জজসাহেব আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন আর হেসে কুটিপাটি হচ্ছেন। একজন জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? উনি বললেন, আরে, পৃথিবীর সবচেয়ে মজার রসিকতাটা শুনলাম। লোকটা বলল, তাই? বলুন, বলুন। জজ বললেন, তা হয় নাকি? এইমাত্তর একজনকে দশ বছরের কারাদণ্ড দিলাম, ওটা বলার জন্যে!
এটা সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা ধ্রুপদী চুটকি। প্রবল ক্ষমতার সঙ্গে প্রবল ব্যঙ্গ ফ্রি পাওয়া যায়— সব সংস্কৃতিই এটা জানে। আপনাদের কম্পাউন্ডের যে সেক্রেটারি কিছুতেই ক্রিকেট খেলতে দেন না তাঁর ছবিতে গোঁফ এঁকে দেওয়া থেকে, প্রধানমন্ত্রীর ছবির দাড়িতে ক্ষুর চালিয়ে দেওয়া— কৌতুক সব ক্ষেত্রেই বিরোধিতার একটা অস্ত্র। কৌতুক একটা শক্তি। খুব হিংস্র নয়, কিন্তু খোঁচা দিতে এর জুড়ি নেই। একটা সত্যিকারের ভাল রসিকতা ক্ষমতাকে একেবারে দেউলিয়া করে ছাড়ে। যে অন্যকে অত্যাচার করে আনন্দ পায়, সে রসিকতা আদপে পছন্দ করে না। কড়া শিক্ষকেরাও রসিকতা ভালবাসেন না। এমনকী আপনিও বরদাস্ত করতে পারেন না, যখন দামি রেস্তরাঁর ওয়েটার আপনার অর্ডার নিতে এসে আপনার ইংরেজি উচ্চারণ শুনে ফিকফিক করে হাসে।
এ অনেকটা প্রাকৃতিক নিয়মের মতো। যদি আপনি সমাজে বেশ ক্ষমতার আসনে থাকেন, একটা না একটা রসিকতা এসে আপনার ফুরফুরে রঙিন বেলুনগুলো চুপসে দিয়ে চলে যাবে। আপনি যাকে সামাজিক প্রতিষ্ঠার দিক থেকে বেশ নিচু ভাবেন, সে যদি আপনাকে নিয়ে হাসাহাসি করে, আপনার এত খারাপ লাগে, বিশ্বযুদ্ধ হেরে গেলেও জেনারেলের তা লাগত না। যাঁরাই জাতপাত, গায়ের রং, লিঙ্গ, ধর্ম— এসব ব্যবহার করে কিছু মানুষকে দমিয়ে রেখেছেন আর ক্ষমতার ক্ষীর খাচ্ছেন, তাঁরাই আজ নয় কাল প্রতিবাদের পাটকেল খাবেন। আর কৌতুক প্রতিবাদেরই একটা ধরন। আরও একটি অসামান্য রুশ রসিকতা বলি— একজনকে ধরে আনা হয়েছে, সে নাকি চিল্লিয়ে বলেছে, ‘নিকোলাই একটা গর্দভ!’ পুলিশ তাকে এক চাপাটি মারতেই সে বলছে, ‘স্যার, আমি আমাদের মহামান্য শাসকের কথা বলছিলাম না, অন্য একজন নিকোলাইয়ের কথা বলছিলাম।’ পুলিশ বলছে, ‘আমাকে বোকা পেয়েছিস? আমাদের জাঁহাপনা জার (Tsar) ছাড়া কেউ কখনও গর্দভ হতে পারে?’
অসামান্য। সব নেতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (আশা করি আমি আর আপনি একই নেতার কথা ভাবছি)। রসিকতা এমন ভাবে প্রতিবাদ আর মতানৈক্যকে হাজির করে, ক্ষমতা তার অস্তিত্বটা নিয়েই ধন্দে পড়ে যায়। ক্ষমতা নিজেকেই তখন জিজ্ঞেস করে, ‘আমি আমাকে যতখানি ভাবছি, আমি ততখানিই তো?’ আর, আমরা সকলেই জানি, ক্ষমতা প্রশ্ন ব্যাপারটাকেই ঘেন্না করে। এতটা ঘেন্না করে যে, গোটা জাতির কোনও প্রশ্নকেই পাত্তা দেয় না, সাত বচ্ছর ধরে ক্ষমতায় থেকেও। সিএএ নিয়ে প্রতিবাদ যখন চলছিল, যখন ক্ষমতাবান শাসকেরা আমাদের ফুটিফাটা বাস্তবকে ধর্মের ভিত্তিতে আরও ভেঙে দিতে চাইছিলেন, তখন সংগ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছিল এসব দুরন্ত মজাদার লাইন: ‘যব হিন্দু-মুসলিম রাজি, তো কেয়া করেগা নাজি (নাৎসি)’, ‘মুরগি কেটে হবে চিকেন পার্টি, ছাগল কেটে মাটন পার্টি, আর গরিবের পেট কেটে ভারতীয় জনতা…’
শেষটায় কী বসবে আমরা সবাই জানি নিশ্চয়ই। জানলেই ভাল, কারণ হাসতে পারার মধ্যেই বাঁচতে পারার চাবি লুকিয়ে আছে। জার্মান চলচ্চিত্রকার ওয়ার্নার হেরজগ বলেন, ‘আমরা যদি ছবিতে আমাদের ধরে রাখতে না পারি, ডাইনোসরের মতো লুপ্ত হয়ে যাব।’ আমি বিশ্বাস করি, রসিকতার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা একদম তা-ই।
যে সমাজে কৌতুক মরে যাচ্ছে, সেখানে বেঁচে থাকা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। নাৎসিদের আমলে, কয়েকটা ফিসফিসে রসিকতা চলত। মানে, সেগুলো সবার সামনে হইহই করে বলা যাবে না, কারণ তা কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করে। কিন্তু ফিসফিস করে সেগুলো চলতই, কারণ কৌতুক বা প্রতিরোধ না চললে, মানবতাই ফৌত হয়ে যাবে। তাই, যারা ফুয়েরারের জুতো জিভ দিয়ে চেটে সাফ করে দিচ্ছে, তাদের রাগিয়ে দিতেই হবে এবং তাদের তথাকথিত আবেগকে আঘাত করতেই হবে। যদি আমার রসিকতায় আপনার আবেগে আঘাত লাগে, তার মানে হল, চারিদিকের বাস্তব পরিস্থিতি আমার আবেগকে আঘাত করছে। এই মুহূর্তে রসিকতাকে কত প্রয়োজন, তা বোঝাতে আমি এই লাইনগুলোর আশ্রয় নেব— ‘হায় অন্ধেরি রাত পর দিয়া জলানা কব মনা হ্যায়…’ (হায়, আঁধার রাতে প্রদীপ জ্বালানো কবে নিষেধ হল…)
যে লোকটা রসিকতা করছে, সে আসলে সুড়ঙ্গের শেষে একটা আলো খুঁজছে। মাঝে মাঝে বলা হয়, মজাদার লোকেরাই সবচেয়ে বিষণ্ণ। কথাটা খুব ভুল নয়, কারণ এর মধ্যে বলা আছে: মানুষ কীভাবে নিজের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়ায়, আর তখনই ক্ষমতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোও তার পক্ষে সহজ হয়ে ওঠে। তার মানে এই নয় যে রাজামশাইয়ের ভাড়া করা বিদূষকেরাও মজা করতে জানে না। নিশ্চয় জানে, কিন্তু তারা স্বাধীন নয়। তবে সেসব আলোচনা তো হবে তখন, যখন প্রলয় আসবে এবং সব্বাই নিজের নিজের আফশোসের কথা বলতে শুরু করবে, আর সেই বিদূষকেরা বলবে, তাদের দুঃখু স্বাভাবিক ভাবেই সবচেয়ে বেশি। বা, বলবে না, চেপে যাবে। সব শাসনই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে চিরকাল শত্রু হিসেবে দেখেছে এবং আমি আশা করি ফ্যাসিস্টরা কোনওদিনই হাসতে শিখবে না। আমার কথাগুলোকে খুব ছড়ানো-ছেটানো মনে হচ্ছে কি? তাহলে পুরোটাকে বেঁধে দিই একটা রসিকতায়—
ফুয়েরার একটা পাগলা-গারদ পরিদর্শনে গেছেন। রোগীদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, কীভাবে লাইন করে দাঁড়াবে, কীভাবে স্যালুট করবে। যখন হিটলার এলেন, সবাই ডানহাত তুলে চেঁচাল, ‘হেল হিটলার!’ শুধু লাইনের এক্কেবারে শেষে দাঁড়ানো লোকটি হাতও তুলল না, কিছু বললও না। হিটলার রেগে লাল হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘জানো না আমি কে! স্যালুট করলে না কেন?’ লোকটি ভারি ভদ্রভাবে বলল, ‘আমি এখানকার ডাক্তার। পাগল নই।’