সূর্যদেবের কন্যা সূর্য্যা, যমজ দেবতা অশ্বিনীকুমারদের বিবাহ করে তাঁদের রথেই বিচরণ করতেন। ঋগ্বেদে তাই বলে। পরে এ-ও বলা হয়, অশ্বিনীকুমারদ্বয় আসলে ঠিক তাঁকে বিবাহ করেননি, কেবল অন্য এক স্বামীর হয়ে তাঁকে পাণিগ্রহণে রাজি করিয়েছিলেন। ঋগ্বেদ ৮৫-তে যে বিবাহের শ্লোক রয়েছে, তাতে কন্যাকে অর্পণ করা হয় সোমের কাছে, তারপরে গন্ধর্বের কাছে, অতঃপর অগ্নির কাছে, এবং সর্বশেষে নিজের স্বামীর কাছে। এর অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে? একই সময়ে এক নারীর একাধিক স্বামী থাকা তা হলে কি শাস্ত্রমতে সম্ভব?
লোকে যখন ভারতের ‘প্রথাগত সংস্কৃতি’র কথা বলে, তারা ধরে নেয় ১০০০ বছর আগে মুসলমানদের এ দেশে আগমন পর্যন্ত ও জিনিসটি যেন চিরকাল স্থবির, অচল এবং ছকে বাঁধা ছিল। এ কথা একেবারেই সত্যি নয়। হিন্দুমতে বিবাহের যে রীতি, তাতে যেমন হরপ্পার এবং বৈদিক যুগের আদর্শ ও চিন্তাধারার প্রভাব আছে, তেমনই রয়েছে গ্রিক, শক, কুষাণ, হূন, তুর্কি, আফগান, ফারসি, আরব, এমনকী ইউরোপীয় সমাজেরও নানা প্রভাব, যা সেসব সমাজের মানুষের সঙ্গে এদেশে পদার্পণ করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আচার-প্রক্রিয়াও যেভাবে পাল্টেছে, সেভাবেই পাল্টেছে বিবাহের ধারণাও।
‘সিঁদুর’ আর ‘শাঁখা-পলা’ বা হাতের চুড়ির উৎপত্তি হরপ্পা-সভ্যতায়, আবার ‘মঙ্গল সূত্র’র উৎস দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতিতে। ঋগ্বেদ যখন লেখা হয়নি, তখনও কি এ আচারগুলির অস্তিত্ব ছিল? এ বিষয়ে কেবল জল্পনাই করা যায়। বীর যোদ্ধা স্বামীর চিতায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন বিধবা, সেই প্রাচীন সতীপ্রথার কথা রাজপুতেরা বলতেই পারেন, তবে হরপ্পা এবং দ্রাবিড় উভয় সমাজেই মৃতদের কবরে গোর দেওয়া হত। হরপ্পায় অন্তত একটি কবরে পাশাপাশি একসঙ্গে একজন পুরুষ ও একজন নারীর দেহ পাওয়া যায়। এঁরা কি স্বামী-স্ত্রী? এঁদের মৃত্যু কি একসঙ্গে ঘটেছিল? না কি এঁদের ভালবাসার স্বীকৃতি হিসেবেই এই ব্যবস্থা? আমরা ঠিক জানি না।
উত্তর ভারতের সমাজ মাসতুতো-পিসতুতো ভাইবোনের বিবাহের ঘোর বিরোধী, এমনকী সগোত্র বা সপিণ্ড বিবাহও সেখানে বারণ। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তুতো-ভাইবোনদের বিয়ের রেওয়াজ রয়েছে— জমি বা ভূমিজ সম্পত্তি যাতে বৃহত্তর পারিবারিক আয়ত্তের বাইরে চলে না যায়, তারই ব্যবস্থা করতে এ এক পুরনো প্রথা। আমরা ভাগবতে পড়ি, অর্জুনের বিবাহ হয়েছিল তাঁর মামাতো বোন সুভদ্রার সঙ্গে। সুভদ্রার পুত্র অভিমন্যু বিবাহ করেন নিজের জ্যাঠা বলরামের মেয়ে শশীরেখাকে, আবার রুক্মিনীর পুত্র প্রদ্যুম্নের বিবাহ হয় রুক্মিনীরই ভাই রুক্মীর কন্যা রুক্মাবতীর সঙ্গে। এসব কাহিনি কি তাহলে দক্ষিণ ভারতের, না কি কৃষ্ণের বাসস্থান সেই উত্তর ভারতেরই?
‘সাত পাকে বাঁধা’র রীতিটি ঋগ্বেদ থেকে আসে। তবে সে-যুগে এসব রীতি শুধু বিবাহের আচারে নয়, নানা রকম বোঝাপড়ারই অঙ্গ ছিল। তামিল ব্রাহ্মণদের বিবাহে যে ‘কাশীযাত্রা’র রীতি, তা আসলে মনে করিয়ে দেয় এক প্রাচীন যুগের কথা, যখন ব্রাহ্মণ পিতাদের মনে আশঙ্কা থাকত, ছেলে বুঝি-বা বৌদ্ধ বা জৈন ধর্মে দীক্ষিত শ্রমণ হয়ে যায়! দেবতা শিবের অনুচর ভয়ানক সব ভূতপ্রেতের দল তাঁর সঙ্গে হল্লা করতে করতে হিমবানের বাড়ি যাচ্ছে তাঁর নতুন বউ আনতে, এ গল্প আমরা পুরাণে পাই— আধুনিক যুগে ‘বারাত’ বা বরযাত্রী প্রথার এখানেই জন্ম। অশ্বারোহী বরের যে ‘সেহরা’, যে প্রথা মুসলমানদের মধ্যেও প্রচলিত, তার উৎস মধ্য এশিয়ার এক রীতিতে— বধূকে জয় করতে বেরিয়ে পড়া তরুণ ও সুদর্শন বরের উপর যাতে ‘কুনজর’ না পড়ে, সে-ব্যবস্থা করতেই এ রীতির জন্ম।
‘হলদি’ (গায়ে হলুদের প্রথা) যেমন হিন্দু রীতির প্রভাব, ‘মেহেন্দি’ (হেনা ব্যবহারের প্রথা) রীতির উৎস তেমনই মুসলমান রীতি। শরীরী ইঙ্গিতপূর্ণ চটুল গানে ভরা যে জনপ্রিয় ‘সঙ্গীত’ অনুষ্ঠান এক সময়ে শুধু উত্তর ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল, বলিউডের আশীর্বাদে তা আজ সারা ভারতবর্ষের বিবাহ অনুষ্ঠানে পারিবারিক নাচ-গানের আসরে পরিবর্তিত হয়েছে। আবার, এনগেজমেন্ট রিং বা বাগদত্তাকে আংটি পড়ানোর প্রথাটি ভীষণ ভাবেই খ্রিস্টান রীতি।
হিন্দুধর্ম কোনওদিনই বিবাহকে চুক্তি হিসেবে দেখেনি, দেখেছে যাত্রাপথের একটি অভিষেক হিসেবে। ‘বিয়ের সার্টিফিকেট’-এর ব্যাপারটা দেখে ধর্মনিরপেক্ষ এবং নেহাতই সেকুলার ভাবে সরকারি মনে হতে পারে, তবে এর মূলে রয়েছে জুডেও-খ্রিস্টান দৃষ্টিভঙ্গি, যা বিবাহকে দেখে সাক্ষীসাবুদের সামনে দুজন মানুষের করা পবিত্র অঙ্গীকার হিসেবে। বলা ভাল, সব বিবাহ মোটেও ‘চিরকাল’ বা ‘সাত জন্ম’-এর জন্য বাঁধা ছিল না। জরৎকারু বা কর্দমের মতো মহান ঋষিরা কেবল সন্তান উৎপাদন এবং পিতৃপুরুষের প্রতি নিজেদের কর্তব্যপালনের জন্যেই বিবাহ করেন, এবং কাজ শেষ হবার পর স্ত্রীদের ত্যাগ করে চলে যান। ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নিয়ে যেসব গোষ্ঠীদের মাথা-ব্যথা, এসব ‘ইতিহাস’ নিয়ে আলোচনা তাঁরা এড়িয়ে যান।