আমি প্রত্যেকদিন নতুন নতুন করে বাড়িটার মধ্যে ঢুকে পড়ছিলাম। আর বাড়ির মানুষগুলোও ঢুকে পড়ছিল আমার মধ্যে। রোজ বাড়ির ভেতরকার বাতাসের অপরিবর্তনীয় বিশেষ গন্ধ আমি নাক উঁচু করে নিয়েছি। এখানে যখনই নিঃশ্বাস নিই, তখনই দেওয়াল থেকে, মেঝে থেকে, সিলিং থেকে সেই গন্ধের আবহ নেমে এসে আচ্ছন্নকারী এক শক্তি নিয়ে আমায় গ্রাস করে ফেলে। আর তক্ষুনি আমি বুঝতে পারি, সেই মুহূর্তের একান্ত নিজস্ব অসহায়তা।… নিজের অস্তিত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে না, অথচ মানুষগুলোর সঙ্গে মানসিক বিনিময় চলছেই।
চারতলা বাড়িটার প্রত্যেক তলা এক-এক ভাইয়ের দখলে। একতলাটা নাকি ছোটভাই কার্তিকের। কিন্তু সে তরুণ, অবিবাহিত ও বেকার বলে আঁটাপট্টিময়। কোনও সংসার তার নেই। খায় দোতলার মেজদা, মানে কালীপদদার সঙ্গে। পারিবারিক কাঁসা-পেতলের ব্যবসার পুরোটাই এখন মেজদার করায়ত্ত। একক মালিকানা। তাই তিনতলার বাসিন্দা বড়ভাই মহাদেবদা মেজোর ওপর প্রচণ্ড খাপ্পা। শাপ-শাপান্ত, গালিগালাজ, হুমকি চলে। আর সেজোভাই গদাধরের থাকার জায়গা, চারতলার চিলে-ঘরে। তার মতো একজন উন্মাদের পক্ষে এটাই যথেষ্ট। কিন্তু সেখানে সে থাকে না। সারা বাড়িতেই ঘুরে বেড়ায়, মূলত তিনতলায়। তার খালি গা। পরনে একমাত্র এক মেরুন পাজামা। ছেঁড়া জায়গাগুলো গিঁট মারা। মুখে সলজ্জ বিব্রত হাসি। খেতে দেয় বড়ভাই। বড়দার কঠোর ব্যক্তিত্বের কাছে সে ত্রস্ত।
‘জানো, সবসময় খিদে পায়।’ আমাকে সে বলেছিল।
— দিনে ক’বার খান, দাদা?
— দু’বার চা-বিস্কুট, দু’বার ভাত।
— মহাদেবদাকে বলুন, আর দু’বার মুড়িটুড়ির ব্যবস্থা করতে।
বড় স্নিগ্ধ, লজ্জিত হাসি সেজদার। নিজের খালি গায়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে বলে, ‘কী মনে হয় তোমার, এই গদাধর বণিক কারও কাছে নিজের জন্য খাবার চাইবে? তাও আবার বড়দার কাছে? সে হয় না।’
— কেন? বড়দার সঙ্গেই তো আপনি খান।
— তা ঠিক, তা ঠিক।
বলতে বলতে খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে খালি-গা মানুষটি আমার দিকে পেছন ফিরে তাড়াতাড়ি, টালমাটাল হাঁটতে থাকে সরু বারান্দা ধরে। মাঝে মাঝে বাঁদিক-ডানদিকের দেওয়ালে হাত ঠেকিয়ে টাল সামলায়। মাথাও ঝাঁকায় ক্ষণে ক্ষণে। ঘোলাটে ঘোলাটে আবছায়া মতো একটা ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে যায় তারপরে। সে-ঘরে কোনও আসবাব নেই। মেঝেতে একটা বড় ক্যারমবোর্ড পাতা থাকে শুধু। কারা খ্যালে বা খেলত কে জানে!… আমার কাজে আমি লেগে পড়ি। বড়দার মেয়ে। মিঠাইকে পড়াই। এই তো সবে এক-দেড় মাস পড়াচ্ছি। মেয়েটা পা টেনে-টেনে হাঁটে। আশ্চর্য যে, সব সময়ই ওকে স্কুলড্রেস পরা অবস্থায় দেখি। আর মাঝে মাঝেই নাকে জল চলে আসে ওর। রোগা টিঙটিঙে হাড়ের খাঁচা যেন। কিন্তু বাজখাঁই গলা। বাপের মতো।
ওদের ঘরে ঢুকতেই তীক্ষ্ণ জোরালো গলায় বড়দা বলে ওঠেন, ‘কী বলছিল ও তোমায়? খেতে পায় না?’
আমি চমকে তাকাই। সম্মোহিত হয়ে যাই ছ’ফুট তিন ইঞ্চির কাঠামোয় জুড়ে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফজলি আমের মতো মাথা আর ঠিকরে থাকা গোলাকৃতি দুই চোখ দেখে। চোখের সাদা অংশের ঠিক কেন্দ্রে দুটো ঈষৎ খয়েরি মণি। জ্বলছে।… এ কে! এ কি কোনও সাধারণ মানুষ? কোনও ভিলেন? না কি, কোনও অন্তর্যামী? শুনেছি ওঁর জমিবাড়ির দালালি, হার্ডওয়ারের ব্যবসা সবই ফেল পড়েছে। হতে পারে সাময়িক ভাবে হয়তো।
ক’দিন পরে মিঠাই পড়তে এল সিঁড়িতে বসে। আমি অপ্রস্তুত। বহু বছরের পরিষ্কার না-হওয়া বারোয়ারি সিঁড়িতে বসে ছাত্রী পড়াতে হবে! বললাম, ‘ঘরে পড়বে না?’
— ঘর তালাবন্ধ। বাবা-মা নেই। দাদাও নেই।
— কোনও কাজে গেছে বুঝি?
উঁকি মেরে দেখলাম, বন্ধ দরজায় এত্ত বড় এক তালা।… অঙ্ক শেষ করে ইংলিশ চলছে। এমন সময় ধুপধাপ, খ্যাসখ্যাস শব্দে তিনটে লোক উঠে এল। হাঁক পাড়তে লাগল সমস্বরে,
— ও মহাদেবদা… মহাদেবদা… বড়দা…
— মা-বাবা-দাদা নেই।
— কোথায় গেছে?
— মামাবাড়ি।
— তুই গেলি না?
— সামনে পরীক্ষা। আমার পড়া আছে।
— আর, দাদার পড়া নেই?
— জানি না।
লোকগুলো চলে গেল। পদশব্দ মিলিয়ে গেল ওদের। পড়ানো চলতে লাগল। পড়াতে পড়াতে দেখছি ছাত্রীর মন নেই।
— কী হল? শুনছ না যে!
— হি হি হি। বাবুইদি, হি হি, বাবারা ঘরের ভেতরেই আছে। হি হি।
— অ্যাঁ!
— হ্যাঁ গো। এবার ঘরে যাবে? এই দ্যাখো চাবি, পেনসিল-বক্সে।
— না না, এখানেই ঠিক আছে। আজ এখানেই পড়াই।
এই সময়েই ক্যারম-ঘরের ভেজানো দরজা আস্তে খুলে যায়। ঠান্ডা লাল মেঝেতে শোওয়া অবস্থায় পিছলে এসে এক মুন্ডু উঁকি মারে। জামাহীন কাঁধটাও শুয়ে শুয়ে বেরিয়ে আসে খানিকটা।
— এই মিঠাই, যা, খুলে দিয়ে আয়।
— একটু পরে যাচ্ছি। এখন পড়ছি না!
— এখনই খোল। তোতন বাজারে যাবে তো। বউদি কালই বলছিল, চাল নেই। রান্না হবে না কিন্তু।
— উঁউঁউঁ, শুধু নোলা! তুমি বাজারে যেতে পারছ না?
— যাচ্ছি। পয়সা এনে দে।
— পয়সাও নেই! আজ তোমার খাওয়া বন্ধ।
মাথা আর কাঁধ আবার পিছলে ঘরে ঢুকে গেল। আস্তে ভেজানো হল দরজার পাল্লা। সিঁড়ি থেকে পেছন ঝেড়ে আমিও উঠে পড়লাম।
কখনও যাই দিনের বেলা। কখনও যাই বিকেলে। কখনও যাই সন্ধেতে। মিঠাইয়ের সুবিধা ও সময় অনুযায়ী। অল্প পয়সার দিদিমণিদের অঢেল সময়।… হাটখোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ি। চপ্পল ফটফটিয়ে উঠে যাই একতলা হয়ে দোতলা, দোতলা হয়ে তিনতলা। তাকিয়ে থাকি চারতলার দিকে। চারতলার সিঁড়িগুলো তুলনায় নতুন। তবে ইট-গাঁথনির কাঠামোর ওপর কোনও সিমেন্ট বালি পড়েনি। রেলিং নেই। ন্যাড়া। এখনও বাঁশ বাঁধা আছে। বড়দা কোনও এক সময় এটার দখল নিয়ে নেবে। চিলেকোঠার অফিশিয়াল বাসিন্দা তিনতলার ক্যারম-ঘরে দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকবে খাবারের ডাক আসার। আর সরু অপস্রিয়মাণ বারান্দায় সিঁড়ির মুখোমুখি বাঁধা আছে এক রোগা, সাদা ছোট্ট চেহারার কুকুর। ও বাঁধা আছে একটা মান্ধাতা আমলের ভারী কাঠের চেয়ারের পায়ার সঙ্গে, বেঁটে দড়ি দিয়ে। যখনই দেখি, দেখতে পাই কাঁধা-উঁচু টাল-খাওয়া রেকাবিতে পড়ে থাকে খানিকটা সাদা ভাত। আর থাকে, তলানি-জলওয়ালা ছ্যাৎলাপড়া জলের বাটি। কুকুরটার স্থান ও ডিউটি নির্দিষ্ট। মেজোভাই কালীপদদার বাঁজা বউ যখন জামাকাপড় শুকোতে দিতে বা তুলতে ছাদে ওঠে, তখন ঘেউ ঘেউ করতে হবে। কিন্তু দুবলা ভুলুর ডাকটা শুনতে লাগে ‘খেউউ, খেউউ’। বেঁটে দড়ির কারণে ও এগোতে পারে না বটে, কিন্তু চেষ্টা করে এগোনোর। লেজটা পাঁইপাঁই করে নাড়ে কাকুতির ভঙ্গিতে। শত্রুমিত্র যে কেউ যদি ওকে বাঁধন থেকে মুক্তি দেয়, যদি সুযোগ ঘটে চরে-বরে খাওয়ার… তাহলে… তাহলে ও কতই না প্রোটিন সংগ্রহ করতে পারে, ভাবখানা এমন। ব্যাটা বুড়ো না ছোকরা, তাও বোঝা যায়। না। এক চোখের ছানিটা বার্ধক্যজনিত না কি অপুষ্ট শৈশবের কে জানে! যাদের জানার কথা, তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা হুঁ-হাঁ করে। কারই বা সময় আছে এসব নিয়ে গবেষণা করার!
— বউদি নমস্কার। কী করছেন?
— এই ভাই, একটু দেখছিলাম। কতদিন জল দিই না গাছগুলোয়। তুমি আজ এ সময়ে?
বলতে বলতে হাতের লাল ভাঙা মগ থেকে জল ছোঁড়েন, দোতলার মাথার ছোট্ট একফালি ছাদটুকুতে রাখা পাঁচ-ছ’টা টবে।
— মিঠাই আজ এ-সময়েই আসতে বলেছে।
— ও।… চা খাবে? আমিও খাব। বড় মাথা ধরেছে।
— দিন। মিঠাইকেও ডাকুন। ওর ঘুম ভেঙেছে? মর্নিং স্কুল হলে এ-ই হয়। দুপুরে ঘুমোনোর বাজে অভ্যাসটা হয়ে যায়।
— তুমি এখানে এই টুলটাতে বোসো। দ্যাখো কী সুন্দর বেলফুল হয়েছে। একটু বৃষ্টি হল বলে…
বলতে বলতে কষ্টেসৃষ্টে ওঠেন বউদি। অবেড়যোগ্য মধ্যপ্রদেশ সহ অধিক উচ্চতার কারণে বেসামাল তিনি। থপথপ পা ফেলে ফেলে বড়সড় মানুষটা এগোতে থাকেন। বিশাল দেহপর্বতে ছোট্ট মাথাটি হাস্যকর দেখায়। এই ক’দিনের মধ্যেই বেশ কয়েকবার ওঁর চোখে জল দেখেছি।
চায়ে চুমুক দিয়ে বলি, বউদি আপনাদের ভুলুটার জাত কী?
— ঠিক জানি না গো।
বউদি সবসময়েই আনমনা থাকেন।
— ওর বয়স কত হল?
— সে তোমার দাদা সঠিকটা বলতে পারবে। আমি ঠিক মনে করতে পারছি না যে, ও কোন বছর এসেছে। মিঠাইকে জিজ্ঞাসা কোরো তো। ওর নিশ্চয়ই মনে থাকবে। আমার না, কোনও কিছু মনে থাকে না। আর মনে রাখবই বা কেন বলো? কী লাভ?
— হ্যাঁ, তা ঠিক।… বউদি ও কী খায়?
— দুধ-ভাত গো। সে তোমার দাদাই দেয়। কী দেয়… কী করে, কে জানে! দুধ তো কাপে করে নেয় দেখি। এমন সময় ঘুম ঘুম চোখে মিঠাই ডাকতে আসে। পরনে স্কুলড্রেস। জানতে চাইলাম, ‘মিঠাই, স্কুল থেকে এসে জামা চেঞ্জ করোনি?’
— বাড়িতে পরার সুতিরগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে। এটা টেরিকটের তো, টেরিকট ছেঁড়ে না। তা ছাড়া দু’সেট আছে।
— বাঃ, তা বললে চলে নাকি? তুমি…
বাচ্চাটার পেট থেকে একটা সাংঘাতিক গলা বেরোল— ‘বাবুইদি তোমার চপ্পলটায় অনেকবার সেলাই পড়েছে। না পালটালে কিন্তু বাসে উঠতে গেলে বা নামতে গেলে ছিঁড়ে যাবে!’
— মিঠাই, দেব ধরে কানের গোড়ায় একখানা। এ কী গলা তোর? আর কী বিচ্ছিরি বচন!
দেখি সেজদা এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মিঠাইয়ের গলা একটুও বদলায় না।
— দেখি তো, কানের গোড়ায়, কীরকম দিতে পারো! নিধিরাম সর্দার এলেন!
ঠিক তক্ষুনি বাজ পড়ল। বড়দার হুঙ্কার, ‘গদা! তুই এখানে কেন? মহিলাদের সামনে খালি গায়ে ঘুরছিস, লজ্জা করে না? আর, কানের গোড়ার কথা ভুলে যা। ওখানে মারলে মানুষ মরে যেতে পারে। তোরও কানের গোড়া আছে। বুঝতে পেরেছিস?’
… সেজদা পালাতে লাগল ক্যারম-ঘরের দিকে। বড়দার চোখ ঘুরছিল বনবন করে। আর বউদির চোখে জল।
হাত লম্বা করে বড়দা মিঠাই-এর কলার চেপে ধরলেন।
— তুই এদিকে আয়। খুব বেড়েছিস, না? ভাল ব্যবহার কী করে করতে হয় আজকে তোকে শিখিয়ে দেব। এইভাবে কথা বলে, দিদিমণির সঙ্গে?
প্রকৃতপক্ষে স্কার্টের কোমর ধরে রোগা মেয়েটাকে তিনি ঝুলিয়ে নিয়ে চললেন। যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে খুব মিষ্টি করে আমায় বললেন, ‘বাবুই, তিনদিন তুমি এসো না। ওকে একটু সহবৎ শেখাই। কিছু মনে কোরো না কিন্তু।’
এত দ্রুত সবকিছু হল যে, বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু করার রইল না। বহুবার সারিয়ে তোলা চপ্পলটায় পা গলিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোতে এগোতে আড়চোখে দেখলাম, বউদি বেলফুল দেখছেন আর ভুলু প্রচণ্ড কাকুতি-মিনতিময় ল্যাজ নাড়ছে। ছানিপড়া অসহায় দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে সামান্য হাসির আভাস।… আর্তি। মুক্তি চায়। দুনিয়ার যাবতীয় প্রোটিন ওর আওতার বাইরেই রয়ে গেছে। চটি সামলে সাবধানে দৌড়ে নেমে গেলাম সিঁড়ি দিয়ে।
তিনদিন পরে বাড়িটাতে আবার যেতেই হল। না গিয়ে উপায় কী? দ্বিতীয় মাসের পনেরো তারিখ হয়ে গেল, এখনও প্রথম মাসের মাইনে পাইনি। ওই সামান্য ক’টা টাকা আমার কাছে খুবই জরুরি। আজকে পায়ে নতুন চটি। আমার পায়ে নতুন, আসলে দিদির বাতিল চটি। আর একটু হলেই আমার নাকের ডগা দিয়ে শক্তপোক্ত সামান্য হিল-ক্ষওয়া বস্তুটা ঠিকে-লোকের খপ্পরে চলে যাচ্ছিল। আমি ছোঁ মেরে আগেই নিয়ে নিয়েছি। আমার স্পিড দেখে দিদি বলেছে, বাপ রে! দিদি একটা এন.জি.ও-র স্কুলে পড়ায়। স্কুলশিক্ষিকা আর গৃহশিক্ষিকার মধ্যে পার্থক্য থাকবেই।
কিন্তু আজ ও-বাড়ির সদর দরজায় পৌঁছনোর আগেই আমার নতুন চটির গর্বিত পদক্ষেপ থেমে গেল বড়দার বাথরুমের দিকের গলির কাছে। সেখানে অনেক লোক জমা হয়েছে। খুব চেঁচামেচি চলছে। ওপর থেকে ভেসে আসছে বড়দার তীব্র তর্জন-গর্জন। মেজোভাই কালীপদদাকে ব্যস্তভাবে ঘোরাঘুরি করতে দেখা যাচ্ছে। প্রচুর হইচইয়ের মধ্যে থেকে একটা বিচ্ছিন্ন চিৎকার ভেসে এল, ‘কালীপদদা, এবার থানায় ডায়রি করুন। অনেক হয়েছে। রুলের গুঁতো খেলে তবে সিধে হবে।’
উচ্চকণ্ঠের এই উক্তি বড়দার কানেও পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। তাই মহাদেবদার হুঙ্কার ভেসে এল, ‘কে রে! কোন এক-বাপের ব্যাটার এত বড় সাহস, যে, পুলিশ ডাকবে? ডাক তোর পুলিশ। দেখি কে কী করে?’
পড়াতে শুরু করার আগেই আমায় সাবধান করে দেওয়া হয়েছিল, কালীপদদা-দের সঙ্গে যাতে কথা না বলি। তাই জমায়েতের একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ব্যাপারটা কী?’
— আর বোলো না ভাই, ক’দিন ধরে ওপর থেকে সমানে গু ফেলছে। দ্যাখো গলিটার অবস্থা। নিজেদেরই গলি…! দোতলায় কালীপদদার ঘরের কার্নিশে গু পড়ে ছিটকে চারিদিক হচ্ছে। কী কাণ্ড বলো তো!
ভাবছিলাম, তার মানে, যে কোনও অজুহাতেই একদিন আমায় ছুটি দিতেই হত।
লোকটি আবার বলল, ‘তুমি মহাদেবদার মেয়েকে পড়াও না? কী লোক দ্যাখো! ’
ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তিনতলার বাথরুম থেকে বেরোনো ফুট দুয়েকের একটা পাইপ থেকে এই বীভৎস কাণ্ডটা ঘটছে। কী করব জানি না, আমার পা যেন রাস্তাতেই আটকে গেল। কিন্তু আমায় তো যেতেই হবে। টাকা বড় বালাই।
মিঠাইদের ঘরে ঢুকতেই বড়দা আবেগঘন হুঙ্কারে বললেন, ‘মহাভারত পড়া আছে, বাবুই? যদুবংশ ধ্বংস হল কেন?’
ভেতরে ভেতরে অজানা অস্বস্তি আর উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলাম। বললাম, ‘নিজেদের মধ্যে মারামারি করে।’
— এ বাড়িতে অনেকদিন ধরেই সেটা চলছে। বুঝলে, জীবনে যা যা ঘটে, খুঁজলে দেখবে সবই মহাভারতে আছে। তুমি এ ক’দিন আসোনি, ভালই হয়েছে। যা চলছে না!
আমি হাঁ করে সামনের মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। যার গোল হয়ে থাকা বিস্ফারিত চোখের মাঝখানে ঝলসানো মণি ঘুরছিল কিংবা স্থির হয়ে চেয়েছিল। শ্রোতার দিকে। পেট থেকে উঠে আসছিল বাজখাঁই আওয়াজ। আর তার শিরা-ধমনী দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল দর্শন, ঘন-কালচে-গভীর। পেছন থেকে খোলা দরজা দিয়ে আসা আলো জ্যোতির্বলয় তৈরি করেছে ওই ছ’ফুট তিন ইঞ্চির ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো শরীর ঘিরে। শক্ত চোয়াল আর মুষ্টিবদ্ধ হাতের এই মানুষটাকে বলা গেল না যে, কাণ্ডটা তো আপনিই ঘটাচ্ছেন। সেই জোরালো বাজখাঁই গলা আবার শোনা গেল, ‘বাবুই, তুমি প্রাপ্তবয়স্ক। তুমি শিক্ষিত ও আলোকপ্রাপ্ত একজন। তোমার পাঠ্য বিষয় বিজ্ঞান ছিল। বিজ্ঞান নিয়ে বারো ক্লাস তুমি পড়েছিলে। তুমি নিচের জমায়েতের জনতার তুলনায় অনেক আলাদা। ওরা কিছু জানে না, তাই চ্যাঁচাচ্ছে।’
— না মানে… আমি ঠিক…
— তোমার বউদির কোমর, শিরদাঁড়া, হাঁটু সব গেছে। ওর জন্যেই কমোডটা বসানো হল। কিন্তু আমার গুণধর মেজো এবং ছোটভাই কিছুতেই কমোডের পাইপটা সেপটিক ট্যাঙ্কে গুঁজতে দিল না। ব্যাস, আমিও মিস্তিরিকে বললাম পাইপটা খুলে দিতে। এবার কী করবি কর! তো আমার ভুলটা কোথায়? আমার বউয়ের আমিই কৃষ্ণসখা, বুঝলে? ওই যে, যিনি নিজেকে পরম অপরাধী ঠাউরে রান্নাঘরের দরজার আড়ালে চোখের জল ফেলছেন।
এরপর গলা আরও তুলে বললেন, ‘দু’কাপ চা দিও। বাবুই এসেছে। আমিও খাব।’
— না-না।
আমি আঁতকে উঠলাম, ‘চা খাওয়া আমি ছেড়ে দিয়েছি।’
গলির ওই দৃশ্য দেখার পরে এদেরই বানানো চা খাওয়া যায়? অনুযোগঘন জোরালো গলায় বললেন মহাদেবদা, ‘বেশ বেশ। আমি একাই চা খাব। এক কাপ চা দিও।… বাবুই, সামান্য কারণে মিথ্যাচার করবে না। তুমি একটা শিশুকে পড়াচ্ছ। সে তাহলে কী শিখবে?’
গোল্লা-গোল্লা চোখের মাঝখানে স্থির কিংবা ঘূর্ণিত মণি দুটোর রং চায়ে গাঢ়-স্বচ্ছ লিকারের মতো দেখাল। বললেন, ‘কিছু মনে কোরো না। আমি তোমার বড়দাদার মতো।… মিঠাই, বারান্দা থেকে চলে এসো। বাবুইদিদি এসেছে। তোতন, তুইও পড়তে বোস। রবিবারের সকালটা এভাবে নষ্ট কোরো না তোমরা।’
টাকাটা আদৌ পাব কি না সেই সন্দেহ মনের মধ্যে ঘনীভূত হতে লাগল। কিন্তু বোঝা গেল যে, বড়দাকে টাকার কথাটা আমি সারা জীবনে কখনও বলে উঠতে পারব না বোধহয়।
তিন মাসের অক্লান্ত, শঙ্কিত অপেক্ষার পর এক মাসের মাইনেপ্রাপ্তি ঘটেছে। এটা আশাব্যঞ্জক না নিরাশাব্যঞ্জক, কে জানে! মাইনের সূত্রপাত হল, এটা হয়তো আশার কথা। আবার, তিন মাস পরে এক মাসের মাইনে, এটা আতঙ্কের। কিন্তু এখনই ছাড়ার কথা ভাবা যাচ্ছে না। কারণ পকেট একেবারে শূন্য। তার ওপর ওই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাড়িটা আর যুদ্ধবিগ্রহে ক্লান্ত চরিত্রগুলো সমষ্টিগতভাবে আমার রক্তে ইশারা পাঠায়। কিছুদিন পর-পরই মহাদেবদার অনুপস্থিতিতে বাজখাঁই শিশুকণ্ঠের তীব্র কশাঘাতে আহত হই। তবুও আমি যাই। ওই অস্থায়ী, বিকল্পহীন চাকরিস্থলে আমার একনিষ্ঠ শ্রম দান করে চলি। প্রথম চাকরি বলে কথা। তাছাড়া হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা-ছুটের কী-ই বা ভবিষ্যৎ!
এর মধ্যে শীতের হাওয়া দিল ক’দিন। জ্বরের তাড়সে সব রুটিন এলোমেলো হয়ে গেল। একুশ দিন পরে হাজির হলাম পড়াতে। গিয়ে দেখি আমার জায়গায় অস্থায়ী এক মাধ্যমিক-ফেল বহাল হয়েছে। চলে যাবে। টাকা আগেই দিয়ে দিতে হয়েছে তাকে। সেটা কাটা যাবে আমার মাইনে থেকে। পড়ন্ত বিকেলে বউদির কাছে গিয়ে বসলাম। বউদি তাকিয়েছিলেন রুগ্ন গাছগুলোর দিকে। ওদের পুষ্টিহীন শরীর আর মরন্ত পাতা বেয়ে জল পড়ছিল টপটপিয়ে। আমায় দেখে বউদি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘শুধু জলে কি আর গাছ হয় গো! ওদের কত খিদে পায় বলো তো। শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না, এই যা।’
গাছেরা চুপ করে রইল। কিন্তু ভুলু কেঁদে উঠল, কেঁইইই।
— অনেকদিন পরে তোমায় দেখেছে কিনা, তাই ভালবাসায় কাঁদছে। ও-ও জানে যে, তুমি ওকে ভালবাসো।
— খিদেতেও হতে পারে বউদি।
— না না, দ্যাখো গাল-দুয়েক ভাত এখনও পড়ে আছে রেকাবিতে।
…একটা মরিয়া ভাব এল ভেতর থেকে। বলেই ফেললাম, তবে ফিসফিস করে, ‘ওর অরুচি হয়েছে, বউদি। একটু ডিম হবে? কিংবা মাছ বা চিকেন?’
বউদি অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। শেষে ফিসফিস করেই উত্তর দিলেন, ‘কেনাকাটা সব তোমার দাদাই করে গো। পয়সা কোথায় আমার?’
তারপরে অনেক আশা নিয়ে আমার হাত চেপে ধরে ফিসফিস করলেন।
— তুমি আনতে পারবে? যদি লুকিয়ে আনো, আমিও লুকিয়ে ভুলুকে দিয়ে দিতে পারব।… বাবুই, একটু সার এনে দেবে আমায়?
আশায় উৎসুক চোখদুটো ছলছল করছে তাঁর।
…ঘরের ভেতর থেকে হুঙ্কার এল, ‘বাবুই, ফিসফিস আমার পছন্দ নয়। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও।’
— হ্যাঁ দাদা, এবার যাব।
ঠিক এই সময়েই নাকে ভেসে এল একটা অপরিচিত পচা গন্ধ। মনে হল, গন্ধের উৎস আমার পাশেই দাঁড়িয়ে। তাকিয়ে দেখি সেজদা গদাধরদা। মেরুন পাজামার নিচের দিকটা একেবারেই ছিঁড়ে গেছে। ছিন্ন অংশগুলো ঝুলছে অবিন্যস্ত ঝালরের মতো। ডান পা-টা অনেকখানি বেরিয়ে রয়েছে। সেখানে খানিকটা জায়গা কালো।
— কী হয়েছে এখানে? কালো কেন?
— ঘা হয়েছে গো। একবার হাসপাতালে নিয়ে যাবে আমায়? যেদিন নিয়ে যাবে সেদিন একটা পুরনো শার্ট নিয়ে আসবে। নতুন এনো না কিন্তু।
আবার হুঙ্কার, ‘গদা! পা কেটে হাতে ধরিয়ে দেব, বুঝলি। বাবুই, বাড়ি গিয়ে বিশ্রাম করো। মিঠাইকে পড়াতে পাপিয়ার অসুবিধা হচ্ছে। তুমি সামনের মাস থেকে আসবে।’
আমার পেছন পেছন খালি পায়ে নিঃশব্দে সেজদা নেমে আসছিল, আর ফিসফিসিয়ে বলছিল, ‘মাছির হাত থেকে আমাকে বাঁচাও, বাবুই। রস গড়াচ্ছে তো। তাই সেয়ানাগুলো ঝাঁকে ঝাঁকে আসছে। কীরকম গন্ধ বেরিয়েছে, দেখেছ? তেমনি ব্যথা। আমি তো হাসপাতাল চিনি না।’
— মেজদা-ছোড়দাকে বলুন। আমি কী করে বড়দাকে এড়িয়ে আপনাকে নিয়ে যাব? চাকরি চলে যাবে তো।
নামতে নামতে বললাম।
একদৌড়ে নেমে পড়লাম রাস্তায়। জানি সেজদা পথে নামবে না। রোয়াক-বারান্দাটাই তার সীমানা। পয়সা হাতে দিয়ে দোকানে না পাঠালে এই সীমা সেজদা সাধারণত ডিঙোয় না। কী এক বাধ্যবাধকতায় হতভম্ব হয়ে অদৃশ্য লক্ষ্মণরেখার ওপাশেই দাঁড়িয়ে পড়ে।
পরের মাসে পড়াতে এসে তীব্র দুর্গন্ধের মুখোমুখি হতে হল। ঝিমন্ত ভুলুকে পেছনে ফেলে বড়দার ঘরের দিকে যেতে গিয়ে দেখি, ক্যারম-ঘরের দরজার কড়া দুটো শাড়ির পুরনো পাড় দিয়ে বাঁধা। কিন্তু বাঁধনটা ঢিলে-মতো। দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতর দৃশ্যমান। ভেতরে লাল সিমেন্টের মেঝেতে সেজদা হামাগুড়ি দিচ্ছে। শতচ্ছিন্ন মেরুন পাজামা কোমর ঘিরে হিজিবিজি হয়ে রয়েছে। দুর্গন্ধ এ-ঘর থেকেই আসছে। গদাধরদার চোখে যেন অচেনা দৃষ্টি। কুচকুচে কালো ডান পা থেকে পুঁজ গড়াচ্ছে। মুখে একটা অস্ফুট আওয়াজ, আঃ, আঃ…
অবস্থা খারাপ থেকে খারাপতর হচ্ছিল। পরের দিকে দরজাটা শক্ত করে কড়া বেঁধে বন্ধ করে রাখা হত। তাতে গন্ধের প্রকোপ কিছুটা কমত। তারপর একদিন এসে দেখলাম ক্যারম-ঘরের দরজা খোলা। ব্লিচিং পাউডার দেওয়া হয়েছে। ধূপ জ্বলছে। গদাধরদার গায়ে-জামা-পরা একটা ছবিতে কাগুজে ফুলের মালা দেওয়া আছে।
সব কিছু ধীরে ধীরে থিতিয়ে গেল এবং ক্রমেই একটা উৎসবের আবহ জেগে উঠতে লাগল মহাদেবদার সংসার ঘিরে। সেদিন মুরগির ঝোলের সুগন্ধে ম-ম করছিল তিনতলাটা। সেজদার চারতলার চিলে-ঘরে পেতে দেওয়া হয়েছিল বউদির ঠাকুরের সংসার।
— চলো বাবুই, আমার ঠাকুরঘর দেখবে চলো।
এত উজ্জ্বল বউদিকে কখনও দেখিনি। গিয়ে দেখি, ছোট ছোট কিছু মূর্তি আর অনেক অনেক ঠাকুর দেবতার ক্যালেন্ডারের ছবি কেটে কেটে দেওয়ালে সাঁটা। ফুল-বেলপাতা সহযোগে বেশ একটা ঠাকুরঘর মতো। ঘরের সামনেই ইতস্তত ছড়ানো বউদির গাছের টবগুলো। একটা সারের প্যাকেটও দাঁড় করানো আছে। বউদি স্মিত হাসছিলেন, ‘লুকিয়ে একটুকরো মাংস দিয়েছি ভুলুকে, বুঝলে। ওঃ, কী লেজ নাড়া! তোমার মহাদেবদা কিছু টের পায়নি। বেশ ভাল হল না?’
— খুব ভাল হল বউদি।
কী একটা ব্যবসায় মহাদেবদার একটু-আধটু লাভ হচ্ছিল। আমাকেও মাঝে মাঝে মাইনের টুকরো-টাকরা ঠেকাচ্ছিলেন। দেখলাম, এল.আই.সি-র এজেন্টরা আনাগোনা করছে। মেডিক্লেম হয়ে গেল।
একদিন বড়দা আমাকে বললেন, ‘শোনো বাবুই, ভাবছি, তোমাকে আর মাইনে দেব না।’
শুনছিলাম, আর একটা হিম স্রোত আমার শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। দেখলাম সেই বিপুল মূর্তির ফজলি আমের মতো মুখে গোল-গোল চোখের সাদা জমির মাঝখানে ঈষৎ খয়েরি মণিদুটো আমার দিকে স্থির হয়ে আছে। দেখে নিচ্ছে আমার রক্তপ্রবাহের মধ্যের সবটুকু গোপনীয়তা।… নিশ্চুপ হয়ে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর শোনা গেল বাণী, ‘বাবুই, তোমাকে কেউ কিছু বললে, কী বলছে, তার থেকেও জরুরি হল, কে বলছে। আক্ষরিক ভাবে একই বক্তব্য কৌরব বলল না পাণ্ডব বলল, সেটা কি ভাবা উচিত নয়? আরে, অন্তর্গত মানবিক মনস্তাত্ত্বিক পদার্থের ওপর নির্ভর করে মানুষটার জাত। তুমি জাত-বেজাত বোঝো না? আরে বাবা, কী জাতের মানুষ কথাটা বলছে সেটা বোঝো। শোনো আগে গোটা বক্তব্যটা! তবে না প্রশ্ন উঠছে, ভিরমি খাবে না স্বস্তি বোধ করবে! তুমি আধা শুনেই ঘাবড়ে গেলে? শোনো, তোমার নামে আমি একটা এল.আই.সি আর মেডিক্লেম করে দিতে চাই। সেগুলোর দেখভাল আমিই করব। তোমার টাকাগুলো প্রিমিয়াম হিসাবে জমা দেব নিয়ম করে।’
এই প্রথম আমি রুখে উঠলাম, ‘কক্ষনও না বড়দা। এল.আই.সি আমি করব না। আগে তো বাঁচি, তবে না এল.আই.সি। আর মেডিক্লেম কেন করব, যেখানে দু’টাকার টিকিটে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয়। আর বেশি টাকা দিলেই যদি খুব বেশি বাঁচা যেত মহাদেবদা, তবে বড়লোকেরা তো চিরজীবী হত। আমি এই মুহূর্তের জন্য বেঁচে থাকি। পরে কী হবে না হবে, অত কিছু ভাবি না।’
ফোঁস কোরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন বড়দা, ‘অর্বাচীন। শিশু। এখনও বড় হলে না, বাবুই।’
ইচ্ছে হল, বলি, কয়েকবার প্রিমিয়াম দিতে না পারলে সবটুকুই তো চলে যাবে। নিয়মিত যে মাইনে দিতে পারে না, সে নাকি নিয়মিত আমার হয়ে প্রিমিয়াম দেবে! হুঁঃ। অত অর্বাচীন, অত শিশু আমি নই।
এমন সময় বাজারের ব্যাগ রান্নাঘরের দরজায় নামিয়ে চলে যাচ্ছিল তোতন। বড়দা হুঙ্কার দিলেন, ‘অ্যাই, চলে যাচ্ছিস যে! বাকি পয়সা কই?’
— সবই খরচ হয়ে গেছে। আলুর দোকানে কুড়ি টাকা পাবে।
রক্ত জল করা স্বর শোনা গেল, ‘হিসাবটা দিয়ে যা। তোকে বলেছি না, দোকানে বাকি রাখবি না। কম খাবি দরকার হলে। আর শুনে রাখ, এক পয়সা যদি মেরেছিস তো পিঠ ফাটিয়ে দেব।’
… মিঠাইকে হোমওয়ার্ক বুঝিয়ে দিয়ে আমিও উঠে পড়লাম। সরিয়ে রাখা বিস্কুটটা নিঃশব্দে ভুলুকে দিয়ে নেমে এলাম পথে।
বউদিকে দেখে আজকাল বেশ ভাল লাগে। ওপর-নীচ করে করে সামান্য মেদ কমেছে। বিষাদও কমেছে যেন। মেলা থেকে কিনে কিনে ঠাকুরের মূর্তির সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর বেড়েছে গাছের সংসার। এখন আর সারের অভাব নেই। মহাদেবদাকে বলতে শুনেছি, ‘যত ইচ্ছে টব কেনো আর গাছ লাগাও। দখল করে নাও গোটা ছাদ। দেখি, কে কী করে। ব্যবসা দখলের সময় মনে ছিল না!’
মেডিক্লেমের এজেন্টের ঘন ঘন যাতায়াত চলছে আজকাল। দু’বছরে দু’বার রিনিউও করে ফেলেছেন দাদা। কিন্তু মনটা ওঁর সুস্থির নেই। সারাদিন কোনও অদৃশ্য শত্রুর সঙ্গে লড়ছেন। একদিন বললেন, ‘বুঝলে বাবুই, মেডিক্লেমটা বড় গায়ে লাগছে। রোগ নেই, ভোগ নেই, পয়সা গুনে যাও। স্রোতের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে টাকাগুলো। বুদ্ধি আছে তোমার। আসলে কী জানো, ছোটদের কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখা যায়। দ্যাখো, আমার তো কোনও রোগ হলই না আর তোমার বউদি… তোতন-মিঠাই ওদেরও কিছু হল না।’
এর মধ্যেই মেডিক্লেম এজেন্টের আবির্ভাব।
— আরে, এসো এসো। তোমার জন্যেই বসে আছি। চলো, ছাদে গিয়ে বসি। আমাদের দুটো চা পাঠিও ওপরে।
তোতন-মিঠাই খেলতে বেরোল। আমি রান্নাঘরে গেলাম।
— চায়ের থালাটা দিন বউদি, আমি দিয়ে আসছি ওপরে।
— বাঁচালে। পায়ে খুব ব্যথা। নাও, তুমি একটা অন্তত বিস্কুট খাও।
এদের এখানে চা তো আমি ছেড়েই দিয়েছি। তবে ভুলুর জন্যে বিস্কুটটা নিয়ে নিই। আজকাল কয়েক মিনিটের জন্যে হলেও ওকে কোলে নেওয়ার অধিকার আমার জন্মেছে।
বাবা-মায়ের অসুস্থতার জন্যে দু’সপ্তাহ যেতে পারিনি পড়াতে। ছ’দিন পড়ানো বাদ চলে গেছে। দৌড়ে দৌড়ে এসে পৌঁছলাম। সাঁ-সাঁ করে উঠলাম তিনতলায়। দেখি বউদির চোখটা ছলছল করছে। তোতন-মিঠাই কেমন যেন ঘাপটি মেরে গেছে।
— কী হয়েছে বউদি?
— তোমার দাদা…
— দাদা কী?
— হাসপাতালে ভর্তি।
— সে কী? কেন?
বউদি তোতলাচ্ছিলেন। বলার দায়িত্ব তোতন নিল, ‘বাবুইদি, বাবা না, এজেন্ট কাকুর হেল্প নিয়ে, ডাক্তার ফিট করে নার্সিংহোমে ভর্তি হয়ে গেল।’
— কিন্তু কেন?
— না মানে, বুকে ব্যথা বলে ভর্তি হয়ে মেডিক্লেমের ক্যাশলেস চিকিৎসাটা নেবে। আর তখনই সব কিছু চেক-আপ হয়ে যাবে। আসলে, কোনও রোগ তো হচ্ছিল না। শুধু শুধু টাকাগুলো খরচ হচ্ছিল। তাই আর কী…
এক বিস্ময়কর কাহিনি শোনাচ্ছিল তোতন। ফাইভস্টার নার্সিংহোম ভর্তি করে নিয়েছে আই.সি.ইউতে। এই বয়সে হার্টের গণ্ডগোল হতেই পারে।… একটা রোগকে হাতিয়ার করে পরিষেবা নেওয়া এবং সমস্ত চেক-আপ করিয়ে নেওয়া।… সেখানে চিকিৎসার যন্ত্রপাতি, স্যালাইন, ব্লাড দেওয়ার সরঞ্জাম আর ইঞ্জেকশনের শরশয্যায় শায়িত ভীষ্ম। পরিতৃপ্ত। মুখে মৃদু হাসি।
কিন্তু না, গল্পটা এতেই শেষ হয়নি। হিসাবের বাইরে থেকে শরীরে ঢুকে গেছে আই.সি.ইউতে ভেসে বেড়ানো নিউমোনিয়ার জার্ম। এবং তাতেই অবস্থাটা জটিল হয়ে গেছে। তাই এই মানুষগুলো দিশেহারা। মিঠাই আমার হাত ধরে টানছিল, ‘ও বাবুইদি, বাবাকে তুমি যেভাবে হোক এনে দাও না। কাল সকালে এজেন্ট কাকু একজনের ট্যাক্সি করে আমাদের নিয়ে যাবে দেখা করাতে। তুমি যাবে আমাদের সঙ্গে? বাবাকে ফেরত নিয়ে আসতে পারবে?’
বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছি, দেখি এজেন্টদা আসছে। হন্তদন্ত ভাব।
— কী ব্যাপার এজেন্ট বাবু, মহাদেবদা কেমন আছেন?
এজেন্ট নিজের কপালে একটা চাপড় মারল, ‘কোনও দরকার ছিল না ওঁর এসবের, বোন। মেডিক্লেমের ক্যাশলেস পরিষেবা নেবেন বলে ধ্স্তাধস্তি। কত বারণ করলাম। এবার বোঝো ঠ্যালা! খুব খারাপ অবস্থা। মাত্র সাতটা দিনের মধ্যে এত কিছু ঘটে গেল। কোনও ওষুধ, ইনজেকশন আর কাজ করছে না। কিডনিটা একেবারে গেছে। আমি…’
লোকটা কেঁদে ফেলল। সন্ধের গাঢ় আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল লোকটা। ফোঁপাচ্ছিল আর অদ্ভুত সব অবোধ্য কথা অস্ফুটে আওড়াচ্ছিল।
পরদিন মা’কে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়িতে জমা করে, রান্না সেরে যখন মিঠাইদের বাড়ি গেলাম, তখন বাড়ির সামনের রাস্তায় শোওয়ানো আছে পরাজিতের শরীর। চক্রব্যূহ থেকে বেরনোর কায়দাটা যোদ্ধার জানা ছিল না।
কারা যেন ভুলুকে ছেড়ে দিয়েছিল পথে। ভ্যাটের কাছ থেকে ওর ছানিপড়া আগ্রহী দৃষ্টি আমায় ইশারা করছিল। ওকে কোলে নিয়ে চলেছি। মায়ের হেফাজতে দিয়ে, একটা মালা কিনে আবার এখানে আসব। মালাটা রাখব তাঁর বুকের ওপর, যাঁর ঘূর্ণিত লোচন এখন নিমীলিত এবং তুলসীপাতার পবিত্র আবরণে সুরক্ষিত।