ডাকবাংলা

এক ডাকে গোটা বিশ্ব

 
 
  

"For those who want to rediscover the sweetness of Bengali writing, Daakbangla.com is a homecoming. The range of articles is diverse, spanning European football on the one end and classical music on the other! There is curated content from some of the stalwarts of Bangla literature, but there is also content from other languages as well."

DaakBangla logo designed by Jogen Chowdhury

Website designed by Pinaki De

Icon illustrated by Partha Dasgupta

Footer illustration by Rupak Neogy

Mobile apps: Rebin Infotech

Web development: Pixel Poetics


This Website comprises copyrighted materials. You may not copy, distribute, reuse, publish or use the content, images, audio and video or any part of them in any way whatsoever.

© and ® by Daak Bangla, 2020-2024

 
 

ডাকবাংলায় আপনাকে স্বাগত

 
 
  • বিনিদ্র: পর্ব ১৩


    বিমল মিত্র (May 21, 2021)
     

    পর্ব ১২

    গাড়ি যখন হোটেলে এল তখন পণ্ডিত নেহরুর বক্তৃতা চলছে। প্যান্ডেলের ভেতরে। বক্তৃতা শেষ হতেই আমি দল-বল ছেড়ে একলা বাইরে চলে এসেছি। তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে এসে জামা-কাপড় স্যুটকেশ গুছিয়ে নিয়ে হোটেল থেকে বিদায় নিলাম। রইল পড়ে আমার কন্‌ফারেন্স। সাহিত্যের কন্‌ফারেন্সের উপর আমার কোনওদিনই বিশ্বাস নেই। সভাসমিতিতে যাই না আমি কোনওকালে। আসলে দলে পড়ে এসেছিলাম একসঙ্গে কয়েকদিন বিশ্রাম নেব বলে। কিন্তু গুরুর আকর্ষণ আরও বড়। গুরুর কাছ থেকে ডাক আসতেই সভার আকর্ষণ আমার কাছে নিষ্প্রভ হয়ে গেল।

    আমার গল্প সিনেমায়িত হচ্ছে বলে নয়, ছবির চেয়ে গুরুই ছিল আমার কাছে বেশি আকর্ষণীয়। কোথায় সেই মে মাসের শেষে আমি চিত্রনাট্য লেখা শেষ করেছি। আর কোথায় এই পয়লা জানুয়ারি। অর্থাৎ লোনাভালার সেই আরামের দিনগুলোর পর সাত মাস কেটে গেছে। তার মধ্যে অনেক কাণ্ড হয়ে গেছে। গুরু একমাসের জন্যে লন্ডন ঘুরে এসেছে। আব্‌রার আল্‌ভি হিন্দিতে— চিত্রনাট্য লেখা শেষ করে সবটুকু টেপ-রেকর্ডিং করে ফেলেছে। মাঝখানে অনেক লোককে গল্পটা পড়ে শোনানো হয়েছে। এসব খবর জানতে পেরেছি গুরুর চিঠিতে। গুরু যেমন অস্থির-মতি, তার পক্ষে এ-গল্প বাতিল করে দেওয়াও অসম্ভব ছিল না। এ রকম করে কত গল্পেরই চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছে। আধখানা তোলাও হয়েছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা শেষ হয়নি। বোম্বাইয়ের চিত্র-জগৎ খুঁজলে এরকম হাজার-হাজার অসমাপ্ত ছবি পাওয়া যাবে, যা আজও লোক-চোখের অগোচরে থেকে গিয়েছে। এই ‘সাহেব বিবি গোলামে’রও সেই দশা হতে পারে। আমি গুরুর খামখেয়ালির অনেক পরিচয় পেয়েছিলাম আগেই। এর কয়েকদিন আগেই হঠাৎ গুরু একখানা বাংলা ছবি করার দিকে ঝুঁকে পড়ে। সাত রিল ছবিও তোলা হয়। সে ছবির নায়িকা ছিল গীতা। গীতার মুখ থেকেই সে-কাহিনী শুনেছি।

    একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম— সে ছবি হয়নি কেন?

    গীতা বলেছিল— ওকেই জিজ্ঞেস করবেন কেন হয়নি—

    বলেছিলাম— কিন্তু আপনিই যখন সে-ছবির নায়িকা ছিলেন, আপনিই কিছু বলুন না—

    গীতা বলেছিল— খেয়ালি মানুষ ও, ওর খেয়াল বোঝে এমন মানুষ পৃথিবীতে এখনও জন্মায়নি—

    বলেছিলাম— ছবি কেমন হয়েছিল?

    — স্টুডিওতে সে ছবি আছে, আপনিই একদিন দেখে নেবেন। আসলে যে সে ছবি দেখেছে, সকলেরই ভালো লেগেছে—

    — তা হলে শেষ করলেন না কেন?

    গীতা বলেছিল— ওর খেয়াল—

    তারপর একটু থেমে বলেছিল— এই যে এখন ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নিয়ে এত মেতে উঠেছে, এও শেষ হবে কি না কে জানে।

    সেদিন গীতার কথা শুনে আমি মনে-মনে আতঙ্কিত হলেও বিশেষ বিচলিত হইনি। কারণ আমার গল্প ‘সাহেব বিবি গোলাম’ এমন একটা বই যা ভারতবর্ষের প্রত্যেক বাড়িতে, প্রত্যেক রান্নাঘরে, প্রত্যেক ড্রয়িংরুমে সমাদর পেয়েছে। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত সকলের হাতে-হাতে শোভা পেয়েছে। হিন্দিতে অনুবাদ হয়ে বাংলা দেশের বাইরে অবাঙালিদের বাড়িতেও বিরাজ করছে। ছবি হলে বরং তার বিকৃতি ঘটতে পারে।

    একদিন গুরুকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনার ‘গৌরী’ ছবিটা অর্ধেক তুলে বন্ধ করে দিলেন কেন? অনেক টাকাও তো লোকসান গেল আপনার?

    সত্যিই অনেক টাকা লোকসান গেছিল গুরুর। সমস্ত দল-বল নিয়ে কলকাতায় এসে নিউ আলিপুরে একটা বাড়ি ভাড়া করা হয়েছিল। এক লাখ টাকা যখন খরচ হয়ে গেছে, তখন একদিন গুরু বললে— ছবি বন্ধ থাক।

    সে-সময়ে এ-ঘটনায় অনেকে চমকে উঠেছিল। গুরুর খেয়ালিপনা দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। এ কী রকম খেয়ালি লোক? এ কী রকম অপব্যয়ী মানুষ! তাই আমি একদিন আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম— আপনি ‘গৌরী’ ছবি বন্ধ করে দিলেন কেন?

    গুরু বললে— গীতার জন্যে!

    বললাম— সে কী!

    গুরু বললে— গীতা আমার কথা শুনতো না। আমি যখন ছবির ডিরেক্টর, তখন আমি কারো স্বামী নই, কারো ছেলে নই। তখন আমি শুধু পরিচালক—

    আসল কথাটা শুনে মনে হল গুরু নিজেকে স্তোক দিচ্ছে ওই যুক্তি দিয়ে! আসলে গুরু নিজেই জানতো না কেন ছবি তৈরী করছে? যে-লোক একবার কুকুর পোষে, সেই লোকই আবার সেই কুকুর বেঁচে আছে কি নেই সে-খবর রাখবার দরকার বোধ করে না। যে-লোক নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই জানে না, সে-লোক হঠাৎ যখন নিজের মুখোমুখি দাঁড়ায়, তখন আর নিজেকে চিনতে পারে না। নিজেকে চিনতে পারলে তবেই তো মানুষ নিজের কাজের একটা যুক্তিগ্রাহ্য সমর্থন পায়। নিজের খেয়ালিপনার কোনো যুক্তি যখন খুঁজে পায় না মানুষ, তখনই সে পরের ওপর দোষ চাপায়। এ-রকম ঘটনা গুরুর জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যখনই তার খেয়াল-খুশির সমর্থন পেত না কারোর কাছ থেকে, তখনই রেগে যেত। রেগে গিয়ে নিজেকে পীড়ন করত, আশে-পাশের দশজনকে পীড়ন করত। যাকে সামনে পেত, তাকে দোষারোপ করত। শেষকালে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারত, তখন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তখন শুরু হত আত্মনিগ্রহের পালা। তখন যত পারত নিজেকে ভোলাবার চেষ্টা করত। নিজেকে ভোলাবার একমাত্র পথ ছিল তার আরো বেশি খরচ করা। তখন পালিয়ে যেত বিলেতে। কিংবা যার সঙ্গে পারত আড্ডা দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। সে যদি মদের ভক্ত হত তো আরো সুবিধে।

    নিজের খেয়ালিপনার কোনো যুক্তি যখন খুঁজে পায় না মানুষ, তখনই সে পরের ওপর দোষ চাপায়। এ-রকম ঘটনা গুরুর জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যখনই তার খেয়াল-খুশির সমর্থন পেত না কারোর কাছ থেকে, তখনই রেগে যেত। রেগে গিয়ে নিজেকে পীড়ন করত, আশে-পাশের দশজনকে পীড়ন করত। যাকে সামনে পেত, তাকে দোষারোপ করত। শেষকালে যখন নিজের ভুল বুঝতে পারত, তখন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। তখন শুরু হত আত্মনিগ্রহের পালা। তখন যত পারত নিজেকে ভোলাবার চেষ্টা করত। নিজেকে ভোলাবার একমাত্র পথ ছিল তার আরো বেশি খরচ করা। তখন পালিয়ে যেত বিলেতে। কিংবা যার সঙ্গে পারত আড্ডা দিত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা। সে যদি মদের ভক্ত হত তো আরো সুবিধে।

    সে তখন সুবিধে পেয়ে গুরুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আরো ঘাড়ে চেপে বসত। গুরুর হিতাকাঙ্ক্ষী সেজে গুরুর অর্থ, সময়, স্বাস্থ্য সমস্ত কিছু হরণ করে গুরুকে ফতুর করে দিত। গুরুর এই রকম বন্ধুর সংখ্যা ছিল অনেক। তারা গুরুর ভালোর চেয়ে নিজের ভালোটা ভালো করে বুঝত। তাদের সঙ্গে গুরু যখন মিশতো, কথা বলত, তখন আমি অবাক হয়ে যেতাম। কিন্তু পরে বুঝেছিলাম ও-গুরু আলাদা। আমার সঙ্গে যে-গুরু মিশতো, সে অন্য মানুষ। তার দুটো পৃথক সত্তার মধ্যে ফারাকটা তখন স্পষ্ট হয়ে উঠত আমার কাছে। আমি নিশ্চিন্ত হতাম। আমি আশ্বস্ত হতাম। কিন্তু ভয়ও পেতাম। তাই যখন সেদিন হোটেল থেকে সোজা স্টুডিওতে গিয়ে পৌঁছোলাম, দেখি সেখানে এলাহি কাণ্ড। সেদিন প্রথম ‘সাহেব বিবি গোলাম’ ছবি শুরু হয়েছে। বেশ ভিড় চারিদিকে। ক্যামেরাম্যান, আর্ট ডিরেক্টর, পরিচালক সবাই হাজির।

    সামনেই দেখি ভূতনাথ। আমি যেন ভূত দেখে দুহাত পেছিয়ে এসেছি।

    কিন্তু না, ভূতনাথ নয়, গুরু দত্ত ভূতনাথ সেজে হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি আশ্বস্ত হলাম। তাহলে সত্যি-সত্যিই ছবি আরম্ভ হল।

    গুরু বললে— বিমলবাবু, আপনি শেষকালে হোটেলে উঠলেন?   

    পুনঃপ্রকাশ
    মূল বানান অপরিবর্তিত
     
      পূর্ববর্তী লেখা পরবর্তী লেখা  
     

     

     




 

 

Rate us on Google Rate us on FaceBook