেকে… আমার ছোটবেলার করুণ হৃৎপিণ্ড…