হরপ্পার প্রায় চার হাজার বছরের প্রাচীন সিলমোহরগুলোয় একটি জিনিস স্পষ্ট বোঝা যায়— ওই সমাজে গাছের গুরুত্ব কতটা ছিল। এসব সিলমোহরে পিপুল এবং বাবলা (একাশিয়া) গাছকে শনাক্ত করা গেছে— পিপুল গাছ চেনা যায় তার চওড়া, কোণার দিকে সরু হয়ে আসা পাতা দিয়ে, আর বাবলা গাছ চেনা যায় ডালের বিচিত্র বিন্যাস এবং কাঁটা দেখে। হরপ্পা সভ্যতায় এই দুটি গাছ যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বেড়ার মধ্যে গণ্ডি বেঁধে এ গাছ রেখে গাছের পুজো করা হচ্ছে, এমন ছবি পাওয়া যায়। গাছের থেকে দেবী আবির্ভূত হচ্ছেন, মাথায় ডালপালা, পাতা, বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে মোষের শিং বেঁধে লোকেরা এই বৃক্ষদেবীকে বন্দনা করছে, তাঁকে নানারকম অর্ঘ্য দিচ্ছে, এ চিত্রও রয়েছে। সেসব অর্ঘ্যের মধ্যে বলিদানও রয়েছে (পশুও হতে পারে, নরবলিও হতে পারে, এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় না)। তবে হরপ্পা সভ্যতায় যে গাছ পূজিত হত, সেটা স্পষ্ট।
এর তাৎপর্য একটি সিলমোহর দেখলে বোঝা যায়। এ ছবিতে দেখা যায়, গাছের উপরে একটি লোক বসে আছে, এবং নীচে পিছন ফিরে তার দিকে তাকিয়ে আছে একটি বাঘ। অর্থাৎ গাছের উপর চড়ে নিজেকে বাঘের হাত থেকে লুকিয়ে রক্ষা করছে মানুষ। এ কারণেই হয়তো এই গাছ, অথবা কাঁটাগাছের একটি উপবন, পরবর্তীকালে পবিত্র হয়ে উঠেছে মানুষের কাছে– বন্য বাঘের থেকে সে গাছ মানুষের রক্ষার পীঠস্থান। অতএব, এ গাছের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়ছেন মাতৃরূপী দেবী।
সমকালীন আদিবাসী রূপকথাতেও পবিত্র উপবন, এবং ডালপালা বা কাঁটার দ্বারা মানুষকে বন্য পশুর হাত থেকে তারা রক্ষা করে বলে বিশ্বাস রয়েছে। মুন্ডাদের মধ্যে একটি উপকথা প্রচলিত আছে, যেখানে একজন মানুষ উপবনে লুকিয়ে সিংহের হাত থেকে রক্ষা পায়। ভারতবর্ষ জুড়ে বহু সমাজে আজও গাছের পুজো করার রীতি বর্তমান।
বহু আদিবাসী সমাজের পূজ্য হিসেবে রয়েছে গাছের পবিত্র উপবন বা ‘গ্রোভ’। এসব জায়গায় শাল, মহুয়া, নিম বা বটের মতো গাছ থাকে, কারও সে সব জায়গায় প্রবেশ নিষিদ্ধ। এগুলো এক একটি জায়গার জীববৈচিত্র রক্ষা করতে সাহায্য করে, এই পবিত্র উপবনের রক্ষার পিছনে এই হল যুক্তিসঙ্গত কারণ। স্থানীয় মানুষ চাষবাসের সময়ে এই জায়গাটুকুর উপর কোনও হস্তক্ষেপ করেন না। ভিলদের মধ্যে এই পবিত্র উপবনকে সার্না-স্থল নামে ডাকা হয়।
বলা হয়, এই পবিত্র গাছে বা পবিত্র উপবনে দেবী বসবাস করেন, তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে তিনি দোলনায় খেলা করেন। এ উপবনে কোনও ছেলে প্রবেশ করলে মেয়ে হয়ে যায়, পুরুষ পশু হয়ে যায় নারী পশু। অশ্ব হয়ে যায় অশ্বিনী, সিংহ হয়ে যায় সিংহী। অতএব, এ জায়গা থেকে দূরে থাকা চাই।
প্রসঙ্গত, ঝাড়খন্ডের বহু জনসমাজ দাবি তুলেছেন, হিন্দুধর্মের সর্বব্যাপী ছত্রছায়ার বাইরে ‘সার্নাবাদ’ বা বৃক্ষ ও উপবন পুজোর রীতিকে স্বাধীন স্বীকৃতি দিতে হবে।
বৈদিক শাস্ত্রেও ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন গাছের কথা পাওয়া যায়, যেমন পিপুল গাছ, বট গাছ, অথবা বাবলা গাছ। বেদের ধর্মগীতি বা শ্লোক যে ভারতবর্ষেই রচিত, এ প্রমাণ তার আভাস দেয়। হরপ্পা সভ্যতার পতনের পরে যেহেতু এই সংস্কৃতির উত্থান, সেহেতু বোঝা যায় এই সব শ্লোকের সৃষ্টি হয়েছিল পূর্ববর্তী হরপ্পান শহরের অধিবাসীদের সাথে বাইরে থেকে আসা ইন্দো-আর্যদের সংমিশ্রণের ফলে। অতএব বৈদিক শ্লোকে হরপ্পার স্মৃতি বেঁচে থাকতে বাধ্য। স্থানীয় বৃক্ষ-উদ্ভিদের আরাধনা ও উদযাপনে এ স্মৃতি প্রকাশ পায়।