সময় কি তবে থমকে গেল? না কি আমরা এমন একটা নাগরদোলায় চড়ে বসেছি, যেটা ঘুরপাক খেতে খেতে প্রতি মে মাসে একটা বিভীষিকাময় অতিমারীর সঙ্গে একটা ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের মুখোমুখি দেখা করিয়ে দেয়? এলিয়ট লিখেছিলেন এপ্রিল হচ্ছে নিষ্ঠুরতম মাস, এখন কি তা বদলে মে মাস হয়ে দাঁড়াল? কারণ এই নিয়ে দ্বিতীয়বার, মে মাসেই তো উপকূল জুড়ে আছড়ে পড়ল ভয়ঙ্কর ঝড়। গত বছর তছনছ হয়েছিল পূর্ব উপকূল, কলকাতা আর দক্ষিণ ২৪ পরগণায় আমফান ধ্বংসলীলা চালিয়েছিল। ভারত তখনও প্রিয়জন হারানোর মিছিলে অসাড় হয়ে যায়নি, তখনও অতিমারী তার নিজের প্রকাণ্ড বিষাদ-ঝড় শুরু করেনি। এই লেখাটা যখন লিখছি, তখন গুজরাট সহ ভারতের পশ্চিম উপকূলকে ‘তওতে’ নামের সাইক্লোন লন্ডভন্ড করছে। এর মধ্যে আবার শোনা যাচ্ছে, ইয়াস নামের সাইক্লোন সুন্দরবন, দক্ষিণবঙ্গ আর বাংলাদেশে ঝাঁপিয়ে পড়বে। তবে হ্যাঁ, এই সব ঝড়ে যা প্রাণহানি হবে, তা রোজ কোভিডে যত মানুষ মারা যাচ্ছেন, তার তুলনায় কিছুই নয়। আমরা বোধ হয় এমন একটা সময়ে বাস করছি যখন অনেকগুলো প্রলয় পরস্পরের সঙ্গে প্রতিষোগিতায় নেমেছে।
গত বছর আমফান ঠিক এই সময়ে কলকাতাকেই উপড়ে ফেলেছিল, গুঁড়ি সমেত গাছ, বাড়ি থেকে জানলা উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল, আর নানাবিধ গুমটি আর বড় বড় হোর্ডিংকে দুমড়ে-মুচড়ে এমন ছুড়ে দিয়েছিল, যা প্রায় প্রাণঘাতী এক একটি ছোট মিসাইলে পরিণত হয়েছিল। ঘুরে তাকালে, দুটো ব্যাপার লক্ষ করা যায়। এক, একটা ভাল দিক— ভারতের উপকূলবর্তী সব রাজ্যেই সুপরিকল্পিত স্থানান্তর প্রক্রিয়ার বন্দোবস্ত আছে (ঝড়ের সতর্কীকরণ পেয়ে সরকার সময় থাকতে উপকূলবর্তী মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়)। ২০১০ সালে আয়লা ঝড়ে— যা আমফানের চেয়ে অনেক কম শক্তিশালী ছিল— প্রায় ৩৫০ জন মানুষ প্রাণ হারান। কিন্তু গত দু’দশকের সবচেয়ে শক্তিশালী ঝড় আমফানের প্রকোপে প্রাণ হারান ১০০ জন মানুষ। আমফানের ঠিক পরেই কথা বলেছিলাম লেখক অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে, যিনি ভারতীয় উপকূলে জলবায়ু পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে অত্যন্ত বিশদে লিখেছেন। তিনি বলছিলেন, ‘উপকূল থেকে মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ওড়িশা। এ জন্য মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সাধুবাদ প্রাপ্য।’ গত বছর আমফানের সময় মানুষজনকে সময় থাকতে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে, বহু মানুষের প্রাণ বেঁচেছে, যতই সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হোক না কেন। আরও একটা অত্যন্ত জরুরি বিষয় হল, এই ধরনের ঝড়ের পূর্বাভাস এখন অনেক নিখুঁত ভাবে দেওয়া যাচ্ছে, এবং ঝড়ের অনেকটা আগেই দেওয়া যাচ্ছে। ফলে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে, আর যেখানে নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে অনেক আগে থেকে বিভিন্ন পরিষেবার বন্দোবস্ত করে রাখা যাচ্ছে।
আর যে খারাপ দিকটা, সেটা হল, ঝড় চলে যাওয়ার পর কিন্তু উদ্ধারকার্য ও পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ কোনও পরিবর্তন হয় না।প্রয়োজনের তাগিদে, গ্রামের মানুষদের ভাঙাচোরা বাড়ি-ঘরেই ফিরে যেতে হয়, আর শহরের মানুষ সব ভুলে যথারীতি তাদের রোজকার জীবনে ফিরে যান।
কুলতলির মতো গ্রামের অবস্থা দেখলে মনে হয়, এখানে গল্পটা কিছুটা সাহসের, আর কিছুটা ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণের। এই গ্রামটা সুন্দরবনের অন্যান্য গ্রামের মতো খুব ভেতরদিকে না হলেও, বাড়িগুলো আমফান ঝড়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। গ্রামের একমাত্র পাকা স্কুলবাড়িটাই ছিল গ্রামবাসীদের একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু আমফানের দিন-দশেক পরেই, ২০২০ সালের জুন মাসের গোড়ার দিকে, গ্রামের লোকজন ধীরে ধীরে ফিরে গিয়েছিলেন নিজেদের বাড়ির দিকে, জীবন ঠিক আগের ছন্দেই ফেরার চেষ্টা করছিল। বাড়ির পুরুষরা চলেছেন বনের ভিতর মধুর খোঁজে, মেয়েরা লঙ্কা চাষে মন দিচ্ছেন, কলকাতার বুটিকের এমব্রয়ডারির অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে বসেছেন। সবাই নিশ্চিত ছিলেন, মাসখানেকের মধ্যেই ঝড়ের তাণ্ডবের কথাটা একেবারে ভুলে যেতে পারবেন।
‘উপকূল থেকে মানুষজনকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিশ্বে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ওড়িশা। এ জন্য মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়কের সাধুবাদ প্রাপ্য।’
অমিতাভ ঘোষ, সাহিত্যিক
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে প্রবল আবহাওয়ার ঝামেলাগুলো হচ্ছে, তা গোড়াতেই আছড়ে পড়ে সুন্দরবনে। তাই, ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ বাস করার অভ্যাস আছে বলে, সুন্দরবনের মানুষ অনেক শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছেন। বাড়িঘর বাঁচানোর ক্ষেত্রে তাঁদের হাতে কোনও আশ্চর্য সুবিধে নেই বটে, কিন্তু তাঁরা খুব ভাল করে জানেন, ঝড় হচ্ছে তাঁদের বাস্তবের অনিবার্য অঙ্গ। এই জেনে রাখাটাই তাঁদের একটা অস্ত্র। অবশ্য তার সঙ্গে একথাও বলতে হবে, সুন্দরবন ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়াও এই অঞ্চলের আখ্যানের অংশ। প্রতি বছর প্রায় পাঁচ লাখ তরুণ-তরুণী সুন্দরবন থেকে কাজের খোঁজে পশ্চিম ভারতের দিকে চলে যান, বিশেষ করে পর্যটনের জন্য বিখ্যাত গোয়া, কেরালা, এই সব রাজ্যে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে জর্জরিত এলাকার মানুষদের পরিকল্পিত পুনর্বাসন (সকলকে পাকাপাকিভাবে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া) এবং পুনর্বাসিত নতুন এলাকায় এদের কি কাজের সুযোগ বা নিরাপত্তা দিতে পারবে সরকার? বিশেষজ্ঞরা অন্তত এ সমাধানের ব্যাপারে খুব নিশ্চিত নন।
অন্নু জেলে এবং অমিতেশ ভট্টাচার্য, দুই সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ, যাঁরা বহুকাল এই অঞ্চলে কাজ করেছেন, বলছেন, ‘ভারতের বিভিন্ন বাঁধ তৈরির জন্য এলাকার মানুষদের সরিয়ে দেওয়ার অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, এই স্থানান্তরের ফল ভাল হয়নি। সুন্দরবনের মানুষ কেবল জলবায়ু-পরিবর্তনের জন্যই বিপন্ন হননি। কিংবা পরিকাঠামোর অভাব (ব্রিজ, জেটি, হাসপাতাল, পাকা রাস্তা তৈরি হয়নি) তাঁদের বিপন্নতার মূল কারণ নয়। আসল কারণ হল, সরকার এই দ্বীপের মানুষগুলিকে নাগরিক হিসেবে গণ্য না করে, তাঁদের প্রতি দীর্ঘ ঔদাসীন্য দেখিয়েছে ও তাঁদের অধিকারকে আমলই দেয়নি।’ অমিতাভ ঘোষও এ ব্যাপারে একমত, বাসিন্দাদের স্থানান্তরিত করলে (যা নেদারল্যান্ডস-এর মতো দেশের একটি নিয়মিত ব্যাপার) অনেক বিপদ দেখা দেয়। তিনি বলেছেন ‘সরকারি উদ্যোগে এই ধরনের স্থানান্তর ভয়ানক সব হিংস্র পরিস্থিতির জন্ম দেয়।’ আদতে, সুন্দরবনের কাহিনি হল, বাঁচার তাগিদ তেকে তৈরি হওয়া প্রতিরোধের কাহিনি। এখানকার মানুষ মনে করেন, তাঁরা এখানকার অবিচ্ছেদ্য অংশ, এবং প্রকৃতির খামখেয়ালের বিরুদ্ধে তাঁরা যেভাবে একজোট হয়ে রুখে দাঁড়ান, তা দেখলে সম্ভ্রম জাগে।
কলকাতা আর তার আশপাশ এখন আমফানের ভিলেনগিরি ভুলেই গেছে। নাগরিকেরা ভুলে গেছেন যে তাঁরা অনেকেই দিন-পনেরো বিনা বিদ্যুতে কাটিয়েছেন। আমরা এ-ও ভুলে গিয়েছি, ফুটপাথের গাছ পুঁতলে তাদের শিকড় দুর্বল হয়ে যায়, সেগুলো পড়ে গেলে বাড়িগুলোর বিপদ ঘটে, এলাকার মানুষজনেরও। ঠিক আগের মতো ভুল পদ্ধতিতেই ফের গাছ পোঁতা হয়েছে। আমরা ভুলেছি যে গাদা গাদা ওভারহেড তার কেটে নামিয়ে, সেসব তার মাটির তলা দিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। অতিমারীর এই নির্জন সময়টি এইসব কাজ সেরে ফেলার আদর্শ সময় ছিল, কারণ যান-চলাচল খুব কম ছিল। সেই সুযোগ এখনও আছে, আর একইসঙ্গে আছে শহর জুড়ে তারের কাটাকুটি খেলা।
বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা যাঁরা করেন, তাঁরা আমফান থেকে শিক্ষা নিতে পারতেন যে, উঁচু বাড়ির তেইশ-তলার বারান্দা বা সামনের দিকটা অনেকটা কাচ দিয়ে বানানো খুব ভাল ব্যাপার নয়। কিন্তু ভারতে এখনও এগুলো বড়লোকিয়ানার পরিচয়। এগুলো শুধু কলকাতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, বরং মুম্বই, চেন্নাই এবং সমুদ্রের ধারের অন্যান্য শহরগুলো কলকাতার তুলনায় আরও বিপন্ন। আধুনিক জীবনযাপনের ফাঁদ তাদেরও একই রকম বিপদের সম্ভাবনার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, যেমন বিপদে কলকাতা পড়েছিল আমফানের সময়।
গত বছরের সেই ভয়ানক বুধবার সন্ধের পর একটা পছর পেরিয়ে গেছি আমরা। কলকাতায় প্রত্যেকের আমফান নিয়ে একটা করে নিজের গল্প আছে, প্রিয় গল্প। আমারটা হল একটা কলাগাছকে নিয়ে। আমফান আছড়ে পড়ার সময়টায় যখনই আমি সাহস করে বাইরে মুখ বাড়াচ্ছিলাম, দেখছিলাম অল্প বেড়ে ওঠা কলাগাছটা পাগলের মতো এদিক-ওদিক দুলছে ঝড়ে। ফল পড়ে যাচ্ছে, ফুলগুলো ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। গাছটার জন্য খুব ভয় করছিল আমার। পরের দিন সকালে, সমস্ত তছনছের মধ্যেই দেখি, গাছটা, একটু বেঁকে গেলেও, ঠিক দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছটাই এখন আমার বাড়ির দোতলার জানলায় দুলে দুলে পাতা দিয়ে ধাক্কা দেয়। আর বাড়ির লোকজন যখন পাতুরি রান্না করে, তার পাতা দিয়েই বেশ করে মুড়ে দেয়। তাই ঝড় আছেই, থাকবেই, আর তার সঙ্গেই থাকবে আশা আর পুনর্জন্মের গল্প।