কমলকুমার মজুমদার নাকি বলতেন, ‘সাফারিং-এর মধ্যে একটা grandeur আছে।’ আর একথা ভাবতে কে না ভালবাসে যে, তার মতো সমস্যায় জর্জরিত ব্যক্তি দুনিয়ায় বিরল! পড়াশোনা আছে অথচ চাকরি নেই, দেখতে সুন্দর তবু বিয়ে হচ্ছে না, টাকা আসছে এদিকে জলের মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে, আর মানসিক অশান্তির কথা তো ছেড়েই দিলাম! প্রতিনিয়ত কোন এক দৈব ষড়যন্ত্রের কারণে, আমরা যেন আমাদের পূর্ণ সুখ থেকে বঞ্চিত হয়ে চলেছি। সকলেই ভাবছি, অন্যের সব হচ্ছে, আমারই কিছু হচ্ছে না! কিন্তু হবে না-ই বা কেন? এমন লোক কি নেই, যাঁর ন্যূনতম টোটকায় জাত-বেকারের বিরাট চাকরি হয়, এমনকী হাঘরের জিম্মায় রাতারাতি পাঁচতলা বাড়ি? কথায় আছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’ এবং এই বিশ্বাসকে টোপ করেই কলকাতার আনাচেকানাচে, পেশাদার জ্যোতিষীদের পাশাপাশি একদল গণৎকার আছেন, যাঁরা টিয়াপাখির সাহায্যে ভাগ্যগণনার বিচিত্র পদ্ধতিতে দিনের পর দিন রমরমিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন!
খাঁচায় পোষা টিয়াপাখি কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভাগ্যের হাল-হকিকত জানিয়ে দিচ্ছে— তাও মাত্র কুড়ি কি তিরিশ টাকায়! কলকাতায় ইদানীং এই দৃশ্য কিছুটা কমে এসেছে বটে, কিন্তু এখনও ভারতীয় জাদুঘর, হাওড়া ব্রিজ, জোড়া গির্জা কিংবা মল্লিকবাজারের ফুটপাতে এরকম অদ্ভুত মুহূর্তের সাক্ষী থাকতে পারা যায়। কীভাবে হয় এই ভাগ্যপরীক্ষা? পাখির খাঁচার একপাশে সার দিয়ে সাজানো থাকে একাধিক খাম, যার যে কোনও একটার ভেতরেই রয়েছে নিজের ভাগ্যের খবর। এরপর নাম-পদবি সব টিয়ার কাছে বলা হলে সে বাইরে এসে শুধু একটা খাম তুলে, আবার ছোলা খেয়ে খাঁচায় ঢুকে যাবে। ব্যস, ওটুকুই। পরের কাজ টিয়ার সঙ্গে যিনি থাকেন, তাঁর। তিনি এবারে ওই খামের ভিতরের চিরকুট (হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় লেখা) পড়ে পড়ে ভাগ্যের কথা জানাতে থাকবেন, আর কোনও বাধা থাকলে তা পেরোবার পথও বলে দেবেন! কিন্তু মজার কথা হচ্ছে এই, প্রতিটা ভাগ্যনির্ণায়ক চিরকুটেই জীবনের বাধার কথা বাঁধাধরা।
ঠিক কী ধরনের কথা ঘোরাফেরা করে এই চিরকুটগুলোয়? লেখা থাকে, ‘আপনি অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে, কিন্তু আপনার ভাল সময় প্রায় সামনেই’, ‘মনের কথা কক্ষনও কাউকে বলবেন না, এমনকী প্রিয়জনকেও না, তাতে সাফল্য ব্যাহত হয়’, ‘পরিবারের মধ্যেই আসল শত্রু লুকিয়ে রয়েছে’, ‘চাকরিতে যতটা উন্নতির কথা ছিল, শনির প্রভাবে তা আটকে আছে’, ‘সারাক্ষণ মাথার ভেতরে হাজার একটা চিন্তা ঘুরছে’, ‘সামনের মাস থেকেই আয় আগের চেয়ে অনেক বেড়ে যাবে’, ‘গরুকে খাওয়ালে এবং ব্রাহ্মণকে দান করলে আপনার ভাল হবে’— এই রকম। আর গ্রহের দোষ কাটানোর উপায়? সেখানেও এক-একজনের এক-এক রকম টোটকা। কেউ সঙ্গে রাখতে বলেন মঙ্গল কবচ, কেউ-বা মহামৃত্যুঞ্জয় কবচ। সেন্ট টেরেসা গির্জার কাছে বসা শম্ভুনাথ পান্ডে আবার কবচের বদলে দুশো বছরের প্রাচীন মুদ্রাও দিয়ে থাকেন, জীবন বদলানোর প্রয়োজনে। এগুলোর দাম ৩০০ কি ৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়, তারপর চলতে থাকে দরাদরি।
‘আচ্ছা, টিয়াপাখি কি সত্যি সত্যি ভাগ্য বলতে পারে?’— এর উত্তরে গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের সামনে বসা মহেন্দ্র পান্ডে জানান, ‘ওদের ওইভাবেই ট্রেনিং দেওয়া হয় বাবু। লোক দেখলে ওরা ঠিক বুঝতে পারে, কার কপালে কী লেখা আছে।’ (সত্যি টিয়া লোক দেখে কিছু বোঝে না নিশ্চয়ই, কিন্তু কীভাবে যে একটাই কার্ড তোলে, বা কখনওই কার্ড না তুলে খাঁচায ফেরে না, সে কোচিং-এর রহস্য কেউ ফাঁস করেননি, বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও।) মহেন্দ্র আর শম্ভুনাথ দুই ভাই। বাড়ি দেওঘরে। এখানে থাকেন বড়বাজার অঞ্চলে। দাদার কথায় শম্ভুনাথ বলতে থাকেন, ‘১৯৮১ সালে দাদার সঙ্গে কলকাতায় চলে আসি। কয়েক বছর জাদুঘরের কাছে বসে, তারপর থেকে একটানা এই মৌলালি অঞ্চলেই… কী করব বলুন, পয়সা রোজগারের নেশা তখন মাথায়!’ তবে টিয়াপাখির এই খেলা আদপেই লোক টানার কৌশল— প্রত্যেকেরই লক্ষ্য থাকে হস্তরেখা বিচার। আর এই বিচারের নমুনা? পর পর দু’একজন-এর কাছে গেলেই, একজন বলবেন বড় ঘরের মেয়ে বিয়ে করার সম্ভাবনা আছে, তো অন্যজন বলবেন বউয়ের সঙ্গে রোজকার ঝামেলায় নাকি জীবন অতিষ্ঠ! যা বোঝার বোঝাই যাচ্ছে।
তবে এই ব্যবসা যে আসলে এক ধরনের লোকঠকানো ব্যবসা, এই ভয়কে এখনও কেউ কেউ দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি। যেমন হাওড়া ব্রিজে বসা বাবানাথ পান্ডে। বাবানাথ ওঁর আসল নাম কি না তাও জানি না। নামধাম জিজ্ঞেস করায়, প্রথমে কিছুই বলতে চাননি। খালি বলতে থাকেন, ‘এসব ভাল জিনিস না। বিশ্বাসের ব্যাপার পুরোটাই। আমার পরিচয় জেনে কী হবে!’ ছবি তুলতে চাইলে বেঁকে বসেন। অনেক জোরাজুরি করার শেষে ওই নামটুকু। আর ফোন নম্বর চাওয়ায় মল্লিকবাজারের বাবলু পান্ডের মুখ এক মুহূর্তে যেন দপ করে নিভে যায়!
প্রথম কবে এই পেশার মানুষজন এ-শহরে ঢুকেছিল, আজ সে-ইতিহাস প্রায় অজ্ঞাত। তবু কলকাতার রাস্তায় হাঁটতে বেরোলে আজও দেখা যায়, ম্লান ওইরকম কতগুলো মুখ। রোদে-জলে নিজেদের আড়াল করে বসে আছেন। মূল ধারার জ্যোতিষচর্চায় যাঁরা ব্রাত্য, একঘরে। হাজার-হাজার মানুষের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে, একসময়ে কখন যে তাঁদেরই ভাগ্যসূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, তাঁরা তা খেয়ালও করেননি। বিজ্ঞানমনস্কতার কাছে বুজরুকির আর কোনও জায়গাই নেই। ফলে আর দু-চার বছরের ভেতরেই হয়তো একদিন তাঁরা শহরের ফুটপাত থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবেন!