১৯ ডিসেম্বর, ২০১৯। রামলীলা ময়দান, কলকাতা— মিছিলে হাজারে হাজারে মানুষ। গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ, তাদের বয়স আলাদা, পেশা আলাদা, কিন্তু আওয়াজটা এক। এনআরসি আর সিএএ-র বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন এই মানুষগুলো, যাঁদের প্রত্যেকের যাপন আলাদা। মিছিল যখন ধর্মতলার কাছাকাছি, সবার গলা স্লোগান দিয়ে একটু ক্লান্ত হয়ে উঠছে, ঘামে ভিজে আমরা সবাই আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছি, তখন সমস্ত দোকানের মালিক, কর্মচারীরা এসে আমাদের জল দিচ্ছেন, খাবার দিচ্ছেন, ফল দিচ্ছেন। সব বিনামূল্যে। আর বলছেন, ‘তোমরা ছাত্রছাত্রীরা আমাদের সবার জন্য লড়ছ, তাই এই নাও আমাদের ভালবাসার ছোট্ট উপহার, যতটুকু পারলাম দিলাম… জল খেও কিন্তু, নইলে গলা বসে যাবে!’ ছাত্র-আন্দোলনের স্পৃহা, ক্ষমতা আর উৎসাহ সেদিন এক ধাক্কায় দশ পা এগিয়ে গেছিল।
২০১৮, অগাস্ট। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা— বিহারে ১৪ বছরের মেয়ে অঞ্জনাকে ধর্ষণ করেছিল যারা (ক্ষমতাশীল কিছু অমানুষ), তারা আমাদের দেশের স্বাভাবিক আইনের ব্যর্থতার জন্য ছাড়া পেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, হয়তো আরও ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে। সেই অন্যায়ের প্রতিবাদে বিহার ইউনিভার্সিটি আমাদের যাদবপুরের শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদন করে, একটা মিছিলের মাধ্যমে তাদের সমর্থন জানাতে, যাতে পুলিশ ধর্ষকদের গ্রেফতার করে। কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নয়, ছাত্র-সমাজের সচেতন নাগরিক হিসেবে অন্যায়ের প্রতিবাদে এই মিছিলের আয়োজনের সময়, যখন কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ খ্যাতিসম্পন্ন মানুষের কাছে যাই মিছিলে থাকার জন্য, তখন তাঁরা জানান তাঁরা ‘এইসবের মধ্যে নেই’। সেদিন বুঝলাম আমাদের জাতি হিসেবে অজ্ঞানতা ও হীনম্মন্যতা চুঁইয়ে চুঁইয়ে হৃদয় ও মস্তিষ্ককে পচিয়ে দিয়েছে। তাই আরও জোর পেল মিছিল, যেখানে জ্বলল মশাল, চিৎকার করে ছাত্র-যুব জানান দিল, আমাদের বোন অঞ্জনা-রা একা নয়, তাদের অনেক দাদা-দিদিরা ভৌগোলিক ভাবে দূরে হলেও তার জন্য লড়ে যাবেই!
২০০২ সাল। নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র— আমাদের নামে আর নয়— এই কথা শুনতে হবেই রাষ্ট্রপতিকে, এই উদ্দেশ্যে আমেরিকার মানুষেরা তৈরি করলেন ওয়েবসাইট ‘নট ইন আওয়ার নেম’। রাষ্ট্রনেতার অভ্যেস হল যুদ্ধ ঘোষণার সময় বলা যে, আমি যা করছি মানুষের নামে, দেশের হিতের স্বার্থে। এই কিছু আমেরিকানদের বক্তব্য স্পষ্ট, আমাদের নামে এই যুদ্ধ নয়, আমাদের জিজ্ঞেস করে এই যুদ্ধ আপনারা লড়ছেন না, অন্য দেশের সাধারণ মানুষের অনিচ্ছা সত্ত্বেও জোর করে তাদের শান্তি নষ্ট করতে আমরা দেব না, আমাদের সন্তানদের মরতে দেব না আমরা আপনাদের অর্থ উপার্জনের জন্য। এই সংগঠনের মানুষেরা মিছিল নিয়ে নামলেন নিউ ইয়র্কের রাস্তায়, সাড়া তুললেন আর জানালেন যে আমরা সমর্থন করি না এই অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধের উন্মাদনা! সেই মিছিলে উপস্থিত ছিলেন আমার গুরু ও শিক্ষক অভিনেতা-নাট্যকার-নির্দেশক শ্রীচন্দন সেন। তাঁর কাছে মিছিলের গল্প শুনে, ভিডিও দেখে, কানে একটা স্লোগানের প্রতিধ্বনি ভেসে এল— যে আওয়াজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ভারতের যে ভৌগোলিক দূরত্ব, তা প্রতিবাদের শক্তি দিয়ে ঘুচিয়ে দিল।
প্রায় প্রতিদিন, প্রতি বছর— ‘এসবের মধ্যে বেশি না থাকাই ভাল’, ‘আমার এই নিয়ে কিছু বলার নেই’, ‘আমি অরাজনৈতিক থাকলেই নিরাপদ বোধ করি’, ‘মানুষ মরছে তো আমি কী করব?’ ইত্যাদি কথা আসে কিছু অন্ধ, বোধহীন, শিরদাঁড়াহীন মানুষের থেকে, যাঁরা নিজের ভাই মরছে দেখেও তার জন্য লড়াই করেন না। এই কিছু মানুষের নীরবতার ফলে সমস্ত প্রতিরোধেরই দমবন্ধ হয়ে আসে অত্যাচারীর হাতে। এঁরা দায়িত্ব নিয়ে বোধের গলা চেপে ধরেন, সকল ভাল কাজকে মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে চুরমার করে এই সমাজকে বিপন্ন করে তোলেন। তাঁদের বোঝাতে হবে, আমাদের সঙ্গে নিতে হবে, তাই বারবার রামলীলা ময়দান যাব আমরা, অঞ্জনার জন্য মশাল হাতে যাদবপুরের এইট বি-র মোড়ে স্লোগান দেব, ভালবাসা পাঠাব বিদেশে লড়াই করতে থাকা আমার অচেনা বন্ধুকে।
ছাত্র-আন্দোলন এটা পারে, সে বোঝাতে পারে, লড়তে শেখায়, মগজে চাষ করে, মগজে জল প্রদান করে, বোধের সিদ্ধান্তকে খেতে দেয়, মননকে আরও দৃঢ় করে। কেউ যদি এই সাহস গুলিয়ে দিতে আসে, গণতান্ত্রিক দেশে স্বাধীন মত প্রকাশে হস্তক্ষেপ করে, তখন মনে রাখতে হবে এই বাংলা বাঁশের কেল্লার তিতুমীরের, এই ভারতবর্ষ সফদার হাশমির নাটকের, এই পৃথিবী মালালা ইউসুফের লেখার। সেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর আন্দোলনের রূপ সুন্দর ও শুভ্র। যখন হাজার গলার সমবেত স্বর নিজেদের দাবি জানায়, সেটা একটা সুমিষ্ট গানের সুরের চেয়ে কম কিছু নয়। মশাল হাতে রাস্তায় রাস্তায় মৌনী মিছিলও একটি নৃত্যের মতোই বিস্ময়কর ও চমৎকার। সেই শিল্পের আর সত্তার সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা একটা মাঠের দিকে তাকালাম, সেই মাঠের ‘গ্যালারিতে বসে গ্যালিলিও’।